অনিন্দ্য পাল
প্রাণকৃষ্ণ হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে কোন রকমে নিজেকে সামলে নিলেন। রেললাইনটা পেরিয়ে পিছন ফিরে সিগন্যাল দেখতে গিয়েই এই বিপত্তি।
সাতসকালে প্লাটফর্ম-এর থেকে বেশ দূরে এই খানে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। লাইনটা সন্তপর্ণে পেরিয়ে একবার ডিসট্যান্স সিগন্যালটা দেখে নিলেন প্রাণকৃষ্ণ। সবুজ হয়ে গেছে। তাহলে সাতটা সতেরোর ডাউন ক্যানিং লোকাল এখুনি এসে পড়বে। তারপর যা হবার ...।
হুস্ করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল প্রাণকৃষ্ণের বুকের ভিতর থেকে। নাহ্ কোন দুঃখ নেই, নিজের এই সিদ্ধান্তে কোন রকম আফসোস ও নেই প্রাণকৃষ্ণের। শুধু বারবার বিট্টুর মুখটা মনে পড়ছে, বড্ড ন্যাওটা নাতিটা। আর একটা কারণে একটু কষ্ট হচ্ছে, পল্লবীকে একটা স্কুল-ব্যাগ কিনে দেবেন বলেছিলেন, সেটা আর হল না। ওর ছ-বছরের মেয়েটা এবছর এফপি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছে। ক-বাড়ি বাসন মেজে যা পায়, তাতে সংসারটাই চলে না, আবার পড়াশুনার খরচ!
নাহ্, এসব এখন ভাববেন না প্রাণকৃষ্ণ। তাহলে মাথাটা আবার গরম হয়ে যাবে, তাতে সিদ্ধান্তটা বদলে যেতে পারে, আর প্রাণকৃষ্ণ মনে প্রাণে সেটা চান না। আজ হয় এসপার নতুবা ওসপার! একটা রসগোল্লা খেতে চাওয়ার জন্য এরকম মুখ-ঝামটা? স্ত্রী, ছেলে, বৌমা এমনকি ওই যে তিন বছরের ন্যাংটা-পুটো বিট্টু, সেও কিনা বলে, " দাদা, তুমি মিট্টি খেলে তোমার সঙ্গে কতা বলবো না " -- ভাবা যায়? ডায়াবেটিস কি আর হয় না কারও? ওই তো বিপুলের আজ তিরিশ বছর ধরে সুগার, সে তো বলে, মিষ্টি একটা আধটা খাওয়াই যায়। তাছাড়া বাসু ডাক্তার তো বলেইছে যে মাঝে মধ্যে এক আধটা মিষ্টি খেতে পারেন, কিন্তু শারিরীক পরিশ্রম করে ক্যালোরি নষ্ট করতে হবে। তাহলে?
একবার উঁকি দিয়ে দেখলেন প্রাণকৃষ্ণ। সিগন্যাল সবুজ হয়ে থাকলেও ট্রেনের দেখা নেই। বিরক্তিকর! এদেশে কিছুই সময়ে হয় না! সারা জীবন অত্যন্ত নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলা প্রাণকৃষ্ণ এগুলো একেবারেই মেনে নিতে পারেননি।
একবার চারদিকটা ভালো করে দেখে নিলেন প্রাণকৃষ্ণ। লাইনের পাশের যেখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রাণকৃষ্ণ সেখান থেকে লাইন বরাবর খানিকটা হেঁটে গেলেই লেভেল ক্রসিং। হঠাৎ সেদিক থেকে একটা হৈ-হল্লার আওয়াজ পেয়ে উৎসুক হয়ে তাকালেন সেদিকে। কয়েক সেকেন্ড পর যা দেখলেন, তাতে চমকে ওঠাটাই স্বাভাবিক প্রাণকৃষ্ণের। লাইনের পাশের সরু রাস্তাটা ধরে একদল মানুষ হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছে, এদিকেই! আঁতকে উঠলেন, প্রাণকৃষ্ণ। ওরা কি তার পাড়ার লোক? জানতে পারলো? কিন্তু কেমন করে? কাকপক্ষীর ও তো জানার কথা নয়! তিনি তো বাজারে যাওয়ার নাম করেই বেরিয়েছেন। মাত্র আধা-ঘন্টা হয়েছে তিনি এসেছেন। ঘন্টা দেড়েকের আগে তিনি যে বাড়ি ঢুকবেন না, সেটাই স্বাভাবিক, তাহলে? হঠাৎ প্রাণকৃষ্ণের মনে হল, এ নিশ্চয়ই ওই ব্যাটা দুধকুমারের কাজ। এদিকে আসার সময় ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, ঘুরে ঘুরে মাছ বেচে, হয়তো ওই গিয়ে খবরটা দিয়েছে! কি মুশকিল যে হল না?
কি করবেন না করবেন ভাবতে ভাবতেই লোকগুলো চলে এল একেবারে গায়ের কাছে। হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা চেনা গলা বেশ চেঁচিয়ে উঠলো,
-- আরে, মাস্টার মশাই আপনি?
এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়ালো যে, সে জনা, মানে জনার্দন, প্রাণকৃষ্ণের অনেক পুরোনো ছাত্র। দশ বছর হল প্রাণকৃষ্ণ প্রাথমিক স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। এখনও অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা মনে রেখেছে।
-- আপনিও যাচ্ছেন দেখতে? চলুন তবে একসঙ্গে যাওয়া যাক।
প্রাণকৃষ্ণকে কিছু বলতে না দিয়েই আবার বলে জনা,
-- কি অবস্থা বলুন তো? মাত্র চৌত্রিশ বছর বয়স। দু'টো বাচ্চা! কি যে হবে সংসারটার?
কিছু বুঝতে না পেরে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন প্রাণকৃষ্ণ। তখনি ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন বেশ কাঁচা খিস্তি দিয়ে বললো,
-- নিজেতো সুইসাইড করে মরলো, সঙ্গে বৌ-বাচ্চাদের সব্বোনাশ করে গেল আর আমাদের আজকের অফিসটাও মাটি করে দিয়ে গেল!
-- আমার বৌ এর আজ নটায় অপারেশন, হাসপাতালে আটটায় ঢোকার কথা! এখন ট্রেন বন্ধ! কারা নাকি আবার এই কারণে অবরোধ করেছে? এই হারামজাদার সুইসাইড কেসে সব গন্ডগোল হয়ে গেল। এদের না ধরে চাবকাতে হয় একদম।
আর একজন কেউ বলে উঠলো কথাগুলো।
ততক্ষণে ভিড়টা আবার এগিয়ে চলেছে, যেখানে চৌত্রিশ বছর বয়সি কেউ একটা কোন অজানা কারণে ট্রেনের চাকায় আত্মহত্যা করেছে।
প্রাণকৃষ্ণের বুকের ভিতর একটা ভূমিকম্প হচ্ছে।
ট্রেনটা ঠিক সময়ে এলে এই কথাগুলো হয়তো তাঁর মৃতদেহটাকেই শুনতে হত! ছিঃ!
প্রাণকৃষ্ণ একবার মুখ বাড়িয়ে দেখলেন সিগন্যালটা তখনও গ্রীন! মাথাটা একটু নীচু করে নিয়ে আবার বাজারের দিকে হাঁটতে লাগলেন।
==============================