গল্প ।। এই বুঝি তুমি আসবে ।। চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
এই বুঝি তুমি আসবে
চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
---হ্যালো? কে বলছেন?
------- আমাকে বিয়ে করবি দূর্বা? বল না দূর্বা ।প্লিজ দূর্বা না করিস না।বিয়ে কর না আমাকে। আমিও তো ওয়েল এস্টাবলিশড বল। কি নেই আমার? আমাকে বিয়ে কর প্লিজ। আচ্ছা একবার বল আমাকে ভালোবাসিস না? আমি তো তোকে খুব ভালোবাসি রে।
----রচিত তুই ?জানিস তুই কি বলছিস? আর ইউ ড্রাংক? এতদিন কোথায় ছিলি? আজ হঠাৎ করে আমাকে মনে পড়ল? আমি তো সেই ছোট্টবেলা থেকে তোকে ভালোবেসেছিলাম। তুই তো বুঝতেই চাইলি না
-----আজ তবে কেন হঠাৎ করে? তুই কিভাবে জানলি আমার বিয়ের খবর?
----কিরে বল? তোর গলাটা এরকম লাগছে কেন?? আমি যতদূর জানি তুই তো মদ খাস না তবে আজ কি? আমার মনে হয় তুই প্রকৃতিস্থ নয় । পরে ফোন করিস।
দুর্বার পা গুলো টলমল করছে। রচিত এর কথাগুলো শুনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে পড়েছে। বড্ড কষ্ট হচ্ছে ওর। চোখের জলের ঝাপটায় রাস্তার আলো গুলো বড় ফিকে লাগছে। একদিকে ভালোলাগার অনুভূতি অন্যদিকে একটা চাপা কষ্ট দূর্বা কে যেন রাস্তার মধ্যেই দুমড়ে মুচড়ে একাকার করে দিচ্ছে ৷ চেষ্টা করছে তবুও চোখের জলকে বাগ মানাতে পারছে না। রাস্তাঘাটে ওর আশপাশ দিয়ে যে যাচ্ছে সেই ওকে একটু তীর্যক দৃষ্টিতে দেখছে। কেউ কেউ আবার পাশ দিয়ে আজেবাজে কথা বলতেও ছাড়ছে না। একজন তো বলে গেল"এই মামনি কাঁদছে রে" ইত্যাদি ইত্যাদি ৷ দূর্বা এবার দাঁড়িয়ে না থেকে চটপট একটা রিক্সা নিয়ে নেয়।
ভেবেছিল সারাজীবন বিয়ে করবে না। অনেকেই তো একা একা থাকে ,কিন্তু না হবে না ।বাবা-মা র সেই এক কথা দিনরাত বাড়িতে অশান্তি, মায়ের শরীর খারাপ। দূর্বা আর পারেনা ।শেষমেষ রাজি ওকে হতেই হয়। শুনেছে তার পাত্র যেন নাগপুরে থাকে। টেলিফোনে কথা বলা তো দুর তাকে একবার চাক্ষুষ ও দেখেনি দূর্বা। এই যেন বাবা-মার প্রতি তার একরাশ অভিমান। এই বিয়ে বিয়ে নিয়ে মনটা খিচড়ে থাকে সর্বক্ষণ। ভাল লাগেনা কিছু।
ছাদে উঠে দুই হাত প্রসারিত করে একটা জোরে নিঃশ্বাস নেয় দূর্বা। যেন এক ঝাঁক অক্সিজেন ওর শরীরে প্রবেশ করল। দুর্বার মন খারাপের অলিগলি যেন বোঝে এই অন্ধকার ছাদের বাতাস। দুর্বার মনের খবর যেন ওরাই ভাল রাখে।
সে কার্নিশে ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রচিত এর কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় কত খেলা করেছে একসাথে। একসাথে ছবি এঁকেছে। একসাথে স্কুলে গেছে। কত প্রক্সি ও দিতে হয়েছে দূর্বা কে ওর জন্য। সব ভুলে গেছিল রচিত সেদিন। কত রাত জেগে নোটস তৈরি করে দিয়েছে দূর্বা ওকে। রচিত কি কিছুই বোঝে নি সেদিন। উফ খুব জ্বালিয়েছিল রচিত ওকে।
