গল্প।। উপলব্ধি।। সমীরণ সরকার
0
জুলাই ০১, ২০২১
সমীরণ সরকার
সকাল থেকেই দিনটা ভাল যাচ্ছে না অমলের ।পরপর তিনটে এটেম্পট এর দুটো মাঝপথেই ফুস -মানে ওই যে কি বলে না আউট অফ সাইট হয়ে গেল আর তিন নম্বরটা ফুটো কাপ্তান ।চকচকে জুতো পড়ে ভাল করে টেরি বাগিয়ে পকেটে মাত্র সাতান্ন টাকা নিয়ে বেড়িয়েছে! আজ আর কিছু হবেনা মনে হচ্ছে। তারচেয়ে মেট্রোতেই ঘুরে আসা যাক।ওটা অমলের একটা খেলা ।ওর মন ভালো করার খেলা ।যে কোন কারণে মনটা খারাপ হলেই অমল একটা টিকিট কেটে নেমে যায় পাতাল রেলের ঝকঝকে স্টেশনে।ওখানে চলমান সিঁড়ি দিয়ে বারকয়েক ওঠানামা করে ।তারপর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ে ।ট্রেনের আসা যাওয়া দেখে ,যাত্রীদের ওঠানামা দেখে।না, পাতাল রেলে সে কোন কাজ করে না। দু একবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে ।অবশ্য বাসে খুব ভিড় থাকলেও অনেক সময় টার্গেট ফসকে যায় ।সেই জন্য মাঝারি ভীড়ের বাসে উঠে পড়ে অমল।এদিক ওদিক তাকিয়ে টার্গেট ঠিক করে। এরপর ভিড়ের মধ্যে কায়দা করে শরীরটাকে ভিতরে সেঁধিয়ে টার্গেটের কাছাকাছি গিয়ে ভালোমানুষের মত মুখটি করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।টার্গেট কন্ডাক্টরকে ভাড়া দেওয়ার সময় কোত্থেকে মানিব্যাগ বের করল আর সেটা কোথায় রাখল সেটা আড়চোখে লক্ষ্য করে। তারপর টার্গেট সিট ছেড়ে উঠলে তার গায়ে লেপ্টে বাসের গেটের দিকে এগিয়ে যায় । এরপরই হল আসল কাজ, অর্থাৎ 'অপারেশন '।গেটের সামনে টার্গেটের একেবারে গা ঘেঁষে দাঁড়ায় । কৃত্রিম গন্ডগোল বাধিয়ে দেয়। আর সেই ফাঁকে টুক করে অস্ত্র চালিয়ে মাল খালাস করে। এই কাজে অমলের সমকক্ষ আর কেউ নেই রামু ওস্তাদের ঠেকে।অমলের বয়স এখন তেইশ বছর। মাত্র বারো বছর বয়সে ও রামু ওস্তাদের হাতে পড়েছিল। তারপর দীর্ঘ দু-দুটো বছর শিক্ষানবিশি করার পর কাজে নামার লাইসেন্স পেয়েছে।অমল কি ছোটবেলায় কোনদিন স্বপ্নেও ভেবেছিল যে শুধু দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোগাড়ের জন্য তাকে পকেটমারের জীবিকা বেছে নিতে হবে?বাবা চটকলে কাজ করতো ।বাবা আর মাকে নিয়ে কত আনন্দে কেটেছে তার ছেলেবেলা ।স্কুলে পড়তো। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দেখত মা তার জন্য নানা রকম মুখরোচক জলখাবার বানিয়ে রেখেছে ।বাবা সন্ধ্যাবেলায় কাজ থেকে ফিরে তার সঙ্গে গল্প করত। ক্লাস সেভেন পাস করে ক্লাস এইটে উঠল অমল।তারপর এল সেই ভয়ঙ্কর দিন ।কারখানা থেকে বাড়ি ফেরার পথে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেল বাবা। মাস পাঁচেকের মধ্যে বাবার এক সহকর্মী গেনু মিস্ত্রি মাকে বিয়ে করে তার বাড়িতে নিয়ে তুলল।মায়ের সঙ্গে অমল গেনু মিস্ত্রির বাড়িতে গিয়ে দেখল, সেটা একটা পুরনো হাড়জিরজিরে বাড়ি। অনেক লোক থাকে ওখানে । ওখানে সিঁড়ির নিচে একটা স্যাঁতস্যাঁতে জায়গায় অমল রাত্রে একা শুতো।মাকে জড়িয়ে ধরে শুতে না পারার জন্য প্রথম প্রথম খুব কান্না পেত অমলের। বছরখানেক পরেই অমলের একটা নতুন ভাইয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মা টা মরে গেল, ভাইটাও বাঁচল না। গেনু মিস্ত্রি তাড়িয়ে দিল অমলকে।পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে ।একদিন খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একটা দোকান থেকে একটা পাউরুটি তুলে নিয়ে পালাতে গিয়ে ধরা পরল ।জনতা তাকে মারতে শুরু করলো নির্দয়ভাবে ।সেই সময় রামু ওস্তাদ বাঁচিয়েছিল তাকে।একটা বিশাল দল আছে রামু ওস্তাদের । সে দলে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন ধর্মের ,বিভিন্ন জাতির তরুণ আছে। কেউ পকেটমার ,কেউ চিটিংবাজ ,কেউ ছিনতাইকারী। সবারই পিছনের ইতিহাসটা অনেকটাই অমলের মত ।হয়তো একটু উনিশ বিশ। অমল শুনেছে কোন এক রাজনৈতিক দাদার নাকি আশ্রিত রামু ওস্তাদ। ওসব নিয়ে অমলের কোনো মাথাব্যথা নেই।সে রেগুলার কাজ করে । মাল সামলায় ওস্তাদ।টাকার ভাগ যা পায় তাতে তার দিব্যি চলে যায়। যে বস্তিতে থাকে সেখানে সবাই জানে ও কলকাতার কোন একটা কোম্পানিতে চাকরি করে ।শ্যামবাজারে পাতাল রেলে চেপে অমল নামলো ভবানীপুরে। চলমান সিঁড়ি দিয়ে বারকয়েক ওঠানামা করে ক্লান্ত হয়ে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়ল।আজ রবিবার । ট্রেনের আসা-যাওয়া কম । যাত্রীও কম।তবু অমল তাকিয়ে দেখে ,নানা মানুষের মুখ ।হঠাৎই অমলের চোখ যায় উপরে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে। মেয়েটার বয়স সতেরো আঠারোর বেশি হবে না। পরনে হালকা তুঁতে রংয়ের চুড়িদার ।ওর ফর্সা গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মানিয়েছে ।মেয়েটির মুখশ্রীও সুন্দর কিন্তু অদ্ভুত বিষন্ন ওর চোখ দুটো ।দৃষ্টি উদাস ।কোন কিছুই যেন লক্ষ্য করছে না ও।পুরো মুখটা যেন থমথমে। ওকি কারোর জন্য অপেক্ষা করছে? ওর ভাবভঙ্গি দেখে সেরকম কিছু তো মনে হচ্ছে না। কোলে বা পাশে কোন লেডিস ব্যাগ নামানো নেই। মোবাইল ও দেখা যাচ্ছে না ।তাহলে কেসটা কি? তবে কি.....?অমল মোবাইলে ঘড়ি দেখে ।সাতটা বাজে ।তার মানে এখন তো ওপরে অন্ধকার নেমেছে।অমল হঠাৎ দূর থেকে খেয়াল করে ,মেয়েটা হাত দিয়ে চোখ মুছছে ।একি,ও হঠাৎ কাঁদছে কেন ?তবে কি বাড়িতে ঝগড়া করে নাকি প্রেমিকের কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখানে এসেছে? কিন্তু এখানে কেন ? তবে কি........?হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি। প্ল্যাটফর্মের ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। অমল অনুসরণ করে সন্তর্পনে। একটা ট্রেন আসছে ঘোষণা হলো ।একটু পরেই আলো দেখা গেল ।বোঝা গেল ট্রেন ঢুকছে।হঠাৎই মেয়েটা লাইনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল, কিন্তু পারল না ।ততক্ষণে অমলের দুই বলিষ্ঠ বাহুর আকর্ষনে মেয়েটি তার বুকে। ওই অবস্থাতেই ছটফট করছে মেয়েটা ।অমল ওকে শান্ত করার জন্য অনেক চেষ্টা করেও পারছে না ।কি করবে সে ?ট্রেনটা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রী ওঠানামা করছে ।