স্টেশন ছাড়িয়ে বেশ কিছুটা গেলেই শীতলপুর গ্রাম। নামের সঙ্গে সাযুজ্য আছে গ্রামের - - - - - গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা এই গ্রামে পা রাখলেই শীতল হয়ে যায় শরীর মন-----টের পাওয়া যায় না বাইরের উষ্ণতার। গ্রামটিতে বামুন, কায়েতের পাশাপাশি নিম্ন বর্ণের হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন আপন আপন ধর্মকে বুকে জড়িয়ে সুখে দুঃখে কালযাপন করছে।
এই গ্রামের শেষ প্রান্তে মসজিদের পাশে ছোট্ট শাকিব চাঁচের বেড়া দেওয়া একচিলতে ঘরে আব্বু - আম্মার সাথে খেলাধূলা নিয়ে বেশ আনন্দেই থাকে। আমাদের আজকের গল্প এই শাকিবকে নিয়েই। শাকিব গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস থ্রি তে পড়ে। দুষ্টুমিতে ভরা ছোট্ট মাথাটায় পড়াশোনা ধরার জায়গাটাই নেই। নিত্য নতুন দুষ্টুমিতে পাড়ার সবাই তো বটেই - - - - স্কুলের মাস্টারমশাই রাও তটস্থ হয়ে থাকে। কারোর গাছের ফল চুরি করাই হোক বা কারোর অবলা জীবজন্ত্তর পিঠে কালো মোটা পিঁপড়ে ছেড়ে দিতে সিদ্ধহস্ত আমাদের শাকিব। এই তো সেদিন এক বুক জলে নেমে বল কুড়োনোর জন্য কি মারটাই না খেল অঙ্কের মাস্টারমশাইয়ের কাছে। প্রায় প্রত্যেকদিন স্কুলে তো বটেই পাড়ার লোকের কাছেও মারধর! গালাগালি খেলেও কোনো হেলদোল নেই ছেলেটার। আর তাছাড়া সারাদিনের পরিশ্রমের পর ক্লান্ত শরীরে পাড়ার লোকের কাছে অভিযোগ শুনে আব্বুর হাতের মার তো আছেই।
একমাত্র ওর আম্মুই ওকে একটু কোলে বসিয়ে আদর করে - - - - ভাত মেখে খাইয়ে দেয়। শত দুষ্টুমিতেও আম্মু কিচ্ছু বলে না। আব্বুজান এই নিয়ে আম্মিকে বকলে আম্মি বলে"বাছাকে আমার সকলেই বকে। আপনেও রোজ মারধোর করেন। আমি না ভালবাসলে একরত্তি ছেলেটা কার বুকে ঠাঁই নেবে কয়েন তো?"
"তোমার ওই একরত্তি ছেলের মগজে যে দুষ্টুমি গজগজ করছে। পাড়ার মানুষগুলো ওর ল্যেগে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। তা শাকিবের আম্মু----তুমার কী জানা আছে---কাল তুমার পোলা কী কাণ্ড ঘটাইছে? "
ঘোমটায় ঢাকা মাথা নেড়ে না বলতেই শাকিবের আব্বু এনামুল মিঞা রাগত স্বরে বলল"কাল তুমার পোলা মৌলবী সাহেবের গাছের ডাল ভেঙে সব আম পেড়ে নিছে। মৌলবী সাহেব ভালো মানুষ বলে উয়ারে কিছু কন নাই তাবলে পাড়ার লোকে আর ছেড়ে দেবে না বিবিজান! "
স্বামীর কথায় মাথার ঘোমটা সরিয়ে রাগত স্বরে বলল"সবসময় আমার পোলা কন-----উ কী আপনের কেউ নয়? আর তাছাড়া, ছেলেমানুষ দুটো আম পেড়েছে বই তো আর কিছু নয়। উয়ার ল্যেগে এত রাগ করার কি আছে পাড়ার লোকের? "
শাকিবের আম্মুর কথায় এনামুল মিঞা হেসে বলল" তা আমার শাকিব কোথায় বিবিজান? শাকিব----শাকিব"
শাকিবের আম্মু শাকিবকে ডাকতে গিয়ে দেখল আব্বুর টোটোয় কয়েকটা বন্ধুকে চাপিয়ে টোটো চালাচ্ছে ছেলে। ছেলের খেলা দেখে আনন্দে হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকে স্বামীকে তিনওয়াক্ত নামাজ পড়তে দেখে স্বামীকে বিরক্ত না করে রোজার নামাজ পড়তে পাশের ঘরে চলে গেল মীনা।
বাবা মাকে নামাজ পড়তে দেখে এঘর ওঘর আতিপাতি করে কিছু একটা খুঁজে না পেয়ে করুণ চোখে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ইস্কুলে চলে গেল।
টিফিনের ঘণ্টা বাজতেই আজ আর অন্য কোথাও না গিয়ে সোজা ক্লাসরুমে ঢুকে স্যারের চেয়ারের পাশে চুপটি করে বসে পড়ল ও।
"কীরে শাকিব আজ এত ভালো ছেলে হলি কি করে? কোথাও খুঁজতে যেতে হলো না।"
"শাকিবের মনখারাপ স্যার"
"কেন রে?কী হয়েছে শাকিব?"