একমাত্র মেয়ে দূর্বা। শান্তশিষ্ট স্বভাবের মিষ্টি একটা মেয়ে। অত্যন্ত চাপা স্বভাবের। নিজেকে মেলে ধরতে পারিনি কখনো। শক্তিপদ বাবু এবং নীলিমা দেবী ওকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট করার পর থেকেই মেয়েটা কেমন যেন চুপচাপ থাকে। মাঝেমধ্যে কি যেন চিন্তা করে, অফিসে যায় অফিস থেকে ফেরত আসে বাড়িতে দু'চারটে প্রয়োজন হলে কথা বলে। নিজের মত নিজে থাকে। মেয়ের মন পড়তে পারেন না ওরা। রচিত কে খুব ভালোমতোই চেনেন ওরা। দূর্বা এবং রচিত খুব ভালো বন্ধু বলা যায় বেস্ট ফ্রেন্ড। রচিত খুব ভালো ছেলে।
দূর্বা চুপচাপ শুয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুম কই চোখে?? আবার মনে পড়ে রচিত এর কথা। রচিতের মা বাবা ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন। রচিত এর মা যেদিন মারা যান সেদিন রচিত খুব ভেঙে পড়েছিল। বাচ্চাদের মত জড়িয়ে ধরেছিল দূর্বা কে। পাখিরা যেমন খরকুটো কে আশ্রয় করে বাঁচতে চায় সেদিন দূর্বার ও মনে হয়েছিল রচিত ও বোধ হয় ওকে নিয়েই বাঁচতে চায়। বড় দীর্ঘ ছিল সেই রাত। নিশাচর পাখিরা তবু জেগে ছিল। মেঘের তীব্র গর্জন আর আকাশ বিদীর্ণ করা বিদ্যুতের আলোয় একেবারে অন্য রচিত কে দেখেছিল দূর্বা। কিন্তু কিছুদিন পর দুর্বার এই ভুল ভেঙে যায়।
কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী সবচেয়ে সুন্দরী ঈপ্সিতা সাথে ওর প্রেম শুরু হয়। কলেজের ছেলেগুলো তখন ইপস বলতে অজ্ঞান।ইপস হল তখন অত্যন্ত ড্যাশিং ,স্মার্ট ,বোল্ড এবং খুব সেক্সি ছেলেদের চোখে।
বেস্ট ফ্রেন্ড হিসেবে রচিত দূর্বা কেই সব কিছু বলতো। আর দূর্বা নিজের মধ্যেই একটু একটু করে ভাঙতে শুরু করলো। তাই কলেজ শেষে গুটিকয়েক বন্ধু ছাড়া আর কারো সাথে কোন যোগাযোগ রাখল না। রচিত ভালো থাকুক সুখে থাকুক এটাই ও বরাবর চেয়ে এসেছে।
আজ রবিবার। কাল অনেকটা ড্রিঙ্ক করা হয়ে গেছিল। আজ মাথাটা কেমন ব্যথা করছে। পুনেতে একটা ফ্ল্যাটে রচিত এবং ওর এক বন্ধু শেয়ার করে থাকে। ওর বন্ধু আভাস ওকে একটু লেবু জল এনে দেয়। রচিত এর দুর্বার কথা মনে পড়ে। ওর সেই ছেলেবেলা কার বন্ধু। কত খুনসুটি কত ঝগড়া করতো ওরা। দূর্বা এত বোকা! একবার ও বুঝলো না রচিত ওকেই সবথেকে বেশি ভালোবাসতো । পাগলি একটা। ভাগ্যিস রনি ফোন করে জানাল তাই। দূর্বা ওর জন্যই অভিমান করে একটা ভুল স্টেপ নিতে যাচ্ছে। এটা ও কিছুতেই হতে দেবে না। প্রয়োজন হলে ছুটে যাবে ওর কাছে। হাজারবার বোঝাবে। প্রয়োজন হলে কাকু কাকিমার থেকে দুটো মার খেয়ে নেবে তাও ভাল কিন্তু ও কে এই বিয়ে করতে দেবেনা রচিত। রচিত একটা ফোন করে দূর্বা কে। কিন্তু দূর্বা ফোনটা তোলে না। হাল ছাড়েনা রচিত। ফোন করতেই থাকে। বাধ্য হয়ে একবার দূর্বা ফোনটা তোলে।
---বল ,নেশা কাটলো তোর???
-----দূর্বা তুই বিয়ে করছিস??
