গল্প ।। ঋণের নিত্যতা সূত্র ।। শ্রীমন্ত সেন
ঋণের নিত্যতা সূত্র
শ্রীমন্ত সেন
আমার মনটা সদাসর্বদা কেমন যেন হু-হু করে, মনে হয় কী যেন নেই, কী যেন নেই। কেন যে মরতে ভীষ্মের ধনুকভাঙা পণ করতে গেলাম, "জীবনে বিয়ে করব না, মরে গেলেও না।" মরে গেলে বিয়ে কোন কর্মে লাগবে, মরার পর বিয়ের আর দরকারটাই বা কী, তা একবার ভেবেও দেখলাম না। আর বিয়ে না করলেই যে কী এমন স্বর্গলাভ হবে, পাঁচ-সাতটা হাত-পা গজাবে না সুখের বান ডাকবে, তা খতিয়ে দেখলাম বটে, কিন্তু ক্ষতির ব্যাপারটা ধরতেই পারলাম না, পরিমাণ তো দূরস্ত! শুধু একলা ঝুট-ঝামেলা-হীন ভাবে থাকা যাবে এই কুহেলি-মায়ায় মজে, 'বিয়ে করব না'— ব্যস, এই ভেবে ব্যাসদেবের মত নতুন জীবন-মহাভারত রচনায় লেগে পড়লাম!
বন্ধু-বান্ধব থেকে পাড়া-পড়শি মায় শুভানুধ্যায়ীরা পর্যন্ত তখন অকাতরে কত বোঝাল, "বুঝলে গজেন, এখন কিচ্ছুটি টের পাবে না কারণ এখন তো রক্তের জোর আছে, জল চিবিয়ে খাচ্ছো, খেয়ে যাও। যখন বয়স ঢলবে, বাবা-মা আর থাকবে না, বাবা-মায়ের হোটেলও বন্ধ হয়ে যাবে, 'ভবে একা' হয়ে যাবে, তখন বুঝবে 'বিবাহ করণের উপকারিতা'। আমাদের আর কী, জীবন তোমার, শপথ তোমার, ফলভোগও তোমার।" কিন্তু কারও কোনও অনুরোধই আমার মন টলাতে পারল না।
শেষে মাতৃদেবী হাল ধরলেন, "বাবা গজেন, মায়ের কথা শোন্। ঠিক আছে, তুই তোর কথা না ভাবিস, নাই ভাব্। শুধু আমাদের কথাটা একবার ভাব্। তুই আমাদের বংশের একমাত্র সন্তান। তুই বিয়ে না করলে আমাদের বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না বাবা। শেষে যে আমরা অন্য অনেক পুণ্য করলেও এই একটা মাত্র পাপে স্বর্গ থেকে বঞ্চিত হব। জানিস তো মহাভারতে রাজা নহুষের গল্প। তাঁর পুণ্য স্বর্গে বাস-করা-কালে পাপ গ্রাস করার ফলে তাঁকে স্বর্গচ্যুত হতে হয়েছিল আর অজগর সাপ হয়ে অনন্তকাল কাটাতে হয়েছিল। তুই কি চাস যে আমাদেরও সেই দশা হোক?"
তখনকার মত মায়ের হাত থেকে ছাড়া পেতে মাকে মিথ্যে প্রবোধ দিলাম, "আচ্ছা, আমাকে কিছুদিন ভাবতে সময় দাও। আমি দেখছি।" তখন মা নিবৃত হলেন। আমি দেখছি--- যদিও আজও আমার দেখা শেষ হল না।
সেবার কী ফ্যাসাদেই না পড়তে হয়েছিল আমাকে! মায়ের এক বান্ধবী শৈলমাসী তাঁর সোমত্ত কন্যা সুষমা সহ রথযাত্রা উপলক্ষ্যে বেড়াতে এলেন আমাদের বাড়িতে। আজও বুঝে উঠতে পারিনি এর পিছনে মায়ের কোনও সক্রিয় পরিকল্পনা কিংবা সহযোগিতা বা অনুপ্রেরণা ছিল কি না। আমি চিলেকোঠায় একটু শরীরচর্চা করছি, হঠাৎ কার চুপি চুপি আবির্ভাব। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেউ আমার শরীরচর্চা দেখছিল নিশ্চয়। হঠাৎ কার যেন প্রশংসাসূচক ধ্বনি শুনলাম, "বা!"