শাকিবকে উত্তর না দিয়ে মুখ নামিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্নেহ ভরে ইংরেজির মাস্টারমশাই ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই মুখ নামিয়ে দুরন্ত ছেলেটা করুণ স্বরে বলল" আব্বু আজও আমার জামা আনে নাই স্যার"
শাকিবের কথায় ওর বন্ধুরা হেসে উঠে ওকে দুয়ো দিতেই একধমকে ছেলেদের চুপ করিয়ে দিয়ে মাস্টারমশাই বললেন "এতে মনখারাপের কি আছে! ঈদের তো দেরী আছে রে বোকা - - - - তার মধ্যে তোর আব্বু ঠিকই কিনে আনবে।"
স্যারের কথায় শাকিবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল আর ও স্যারের পড়া না শুনে নিজের দুনিয়ায় মত্ত হয়ে গেল।
ওদিকে বাড়িতে নামাজের শেষে মীনা বেগম এনামুল মিঞাকে বলল"শাকিব আজও ঘরে খুঁজছিল।ইস্কুল থেকে ফিরেই জানতে চাইবে।। কী জবাব দেব শাকিবের?
"কি করব বেগম----এখন ট্রেন বন্ধ - - - - প্যাসেঞ্জার নেই। রোজ ধুয়ে মুছে টোটোটা ফাঁকা নিয়ে গিয়ে সারাদিন গাছের ছায়ায় বসেই থাকি।সারা দিনমানে একটা লোকও ওঠে না টোটোয়। তুমার শাড়িটা ছিঁড়ে গেছে - - - - ঘরে পড়ার শাড়ি, শাকিবের একখান জামা কেনার পয়সাটাও হাতে আসেনি। কী যে করি!
স্বামীর পিঠে হাত রেখে মীনা বলল "আপনে এত ভাববেন না। উপোসী শরীরে এত ভাবলে শরীর সাথ দেবেনা। কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন। আর আমার শাড়ির দরকার নেই - - - - শুধু আমার শাকিবের হলেই হবে।"
স্ত্রীর কথায় উত্তর না দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুপুরের রোদ মাথায় নিয়ে টোটোটা চালিয়ে একবুক আশা নিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা দিল এনামুল মিঞা।
বেশ কয়েকদিন পর ঈদের একদিন আগে ইস্কুলের ছুটি শেষে হেডমাস্টারমশাই শাকিবকে ডেকে বললেন" আমাকে একবার তোদের বাড়ি নিয়ে যাবি শাকিব?"
মাস্টারমশাই ওদের বাড়ি যাবে শুনে কোনকিছু না ভেবে মাস্টারমশাইকে সাথে নিয়ে ওদের বাড়িতে এসে মাকে ডেকে নিয়ে আসতেই হেডমাস্টারমশাই বললেন "শাকিবের বাবা বাড়িতে নেই?"
এক মাথা ঘোমটা টেনে ছেঁড়া আঁচলে কোনওরকমে গা টা ঢেকে মীনা বলল" না সার---শাকিবের বাবা টোটো নিয়ে বেরিয়েছে।"
"এটা রাখুন"
"কি আছে সার এতে?"
"এর মধ্যে শাকিবের জন্যে একটা জামাপ্যাণ্ট আছে। এটা আমি ওকে দিলাম"
মীনার বুঝতে অসুবিধে হলো না কোনকিছুই। চোখ দুটো মাস্টারমশাইয়ের প্রতি অসীম শ্রদ্ধায় জলে ভরে আসছিল। এমন সময় বাইরে থেকে এনামুল মিঞার গলার আওয়াজ শোনা গেল" শাকিব - - - বাপজান - - - কোথায় তুই? দেখ তোর জন্যে কি এনেছি? "বলতে বলতে শাকিবের জন্য কেনা নতুন জামাটা বের করে বাড়িতে ঢুকে মাস্টারমশাইকে দেখে লজ্জায় থমকে দাঁড়িয়ে পরতেই শাকিবের আম্মু বলে উঠল "দেখেন না, সার শাকিবের ল্যেগে একটা নতুন জামা এনেছেন।
শাকিবের আব্বু বিস্ময়ে মাস্টারমশাইয়ের দিকে, বৃদ্ধ মাস্টারমশাই বলে উঠলেন" আমি সব জানি - - - - শাকিব আমায় সবটা বলেছে----আমরা না বুঝলেও ছোটরা অনেক কিছু বোঝে যা আমরা জানতেও পারি না। "এরপর শাকিবের দিকে ঘুরে বললেন "ভালোই হল শাকিব - - - - একটার বদলে তোর দুটো জামা হয়ে গেল - - - - আর তো মনখারাপ নেই।"
"না স্যার - - - - তবে আমি একটা কথা ভাবছিলাম।
"কি কথা"
"আম্মু - - - আমি কী আব্বুর দেওয়া জামাটা নিয়ামৎকে দেব?"
সকলে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালে শাকিব বলল" স্যার, নিয়ামতের আব্বু নেই----আম্মি কথাই বলতে পারে না-----ওকে জামা কিনে দেওয়ার ও কেউ নেই। আমার তো দুটো জামা হয়েছে - - - - - একটা জামা কী ওকে দেব? "
শাকিবের কথায় ছলছল চোখে এনামুল মীনা ওর দিকে তাকিয়ে রইল আর মাস্টারমশাই স্থান কাল ভুলে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ছোট্ট ছাত্রটিকে।
----------------------------------------------------------