---হ্যাঁ করছি তোর কী তাতে??
----এ বিয়ে করিস না প্লিজ।-----আবার সেই এক কথা। বাই দ্যা ওয়ে কেন বলতো?? আমি বিয়ে করলে তোর কি? তুই থাক না তোর মত। তোর ইপস কোথায়?? বিয়ে করেছিস?? ইনভাইট তো করলি না?
-----হোল্ড অন হোল্ড অন দূর্বা। আমি কাউকেই বিয়ে করিনি। ফোন নম্বরটা তুই চেঞ্জ করেছিলিস তাই তোর সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
-----এখন পারলি কি করে??
------রনির কাছ থেকে পেলাম। আর তোর বোকামো টাও শুনলাম।
------তখন কেন রনির কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিয়ে ফোন করলি না???? বিজি ছিলি বোধহয় ইপসের এর সাথে??
-----দুর্বা শোন!!!
দূর্বা ফোনটা কেটে দেয়। বালিশে মুখ গুঁজে শুধুই কাঁদতে থাকে। এবার কি করবে সে? একদিকে তার ভালোবাসার মানুষ ফিরতে চাইছে অন্যদিকে পরিবারের পছন্দ করা মানুষ। বিয়ের ডেট মোটামুটি ফাইনাল। এখন কি ইচ্ছে থাকলেও ফিরে আসা যায়? না না আর রচিতের সাথে কথা বলা যাবে না। ও যদি দুর্বল হয়ে যায়। এমনিভাবেই দিন ছয়েক কেটে যায়।
গরম টা বেশ ভালোই করেছে।অনেকদিন পর দূর্বা ছাদে উঠলো। সেই ওর পরিচিত ঠান্ডা বাতাস ওকে ছুঁয়ে গেল। আজ আকাশ ভরা তারা। সারা আকাশে ওরা ঝিলমিল করছে। দূর্বা ওই দিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দুর্বার হঠাৎ করে মনে হল ওর চুলে কেউ যেন বিলি কেটে দিচ্ছে। সেই পুরনো অভ্যেস ওদের।প্রথমেই মনে করে এটা ওর মনের ভুল। কিন্তু তারপর মনে হয় কারো যেন নিঃশ্বাস ওর ঘাড়ের উপর পড়ছে। তাড়াতাড়ি পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে রচিত। ওর ভালোবাসা, ওর প্রিয় রচিত। সমুদ্রের ঝড় উঠলে ঢেউগুলো যেমন পাগলের মত উথাল-পাথাল হতে থাকে দুর্বার বুকের ভেতরটা যেন ঠিক অমনি করতে লাগলো। শুধু জলোচ্ছ্বাসের মতো চোখ দিয়ে জল গড়াতেই থাকল । রচিত পকেট থেকে হাংকি টা বের করে দেয়। দূর্বা বলতে থাকে" তুই কেন"কথা শেষ করার আগেই রচিত ওর ঠোট দুটি নিজের ঠোটের মধ্যে চেপে ধরে ৷ আর দূর্বা কে জড়িয়ে ধরে ৷
----- বোকা মেয়ে একটা ৷ তোর মুখের প্রপোজাল শুনবো বলে আধা জীবন কাটিয়ে দিলাম ৷তাও বলে উঠতে পারলি না ৷ ঈপ্সিতা র সাথে কোনদিনও আমার কোন সম্পর্ক ছিল না। ওটা তোকে জ্বালানোর জন্য ছিল। যাতে তুই আমার কাছে দৌড়ে এসে বলতে পারিস যে তুই আমাকে ভালবাসিস। কিন্তু এতই রাগ আর অভিমান তোর যে আমাকে বুঝতে পারলি না। না বুঝে এই এত বড় একটা ভুল ডিসিশন নিতে যাচ্ছিলি। কিরে এবার কিছু বল??
দূর্বা আজ বাক্যহারা। দুচোখ ভরে চাঁদের আলোয় শুধু রচিত কে দেখে চলেছে। মনে ভাবে এই জন্য ই বুঝি আকাশে তারারা ঝিলমিল করছে আজ।
---এবার চল নীচে যাওয়া যাক। তোর বাবা-মা আমার বাবা আর আমাদের বন্ধুরা নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
🌹সমাপ্ত🌹
কলমে
চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়
Address
640,jawpur road
Kolkata 700074