আমি আবীর রায়, ব্যাঙ্কে চাকরী পেয়েছি সদ্য। ভালবাসি স্বাতীকে, কিছুদিনের মধ্যেই ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে আমাদের ভালবাসার কথা জানাবো, বিয়ের কথা তুলব। এতদিন চাকরী ছিল না বলে সাহস হয়নি ওর বাড়িতে যাবার, বিয়ের কথা তোলার। আজ আর সে সমস্যা নেই, শীঘ্রই একদিন সুযোগ করে যাবো। যাবো যাবো করে দিন কাটে, মনে মনে প্রস্তুতি নিই, কিছুতেই যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। কি জানি বিয়ের ফুল ফোটেনি বোধহয় এখনও। কিন্তু একি, সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে গেল এর মধ্যে। ভুল, বড় ভুল করে ফেলেছি আমি। স্বাতীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারছি না। এ মুখ আমি কি করে দেখাব স্বাতীকে, তার দিকে চোখ তুলে তাকাব কেমন করে? দীর্ঘ পাঁচবছর মেলামেশা করেও এতটুকু চিনলাম না স্বাতীকে? এতটুকু বিশ্বাস নেই আমার নিজের ভালবাসার ওপর? ইচ্ছে করছে ছুট্টে গিয়ে স্বাতীর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিই কিন্তু পরক্ষণেই পা দুটো কে যেন টেনে ধরছে আমার। স্বাতী কি ক্ষমা করবে আমাকে? কত উল্টোপাল্টা মেসেজ করেছি স্বাতীকে আমি, কত ছোট করেছি, যদিও স্বাতী এসবের কোনো রিপ্লাই দেয়নি।
এতদিনের মেলামেশায় কত মধুর স্মৃতি, কত ঘনিষ্ঠতা, কত স্বপ্ন, দু'জনের বিয়ে হবে, সুখের সংসার, শুধু সময়ের অপেক্ষা। অথচ গত দু'মাস যাবৎ স্বাতী যেন আমাকে এড়িয়ে চলছিল, অন্তত আমার তো তেমনই মনে হচ্ছিল। বারবার দেখা করতে চেয়ে ফোন করলে নানারকম অজুহাতে স্বাতী এড়িয়ে যাচ্ছিল, যেটা বেশ ভালই বুঝতে পারছিলাম কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর এতে আরও অস্থির লাগছিল। নিজের মনকেই বোঝাচ্ছিলাম এ আমারই ভুল, হয়তো কোনো সমস্যা আছে, আবার অভিমানও হচ্ছিল, আমাকে কিছু না জানানোর জন্য। আসলে স্বাতীকে কাছে না পেয়ে আমার মনটা বেশ ভাল লাগছিল না ইদানীং, তাই হাজার রকম আজেবাজে চিন্তা মাথায় ভিড় করছিল খালি। কেমন যেন বৈচিত্র্যহীন গতানুগতিক মনে হচ্ছিল জীবনটা। কারো সঙ্গে শেয়ার করতেও পারছিলাম না একথা।
এইতো দু'মাস আগে পুজো হয়ে গেল, দু'জনে একসঙ্গে ঠাকুর দেখলাম, কত আনন্দ করলাম, ফুচকা খাওয়া, ঝালমুড়ি খাওয়া, কখনো বা রেস্টুরেন্ট, স্বাতীর বায়নাক্কার শেষ নেই। দু'বেলা আমরা ঘুরেছি, পুজোয় মজা লুটেছি। ভিড়ের মধ্যে স্বাতীকে অভিভাবকের মত আগলে নিয়ে বেড়িয়েছি হাত ধরে। তবে হল কি! মনের মধ্যে এসব ঘুরতে ঘুরতে সেদিন সন্ধ্যায় আমি স্বাতীকে বার-সিঙ্গার ইলিয়াসের সাথে দেখতে পাই। মনের মধ্যে ঝড় বয়ে যেতে লাগল, ও তবে এই ব্যাপার! নতুন প্রেম! বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আমার স্বাতীকে হারানোর যন্ত্রণায়। স্বাতী অবশ্য আমাকে দেখেনি।
