দেবাংশু সরকার
বহুবছর বিদেশে কাটানোর পর দেশে ফিরেছেন শ্যাম দাদা। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি দেশের বাইরে কাটিয়েছেন। ঘুরে বেড়িয়েছেন আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া অংশ নিয়েছেন আমাজন অভিযানে। চড়েছেন আল্পস পর্বতমালায়। ভয়ংকর বালি ঝড়ের মধ্যে টেন্টে রাত কাটিয়েছেন সাহারা মরুভূমিতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অংশ নিয়েছেন অনেক সামুদ্রিক অভিযানে। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযানের অমোঘ আকর্ষণে। এই অভিযানের ফলে গোটা পৃথিবীটাই যেন তার ঘরবাড়ি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বেশ কয়েক বছর পর শ্যাম দাদা বাড়ি ফিরেছেন শুনে পাড়ায় একটা উন্মাদনার সৃষ্টি হয়েছে। পাড়ার ছেলে বুড়ো সকলে প্রতিদিন সকালে বিকালে নিয়ম করে শ্যাম দাদাকে দেখতে আসছে। তবে ছোটদের মধ্যে আনন্দটা যেন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। স্কুলের ছুটির পর বাড়ি ফিরে খাওয়ার পর খেলার মাঠে না গিয়ে তারা হাজির হয় শ্যাম দাদার বাড়ির বাগানে।
শ্যাম দাদার বাড়িটা। প্রায় দুশো বছরের পুরান দোতলা বনেদি বাড়ি। তবে অধিকাংশ সময়ে ফাঁকা পড়ে থাকে কারণ শ্যামা দাদা বিদেশে থাকেন। কয়েক বছর অন্তর দেশে ফেরেন। যদিও বাড়িটাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন কেয়ারটেকার আছে। বাড়ির সংলগ্ন একটা বড় বাগান আছে। বাগান ভর্তি আম, জাম, নারকেল গাছ রয়েছে। রয়েছে অনেক রকম ফুলের গাছ। সেই কেয়ারটেকার বাগানের পরিচর্চাও করে। বাগানের মধ্যে কয়েকটা সিমেন্টের তৈরি সিট রয়েছে, প্রত্যে।কদিন বিকালে শ্যাম দাদা সেখানে এসে বসেন সেই সময় পাড়ার বাচ্চারা সেখানে হাজির হয়। তারা শ্যাম দাদার বিভিন্ন অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনতে শুনতে শিহরিত হয়ে ওঠে। শ্যামদাদাও বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাদের তার জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে থাকেন। গল্প শোনা ছাড়াও প্রত্যেক বিকালে শ্যাম দাদার বাগানে আসার আরও একটা কারণ আছে। শ্যাম দাদার বাগানে আসেন পকেট ভর্তি করে বিদেশ থেকে আনা চকোলেট নিয়ে। সেই চকোলেট তিনি ভাগ করে দেন বাচ্চাদের মধ্যে। বাচ্চারাও চকোলেট পেয়ে দারুণ খুশি হয়।