আমি পিছন ফিরে শব্দের উৎসসন্ধান করতে গিয়ে দেখি মূর্তিমতী সুষমা— তার চোখে মুখে বিস্ময়সূচক আভাস। অনিন্দ্য সুন্দরী না হলেও সুষমা বেশ ভালই সুন্দরী, লেখাপড়াতেও বেশ ভাল, অন্তত আমার তুলনায়। মনে মনে বুঝতে পারলাম— আমার মনটা একটু একটু করে কেমন যেন গলে যাচ্ছে, মুগ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে, আমার ভীষ্মপ্রতিজ্ঞা অটুট রাখা দায় হয়ে উঠছে ক্রমশ। একবার মনে হচ্ছে 'কী দরকার বাবু অবিবাহিত থেকে। তার থেকে মিষ্টি সুখে ভেসে যাই, সংসারীই হই। গোত্রছাড়া ভাবনায় কাজ কী?' আর পরক্ষণেই মন বলছে, "গজেন, খুব সাবধান। এ প্রলোভনে পা দিও না। আর বিলম্ব নয়, আর বিলম্ব নয়। শক্ত হও--- সিদ্ধান্ত নাও, সিদ্ধান্ত নাও।"
সিদ্ধান্তই নেব ঠিক করলাম। কিন্তু তার জন্য তো চিন্তাভাবনা, দু'টি দিকই ভালভাবে বিচার করা, দু'দিকেরই সুবিধা-অসুবিধার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা দরকার। বিশেষত সামনেই যখন সুযোগ্য পাত্রী এবং বিয়ের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত। আর মায়ের অনুরোধটাও ফেলনা নয় যে ফেলে দেব। পরে যেন ভুল সিদ্ধান্তের জন্য পস্তাতে না হয়। তাই আটঘাট বেঁধে অবিলম্বে অন্তর্দর্শনে বসে গেলাম। আজই এসপার ওসপার করে ফেলব।
প্রথমেই বিবেচ্য 'কেনই বা বিয়ে করব না' বলে প্রতিজ্ঞা করলাম। সংসারের ৯৯.৯৯% লোক যখন বিয়ে করে ঘর-সংসার করে, তখন আমার এই প্রতিজ্ঞার হেতু কী?
সে কী দেশসেবার মত মহৎ কর্ম? না, আমার মোটেই এমত কোনও মহৎ উদ্দেশ্য নেই। কারণ বিয়ে করে সংসারী হয়েও স্বচ্ছন্দে দেশসেবা করা যায়। তার জন্যে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কৌমার্যব্রত অবলম্বন করার দরকার হয় না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ কি গার্হস্থ জীবন পালন করেও দেশসেবা করেননি? এমত হাজারো নিদর্শন জানা আছে। তাহলে?
