বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

গল্প ।। সেই বাড়ির অন্দরের কথা ।। অঞ্জনা মজুমদার


  

সেই বাড়ির অন্দরের কথা 

 অঞ্জনা মজুমদার 


প্রথম স্কুলে চাকরি পেয়েছে সুমনা, কিন্তু স্কুলটা রাঙাপোতা গ্রামে  কলকাতা থেকে এতটাই দূরে যে রোজ বাড়ি থেকে যাতায়াত করা যায় না। স্কুলের বড়দি বললেন, স্কুলে চাকরিটা রাখতে গেলে তো এখানেই কোথাও থাকতে হবে। সুমনা চুপ করে আছে দেখে পাশ থেকে মিনু, বড়দির ছায়াসঙ্গী বলল, একটা বাড়ি আছে কিন্তু তুমি কি সেখানে থাকতে পারবে নতুন দিদি? বিনতা কাকিমা বড্ড কড়া মানুষ। ও বাড়িতে কোনও ভাড়াটে টিকতে পারে না।
সুমনা বলল, আমি ঠিক থাকতে পারবো মিনুদিদি, ঠিক মানিয়ে নেব। তুমি ওই বাড়িটাই ঠিক করে দাও আমার জন্য। 
মিনুর সাথে সুমনা কাকিমার সাথে দেখা করে থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে এল। ব্যবস্থা ভালই। ঘর টয়লেট পাশাপাশি, একটা ছোট্ট রান্নাঘর, বারান্দাও আছে।  তবে কাকিমা হুঁশিয়ারি দিলেন, রাত বিরেতে তুমি একা মেয়ে বাড়ির বাইরে বেরোবে না। আর আমার বাড়ির এ ঘর সে ঘর উঁকি ঝুঁকি দেবে না। 
সুমনা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। পরদিন থেকে সোম থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রাঙাপোতার বিনতা কাকিমার বাড়িতে থেকে শনিবার স্কুল করে কলকাতা ফিরে আসে। কাকিমা কাকু খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ, পুজো-আচ্চা নিয়ে থাকেন। প্রসাদ দেওয়া নেওয়া ছাড়া আর কোনও সম্পর্ক নেই সুমনার সঙ্গে। ভালোই কাটছে সুমনার।
আজ মঙ্গলবার, সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে পাওয়ার কাট হয়ে গেল। আকাশে ঘন কালো মেঘ করেছে। রাঙাপোতায় এসে সুমনা দেখেছে এখানে মেঘ করলেই বিদ্যুতের আলো থাকে না। গত সপ্তাহে একটা এমারজেন্সি লাইট কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছে সুমনা। সেটা জ্বালিয়ে একটু পরেই অফ হয়ে গেল। সুমনার মনে পড়ল, কালও বহুক্ষণ কারেন্ট ছিল না। সকালে চার্জ দিতে ভুলে গেছে। কি করা যাবে হাতের কাছে মোবাইলটা রেখে বারান্দায় এসে বসল সুমনা। 
অলস চোখে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। এ সময় কলকাতার কথা ভেবে বড্ড মন কেমন করে। অন্ধকারে চেয়ে চেয়ে বাড়ির পেছনের দিকের একটা ঘরে আলোর নড়াচড়া নজর কাড়ল সুমনার। বেশ কয়েকটি মাথা দ্রুত নড়াচড়া করছে। হঠাৎই একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। প্রবল ঝটাপটির আওয়াজ। তারপরই সব নিস্তব্ধ। 
অবাক হল সুমনা এমন আর্তনাদে কাকিমা বা কাকু কেউ বাইরে বেরিয়ে এলেন না। তারপরই কারেন্ট  চলে এল। এখন সবকিছু স্বাভাবিক। 
সুমনা ডাকল, কাকিমা, কাকু আপনারা কোনও চিৎকার শুনেছেন? 
কাকিমা অবাক হলেন, কই না তো!  কিসের চিৎকার?  
একটা আলো ছিল,  কিছু লোকের ছায়া আর চিৎকার। মনে হচ্ছিল কাউকে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। 
কাকু বললেন, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?  স্বপ্ন দেখেছ। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার না কাল স্কুল আছে ? 