সত্তরোর্ধ্ব বয়স হলেও ছয় ফুটের উপর লম্বা মেদহীন টানটান শরীরের শ্যাম দাদাকে জিন্স, স্নিকারে দারুণ ঝকঝকে গ্ল্যামারাস লাগে। পকেট ভর্তি বিদেশি চকোলেট নিয়ে তিনি প্রত্যেকদিন বিকালে তার বাগানের একটা কংক্রিটের বেঞ্চে বসে বাচ্চাদের জন্য অপেক্ষা করেন। সেই সময় কখনো তিনি তার বাগানটা ঘুরে ঘুরে দেখেন। বাগান পরিচর্যার লোক থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজের হাতে বাগান পরিচর্যা করেন, যতক্ষণ না পাড়ার বাচ্চারা তার বাগানে হাজির হয়। দশ বারো বছরের লালু, রবি, খোকন, রিজুরা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই হাজির হয় শ্যাম দাদার বাগানে। এতদিন তারা বিকালে হলে স্কুল থেকে ফিরে খেলার মাঠে যেত। শ্যাম দাদা বাড়িতে আসার পর বাচ্চারা বিকালে খেলার মাঠে যাওয়ার বদলে শ্যাম দাদার বাগানে সময় কাটাতে যায়। বাগানে এসেই তারা শ্যাম দাদার পকেটে হাত ঢুকিয়ে চকোলেটগুলো বের করে নেয়। আজও বিকালে শ্যাম দাদা তার বাগানে এসে ফুটে থাকা গোলাপ ফুলগুলোকে দেখছেন। গাছগুলোকে আশেপাশে জমে থাকা আগাছা সাফ করছেন। সেইসঙ্গে অপেক্ষা করছে ছোটদের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হয় লালু, রবির, দল। বাগানে এসেই তারা প্রত্যেক দিনের মত শ্যাম দাদার পকেটে হাত ঢুকিয়ে চকোলেটগুলো বের করে নেয়। ঋজু অবশ্যই এই দিন কিছুটা পরে আসে। ততক্ষণে লালু রবিরা জমিয়ে গল্প করতে শুরু করেছে শ্যাম দাদার সঙ্গে।
ঋজু এসে শ্যাম দাদার পকেটে হাত গলায়। কিন্তু পকেট ফাঁকা! মন খারাপ ঋজুর। তখন শ্যাম দাদা তার ডান হাতটা মাথার ওপর ঘোরাতে দেখা গেল তার হাতে চকোলেট! ঋজু তুলে নিল চকোলেটটা।
শ্যাম দাদা হেসে বললেন, "ইটস ম্যাজিক।"লালু প্রশ্ন করে, "শ্যাম দাদা তুমি বিদেশে গিয়েছিলে কেন? এই দেশটা তোমার ভালো লাগেনি?"উত্তরে শ্যাম দাদা বললেন, "আমি অনেক দেশ দেখেছি। তবে তার মধ্যে সবার থেকে সেরা, সবার থেকে সুন্দর, সবার থেকে বৈচিত্র্যময় আমাদের দেশ ভারতবর্ষ। এবারে আসছি বিদেশে গেলাম কেন? তার আগে বলো, তোমরা পশুপাখী ভালোবাসো?"সমস্বরে উত্তর এল, "হ্যাঁ।"শ্যাম দাদা প্রশ্ন করলেন, "তোমরা কোনও কিছু পুষেছো?"লালু বলল, "আমাদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর আছে।"ঋজু বলল, "আমাদের টিয়া পাখি আছে।"শুনে শ্যাম দাদা বললেন, "একটা বাঘ পুষলে কেমন হয়?"ছোটরা সমস্বরে বলে ওঠে, "অ্যাঁ! বাঘ!"শ্যাম দাদা বললেন, "হ্যাঁ বাঘ। বাঘের জন্যই তো আমার প্রথম বিদেশ যাওয়া।"ছোটোরা পুরো ঘটনাটা শুনতে চাইল। তখন শ্যাম দাদা বলতে শুরু করলেন।"বিএ পাশ করে একটা অফিসে চাকরি পেলাম কলকাতায়। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সহপাঠী চন্দন মালো চাকরি পেল বন দপ্তরে। পোস্টিং হল সুন্দর বনে। জলা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। খুব রোমাঞ্চকর চাকরি! শুনে আমার ইচ্ছা হত কেরানিগিরী ছেড়ে এই ধরনের রোমাঞ্চকর চাকরি করতে। খুঁজতে খুঁজতে কিছু দিনের মধ্যেই চিড়িয়াখানায় চাকরি পেলাম। পশুপাখি নিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগত। নিয়মিত না হলেও মাঝে মাঝে চন্দনের সঙ্গে দেখা হত। তার মুখে শুনতাম বৈচিত্র্যময় সুন্দরবনের কথা। সে আমাকে সুন্দর বন দেখার জন্য আসতে বলত।