Click the image to explore all Offers

অণুগল্প।। চুল।। তনিমা সাহা

 

 চুল

 তনিমা সাহা

:

"এঃ হে হে! আবার চুল...আবার চুল ভাতের থালায়…"।

থালাটাকে এক ঠ্যালা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে বেসিনে গিয়ে হরহরিয়ে বমি করলো বসন্ত। শুধু জল বেরোল কারণ তিনদিনের খালি পেটে কি আর থাকবে। ছোট থেকেই খাবার পাতে চুল পড়লে প্রচণ্ড বিরক্ত আর ঘেন্না পেত বসন্তর। আর তার কপালেই কিনা এমন বউ জুটলো যার কিনা কোমর ছাপানো চুল। ভারি আবার নামের বাহার....'কেশোলতা'।

খ্যান্তপিসি রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বললেন, "কি রে আবার পাতে চুল দেখলি নাকি রে"।

তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বসন্ত বলল, "হ্যাঁ পিসি"।


খ্যান্তপিসি রান্নাঘরে বাসন গুছিয়ে আঁচল গুটিয়ে বললেন, "দেখ বাবা আমার মাথায় তো চুলই নেই। সেই যে বাইশে বিধবা হলাম তখন নাপিত এসে কাঁচি দিয়ে কেটে দিল আমার একঢালি চুল। সেই থেকে মাথায় এই কুঁচো কুঁচো চুল"।


ক্লান্ত ভাবে বিছানায় গা এলিয়ে  বসন্ত বলে, " না পিসি ও তোমার চুল নয়। তোমার তো সাদা চুল। তা-ও ছোট ছোট। কিন্তু এতো লম্বা, কালো চুল"।


টেবিল থেকে এঁটো থালা উঠিয়ে নিয়ে যেতে যেতে খ্যান্তপিসি বললেন, "তেমন চুল তো শুধু আছে কেশোলতার। কিন্তু সে-ও তিনদিন আগেই বাপের বাড়ি গেছে। তুই-ই তো রেখে এলি"।


বসন্ত হ্যাঁ-না কি বলল তা খ্যান্তপিসি ঠিক শুনতে পেলেন না। পায়ে চটি গলিয়ে খ্যান্তপিসি বসন্তকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমি সব রান্না করে ভাল করে ঢেকে রেখে গেছি। ওবেলা দুটো খেয়ে নিস, কেমন। আমি এখন আসি। কাল আবার আসবখন"।


কোনভাবে বিছানা ছেড়ে উঠে বসন্ত দরজাটা দিয়েই আবার শুয়ে পরলো। আজকাল বমি করার পর খুব ক্লান্ত লাগে। মনে হয় শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। এখন তার মনে হয় কেশোলতা এখানে থাকলে ভাল হত। তার সেবা যত্নে বসন্ত ঠিক সুস্থ হয়ে উঠতো।


রাতে খাবারের সময় আর কোন অসুবিধা হল না। তিন দিন তিন রাতের পর আজ প্রথম দুটো খেতে পারল বসন্ত। যার ফলে বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম চলে এল। 


রাত আন্দাজ দুটো-আড়াইটা হবে। হঠাৎ খুব গরম লাগতে শুরু হল বসন্তের। আধ বোজা আধ খোলা চোখ মেলে সে দেখে মাথার ওপর পাখাটা বন্ধ। 


"সে কি তবে কারেন্ট নেই", মনে মনে ভাবে বসন্ত।

ইন্ডিকেটারের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় সেখানে আলো জ্বলছে। 


"তবে.."। 

ভাল করে দেখার জন্য বিছানা ছেড়ে ওঠার সময় গলায় বসন্তের একটা টান অনুভব হয় যেন কিছু শক্ত হয়ে পেঁচিয়ে আছে গলার চারিদিকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখে বসন্ত। জিনিসটা হাতিয়ে বুঝতে পারল যে সেটা গোছাগোছা চুল। তা থেকে জেসমিন তেলের সুগন্ধ আসছে। ঠিক যেমন কেশোলতার চুল থেকে আসত। কেশোলতার চুল নিয়ে ভীষণ আদিখ্যেতা ছিল। চুলে শ্যাম্পু লাগাচ্ছে, সুগন্ধি তেল লাগাচ্ছে, রিঠা আমলা পিষে লাগাচ্ছে। আর স্নানঘরে, ড্রেসিং টেবিলে, বিছানায়, মুখ ধোয়ার ওয়াস বেসিনে খালি গোছায় গোছায় চুল লেগে থাকছে। এমনকি রাতের বেলায় ঘনিষ্ঠ ভালবাসার সময়েও চোখে-মুখে খালি চুল লাগত। বলেছিল বসন্ত বহুদিন চুলটা একটু ছোট করে নাও….দেখতেও ভাল লাগবে আর বয়েসটাও কম লাগবে। কিন্তু কেশোলতা তার চুল নিয়ে খুব একরোখা ছিল। নিষেধ বারণ কিছুই শুনতো না। বসন্তের মনটাও বিষিয়ে উঠছিল দিনদিন। তাইতো সেদিন বাপের বাড়ি নিয়ে যাবার নাম করে মোতিয়াবিলের ডোবাটার ধারে…...।

অস্ত্রটাও যে হাতের কাছেই ছিল….সুদীর্ঘ চুল।


"আহ্..আআআহহহহ্….শ্বাআআস নিতে পাআআরছি নাআআহ্"....

গলির চারপাশে চুলের গাঢ় বাঁধন আরো দৃঢ় আরো টাইট হয়ে গেল। বসন্ত আর দম নিতে পারছে না। দুহাত দিয়ে গলার বাঁধন আলগা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু হাত-পাদুটো কেউ যেন শক্ত করে চেপে ধরে আছে। সমস্ত মুখের রক্তকণাগুলো দুচোখের আশেপাশে গিয়ে জমা হল। প্রবল চাপে চোখদুটো মুখমণ্ডল থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। জিভটাও খোলা মুখ থেকে ঠেলে বাইরে এল। হাত-পা, মাথা, শরীর যথাশক্তি দিয়ে নাড়াচাড়া করার বৃথা চেষ্টায় এখন ক্লান্ত, অবসন্ন। ব্যাস আর কয়েক সেকেণ্ড। তারপরেই এই জীবন মরণের যুদ্ধ শেষ। অনেক কষ্টে জিভ বের করে বসন্ত বলে, "কে…"?


কানের কাছে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে, "আমি গো...তোমার লতা...কেশোলতা.."।


"কেশো…"....বসন্তের আর কিছু বলার ক্ষমতা রইলো না। চোখের কোল দিয়ে ক্ষীণ রক্তধারা গড়িয়ে পড়লো। জিভটা খোলা মুখ থেকে বেরিয়ে ঝুলতে লাগল। ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল কষ।



পরদিন খ্যান্তপিসি সকালে এসে বসন্তের দরজায় ধাক্কা দেন। কিন্তু বহুবার ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও যখন সে দরজা খুললো না তখন আশেপাশের লোকজন ডেকে এনে দরজা ভেঙে ঘরে ঢোকেন। বসন্তের নিঃসার দেহ দেখে খ্যান্তপিসি এক আর্তভেদী চিৎকার করেই মাথা ঘুরিয়ে ঢলে পড়লেন।

-------------------------------

 



ঠিকানা : নারায়ণপুর, কোলকাতা-১৩৬

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.