জানতাম না স্বাতী তখন ছিল এক সঙ্কটময় অবস্থায়। এতদিন পর সমরকে খুঁজে পেয়ে আর ওকে হারাতে চায়নি সে। খবরটা ওকে দিয়েছিল ঋতু, স্বাতীর ছোটবেলার বন্ধু, সবই জানে ওদের বাড়ীর কথা। পিঠোপিঠি দুই ভাইবোন স্বাতী ও সমর,স্বাতী বড়। ছোট থেকেই স্বাতী পড়াশুনোয় খুব ভাল আর সমরের মোটে আগ্রহ ছিল না পড়াশুনোয়, গানে ওর খুব আগ্রহ। ভাল গান শুনলে চোখ বুজে বুঁদ হয়ে যেত সে। বাবা গানবাজনার ভীষণ বিরোধী ছিলেন, শুনতেন না যে তা নয় কিন্তু পড়াশুনোর ক্ষতি করে ছেলেমেয়েরা গান শিখবে এ তাঁর মনঃপুত নয়। তাই সমর একটু বড় হয়ে যখন গান শিখতে চাইল, বাবা তাকে এমন মার মেরেছিলেন যে সমর বাড়ী থেকে সেই যে পালিয়ে গেল আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওর তখন বয়স ১৫ আর স্বাতীর ১৭, বয়ঃসন্ধিক্ষণে অভিমানটা এমনিতেই বেশি হয় আর গানের প্রতি ওর ছিল তীব্র অনুরাগ যেটা বাবা মানতে পারেননি তাই অভিমানে সে আর ফিরল না। মা কেঁদে কেঁদে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, আজও তিনি মনমরা, ডিপ্রেশনের রুগী, বাবাও অবশ্য অনুতপ্ত আর পিঠোপিঠি ভাই, স্বাতী তাকে ক্ষণেক্ষণে হারাত। তাই দু'মাস আগে ঋতুর কাছে শুনে, যদিও ঋতু একটু কনফিউশনে ছিল, এতগুলো বছর না দেখা, ভুল তো হতেই পারে, স্বাতী একটুও দেরী করেনি, ছুটেছে ইলিয়াসের কাছে। কত লম্বা হয়েছে, সাজগোজের ধরনধারণও অন্যরকম তবু বাঁদিকের কানের নিচের কালো জড়ুল, ওর জন্মদাগ, আর কোনো প্রশ্নচিহ্ন রাখেনি। ইলিয়াসও দিদিকে চিনতে পেরেছে কিন্তু অভিমান সে আজও ভোলেনি। সে অভিমান ভাঙ্গানোর দায়িত্ব নিয়ে স্বাতী একটু একটু করে ওকে ছন্দে ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে একটু বুঝি সফল হয়েছে। এরপর স্বাতী শুনেছে সমরের ইলিয়াস হয়ে ওঠার গল্প।
বাবার মার খেয়ে প্রচণ্ড অভিমানে বাড়ী থেকে বেরিয়ে সমর ছুটেই চলেছে, কেউ যাতে তাকে ধরতে না পারে। রাগে, দুঃখে, অভিমানে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে সে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয় হয়, কোথায় পৌঁছেছে সে নিজেও জানে না। ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে একটা গাছের নীচে বসেছে, ক্ষিদে তেষ্টায় কাতর, দরদর করে ঘাম পড়ছে মাথা মুখ বেয়ে। পড়ন্ত বিকেলে গাছের শীতল হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়েছে, অন্ধকার হয় হয়, এমন সময় এক ফকির এসে ওর মাথায় হাত রাখেন। চোখ চেয়ে সমর দেখে অন্ধকার হয়ে গেছে, ভয় ভয় করছে ওর, এত অন্ধকার আগে দেখেনি কখনও। রাগের চোটে চলে তো এল, এখন যাবে কোথায়? ফকিরবাবা কিছু আন্দাজ করেছেন, ওকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে একটা ছোট মিষ্টির দোকানে কচুরী, মিষ্টি খাইয়ে চাঙ্গা করে জানতে চাইলেন, "বাড়ী কোথায়?" সমর চুপ, আবার জিজ্ঞেস করায় জানায়, "আমি আর বাড়ী ফিরব না, বাড়ীর কথা বললে চলে যাব"। এরপর ফকিরবাবা আর জানতে চাননি কিছু, আদর করে নিজের ডেরায় নিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের সন্তানের মত আদরে-যত্নে বড় করেছেন, ভালবেসে নাম দিয়েছেন ইলিয়াস, বাবা-মার দেওয়া নাম আজ সমর ভুলেই গেছে।