চন্দনের কথা রাখতে এবং সুন্দর বন দেখার আকর্ষণে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে গেলাম সুন্দরবন। উঠলাম চন্দনের ডেরায়। চন্দন বেশ আনন্দের সঙ্গে আমাকে সুন্দর বন দেখাতে লাগল।তোমরা তো জানো অনান্য জঙ্গলের থেকে সুন্দর বনের প্রধান তফাৎ হল, অনান্য জঙ্গলে জিপ বা হাতিতে চেপে ঘোরা যায়। কিন্তু সুন্দর বন নদী নালায় ভর্তি এক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। এখানে জিপে চড়া তো দুরের কথা মাটিতে হাঁটাও কষ্টকর।একদিন আমরা নৌকা চড়ে চলেছি। ছোটো নদী, দুদিকে ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। ভরা কোটালের সময়, নদী টই টুম্বুর। আচমকা আকাশ মেঘে ছেয়ে গেল। ঝড় উঠল। তাড়াতাড়ি নৌকা ঘুরিয়ে আমরা ফিরে চললাম। নদীর পাড়ে নৌকা ভেড়ানো বেশ ঝুঁকির। কারণ জায়গাটাতে বাঘের আনাগোনা আছে। হঠাৎ দেখি আমাদের নৌকার পাশ দিয়ে একটা বিড়াল ভেসে যাচ্ছে। চন্দন হাত বাড়িয়ে বিড়ালটাকে তুলে নিল। পরে দেখা গেল ওটা বিড়াল নয়। ওটা একটা সদ্যোজাত চোখ না ফোটা বাঘের বাচ্চা!বাঘিনী সাধারনত মিষ্টি জলের আসে পাশে অর্থাৎ নদী বা খালের ধারে বাসা বাঁধে। সেখানে তার বাচ্চাদের রাখে। নদীতে জলোচ্ছ্বাস হলে বাঘিনী তার বাচ্চাদের মুখে করে নিয়ে গিয়ে নিরাপদ দুরত্ব রেখে আসে। একাধিক বাচ্চা থাকলে, একটাকে নিরাপদ দুরত্ব রেখে আসতে আসতে অন্য বাচ্চাগুলো জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়। চন্দনের ধারণা এক্ষেত্রে সেটাই হয়েছে। জলে ভেজা ছোট্ট শরীরটাতে ডোরাকাটা দাগ স্পষ্ট নয়। তবে বেঁচে আছে। শ্বাস চলছে। দেখে মনে হয় বাচ্চাটার বয়স সাত আট দিনের বেশি নয়। চোখ ফোটেনি। নৌকাতে একটা শুকনো বস্তা ছিল। সেটা পেতে বাচ্চাটাকে তার ওপর শোয়ানো হল।ফিরে এসে ঘরের একটা কোনে শুকনো কাপড় জড়ো করে বাচ্চাটাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। কিছু শুকনো কাঠ জ্বেলে বাচ্চাটাকে গরম করার চেষ্টা করা হয়। আমরা নজর রাখছিলাম। স্থির ভাবে এক দিকে কাৎ হয়ে নিশ্চল ভাবে শুয়েছিল। সদ্যোজাত বাচ্চা, বহুক্ষণ জলে ভিজেছে। বাঁচার আশা কম। তবে পরিস্কার ভাবে শ্বাস নিচ্ছে। ঐ এটুকুই যা আশার আলো। হঠাৎ মনে হল একটু যেন নড়ে উঠল। বোঝা গেল কাঠের আগুনের তাপ পেয়ে ধিরে ধিরে চাঙ্গা হচ্ছে। আমাদের মনে আশার সঞ্চার হচ্ছে। তবে রাতটা কাটলে কিছুটা নিশ্চিত হব।