কাক নিয়ে কা-কা
অনিন্দ্য পাল
মাঠে ফসল কাটছিলেন কান্ত, শীতের বিকেল। হঠাৎ দেখলেন কয়েকশ কাক এসে জড়ো হয়েছে তার জমিতে। যেন একটা সভা বসেছে। কেউ লাফিয়ে একবার এদিক একবার ওদিক চলেছে, কেউবা অন্যের সঙ্গে ঠোঁটাঠৌঁটি করে খুনসুটি করছে। কয়েকটা কাক আবার জটলা করে কোন একটা বিষয়ে একমত হতে না পেরে তারস্বরে চেঁচানি জুড়ে দিয়েছে। মাঝে মধ্যে একে অপরকে আক্রমণ ও করছে।
উপমা কুয়ো থেকে জল তুলছিলেন, হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাচ্চা কাক এসে কুয়োর মধ্যে জলে পড়লো, তারপর উঠতে না পেরে ঝটপট করতে লাগলো। উপমা কী করবে বুঝতে না পেরে যখন এদিক ওদিক তাকিয়ে আছে ঠিক তখনই, মাত্র কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই জড়ো হয়েছে অজস্র কাক। শুধু কি জড়ো হওয়া, বাড়ি ময় চিৎকার, চেঁচামেচি করে একেবারে তটস্থ করে তুললো সবাইকে। কোন ভাবে একটা বালতি কুয়োতে নামিয়ে দিতেই বাচ্চাটা সেই বালতিতে উঠে পড়লো। উপরে টেনে তুলে নামিয়ে দেওয়া হল কুয়োর পাশে বাচ্চা কাক তখন প্রকৃত অর্থেই "কাকভেজা"। আর কি আশ্চর্য, ততক্ষণে সব কাক গেছে চুপ করে।
কাক নিয়ে এরকম ভালো মন্দ মিশিয়ে অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই কমবেশী আছে। কাককে পাখিজগতের সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান পাখি বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, প্রাণীজগতের অন্যতম বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে এদের গণ্য করা হয়। আধুনিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কাক যে কেবল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে পারে তাই নয়, যন্ত্রপাতি নির্মাণেও এরা পারদর্শী।
কাক (Crow) কর্ভিডি গোত্রের অন্তর্গত একজাতীয় কালো পাখি। কাকের উদ্ভব ঘটেছে মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকে এটা উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে দক্ষিণ আমেরিকা ব্যতীত উষ্ণমণ্ডলীয় সব মহাদেশ এবং বেশ কিছু দ্বীপ অঞ্চলে কাকের বিস্তার রয়েছে। পৃথিবীতে ৪০টিরও বেশি প্রজাতির কাক দেখা যায়। তবে আমাদের চারপাশে সাধারণত দাঁড়কাক ও পাতিকাক—এই দু-ধরনের কাক বেশি দেখা যায়। এই পাখি কেবল অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া প্রায় পুরো বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে আছে।
দাঁড়কাকের শরীর কুচকুচে কালো। এদের শরীরের পালকগুলো চকচকে প্রকৃতির। এরা আকারে বেশ বড় হয়, ঠোঁট মোটা। এই কাকের বৈজ্ঞানিক নাম করভাস ম্যাকরোরিনকোস যার অর্থ বড় ঠোঁটের কাক। এদের গলার স্বর প্রচন্ড কর্কশ। কর্কশ গলায় এদের গান গাইতে দেখা এবং শোনা যায়। মাঝে মাঝে জীবন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং গান গায়। মার্চ থেকে মে মাস দাড়ঁ কাকের প্রজননের সময়। এদের বেশির ভাগ জঙ্গলে দেখা যায়।
পাতিকাকের মাথার পেছন থেকে গলা ও বুক এবং পেটের সামনের দিকটা ধূসর বা ফ্যাকাসে ধূসর; বাকি সারা দেহ, ঠোঁট, চোখ ও পা কালো। মাথার তালু, কপাল ও গলার নিচের দিকটাও কালো। ঠোঁট দাঁড়কাকের মতো, তবে একটু কম বাঁকা। ঠোঁটে গোঁফ দেখা যায়। পাতিকাকের বৈজ্ঞানিক নাম করভাস স্প্লেনডেনস। এরা আকারে দাঁড়কাকের তুলনায় বেশ ছোট হয়।
আমরা আশপাশে যে কাক দেখি তার প্রায় সবই পাতিকাক। পাতিকাক সর্বভুক অর্থাৎ সব খায়। এদের খাদ্যতালিকা বেশ বড়। প্রাণীর মল থেকে শুরু করে ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ, হাঁস-মুরগির ছানা, পোকামাকড়, ফলমূল, বড় বড় ফুলের মধু, ফসলের বীজ, পাখির ডিম, ছোট সরীসৃপ, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খায়।
স্ত্রী কাক মূলত বাসা তৈরি করে। এরা প্লাস্টিক, ফিতা, রশি, কাপড়ের টুকরা, উল, তুলা, লোহার তার, পলিথিন অর্থাৎ রাস্তায় পড়ে থাকা পরিত্যক্ত প্রায় সব কিছু দিয়েই অগোছালোভাবে বাসা করে। কাকের বাসার অগোছালো বৈশিষ্ট্যের জন্য সম্ভবত 'কাকের বাসা' বাগধারাটির উদ্ভব হয়েছে।
