ছোটগল্পের কিছু কথা
আবদুস সালাম
ছোটগল্পের আবির্ভাব হয় আমেরিকায় । ইংল্যান্ড এর কথা সাহিত্যিকগণ তখন উপন্যাস নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছেন । ছোটগল্পের শিরোপা তখনও জোটেনি। ওয়াশিংটন আরভিং তার গল্পগুলোকে বলতেন sketch বা tales রূপে । তার বিখ্যাত গল্প রিপ ভ্যান উইংকল (১৮২০)তে প্রকাশিত হলে পাঠকমহলে সাড়া পড়ে যায় । tales অভিধাটি সকলের খুব পছন্দ হয় এই সময় বিখ্যাত যে সব গল্পকার আসেন তারা হলেন এবার আ্যলান পো, ন্যাথানিয়েল হর্থন, হার্মান মেলভিল প্রমূখ বিদগ্ধ পণ্ডিতজন। সংবেদনশীলতা, রহস্যময়তা ও ইঙ্গিতময়তা শিল্পরীতির জন্য আ্যলান পো-কে ছোটগল্পের জন্মদাতা বলা হয়। তার বিখ্যাত গল্প হলো The Gold Bug, The Black Cat, The Pita and Pendulum । হর্থনের গল্প গুলো নীতিবোধ ও নৈতিক দ্বন্দের বিষয় ভাবনা দিয়ে সাজানো । তার বিখ্যাত গল্প হলো Young Good man Brown ও Old Esther Double বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম যে নামটি উঠে আসে তার নাম কিপলিং। কিপলিং এর জন্ম ভারতে। ভারতের অনেক রসদ তার গল্পে খুঁজে পাই। তাঁর অসামান্য গল্প হলো Plain Tales From the Hills কিপলিং এর পরে যে নামগুলো উঠে আসে তারা হলেন রবার্ট লুই স্টিভেনসন, জর্জ ম্যুর ও এইচ জি ওয়েলস। পরে বিখ্যাত উপন্যাসিক লরেন্স, কনরাড, মমর, ফরস্টার জয়েস প্রমূখ ব্যাক্তিগণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। রাশিয়ায় তুর্গেনেভ, টলষ্টয়, চেখভ, গোর্কীওকুপ্রিন ছোটগল্পের শিল্পরীতির এমন পরিণতি দিলেন মা আধুনিক সাহিত্যে বিশ্বনাগরিকত্বের ছাড়পত্র পেল। স্বল্প পরিসরে জীবনের স্পন্দমান খন্ডচিত্রগুলি এমন ভাবে আঁকলেন যে এগুলি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দিশারী হয়ে উঠলো। ফরাসি গল্পকারদের ভিতরে মঁপাসা ছিলেন অন্যতম সেরা গল্পকার। দুশোর বেশি গল্প তিনি উপহার দিয়েছেন। প্যারিসের এক উন্মাদ আশ্রমে অকাল মৃত্যুর আগে প্রমাণ করেছিলেন শ্রেষ্ঠ গল্পকার হিসেবে।
ছোট গল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয় হলো কল্পনার বিদ্যুৎ স্রোত (electrical imaginative current)। ছোটগল্পের শুরু হয় একবারে প্রথম লাইন থেকেই। এ্যালেন পো বলেন 'from the very initial sentence'। জীবনের মাঝখান থেকে বিদ্যুৎ চমকের মতো যার যাত্রা শুরু। আবার জীবনের মাঝখান থেকে হঠাৎ কোন নাটকীয় মূহুর্তে তার পরিসমাপ্তি। এই খন্ড চিত্র দিয়েই গড়ে ওঠে পাঠকের উপলব্ধির সমগ্র চেতনা। সামান্য পরিসরে মানুষ খুঁজে পায় তার উপলব্ধির বিচরণ ক্ষেত্র। একজন গল্পকার জীবনের বিচিত্র সম্ভার থেকে কয়েক টা উপাদানকে বেছে নেন তার গল্পের বিষয়বস্তু থেকে। এ্যালেন পোর বিখ্যাত উক্তি প্রণিধান যোগ্য -"a brief prose narrative requiring from half an hour to one or two hours in this perusal."
