রম্যরচনা।। পরী কাহিনী ।। রতন চক্রবর্তী
পরী কাহিনী
রতন চক্রবর্তী
এক,
ভীষন বর্ষা হচ্ছে। সেই সকাল থেকে বৃষ্টি নেমেছে। থামার লক্ষন নেই। এখন রাত আটটা মতো হবে। বৃষ্টির সাথে সাথে ঝড়ও শুরু হয়েছে। লোডশেডিং চলছে। যদিও বাড়িতে আলো আছে। ইনভার্টার।
অনিক একা থাকে। মা-বাবা বছর দুয়েক আগে কার একসিডেন্টে মারা গেছে। একটা বোন আছে, ওর বড়। স্বামীর সাথে কানাডা থাকে। এতো বড় বাড়িতে অনিক একা । একটা কাজের মাসি আছে। দিনের বেলা রেঁধে দিয়ে যায়।
ওর বাবার ব্যবসাটাই সে দেখাশোনা করে। সেনেটারি-ক্লাইম্বিঙের ব্যবসা। দু'জন কর্মচারি আছে, ওরাই চালায়। অনিক মাঝে সাঝে গিয়ে বসে।
বিয়ে থা এখনো করেনি সে। করবে করবে ভাবছে। বোনও তাগাদা দিচ্ছে।
টুং-টাং। কলিং বেলটা বাজলো। চমকে গেলো অনিক। এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কে এলো আবার? সাধারনতঃ এ সময় কেউ আসার কথা না। আবার বাজলো। তারপর আবার। বাজতেই থাকলো। একতলা বাড়িটা টুং-টাং শব্দে ভরে উঠলো। চরম বিরক্তি নিয়ে, হাতের বইটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো অনিক। সদর দরজাটা খুললো। খুলেই থমকে গেলো।
দুই,
দেখলো কেউ কোথাও নেই। তবে? হঠাৎ নিচের দিকে চোখ গেলো ওর। চমকে গেলো।
একটা মেয়ে। চোখ ঝলসানো রূপ। অজ্ঞান হয়ে দরজার কাছে পড়ে আছে। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো অনিক। অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। এই মেয়ে এখানে এলো কী করে? এমন রূপসী মেয়ের তো এখানে থাকার কথা না। দেখে মনে হচ্ছে ধনী বাবার আদরের মেয়ে।
গায়ের পোষাকটা গাঢ় নীল, আর অদ্ভুত সুন্দর। গলায় নীল রঙের মুক্তোর মালা। এ ছাড়া, গায়ে আর কোন গয়না নেই। মাথা ভর্তি কালো চুলের ঢেউ।
কিন্তু এই মেয়ে এখানে কী করছে?
নিশ্চই কলিং বেল টিপে টিপে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে।বাড়ির নিচু বাউন্ডারি দেয়াল ডিঙিয়ে রাস্তায় চোখ গেলো অনিকের। অন্ধকার। হঠাৎ হঠাৎ বিজলির চমকে, রাস্তাটা আলোকিত হচ্ছে। এলাকাটা ঘন বসতি নয়। দূরে দূরে একেকটা বাড়ি। এখনে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। সেই সাথে হাওয়ার দাপট। চারপাশটা দেখেও কিছুই বুঝলো না অনিক।
মেয়েটাকে ফেলে তো আর দরজা বন্ধ করে দেয়া যায়না।
অনিক, মেয়েটাকে পাঁজা কোলে করে ঘরে নিয়ে এলো। ফর্সা শরীর মেয়েটার। তেমন একটা ভারি নয়। মেয়েটাকে ওর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সদর দরজাটা বন্ধ করে দিলো। কতক্ষন কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে নিজের কর্তব্য ভাবতে লাগলো। আগে মেয়েটার জ্ঞান ফেরাতে হবে।
তিন,
মেয়েটা আধশোয়া হয়ে বালিশে হেলান দিয়ে আছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে।
অনিকের হাতে এক গ্লাস কুসুম গরম দুধ। মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে।
অবশেষে অনিকের হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিলো মেয়েটা। ঢক্ ঢক্ করে দুধটা খেয়ে নিলো।
অনিক মেয়েটাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলো। কিন্তু মেয়েটা জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।
রাতের খাবারের সময় অনিক যা খেলো, সেও তৃপ্তি করে তাই খেলো। অনিক মেয়েটাকে তার বিছানাটা ছেড়ে দিয়ে, গেস্ট রুমে ঘুমুতে গেলো।
টলটলে নীল জলের একটা বড় দীঘি। তাতে ধবধবে সাদা চারটে রাজহাঁস, মনের আনন্দে সাঁতার কাটছে। সেই জলে ফুটে আছে অসংখ্য নীল পদ্ম। ঝকঝকে মার্বেল পাথরের সিড়ি নেমে গেছে দীঘির জলের দিকে। অনিক হাঁটতে হাঁটতে সেই সিড়ির দিকে গেলো। ওখানে একটা কাঁর্ঠালি চাঁপার গাছ। তার পাশে জুঁই ফুলের ঝাড়। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। গন্ধে ম ম করছে চারদিক।
সে সব ছাড়িয়ে জলের দিকে নেমে যেতে থাকলো অনিক।
সহসা সামনের সিঁড়িতে একটা নীল বসনা মেয়েকে বসে থাকতে দেখলো সে। ওর পায়ের শব্দেই হয়তো, মেয়েটা ওর দিকে মুখ ঘুরিয়ে চাইলো। সাথে সাথে চমকে উঠলো অনিক। এ তো সেই মেয়ে, যাকে সে দরজা থেকে তুলে এনেছে, তার বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে!
মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো। দৌড়ে এসে অনিকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওর বুকে মুখ ঘসতে ঘসতে অভিমানি গলায় বললো, ' জানো, আমি কে? আমি পরী। কিন্তু আমাকে এই পৃথিবীতে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে। '
' কেন? ' অনিক জিজ্ঞেস করলো।
' সবার মতো, আমার পিঠে পাখা নেই তো তাই। ' জবাব দিলো নীল বসনা।
হঠাৎ জুঁই ফুলের্ গন্ধের্ তীব্রতা বেড়ে গেলো। ছটফট করতে করতে জেগে গেলো অনিক।
তার মানে এতক্ষন সে স্বপ্ন দেখছিলো। জুঁই ফুলের গন্ধটা এখনো তার ঘরে আছে। হঠাৎ ডিম লাইটের নীল আলোয় মেয়েটিকে ঘরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলো সে।
চার,
মেয়েটিকে সে তার ঘরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছিলো। অথচ এখন মেয়েটি এই গেস্ট রুমে দাঁড়িয়ে অনিকের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
অনিক চমকে গেছে। ভীষন ভাবে চমকে গেছে। নীলবসনার শরীর থেকেই ভুর ভুর করে জুঁই ফুলের গন্ধ বের হচ্ছে।
কিন্তু, স্বপ্নটা এতো বাস্তব মনে হচ্ছিলো যে, স্বপ্ন বলে বিশ্বাস করতে মন চাইছিলো না অনিকের।
হঠাৎ মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। কী মনে হতে অনিক বিছানা থেকে নেমে মেয়েটার পিছু নিলো।
মেয়েটা ছাদে চলে এসেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ পরিস্কার। সেই আকাশে একাদশির চাঁদ। সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটা কাঁদছে হুঁ হুঁ করে। মেয়েটার কান্না দেখে, অনিকের কী থেকে কী হয়ে গেলো। এগিয়ে গিয়ে, গভীর সম বেদনায়, মেয়েটার কাঁধে হাত রাখলো।
সাথে সাথে মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে, ঝাঁপিয়ে পড়লো অনিকের বুকে। মনে হলো অনিকের সাথে ওর অনেক দিনের চেনা।
অনিক ভাবছে, স্বপ্ন তাহলে সত্যি হচ্ছে?
অনিকও তাকে জড়িয়ে ধরলো। জিজ্ঞস করলো, ' কী হয়েছে তোমার্, কাঁদছো কেনো? '
মেয়েটি জবাব দিচ্ছে না। কাঁদছেই। অনিক পড়েছে মহা ফাঁপরে। কী করবে বুঝতে পারছে না।
পাঁচ,
অনিক মেয়েটার ছবি সহ পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে।
কিন্তু পাঁচ ছয় দিনেও কোন খবর হলো না। অনিক ইচ্ছে করেই পুলিশে্র কাছে গেলো না।
এদিকে এই মেয়ে দিনের বেলাতে ঘর থেকেই বের হতে চায় না। অনিকও ধীরে ধীরে মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছে। মেয়েটাও অনিকের অনেক ঘনিষ্ট হয়েছে। অনিক ওর নাম দিলো নীলাঞ্জনা।
অবশেষে একদিন অনিক নীলাঞ্জনাকে এক স্থানীয় কালি মন্দিরে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করলো। তাও রাতের বেলা।
রাতে ঘুরে ঘুরে সপিং করলো বউকে নিয়ে। কিন্তু নীলাঞ্জনা কথা বলে না। অনিক মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে দেখে তার বউ বিছানায় নেই।
ছাদে উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদছে আর অদৃশ্য কাকে কী সব বলছে। অনিক এসেছে টের পেয়েই চুপ করে গেছে।
নীলাঞ্জনা কনসিভ করেছে। ব্যপারটাকে সে ভালো ভাবেই নিয়েছে।
ডাক্তারি চেকাপ করানোর জন্য তাকে নিয়ে এখন দিনের বেলাতেই বের হতে হয় অনিকের। যদিও এতে নীলাঞ্জনার কষ্ট হয়। এদিকে দিন, মাস কেটে যায় হাওয়ায় ভর করে।
এবং তারপর নীলাঞ্জনার কোল আলো করে ফুটফুটে এক মেয়ে এলো। অনিকের আনন্দ আর ধরে না।
ছয়,
সেদিন ছিলো পূর্ণিমা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে অনিক দেখে তার বউ বিছানায় নেই। তার ছয় মাস বয়সি মেয়েটা জেগে কাঁদতে লেগেছে। অনিক মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ছাদে চলে এলো। বাবার কোলে উঠে মেয়েটা চুপ।
নীলাঞ্জনার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো অনিক।
দেখলো তার বউয়ের শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটাচ্ছে। আর তার ব্লাউজ ছিঁড়ে ফর্সা পিঠ দেখা যাচ্ছে। সেই পিঠ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাচ্ছে নীলাঞ্জনা।
তা্রপরই, ফেটে যাওয়া পিঠের দু'দিক থেকে ফড় ফড় করে, ঈগল পাখির ডানার মতো দুটো বিশাল ডানা বেরিয়ে এলো!
যন্ত্রনা ভুলে উল্লাসে, পরনের শাড়ি খুলে ফেলে দিলো নীলাঞ্জনা। তারপর বিস্মিত অনিকের চোখের সামনে, পত্ পত্ করে, বিশাল দুটো ডানা ঝাঁপটে, উড়াল দিলো জোছনা আলোকিত আকাশে! হারিয়ে গেলো কোন সুদূরে!
-----------------------------------------------------------------------
রতন চক্রবর্তী
বিবেকানন্দ রোড
চাঁপাডালি মোড়
বারাসাত, কোলকাতা-৭০০১২৪।