দিনের বেলায় কাক খাবারের সন্ধানে দলবেঁধে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় যায়। ভোরে ও সন্ধ্যায় নজর রাখলে এরকম দলে দলে কাক উড়ে যাবার দৃশ্য দেখা যায়। রাত এলে কাকেরা বেশ অসহায় বোধ করে। দিনের বেলায় খাবার সংগ্রহ শেষে রাত নামার আগেই তারা দল বেঁধে নিজেদের আশ্রয়ে চলে যায়। নিজের বাসা থেকে দূরে চলে এলে দলবদ্ধ কাক অপেক্ষাকৃত যৌক্তিক ও নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে। সেখানেই তারা আশ্রয় নেয়, বিশ্রাম নেয় ও ঘুমায়।
কাকের প্রজনন ঋতু মূলত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত, তবে স্থানভেদে প্রজনন ঋতুর বিভিন্নতা দেখা যায়। কাক একবারে ৩-৬টি ডিম দেয়। ডিমের রং আকাশি, তার ওপর থাকে কালচে-বাদামি ফোঁটা। ডিমের মোটা অংশে বাদামি ফোঁটার ঘনত্ব বেশি। স্ত্রী কাকই মূলত ডিমে তা দেয়। পুরুষ কাকও দেয়, খুব কম সময়ের জন্য। তবে বৃষ্টি নামলে, শিলাবৃষ্টি হলে বা প্রচণ্ড রোদ পড়লে পুরুষ কাক স্ত্রী কাকের সঙ্গে ডিম আগলে রাখে। ১৬ থেকে ১৭ দিন পর ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। সদ্যোজাত কাকের ছানার গায়ে পালক থাকে না, চোখ বন্ধ থাকে। দেহের বর্ণ আর ঠোঁট গোলাপী থাকে। ৭-১০ দিন বয়সী ছানার শরীর কালচে হয়, ঠোঁট কালচে-ধূসর ও চোখ কালো হয়। ২১ থেকে ২৮ দিন পর ছানারা বাসা ছাড়ে। বেশির ভাগ প্রজাতির কাকের আয়ুষ্কাল ১০-১৫ বছর।
কাকের বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ প্রজাতির কাক বর্তমানে বিদ্যমান। তবে এদের আকার আকৃতি এবং বৈশিষ্ট্য কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। আমেরিকান কাক আকারে ১৭.৫ ইঞ্চি। অন্যদিকে ফিশ কাক ১৯ ইঞ্চি। তবে র্যাভেন প্রজাতির কাক ২৭ ইঞ্চি; সবচেয়ে বড়। ছোট থেকে বড় বিভিন্ন কাকের ঠোঁটের রঙ এবং রঙে খুব সামান্য হলেও পার্থক্য থাকে। আমেরিকান কাক থেকে র্যাভেন প্রজাতির কাক, অনেক দিক থেকে এদের মিল রয়েছ। র্যাভেন প্রজাতির কাক অনেক বড় এবং এদের গলার স্বর একটি বেশিই কর্কশ। ঠোট অনেক শক্ত এবং ভারী।
অঞ্চলভেদে কাকেরা বিভিন্ন স্থানে বাস করতে পারে এবং সেখানকার পরিবেশ এর সাথে খুব সুন্দর ভাবে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারে। নর্থ আমেরিকার ফাঁকা জায়গা গুলোতে এবং কৃষি জমির এলাকায় বেশি দেখতে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে দুই ধরনের কাক পাওয়া যায়।
প্রকৃতির এক বিরল ঘটনা সাদা কাক। এদের পালকের রঙকে ঠিক প্রাকৃতিক বলা যায় না। আসলে এটা একধরনের মিউটেশনের ফলস্বরূপ। একে অ্যালবিনিজম বলে। এদের ত্বকে মেলানিন রঞ্জক তৈরি না হবার জন্য এই ঘটনা ঘটে। এদেরকে সচরাচর দেখা যায় না। এরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ায়। তবে কখনো কখনো এক আধটা সাদা কাক একদল কাকের মধ্যে দেখা যায় না তা নয়। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ঝড়সুগাদা অঞ্চলে এবং কর্ণাটক ও দিল্লী তে সাদা কাক দেখা যায়।
দাঁড় কাক বুদ্ধিমান প্রাণীর এর মধ্যে অন্যতম। প্রান্তিকাক বা পাতিকাক দাড়ঁকাকের থেকে আকারে ছোট হয়। বসতি এবং লোকালয়ের সবচেয়ে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। সহজেই দাঁড় কাকের থেকে এদের আলাদা করে চেনা যায়। এদের ধূসর বর্ণের ঘাড় এবং ছোট আকৃতি সহজেই চোখে ধরা পড়ে।
অন্য সব পাখিদের মত এদের খাবারের কোনো নির্দিষ্ট, বাঁধাধরা মেনু নেই। এরা কমবেশি সব কিছু খেয়ে থাকে। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত এদের প্রজননের সময়। কাক দেখতে কালো এবং আওয়াজ কর্কশ হলেও পাখিদের তালিকা এবং জীব বৈচিত্র রক্ষায় এদের দরকার রয়েছে। বর্তমানে কাকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
=======================
Anindya Paul
C/O Biswanath Paul
Vill-- Jafarpur
PO-- Champahati
PIN-- 743330
PS--Sonarpur
DIST--south 24 Parganas
west Bengal, India