ছোট গল্পে থাকবে না কোন আতিশয্য। নিয়ন্ত্রণ সংযম ও ঘনসংবদ্ধতাই হলো ছোট গল্পের মূল কথা । বিন্দুতে সিন্ধু দর্শনই ছোট গল্পের মূল উপজীব্য। ছোট গল্পের স্বনামধন্য আলোচক ব্রান্ডার ম্যাথুজ এর কথায়"-- a short story deals with a single character,a single event ,a single emotion or the series of emotion called forth by a single situation."
অনেক সমালোচনায় এই মননশীল মনোভাবের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ছোটগল্পের প্রথম দুটি কথা স্মরণ করিয়ে দেয় কি বলতে চায় সে। ছোট ও গল্প ---আকৃতি ও প্রকৃতি মিলে একটি শর্ত তাকে পূরণ করতে হয়।
গল্প কতোটা ছোট হলে তাকে ছোট গল্প বলা যাবে এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখন ও অধরাই থেকে গেছে।
আদর্শ ছোট গল্পের মূখ্য উপাদান হলো একটিই মহা মূহুর্ত বা climex । উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই অধ্যায় থেকে অধ্যায় গমনে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সর্বোচ্চ বিন্দুর দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু সার্থক ছোটগল্পে যে বিদ্যুৎ এর ঝলক কাহিনী কে ঝাঁকুনি দেয়।।
Single impression পাঠকের মনে তৈরি করে সংযত ও ঘনসংবদ্ধ শিল্প রূপ। সংহতি অর্জনের জন্য চায় উপযুক্ত শৈলী ও অভিব্যক্তির সূক্ষ্মতা।
কেবলমাত্র একটি ধারণা কাহিনীর আবর্তে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে এগুবে। পাঠককে পৌঁছে দিবে অবিস্মরণীয় মূহুর্তের দিকে।
ছোটগল্পের শুরু যেমন হঠাৎ হয় তেমনি শেষ খাতেও থাকে চমক।এ ধরণের নাটকিয়তা পাঠকের মনে ঝাঁকুনি দেয়। কবিগুরুর কথায় "শেষ হয়েও হইলো না শেষ"। চেকভের ভাষায় __ I think that when one has finished writing a short story one should delete the beginning and the end.
সাধারণ ভাবে ছোট গল্পের সমাপ্তি কে চুড়ান্ত পূর্ণচ্ছেদ বলে মনে হয়না। তার রেশ চলতেই থাকে পাঠকদের হৃদয়ে ।
কাহিনী বিবরণের গুনে ছোট গল্প মাধূর্য পূর্ণ হয়ে ওঠে। আমরা যখন কবিগুরুর গল্প গুচ্ছ পড়ি তখন ভাষা চাতুর্যের বর্ণনায় মোহিত হয়ে যায়।
ছোট গল্পের শিল্প রূপ কেমন হবে তার রূপ রেখা খুঁজে পাই কবিগুরুর কয়েক ছত্র পড়লে--
ছোট প্রাণ ,ছোট ব্যাথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা
নিতান্তই সহজ সরল
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দুচারটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে, সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়েও হইল না শেষ।।
বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে ছোট সদস্য ছোটগল্পর জনক যে কে তাই নিয়ে মতভেদ বিস্তর।
বাংলা ছোটগল্পের প্রথম আভাস পায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগলারঙ্গীয় ১৮৭৪, রাধারানী ১৮৭৫এ। ১২৮০ বঙ্গাব্দে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণ চন্দ্রের লেখা "মধুমতি"এবং সঞ্জীব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর রামেশ্বরের অদৃষ্ট, দামিনী ইত্যাদি। ১২৯১বঙ্গাব্দে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত কবিগুরুর" ঘাটের কথা"এই দুই গ্রুপের মধ্যে কোনটি সার্থক ছোট গল্প তার নিয়ে আজও তর্ক চলছেই। কেউ কেউ আবার ১২৮৪ তে প্রকাশিত কবিগুরুর "ভিখারিনী" গল্পটিকে ছোটগল্প রূপে চিহ্নিত করতে বদ্ধ পরিকর। পন্ডিতেরা ছোট গল্পকে জ্যা-মুক্ত তীরের মত লক্ষ্য অভিমুখীন এবং তার চলাকে জ্যা-চ্যূত লক্ষ্য পূর্ব তীরের চলমান অবস্থার সাথে তুলনা করেন। বিষয়ের পারম্পর্য, উপস্থাপনের অভিনবত্ব,নিয়মিতি বোধ কে আদর্শ ছোট গল্পের লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয় ।