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি, "তবে কি তুমি অক্ষম?" না, মোটেই না। "তবে কি কোনও প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এই পণ?" না, সুষমাকে দেখার আগে পর্যন্ত কোনও নারীর প্রেমে তো পড়িনি। "তবে কি সুষমার প্রেমে পড়েছ বাছা?" এবার মনের গহনে ডুব দিই। না, সে রকম কিছু তো নিশ্চিতভাবে বুঝছিনে। "অনিশ্চিতভাবে?" " 'জানিনে, জানিনে, জানিনে'।"
"আচ্ছা, বিয়ে না করার সুবিধে কী?" আছে, আছে— অনেক সুবিধেই আছে। কথায় বলে 'অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট'। বিয়ে হলে প্রাইভেসি নষ্ট। সংসার সামলে নিজেকে সময় দিতে পারব না। নিজের মত থাকতে পারব না। "নিজের মত মানে? সংসার থেকে দূরে একলা একাকীত্বে ডুবে নিজেকে নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা? স্বার্থপর স্বার্থপর বলে মনে হবে না?" তা একটু হবে হয়তো। একটু স্বার্থপর না হয় হলামই। বাঁধন নেই, পিছুটান নেই, জীবনটাকে প্রাণখুলে ভোগ করা যাবে। আজ খেতে ইচ্ছে করছে না, খাব না। আজ কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না, যাব না। ক'দিন ছুটি নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসতে ইচ্ছে করছে, বেরিয়ে পড়লাম।
"আর থাকা-খাওয়া?" সে তো শাস্ত্রেই আছে 'ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে।' "অসুখ-বিসুখ হলে পাশে কে থাকবে?" 'পয়সা ফেললে আবার কাকের অভাব!' 'নগদা সেবিকা'-র সাহায্য নেব। "বা! বা!! 'নগদা সেবিকা' অর্ধাঙ্গিনী সতীসাধ্বী স্ত্রীর সেবা দেবে? ভালবাসা মমতা দেবে?" মনকে উত্তর দিতে পারলাম না।
তবুও অবিবাহিত জীবনের তথাকথিত উচ্চমার্গীয় জ্যোতি/শোভা আমাকে টানতে লাগল। মনস্থির করতে না পেরে ক্রিকেট খেলায় টস করার মত 'বিয়ে অথবা বিয়ে নয়' বিষয়ে ফয়সালা করার জন্য সেই টস করারই সিদ্ধান্ত নিলাম, কারণ জীবন তো এক রকম খেলাই। 'বিয়ে' 'হেড', 'বিয়ে নয়' 'টেল'। একটা এক টাকার মুদ্রা নিয়ে টস করলাম। টেল। সেই থেকে মুদ্রাদোষের তথা মুদ্রারাক্ষসের কবলে পড়ে গেলাম।
সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিলাম— যঃ পলায়তে, স জীবতি। আজই রাত্রে পালাতে হবে— এ বাড়ি ছেড়ে— 'অন্য কোনও খানে'। যেমন সিদ্ধান্ত, তেমন কাজ।
রাত্রি নিজঝুম। একটি মাত্র ব্যাগে আমার যৎসামান্য জামা-কাপড় ইত্যাদি নিয়ে আস্তে আস্তে পা টিপে এক তলায় নামি। বাবা-মা নীচের বড় ঘরে ঘুমোচ্ছেন। পাশের একটা ঘরে মায়ের বান্ধবী আর তাঁর মেয়ে সুষমা নিদ্রাচ্ছন্ন। চুপি চুপি সদর দরজা খুলে বাইরে পা রাখলাম। মনটা কেমন যেন হু-হু করে উঠল।
এ কি সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ! আমার যশোধরা কোথায়? কেন— সুষমা? এ কি নিমাইয়ের গৃহত্যাগ? আমার শচীমাতা কোথায়? কেন আমার মাতৃদেবী? আমার বিষ্ণুপ্রিয়া কোথায়? কেন— সুষমা? যেতে মন চায় না, পা চলে না। কিন্তু টসে টেলের পরিণতির কথা ভেবে, টেল-এণ্ডে কী আছে তা না জেনেই, নিজের মনকে অটল করি, তারপর সামনের দিকে টলোমল পা বাড়াই। শুধু সুষমার অস্ফুট প্রশংসাধ্বনি কানে বাজে, "বাঃ!" প্রশংসা নয় তো, যেন শ্লেষের কষাঘাত! কাপুরুষের মত এগোতে থাকি মানে জীবন থেকে পিছতে থাকি।
এরপর চল্লিশ বছর কেটে গেছে। আমি এখন পঁয়ষট্টি বছরের প্রৌঢ়। এখনও অবিবাহিত। নানা ঘাট আর আঘাটার জল খেতে খেতে আজ কোলকাতার এক শহরতলির প্রায় বস্তিতে এসে থিতু হয়েছি। এক বেসরকারি বীমা কোম্পানি থেকে অবসর নিয়ে নিজস্ব ছোটখাট বাড়িতে অবসর জীবন কাটাচ্ছি। তবে একেবারে নিঃসঙ্গ নই— আমার সর্বক্ষণের পরিচারক রাজেন মোহান্তি, কলিঙ্গনন্দন, আর রাঁধুনি তথা কাজের মাসি হেমলতা, রাজেনের সহধর্মিনী—ওদের সন্তানাদি না থাকায় আমার বাড়িতেই পাঁচিলের পাশে একটা ছোট খুপড়িতেই থাকে। বাইরের যাবতীয় কাজ রাজেন আর ঘরের কাজ হেমলতাই সামলায়। বলতে গেলে ওরাই আমার অভিভাবক।
আর আমার দেশের বাড়ির খবর? বাবা-মা কবে মনের দুঃখে মারা গেছেন। আমাদের সেই বাড়ি এখন পাঁচ ভূতে ভোগ করছে। সুষমাদের কোনও খবর জানি না। এখন মাঝে-মধ্যে ভাবি সেদিন যদি টেল না পড়ে হেড পড়ত!