পরের দিন ভোর হতে না হতেই দৌড়ে গেলাম বাঘ বাবাজির কাছে। দেখি পাগুলো নড়ছে। আগের রাতে যেখানে শোয়ানো হয়েছিল, সেখান থেকে কিছুটা সরে গেছে। অর্থাৎ আশার আলো একটু একটু করে জ্বলে উঠছে। তবে সারা রাত বাচ্চাটাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। চন্দন ছুটে গিয়ে কিছু দুরের বসতি থেকে কিছুটা দুধ জোগাড় করে আনে। কিন্তু ফিডিং বোতল পাওয়া গেল না। অগত্যা একটা চামচে করে খাওয়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু চামচে করে একটা বাঘের বাচ্চাকে খাওয়ানো বেশ কষ্টকর। যতটুকু দুধ মুখে যাচ্ছে, তার তিনগুণ বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। তবে কিছুটা দুধ যে খাওয়ানো গেছে এটাই আনন্দের। এভাবে দুতিন দিন কেটে যায়। এক দিন মনে হল 'মিয়াও মিয়াও' করছে। তবে খুব আস্তে। কাছে গিয়ে শুনলাম ঠিক 'মিয়াও মিয়াও' নয়, অনেকটা 'কুঁয়াউ কুঁয়াউ' মনে হল। আমরা পালা করে নজর রাখছি, খাওয়াচ্ছি। সুন্দর বন ঘুরে দেখা মাথায় উঠল। তখন আমার ধ্যান জ্ঞান কেবল বাঘ বাবাজি।আরও একদিন গেল। পরের দিন সকালে দেখলাম, মাথা নাড়ার চেষ্টা করছে। আমার মনে হল এইটুকু বাচ্চাকে এভাবে ফেলে রাখা ঠিক হচ্ছে না। চিকিৎসার প্রয়োজন। ডাক্তার দেখানো দরকার। চন্দন খবর দিল বন দপ্তরের ডাক্তারকে। ডাক্তার বাবু এলেন, দেখলেন, চিকিৎসা করলেন। বললেন, 'তেমন ভয়ের কিছু নেই। তবে বেশ ঠান্ডা লেগেছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়েছি।' ডাক্তার বাবু দুটো ফিডিং বোতল দিয়ে গেলেন, দুধ আর জল খাওয়ানোর জন্য।আমার ছুটি শেষের দিকে। এইটুকু বাঘের বাচ্চাকে চন্দন একা দেখাশোনা করতে পারবে না। তাই আমার ছুটি আরও পনেরো দিন বাড়িয়ে নিলাম। তার মধ্যে চন্দনের কলিগ ফিরে এসে কাজে যোগদান করবে। তখন চন্দন আর তার কলিগ দুজনে মিলে পালা করে বাঘের বাচ্চাটাকে দেখাশোনা করতে পারবে। ডাক্তার বাবুর ওষুধে কিছুটা চাঙ্গা হয় বাচ্চাটা। হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছে। দুধ খাওয়াতে গিয়ে দেখি আমার দিকে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে। চোখ ফুটেছে! ছেলে বড় হচ্ছে! এবার নামকরণ করতে হবে। যেহেতু রবিবারে কুড়িয়ে পাওয়া গেছে, তাই নাম রাখা হল রবি। হাঁটতে চলতেও শিখে গেল বেশ তাড়াতাড়ি। ঘরের মধ্যেই রবি হেঁটে, চলে, ছুটে বেড়ায়। কখনো 'কুঁয়াউ কুঁয়াউ' করে ডাকে। আমাদের দেখতে পেলে দৌড়ে পায়ের কাছে চলে আসে। কোলে বসে ফিডিং বোতলে দুধ খায়, জল খায়। খেতে খেতে ফিডিং বোতলে থাবা বোলায়।