সব কয়টি শর্ত মেনে যে সকল গল্প আমরা পেতে থাকলাম তার প্রথম কবিগুরু ই আমাদের উপহার দিয়েছেন।মোঁপাশা,চেকভ,এডগার আ্যলেন পো ছোট গল্পের মননশীলতাকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছেন সে পর্যায় প্রথমে কবিগুরুর হাতে দেখতে পাই। এখানে আমরা সার্থক পিতা হিসেবে কবিগুরু কে দেখতে পাই। পরে প্রমথ চৌধুরী ফরাসি ভাষার দক্ষতা নিয়ে বাংলা ছোটগল্পের আঙিনায় উপস্থিত হন। "ফুলদানি" গল্প টি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কবিগুরু বিদেশি প্রভাব মুক্ত করে সম্পূর্ণ বাঙালীয়ানাকে গল্পে ঠাঁই দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও গ্রামের মানুষ কে নিবিড় ভাবে উপলব্ধি করে তার গল্পে ঠাঁই দিয়েছেন। রবীন্দ্র প্রতিভার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো চলমানতা। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাওয়ার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি।
কবিগুরুর ছোট গল্পের বৈচিত্র্যকে আমরা নয়টি ভাগে ভাগ করতে পারি। মনস্তাত্ত্বিক, ঘটনা প্রধান, সামাজিক, গার্হস্থ্য, রহস্যময়, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও হাস্যরস প্রধান। এসব গল্পের মধ্যে খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, কাবুলীওয়ালা, পোস্টমাষ্টার, দেনাপাওনা, প্রায়শ্চিত্য ইত্যাদি সব কালজয়ী গল্প আমাদের উপহার দিয়েছেন।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম যুগে ছোটগল্প দেখি বিষয় প্রধান। গল্প শোনানোর জন্য ঝোঁকের মাথায় সব টুকু নিঃশেষ করে দিতেন। কল্লোল যুগে ছোট গল্প নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা হয়েছে। গল্পের উপস্থাপনে বৈচিত্রের সূচনা হয়েছে।পরে কালিকলম,প্রগতি ও সংহতি এই অগ্রগতি কে ত্বরান্বিত করেছে।
কল্লোল গোষ্ঠীর বিশিষ্ট লেখক প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলীর বিশেষত্ব হলো ১-বিষয়বস্তু নির্বাচনে অনন্য সাধারণত্ব ২-আঙ্গিকের সচেতনতা ৩-দৃষ্টি ভঙ্গির স্বচ্ছতা ৪-তীক্ষ্ণ অনুভূতি প্রস্রবণ মানসিকতা ৫-সুরধর্মীতা।
কল্লোলকালীনদের ছোটগল্পে বিষয় ভিন্নতার হাত ধরে ভাষার ভিন্নতা এসেছে । বুকে পড়েছে নিম্ন বর্গীয় লোকেদের ব্যাবহৃত শব্দ , অভিজাতদের কথা, মনমানসিকতা। তৎসম শব্দের ব্যবহার কমে গিয়ে বদলে যেতে থাকলো বিশেষণ পদের ঝংকারময়তা, বদলে যেতে থাকলো উপমা। বদলে যেতে থাকলো চিত্র কল্প। কিছু কিছু গল্প মাইলফলকের মতো দেখিয়ে দিল রূপ-রীতি-ভাষার পরিবর্তন কাকে বলে। তখন থেকে অদ্যাবধি ভাষা রীতি, নানা সামাজিক টানাপোড়েনে বিধ্বস্ত জনপদ, দুঃসাহসিক জীবন অতিবাহিত করার ধরন, শাস্ত্র বিরোধিতা করার প্রবণতা ডিঙিয়ে সন্ধান করে চলেছে নতুন নতুন দিশা ।
বিশ শতকের মধ্যভাগে রচিত হয়েছে অনেক নষ্ট্যালজিক অনুভূতি সম্পন্ন ছোটগল্প। বাংলা ছোটগল্পের পথিকৃৎ ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী রবীন্দ্রনাথ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আপাত তুচ্ছ জীবনের ভেতরের আনন্দ বেদনার যে গোপন প্রবাহ তাকে অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি ও কাব্য সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ তার ছোট গল্প গুলিতে। অসাধারণ গল্প গুলোর মধ্যে নিশীথে ,মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ পোস্ট মাষ্টার ,কাবুলীওয়ালা, ছুটি, অতিথি ইত্যাদি ।