সুমনা চুপ করে গেল। কাকু কাকিমা কিছু কি আড়াল করতে চাইছেন?  মনে দ্বিধা আর একটা কিছু সন্দেহ নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে সুমনা শুয়ে পড়ল। 
আজ ঘুম আসছে না। চোখ বন্ধ করেও সেই আর্তনাদ কানে ভেসে আসছে সুমনার। ঘরের আলো নেভানো। কিন্তু চোখ বারবার চলে যেতে চাইছে ওই ঘরের দিকে। এমন সময় তিন্নি দিদির ফোন। 
তিন্নি সুমনার মাসতুতো দিদি। লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে বছর পাঁচেক কাজ করছে। সুমনার থেকে দুই বছরের বড় হলেও দুজন খুব ভালো বন্ধু। 
ফোন ধরেই  সুমনা, জানো তিন্নি দিদি আজ কি হয়েছে? 
কি রে, কি হয়েছে সুমি?  তারপর দুই বোনের কথপোকথন থেকে সন্ধ্যার রহস্য জনক আলোর কথা তিন্নির সব জানা হয়ে গেল। 
শোন শোন সুমি, আর কদিন নজর রাখ। আমি ঠিক সময়ে আসছি।
তুমি আসবে?  পুলিশ নিয়ে ? 
আমি আসবো তোর দিদি হয়ে। চিন্তা করিস না। 
সুমনা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু রাতেও ঘুমের মধ্যে আর একবার সেই একই আর্তনাদ শুনতে পেল সুমনা। আবার ঘুমিয়ে পড়ল। 
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে সুমনা অবাক!  তিন্নি দিদি এসেছে। কাকিমার সঙ্গে গল্প করছে। বলে কি?  তার নাকি বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তাই বিয়ের আগে কদিন সুমনার সঙ্গে গ্রামে কাটাতে এসেছে। 
ঘরে ঢুকে সুমনা বলল, তোর আবার নতুন করে বিয়ে হবে কি?  বলবো বিমানদাকে?  তোমার বউ আবার বিয়ে করবে বলছে।
তিন্নি মুচকি হেসে বললে, ওই বলেই তো গল্প জমিয়ে গোটা বাড়ি ঘুরে দেখলাম। 
তোকে বাড়ি দেখালেন কাকিমা ?  আমি তো কোনও দিন বাড়িটা ঘুরে দেখার অনুমতি পাইনি। 
তিন্নি গম্ভীর হয়ে গেল। তোর কথাই ঠিক মনে হয়। কিছু একটা সমস্যা আছে ওই পেছনের ঘরে। বন্ধ দরজার পেছনে একটা সন্দেহজনক আওয়াজ শুনেছি। কাকিমা বললেন ও ঘরে কাকুর ব্যবসার জিনিস থাকে। চাবিও কাকুর কাছেই থাকে। আজ রাতে নজর রাখতে হবে। 
সন্ধ্যা বেলায় কাকু কাকিমা দু'জনে এলেন প্রসাদ দিতে। 
প্রসাদী সন্দেশ নিয়ে তিন্নি দিদি মাথায় ঠেকিয়ে বললে, রাতে খাবার পরে এই মিষ্টি খেয়ে মিষ্টিমুখ করবো। 
কাকু যেন নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরে ফিরলেন। 
ওরা চলে যেতেই তিন্নি দিদি সন্দেশটা বাটিতে ঢাকা দিয়ে রেখে বলল, চল্ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিই। রাতে কাজ আছে। 
সুমনা বলল, বুঝতে পারছি তোর কিছু প্ল্যান আছে। আমাকে বলবি না? 
তিন্নি মুচকি হেসে বলল, আগে খেয়ে নিই। 
দু'জন খেয়ে নিল রাতে রুটি আর ডিমের কারি।
তারপর দুই বোন পাশাপাশি শুয়ে পড়তেই তিন্নি ফিসফিস করে বলল, আজ ঘুম নয়। পাহারা দিতে হবে। সার্ভিস রিভলবার মাথার বালিশের নিচে রাখল।
সুমনা বুঝতে পারল আজ রাতে তিন্নি দিদির বিখ্যাত অ্যাকশন হবে। আগে গল্প শুনেছে, আজ দেখবে নিজে চোখে। 
রাত তখন সাড়ে বারোটা। বাইরে কিছু মানুষের চলাফেরার ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
তিন্নি দিদি ফোনে কাকে যেন কি নির্দেশ দিয়ে বিছানায় উঠে বসেছে। 