ক'দিন ধরেই দেখছি এখানকার পরিবেশও পাঁচ ভূতে, বিশেষত আমার পাশের পড়শিই, নষ্ট করে দিচ্ছে। সত্যি বলতে কী আমাদের বাড়ির পশ্চিমদিক ঘেঁষা বস্তিবাড়িটার শব্দদূষণ আর দৃশ্যদূষণ বেশ বেড়ে গেছে। একাই একশ এই ভদ্রলোকের চিমসে মত চেহারা, মোটের উপর পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স, ফর্সাই বলা চলে, তবে কেমন যেন ধূর্ত ধূর্ত দেখতে, আর চাউনিটাও কেমন কেমন যেন সবজান্তা ধরনের— তাকালেই মনে হয় যেন মনের ভিতরটা পর্যন্ত উঁকি মেরে দেখে নিচ্ছে। ভদ্রলোকের(?) নাম – কী যেন পাকড়াশি, হ্যাঁ পুরঞ্জয় পাকড়াশি। কী করেন 'দেবা ন জানন্তি, কুতো মনুষ্যাঃ'। তবে বাড়িতে অর্ধাঙ্গিনীটি বড়ই সতীলক্ষ্মী বেচারা ধরনের, খুবই সুন্দরী, একটু কৃশকায়া। আর হবে নাই বা কেন, আটতিরিশ উনচল্লিশ বছর বয়স হবে, এর মধ্যেই আধ ডজন ছেলেমেয়ের মা হতে হয়েছে পাকড়াশির ঘর সামলাতে সামলাতে।
সচরাচর মুখে রা-টি নেই। কেবল ছেলেপুলেরা যখন খিদের জ্বালায় খাবারের জন্য জ্বালাতন করে কিংবা স্বামীপ্রবর অন্যত্র মৌত করে উপরন্তু রেস খেলে টাকাপয়সা ফৌত করে এসে তার বা ছেলেমেয়েদের উপর অকারণে অত্যাচার করে, তখনই মাত্র সে ভগবানের কাছে চেঁচিয়ে কেঁদে-কেটে নিজের ও ছেলেমেয়েদের মৃত্যু কামনা করে। তখন কেন জানি না-- আমার মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়।
কতদিন দেখেছি ভদ্রমহিলার চোখে অসহায় করুণ দৃষ্টি, কখনও দেখেছি মারের চোটে প্রকাশ্য অঙ্গে রক্ত জমে নীল হয়ে গেছে। কখনও লক্ষ করি এক দু'দিন উনুনে আঁচই পড়ে না মানে রানাবান্নাই হয় না। তখন ছেলেমেয়ে বা ভদ্রমহিলার কান্নাকাটি আরও বেড়ে যায়, তার উপর স্বামীপ্রবরের মারধর।
ওরা আমার কোনও কুলের কেউ হয় না। একে তো নিজের জেদের বশে আমার সংসারই হল না সেই অর্থে। তবু কেন জানি না ওদের জন্য আমার বড় মায়া লাগে। তাই হেমলতাকে বলে কয়ে ওদের মাঝেমধ্যেই কিছু কিছু রান্নাকরা খাবার-দাবার পাঠিয়ে দিই। অনুভব করি কান্নাকাটিতে কিছুটা হলেও যেন ছেদ পড়ে। তখন কেন জানি না নিজের জীবনকে কিছুটা হলেও সার্থক বলে বোধ হয়। এরকম প্রায়শই হয়। আর তার পরেই পাকড়াশির সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে তার দৃষ্টিতে কী যেন অতিরিক্ত কিছু দেখতে পাই, সেটা কৃতজ্ঞতা বা অন্য কিছু, তা হলফ করে বলতে পারি না।
এর ক'দিন পরে সকাল আটটা নাগাদ নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছি, রাজেন সবে বাজার করে ফিরেছে, আর কিছু পরেই হেমলতা রান্নাবান্না শুরু করবে। এমন সময় হঠাৎ বাইরের ঘরে কার যেন গলা শুনলাম, কে বা কারা যেন ভিতরে আসতে চায়, কী যেন বলতে চায়, আর মনে হল রাজেন যেন তাকে বা তাদের চোটপাট করে বিদায় দিতে চায়। থাকতে না পেরে আমি দিলাম এক হাঁক, "রাজেন, বলি ব্যাপারখানা কী? কারা এসেছেন?"