বঙ্গ দর্শন, হিতবাদী,ভারতী , সাধনা, সবুজ পত্র বিচিত্রা, সাহিত্য, প্রবাসী, কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি, পরিচয় প্রভৃতি সাময়িক পত্রের ক্ষেত্র ভূমি তে সাফল্যর সাথে ছোট গল্পের আবাদ হয়েছে। রবীন্দ্র সমাকালীন অনেক গল্পকারদের মধ্যে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় , প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ।প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় এর দেবী, আদরিণী,ও রসময়ীর রসিকতা সবার মনে স্হায়ী আসন করে নিয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তো সকলের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসে আছে। গঠন রীতির শৈথিল্য সত্ত্বেও মহেশ, অভাগীর স্বর্গ ও বিলাসী সবার মনে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। আরো নাম না বললেই নয় চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়,প্রমথ চৌধুরী , জগদীশ গুপ্তের নাম । রবীন্দ্র বলয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে যারা কলম ধরেছিলেন তারা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ মুজতবা আলী, অচিন্ত্য কুমার সেন গুপ্ত, বুদ্ধদেব বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়।ইনারা সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতার দিকে আঙ্গুল উঠিয়েছিলেন। অস্থিরতা ,ভ্রষ্টাচার , লাঞ্ছিত অবহেলিত মানুষদের উত্তোরণের সংকেত ঘোষণা করেন। প্রেমেন্দ্র মিত্রের "বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে" এবং অচিন্ত্য কুমার সেন গুপ্তের "তেলেনা পোতা আবিষ্কার"উল্লেখযোগ্য গল্প যা এখনও পাঠকের উপলব্ধির জগতে খেলা করে । কল্লোল পর্বে তিন মহান গল্পকার আমাদের মাঝে আসেন এবং আমাদের মাঝে আলোড়ন সৃষ্টি করেন তারা হলেন তারাশঙ্কর -বিভূতিভূষণ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের "তারিণী মাঝি -,বেদেনী- শেষ কথা", মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "প্রাগৈতিহাসিক,- সর্পিল -টিকটিকি"র মতো অনবদ্য গল্প আমাদের উপহার দিয়েছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের "মেঘমল্লার, -মৌরী ফুল,-কিন্নরদল" ছোট গল্পের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছিল। কল্লোল পরবর্তী যুগ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্বাধীনতা, দেশভাগ, দাঙ্গা , উদ্বাস্তু স্রোত নিয়ে বিপর্যস্ত একটা যুগ।এই বিপন্নতার যুগে যারা মানুষের দু ঃখ বেদনা কে কলম ধরেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সুবোধ ঘোষ,নারান গঙ্গোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ী, সন্তোষ কুমার ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র,জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, নবেন্দু ঘোষ উল্লেখযোগ্য।
আরো কিছু মুখ বাংলা ছোটগল্পের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছিলেন তারা হলেন অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, বনফুল,সরোজ কুমার রায় চৌধুরী,মনোজ বসু, প্রমুখ।
স্বাধীনতা উত্তর পঞ্চাশের দশকে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শুধু আশা ভঙ্গের সাতকাহন, অতৃপ্তি, বঞ্চনার চলমান দৌরাত্ম্য, কি ছিলাম এখন কি পেলাম। সামাজিক নৈতিকতার প্রশ্নে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের প্রকাশ দেখতে পাওয়া গেল। এসময়ে যারা গল্পের জগতে এলেন তারা হলেন সমরেশ বসু, বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, গৌরী কিশোর ঘোষ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, কমল কুমার মজুমদার, প্রফুল্ল রায়, দীপেন বন্দোপাধ্যায়,মতি নন্দী, মহাশ্বেতা দেবী শান্তি রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ দিকপাল গল্পকারগণ। এই সময়ে যারা কলম ধরেছিলেন তাদের গল্পে নানা আঙ্গিক, গল্পের ফর্মে বৈচিত্রের সূচনা হয়। গল্পের বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা নীরিক্ষা চালিয়েছেন বিস্তর ।