তিন্নি দিদির কথায় দুই বোন কালো পোশাক পরেছে। পা টিপে টিপে দুজনে বারান্দায়। ঘরের দরজায় ছিটকানি দেওয়া ছিল না। নিঃশব্দে দরজা খুলে তিন্নি সামনে, সুমনা পেছনে। তিন্নির হাতে রিভলবার আর সুমনা দরজার খিলটা হাতে।
পেছনের যে ঘরে আলো জ্বলছে সেখানে গিয়ে দেখে দুজন লোক। চারটে মেয়েকে হাত পা বেঁধে মেঝেতে ফেলে রেখেছে। ঘরে আর একজন, গলা শুনে কাকুকে চিনতে পারল সুমনা।
আজই এদের নিয়ে চলে যাও। স্কুলের দিদিমণি সন্দেহ করেছে।
একটি লোক বলল, দিদিমণি আবার চলে আসবে না তো?  আজ আবার আর একটা দিদি এসেছে ওর কাছে।
না না আমি প্রসাদে খুব করে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছি। সকালের আগে ঘুম ভাঙবে না।
মেয়েগুলোকে ধরাধরি করে ঘরের বাইরে নিয়ে পেছনের দরজা খুলে একটা গাড়িতে তুলল লোকদুটো। কাকু দরজা ভেজিয়ে গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে টাকা নিচ্ছেন আর ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল চার পাঁচটা, তিন্নি দিদি আর বিমানদার হাতে রিভলবার, হ্যান্ডস্ আপ। গাড়িটার চারপাশে খাঁকি পোশাকের পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। সুমনা বলল,  বিমানদা তুমি ?  
কাকুর দিকে রিভলবার তাক করে বিমানদা বললেন, সুদেব মন্ডল তোমার মেয়ে পাচারের ব্যবসা এবার শেষ। 
কাকু হো হো করে হেসে বললেন, আমাকে ধরলেও ব্যবসা শেষ হবে না। বস্ কে ধরা অত সোজা নয়। 
কে তোমার বস্?  ওই গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান?  যে স্টেশনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ?  ও আগেই পাঁচটি অপহরণ করা মেয়ে সমেত ধরা পড়েছে। লালবাজার থেকে পুলিশ ফোর্স পৌঁছে গেছে। 
রাঙাপোতা গ্রামের ও সি সামনে এলেন। কয়েকমাস ধরেই আশপাশের গ্রামের মেয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত করতে করতে যখন থই পাচ্ছি না, তখন লালবাজারের সাহায্য চাই। 
বিমান স্যর আর তিন্নি ম্যাডাম এগিয়ে আসেন। আর সুমনা দিদিমণি এখানে আসার পর আমাদের সুবিধা হল, তিন্নি ম্যাডাম আসলেন। উনি তদন্ত করে আমাদের পাচার চক্র ধরতে সাহায্য করলেন। 
ইতিমধ্যে কাকিমা চলে এসেছেন। কাকুর দিকে এগিয়ে এক চড় মেরে বললেন, বদমাইস আমাকে ভয় দেখিয়ে আমার স্বামী সেজে আমার বাড়ি দখল করে রেখেছে। আমার স্বামীকে সিঁড়ির নিচের ঘরে তালা দিয়ে আটকে রেখেছে। আপনারা ওকে উদ্ধার করুন।
তিন্নি দিদি বলল, অফিসার তাড়াতাড়ি আসুন, সিঁড়ির নিচের ঘরের তালা ভাঙতে হবে। 
তালা ভেঙে আসল কাকুকে উদ্ধার করা হল। আশ্চর্য দুই কাকুকে একই রকম দেখতে। কাকিমা বললেন, হবে না কেন?  দুজনে তো যমজ ভাই। একজন ভালো মানুষ, আর একজন অপরাধী। 
কাকুর চোখে জল। ভাইটা ছোট থেকেই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। অনেক ভালো করার চেষ্টা করেছি। ও শোধরাবার নয়। এবার আইন ওকে সাজা দিক।

=============== 
অঞ্জনা মজুমদার 
এলোমেলো বাড়ি 
চাঁদপুর পল্লী বাগান 
পোঃ  রাজবাড়ি কলোনী 
কলকাতা    ৭০০০৮১

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.