রাজেন হন্তদন্ত হয়ে ঢুকেই ব্যাজার মুখে কী যেন বলতে যেতেই দেখি তার পিছন পিছন একটা বড়সড় মাটির হাঁড়ি সহ সেই সবজান্তা মার্কা ধুরন্ধর পুরঞ্জয় পাকড়াশির প্রবেশ ও আমার পায়ের কাছে সেই হাঁড়িটি রেখেই সাষ্টাঙ্গে প্রণামের জন্য মাটিতে দণ্ডবৎ শয়ন।
"আরে করছ কী! ওঠো, ওঠো— বলি এমন করছ কেন?" "বাবা, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি বাবা। আমার এই মহা অপরাধ ক্ষমা করে দিন" বলেই সেই হাঁড়িটার দু'পাশ দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার দু'টি পা সজোরে আঁকড়ে ধরে। ভাবটা এই "যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না নাথ!" সেই যে পা পাকড়েছে পাকড়াশি, ছাড়ার আর নামটি নেই। আমার একেবারে পদস্খলন হবার জোগাড়!
বিপদ দেখে শেষে দিলাম এক ধমক, "ওঠো বলছি। ওঠো।" অগত্যা বাধ্য ছেলের মতই পাকড়াশি সেই হাঁড়ি সহ উঠে দাঁড়ায়। তারপর বলে, "বাবা, বলুন— আপনি অবোধ ছেলেকে ক্ষমা করলেন।" "ছেলে! অবোধ ছেলে! কে ছেলে! কে অবোধ!" "কেন বাবা আমি, আমি আপনার ছেলে, আপনার অবোধ ছেলে।" "তুমি আমার ছেলে! বলো কী? তুমি আবার আমার ছেলে হবে কবে?" "কেন বাবা, আগের জন্মে।" "আগের জন্মে! ধাষ্টামো করার আর জায়গা পাওনি।" সঙ্গে সঙ্গে জিভ কেটে পাকড়াশির পাকবার্তা, "এমন কথা শোনাও পাপ বাবা। আমি যে আগের জন্মে আপনার সত্যিকারের ছেলে ছিলাম বাবা। আমি বড় হতভাগা যে আগে আমি এ কথা জানতে পারিনি। এই মাত্র আজ ভোরে— আজ ভোরে একটা স্বপ্ন দেখলাম আর সঙ্গে সঙ্গে সব মনে পড়ে গেল। মনে হল যেন চোখের উপর থেকে মানে মনের উপর থেকে একটা পর্দা সরে গেল।" "কীসের পর্দা?" "আজ্ঞে, বিস্মরণের পর্দা। আমার আগের জন্মের কথা হুবহু মনে পড়ে গেল। জানেন তো যে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়?"