এবার আমাকে ফিরতে হবে। রবিকে ছেড়ে যেতে একেবারেই ইচ্ছা করছে না। কিন্তু উপায় নেই। আর ছুটি বাড়ানো যাবে না। রবিকে নিয়ে অন্য চিন্তাও আছে। ক্রমশ বড় হচ্ছে রবি। বন দপ্তরের ছোটো ঘরে আর তাকে রাখা যাবে না। তাছাড়া তার গায়ের গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে। ঐ গন্ধে অন্য বাঘের হামলা হতে পারে বনকর্মীদের ঘরে। আবার রবি এতটা বড় হয়নি যে জঙ্গলে ছাড়া যাবে। বাঘের বাচ্চা দুবছর অবধি মায়ের কাছে থাকে। দুতিন মাস বয়স থেকেই শিকার করতে শেখে। ছমাস বয়স থেকে নিজেরা শিকার করে। কিন্তু রবিরতো এসবের কোনও সুযোগ নেই। কে তাকে শেখাবে শিকার করতে? রবির পক্ষেতো জঙ্গলের কঠিন জীবনে টিকে থাকা কোনও ভাবেই সম্ভব নয়!চন্দন আবার যোগাযোগ করে বন দপ্তরের সঙ্গে। উচ্চ পদস্থ কর্তারা ঠিক করলেন আপাতত চিড়িয়াখানায় রাখা হবে রবিকে। তারপর অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সিদ্ধান্তটা আমার খুব ভালো লাগল। এতদিনে রবির ওপর আমার বেশ মায়া পড়ে গেছে। রবিকে চিড়িয়াখানায় রাখলে আমি নিয়মিত দেখতে পাব।তিন সপ্তাহ পর আমি চিড়িয়াখানার কাজে যোগ দিলাম। পরের দিন চিড়িয়াখানায় নতুন অতিথি রবি এসে হাজির হল। চিড়িয়াখানার অধিকর্তার সঙ্গে দেখা করে সুন্দর বনের ঘটনাটা খুলে বললাম। আধিকারিক একটু চিন্তায় ছিলেন, এক মাসের বাচ্চা বাঘকে কি করে প্রতিপালন করবেন! আমার কথা শুনে বেশ আশ্বস্ত হলেন। রবিকে দেখা শোনার পুর্ণ দায়িত্ব আমাকে দিলেন।একটা আলাদা ঘরে রবিকে রাখার ব্যবস্থা করা হল। এক মাসের রবি বড় ঘর পেয়ে বেশ মজায় আছে। গোটা ঘরময় লাফিয়ে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমাকে বারে বারে আসতে হয় রবির ঘরে। ফিভিং বোতলে দুধ নিয়ে আসি। পেটে খিদে থাকলে চুকচুক করে খেয়ে নেয়। তারপর আমার হাত চাটতে থাকে। কখনো লাফিয়ে আমার ঘাড়ে উঠে, জিব দিয়ে আমার মুখ চেটে দেয়। যখন আমার কাঁধে চড়ে বসে বুঝতে পারি একটু একটু করে ওজন বাড়ছে। পায়ে নখের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে। গলার জোরটাও বেড়েছে। 'কুঁয়াউ কুঁয়াউ' এর সঙ্গে একটা 'গরর গরর' শব্দ শোনা যায়। ক্রমশ গায়ের লোমের ডোরাকাটা যেন স্পষ্ট হচ্ছে। আমার সহকর্মীরা মাঝে মাঝে রবিকে দেখতে আসে। তাদের রবি খুব একটা পাত্তা দেয় না। উটকো লোক দেখলে একটু দুরে দুরে থাকে।দেড় মাসের রবি কিছুটা বড়সড় হয়ে উঠেছে। ফিডিং বোতলে খাওয়া ছেড়েছে। একটা গামলাতে দুধ দেওয়া হয়। নিজেই খেয়ে নেয়। এবার একটু শক্ত খাবার দেওয়া দরকার। ছোটো ছোটো মাছের টুকরো খেতে দিই। কখনো মাংসের টুকরো। চিবিয়ে খেয়ে নেয়। একটা দুশ্চিন্তা অবশ্য থেকে গেছে। এই বয়স থেকেই বাঘের বাচ্চারা শিকারের পেছনে ছুটতে শেখে। তাদের মায়েরা শেখায়। এই শিক্ষা প্রায় দুবছর অবধি চলে। তারপর তারা মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু রবিতো কিছুই শেখার সুযোগ পাচ্ছে না! ভবিষ্যতে কি করে জঙ্গল জীবনে মানিয়ে নেবে? নাকি সারা জীবন চিড়িয়াখানাতে থেকে যাবে?