ওপার বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু গল্পকার ছোটগল্পের জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন । তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আবুল মনসুর আহমেদ (১৮৯৮--১৯৭৯), আব রশিদ (১৯১৯--) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১)। তার বিখ্যাত গল্প রাজধানীতে ঝড়, প্রথম যৌবন ইত্যাদি। তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ভন্ডামীর বিরুদ্ধে কলম শানিয়ে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের পর ওপার বাংলায় রাজনীতির টানাপোড়েনে তরঙ্গবিক্ষুব্ধ হয় সমাজ জীবন । ১৯৫৮এর সামরিক শাসন, ১৯৬৯এ গণআন্দোলন,১৯৭১এ মুক্তযুদ্ধ ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় সাধারণ মানুষের জীবন মাত্রা। অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এই সময় যে সব গল্পকার ছোট গল্পের নতুন স্বাদ এনে দেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন লায়লা সামাদ, হাসান হাফিজুর রহমান, আব্দুল মান্নান সৈয়দ, আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস,সেলিনা হোসেন প্রমুখ দিকপাল গল্পকারগণ। আক্তারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন সর্ব অর্থে ব্যাতিক্রমী গল্পকার। গল্পের উপস্থাপনে বৈচিত্রের সূচনা করেন।লোভ লালসা, ভালোবাসা, ঘৃণা, হিংস্রতা,ক্রুরতা ছিল গল্পের উপজীব্য বিষয়।হাসান আজিজুল হক, আব্দুল মান্নান সৈয়দ ওপার বাংলার বিখ্যাত নাম । হাসান আজিজুল হক ১৯৭৪এ( নামগোত্রহীন) গ্রন্থের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেন। হুমায়ূন আহমেদ ছাডা আরো অনেকে গল্পের জগতকে সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
আরো পরে যারা গল্পের মানচিত্রকে সমৃদ্ধ করেছিলেন তারা হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়,শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়,সন্দিপন চট্টোপাধ্যায়, দেবেশ রায়, দিব্যেন্দু পালিত, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, অতীন বন্দোপাধ্যায়, আব্দুর রাকিব, এম,এ,মান্নাফ, আব্দুল আজিজ আল্আমান প্রমুখ দিকপাল গল্পকারগণ।
অদ্যাবধি গল্প জগতে তারা বিচরণ করে চলেছেন তাঁরা হলেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সমীর রক্ষিত,অমর মিত্র , আবুল বাশার,স্বপ্নময় চক্রবর্তী ফজলুল হক, শচীন বন্দোপাধ্যায় , সোহরাব হোসেন , নীহারুল ইসলাম প্রমুখ দিকপাল গল্পকারগণ। ইদানিং নতুন নতুন মুখ উঠে আসছে গল্পের জগতকে সমৃদ্ধ করতে।
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
=======================
তথ্য সূত্র
সাহিত্যে ছোট গল্প--নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা ১৯৬২
বাঙলা সাহিত্যে ছোট গল্প ও গল্পকার --ভূদেব চৌধুরী১৯৮৯
স্বরূপের সন্ধানে -আনিসুজ্জামান জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী ঢাকা ১৯৯১
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস--সুকুমার সেন আনন্দ সংস্করণ ১৯৯৩
বাংলা দেশের ছোট গল্প, জীবন ও সমাজ বাংলা অ্যাকাডেমি ঢাকা ১৯৯৭
###
আবদুস সালাম
প্রয়াস শ্রীকান্তবাটি মাদারল্যান্ড
ডাক রঘুনাথগঞ্জ