ডেরায় অনেক বাউল আসত, গানবাজনা হত, সে এক জমজমাট ব্যাপার। সমরের খুব ভাল লাগত, গানের গলাটাও ওর চমৎকার কিন্তু বরাবরই ঝোঁক ছিল আধুনিক, হিন্দী, ইংলিশ গান এসবের প্রতি, যদিও এদের কাছে বাউল গানও সে খুব ভালই শিখে ফেলেছে, এমনকি বিভিন্ন জায়গায় এই বাউলদের সঙ্গে গান গেয়েও বেড়িয়েছে সে। এরকমই এক অনুষ্ঠানে ওর গানের মধুর গলা শুনে এক সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ওকে গান শেখাতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ফকিরবাবা জানতেন ওর পছন্দের গানের কথা আর এও ভাবলেন, নানারকম গান শিক্ষার এমন সুযোগ যখন যেচে এল, ছেলেটা শিখুক, সবরকম শিক্ষা ওর হোক, তাই সানন্দে তিনি রাজী হয়ে গেলেন। সেখানে সমর গুরুগৃহে থেকে বিভিন্নরকম গান শেখে, যদিও ভাগ্য তার প্রতি অপ্রসন্ন, নাহলে আজ তার জীবনটা অন্যধারায় বইত। বেশ নানারকম গান শিখতে লাগল সমর, এগোতেও লাগল বেশ তাড়াতাড়ি, গুরুজীও খুশী এমন ছাত্র পেয়ে কিন্তু সইল না সমরের। এর কিছুদিনের মধ্যেই গুরুজী মারা গেলেন অকস্মাৎ। ফিরে এল সমর ডেরায়, কিন্তু ফকিরবাবাও আর বেশীদিন বাঁচেননি। এরপর সমরের আর মন টেঁকেনি ওখানে, ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়ে সে। শেষে এই বার-সিঙ্গারের চাকরী। এ তার পছন্দ নয় মোটে, কেবল পেট চালানোর জন্য। মনে আক্ষেপ, বাবা যদি ভাল জায়গায় গান শেখাতেন, সে আজ সঙ্গীত জগতে একটা জায়গা দখল করতে পারত। স্বাতী ভাইকে কথা দিয়েছে, "তোকে ভাল জায়গায় গান শেখাবো, আবার নতুন করে তোর জীবন আমি গড়ে দেবো। তোর দিদি এখন চাকরী করে, এটুকু তার ভাইয়ের জন্য সে করতে পারবে"।
একটু একটু করে স্বাতী সব জেনেছে। এও জেনেছে তার ভাই মুসলিম ধর্মে দীক্ষিত আর ধর্মত্যাগ সে করবে না। স্বাতীর এখন একটাই চিন্তা এই মুসলিম ভাইকে কি করে নিয়ে গিয়ে সে ব্রাহ্মণ বাড়ীতে প্রতিষ্ঠা করবে? বাবা কি মানবেন? যদি মানাতে পারে সে তবে তাদের পরিবারে যে আনন্দধারা বইবে, সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। আর এখন তার এই একটাই চিন্তা, অন্য কিছু ভাবার সময় এখন তার নেই।
স্বাতীর সঙ্গে কোনোভাবে যোগাযোগ করতে না পেরে ওর প্রিয়বন্ধু ঋতুর সঙ্গে যোগাযোগ করি, আর ওর কাছেই সব জানতে পারি। নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে আজ। স্বাতী ক্ষমা করবে তো আমায়?
-------------------------
মানসী গাঙ্গুলী
রায়বাগান,পোঃ বুড়োশিবতলা
চুঁচুড়া,জেলা-হুগলী
পশ্চিমবঙ্গ