আরও কয়েক মাস কেটে গেল। রবির এখন দুধ খাওয়া কমছে। মাংস খাওয়া বাড়ছে। একদিন সকালে আমাকে দেখে আর 'কুঁয়াউ কুঁয়াউ' নয়, পুর্ণ ব্যাঘ্র গর্জন করে আমাকে স্বাগত জানালো। বুঝলাম রবির পূর্ণাঙ্গ বাঘে রূপান্তরিত হতে আর বেশি বাকি নেই।আবার চিড়িয়াখানার অধিকর্তার সঙ্গে কথা বললাম। অধিকর্তা ভাবলেন এবার তিনি রবিকে পরীক্ষা করে দেখবেন যে রবি কতটা বাঘ হয়ে উঠেছে। আমরাও অর্থাৎ আমি এবং আমার অন্যান্য কলিগরাও বেশ আগ্রহের সঙ্গে রবির পরীক্ষা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলাম। আমাদের মনেও একটা উৎকণ্ঠা যেন কাজ করছিল অধীর আগ্রহে আমরা এসে হাজির হলাম রবির ঘরের সামনে। দেখার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম যে অধিকর্তা মহাশয় রবির ঠিক কি পরীক্ষা নেন। অধিকর্তা অবশ্য রবির কি পরীক্ষা নেবেন সে বিষয়ে আগে থেকে কোনও আভাস দেননি। রবির ঘরে একটা ছাগলকে ছাড়া হল। আমরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি, দেখার জন্য যে রবি ছাগলটাকে কিভাবে আপ্যায়ন করে। পরীক্ষায় রবি ডাহা ফেল করল । আমাদের হতাশ করল। সে ঘুরেও তাকাল ছাগলের দিকে। যেন কোনও অবাঞ্ছিত অতিথি তার ঘরে এসেছে! অন্যদিকে ইনোসেন্ট ছাগলটা রবির সঙ্গে সখ্যতা বাড়াতে গেলে বিরক্ত রবি তার বাঁ থাবা দিয়ে চড় মেরে ছাগলটাকে সরিয়ে দেয়।রবি চিড়িয়াখানাতে রয়ে গেল। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, যে এক্ষুনি আমাকে বা রবিকে বিরহ যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে না। কিন্তু বিধি বাম।পরের বছরেই চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিলো, রবিকে দক্ষিণ আফ্রিকার নাটাল চিড়িয়াখানায় দিয়ে কয়েকটা জেব্রা আনা হবে। রবি চলল নাটালে, আমি পড়ে রইলাম কলকাতায়!তিন বছর পর আমার সুযোগ এলো। নাটাল চিড়িয়াখানা ব্যাঘ্র সংরক্ষণের ওপর একটা সেমিনার করেছিল। আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় বক্তব্য রাখার জন্য। প্রথম সুযোগ পেলাম বিদেশে যাওয়ার। খুবই আনন্দের ব্যাপার! আবার মনে হল যাচ্ছি নাটালে। দেখা হবে রবির সাথে। রবি কি আমাকে চিনতে পারবে? আমাকে দেখে কি আগের মতো ছুটে আসবে? যখনই ভাবছি মনে পড়ছে ছোট্ট রবির কথা। সেই ছোট্ট রবি, যে আমার কোলে বসে ফিডিং বোতলে দুধ খেত। আমার কাঁধে চড়ে জিব দিয়ে আমার মুখ চেটে দিত। আমার পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়াত। সেই রবির সঙ্গে দেখা হবে। যখনই রবির কথা ভাবি, মনটা আনন্দে ভরে যায়। সেই আনন্দের কাছে ফিকে হয়ে যায় বিদেশ ভ্রমণের আনন্দ।"-------------------------------ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
=======================================