কেউ যদি ওদের এই অবস্থায় দেখে ,তাহলে তো অন্য কিছু ভাববে। ঘটনা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে । সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে অমল হঠাৎই সজোরে একটা চড় কষায় মেয়েটির গালে। মেয়েটা অপ্রত্যাশিত ওই চড় টা খেয়ে হঠাৎই যেন শান্ত হয়ে যায় ।অমল ওর হাতের বাধন একটু আলগা করে দিয়ে চাপা গলায় বলে , মরতে যাচ্ছিলে কেন?---বেশ করছিলাম ।ছেড়ে দিন আমাকে!--ছাড়বো না ।বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশে দেব।--কেন ,পুলিশে কেন? আমি কি করেছি আপনার?---জাননা আত্মহত্যা করার চেষ্টা অপরাধ ?সব খুলে বল আমাকে। নইলে সত্যি কিন্তু পুলিশের কাছে নিয়ে যাবো।কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হলে , প্রায় জোর করেই ওকে উপরে নিয়ে যায় অমল। নিজে চা বিস্কুট খায়, ওকেও খাওয়ায়।অনেকটা স্বাভাবিক হয় মেয়েটা। কথায় কথায় অমল জানতে পারে যে, মেয়েটার বাবা ও মা দুজনেই চাকরি করে ।ক্লাস টুয়েলভে পড়ে মেয়েটা ।মা বাবার প্রচন্ড আশা যে,মেয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করবে। অথচ আজ স্কুলের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বার হওয়ার পর দেখা যায় যে ,ও দুটো সাবজেক্টে ফেল করেছে ।তাই ও মা বাবাকে আর মুখ দেখাবে না ভেবেই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেয়েটাকে বাড়ি ফিরতে রাজি করায় অমল। একা একা ওকে ছেড়ে দিতে ভরসা পায় না। তাই সারাদিনের রোজকার সেই সাতান্নটা টাকা ভেঙে বাস ভাড়া দিয়ে মেয়েটিকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যায় অমল।বাড়িতে ছিলেন মেয়েটির মা ।উদ্বিগ্ন বাবা মেয়ের খোঁজে বাইরে বেরিয়েছেন। অমলের মুখে সব কথা শুনে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন মেয়েটির মা। কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠেন, এ তুই কি করছিলে মা! ওরে,তোকে ছাড়া আমরা বাঁচতাম কি করে ?মায়ের সাথে সাথে কেঁদে ওঠে মেয়েও ।হঠাৎই মায়ের মুখটা মনে পড়ে যায় অমলের।মা আর মেয়ে গলা ধরে কাঁদছে ।এই ফাঁকে টুক করে বেরিয়ে আসে অমল। বেশ কিছুটা চলে আসার পর ওর হঠাৎ মনে হল ,কই মেয়েটার নামটা তো জানলাম না ।ওর মা ওকে খুকু বলে ডাকছিল ।থাক, কি হবে জেনে? ভাগ্যে ওরা অমলের সত্যি পরিচয় জানে না। জানলে তো কথাই বলত না ওর সঙ্গে। আজ অমলের হঠাৎই মনে হলো যে, সে যদি অন্য কোন কাজ করত, তাহলে তো তাকে এভাবে লুকিয়ে পালিয়ে আসতে হতো না।তবে মেয়েটাকে ওর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে অমলের আজ খুব আনন্দ হচ্ছে ।অনেকদিন আগে একটা অপারেশন করে মানিব্যাগে দশ হাজার টাকা পেয়েছিল অমল। খুব খুব খুশি হয়েছিল সেদিন। কিন্তু আজকের আনন্দের অনুভুতি টা যেন একেবারেই অন্যরকম ।ভালো কাজ করলে যে এতো আনন্দ হয় এটা তো জানা ছিল না ।তবে, তবে কি ও এখন থেকে...? কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব...?ভাবতে ভাবতেই একটা রানিং বাসে উঠে পড়ল অমল ।বাইরে অন্ধকার কালো রাত তখন ভোরের প্রতীক্ষায়।------------------------------------------------------
Khelaghar, Lautore,P.O.$ainthia,Dist.Birbhum,W.B. PIN--731234
Tags