"হ্যাঁ, তা জানি বটে। তা কীসের স্বপ্ন? আগের জন্মের কী কথা?" "আজ্ঞে বাবা, ওই যে আগের জন্মে আপনি রাজা যযাতি ছিলেন আর আমি ছিলাম আপনার সন্তান পুরু।" "যযাতি-পুরু? এ যে সেই পৌরাণিক যুগের কথা হে।" "আজ্ঞে, ঠিকই বলেছেন বাবা। সেই পৌরাণিক যুগেরই কথা। কিন্তু সে আমার-আপনারই আগের জন্মের কথা, বিশ্বাস করুন। আপনার দুই স্ত্রী দেবযানী আর শর্মিষ্ঠার মধ্যে শর্মিষ্ঠাই আমার গর্ভধারিণী মা ছিলেন।" তাঁর উদ্দেশে কপালে ডান হাত ঠেকায় আজকের পুরঞ্জয় পাকড়াশি মানে সে যুগের পুরু আর বাঁ হাতে ধরা থাকে সেই মাটির হাঁড়ি।
আমার চোখমুখের ভাব দেখে সে আবার শুরু করে, "বিশ্বাস হচ্ছে না বাবা? ভাবুন, আপনিও ভাল করে ভাবুন। মনে করার চেষ্টা করুন। দেখবেন— আপনারও সব মনে পড়ে যাবে। তা যা বলছিলাম বাবা, আপনি আপনার শ্বশুর মশাই মানে দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের অভিশাপে অকালে যৌবন হারিয়ে জরাগ্রস্ত হলেন। কাটান হিসাবে পাওয়া মুসকিল আসান উপায় ছিল একটাই— যদি অন্য কেউ আপনার জরার বদলে নিজের যৌবন দান করে, তবে আপনি আবার যৌবন ফিরে পাবেন। তাই—"। তাকে থামিয়ে আমি বললাম, "তাই?"
"তাই, আপনার ছেলেদের মানে দেবযানী মা'র দুই ছেলে আর আমার দুই সহোদর দাদাকে আপনি অনুরোধ করলেন আপনার জরার বিনিময়ে যৌবন দান করতে। কিন্তু তারা কেউ রাজি হল না। শেষে—"। "শেষে?" "শেষে আমি পুরু, আপনার দ্বিতীয় পত্নীর কনিষ্ঠ পুত্র মানে তৃতীয় পুত্র পুরু, আমার যৌবন আপনাকে দান করলাম— আপনি আবার যুবক হলেন আর আমি আপনার জরা নিয়ে হলাম জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ মানুষ।"
শুনেই আমার আক্কেল গুড়ুম! ছিঃ ছিঃ! আমি এতবড় স্বার্থপর ছিলাম। কেমন যেন বিশ্বাসও করতে শুরু করলাম, হবেও বা। এ জন্মেও তো কম স্বার্থপর নই। নিজের বাবা-মাকে দেখলাম না, তাঁদের অযথা মনঃকষ্ট দিয়ে তাঁদের অকাল মৃত্যুর কারণ হলাম, বিবাহেচ্ছু সুষমার কাছ থেকে কাপুরুষের মত পালিয়ে এলাম। সমাজ-সংসারের কোনও কাজেই লাগলাম না।
আমার ভাব-বৈকল্য অনুধাবন করে পুরঞ্জয় তথা পুরু বলল, "অবশ্য পরে, সে অবশ্য হাজার বছর পরে, আপনার মনোভাবের বদল হয়েছিল বাবা। আপনার ভোগবিলাসে অরুচি ধরে গিয়েছিল। তখন আপনি আমাকে আমার যৌবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বৃদ্ধাবস্থায় বনে তপস্যা করে মহান ঋষি হয়েছিলেন আর তার ফলে স্বর্গেও গিয়েছিলেন। আর যৌবন ফিরে পেয়ে আমি সুখে ঘর-সংসার করেছিলাম। আমার বংশধররা হল পৌরব। শুনে আপনি খুশি হবেন বাবা, আমারই এক বংশধর পুরুরাজ এযুগে আলেকজান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গেলেও 'সে কেমন ব্যবহার প্রত্যাশা করে' এই প্রশ্নের উত্তরে মাথা উঁচু করে বলতে পেরেছিল, 'রাজার প্রতি রাজার মতো ব্যবহার'। সত্যি আমি গর্বিত বাবা।"
বিস্মিত হলেও আমি গর্বিতও হই। পুরুরাজ তাহলে আমারও বংশধর। বিশ্বাস হোক ছাই না হোক, আমার ভাবতে খুব ভাল লাগছে যে আমারও কেউ আছে, আমিও কারও কেউ হই। মনটা ক্রমশ নরম হয়ে আসে। এমন সময় পুরু তথা পুরঞ্জয় অন্দরে মুখ বাড়িয়ে হাঁক দেয়, "কই, কোথায় গেলে গো। এসো, ওদের নিয়ে এসো।"
"ওদের মানে! কাদের?" সে প্রশ্নের অচিরেই সমাধান হয়। হাফ ডজন কিশোর-কিশোরী-শিশু নিয়ে অচিরেই প্রবেশ সেই কৃশকায়া পাকড়াশিপত্নীর। "আরে, প্রণাম করো, প্রণাম করো— ইনি আমার বাবা মানে তোমার শ্বশুর মশাই, আর আমার ছেলেপুলেদের ঠাকুরদা। বাবার চরণে যখন আশ্রয় পাওয়া গেছে, তখন আর চিন্তা কী? এখন ঘর সংসারের হাল ধরো। সবাইকে সুখে রাখো। আগের জন্মে সেবা করার সুযোগ পাইনি, এ জন্মে সে সাধ প্রাণভরে মিটিয়ে নিই, এসো। বাবা মাটির মানুষ, আমাদের সেবা করার সুযোগ নিশ্চয় দেবেন। কী বাবা, আমাকে আর আপনার বৌমা বিধুমুখীকে সে সুযোগ দেবেন না?"
আমি অগত্যা বলে উঠি, "হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই, অবশ্যই।" "রাজেন দা, ও রাজেন দা! এই রসগোল্লার হাঁড়িটা নিয়ে যাও। বৌদিকে বলো সবাইকে দিতে। আর বাবাকেও যেন বেশ কয়েকটা দিয়ে যান"—পুরুর পুরস্কার বার্তা! রাজেন ব্যাজার মুখে হাঁড়িটা নিয়ে অন্দরে যায়।
সেদিন থেকে শুরু হল এক প্রৌঢ় চিরকুমারের নতুন করে সংসারযাত্রা। সানন্দে মাথা পেতে নিই নতুন দায়িত্ব। আগের জন্মের ঋণ না হয় এ জন্মেই যতটা পারি শোধ করব, অকৃতজ্ঞ তো আর নই। তবে সমর্থ ছেলেকে তো আর বসিয়ে খাওয়াতে পারি না। তাই পুরু তথা পুরঞ্জয়কে সামনের বাজারেই খুলে দিই একটা মনোহারি দোকান। বাবা, খেটে খাও।
সুখের কথা-- ক্রমে তার স্বভাবও একটু একটু করে বদলায়। এখন সে ঘোর সংসারী। আর আমার নাতি-নাতনি-ছেলে-বউমা নিয়ে ভরভরাট সংসার। আমার হঠাৎ মনে পড়ে যায়— মা রাজা নহুষের কথা বলেছিলেন না, পুণ্যবলে যাঁর স্বর্গগমন আর পাপের জন্য যাঁর স্বর্গচ্যুতি! সেই রাজা নহুষই তো আগের জন্মে আমার মানে যযাতির বাবা ছিলেন না! মা কি তাহলে কিছু বুঝতে পেরেছিলেন? নইলে ওই বিশেষ উদাহরণই বা দিলেন কেন? আবার নতুন করে সব ভাবি। ভেবে আমার আগের জন্মের কাহিনি বেশ সত্যি বলেই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গেই আমার এও মনে হয়— আমার বাবা-মা বোধহয় আমার এই পুত্র-পৌত্রাদির দৌলতে স্বর্গেই একটু ঠাঁই পেয়ে গেছেন। শুধু সুষমার জন্যই মনটা যেন কেমন হু-হু করে ওঠে।
------
Srimanta Sen
29/A/1, Bhagirathi Lane,
P.O.- Mahesh, Dist- Hooghly
PIN- 712 202
শ্রীমন্ত সেন