বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

প্রবন্ধ : কালীসাধনায় কাজী নজরুল ।। শৌনক ঠাকুর


কালীসাধনায় কাজী নজরুল

শৌনক ঠাকুর 

 

 ব্রাহ্মণ্য হিন্দু উপাসক সম্প্রদায়গুলিতে সাধারণতঃ পাঁচটি ভাগ দেখা যায় — বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, এবং সৌর। তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে বৈষ্ণব ও শাক্ত অনেকটা এগিয়ে। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বৈষ্ণব পদাবলীর পাশাপাশি সমানভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল শাক্তপদাবলী।  রামপ্রসাদ সেন , কমলাকান্ত ভট্টাচার্য , দাশরথি রায়সহ প্রমুখের লেখা গান লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। তবে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীত রচনাকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। যার বড় অংশই ছিল শ্যামাসংগীত। নজরুলের শ্যামাসংগীত শুধু সেকাল বা একাল নয়, সর্বকালের অমূল্য সম্পদ। ডঃ করুণাময় গোস্বামীর মতে , "শ্যামাসংগীত রচয়িতারূপে রামপ্রসাদ সেন বা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সাংগীতিক নান্দনিকতায় যে স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, নজরুল তদপেক্ষা উচ্চস্তরে পৌঁছেছিলেন।" ( 'নজরুলগীতি প্রসঙ্গ' : বাংলা অ্যাকাডেমী পৃ: ২৫৩ )

 

 এই 'উচ্চস্বরে' পৌঁছানোর অন্যতম প্রধান কারণ হল শ্যামাসংগীতে প্রত্যক্ষ স্বদেশীয়ানার প্রচলন। তিনি দেবী কালীকে দেশমাতারূপে দেখেছেন। 'হিন্দুমেলা' প্রতিষ্ঠার আগে এই প্রয়াস তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে দেখা যায় নি। ফলে নজরুলের শ্যামাসংগীত প্রথম থেকেই ছিল ব্যতিক্রমী। স্বতন্ত্র। 'আজই না হয় কালই তোরে কালী কালী বলবে লোকে।' এই গানটিতে 'কালী' যে দেশমাতার প্রতীক এবং তারই কৃপাতে পরাধীন ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণের শৃঙ্খলমোচন হবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। 

 

 একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন ভারতবর্ষের পরিবেশ ছিল উত্তাল। সেই সঙ্গে বিশ্বময় পুঁজিবাদী দেশগুলোর আগ্রাসন নীতি, শাসন, বর্বরোচিত লোভ জনমানুষের মনে ভয় ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। এই দুঃসময়ে কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে শ্যামাসঙ্গীত। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী মহাকালী দুষ্টের দমন করেন। তাই কবি অন্ধকার দূরীকরণের জন্য দেবীকে আহবান করেছেন। 

 

 আবেগধর্মিতা নজরুলের শ্যামাগানের প্রাণ। বাঙালি আবেগসর্বস্ব জাত। আর এই গানগুলির মধ্যেও রয়েছে এক দুর্বার আবেগ, অনাবিল আকুতি। তাই বাঙালির শান্ত-স্নিগ্ধ-নরম হৃদয় আজও গুনগুন করে এই গানগুলি — 'আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে', 'শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা', 'জ্বলিয়া মরিবি কে সংসার জ্বালায়'। আবার 'মোর লেখাপড়া হ'ল না মা, আমি 'ম' দেখিতেই দেখি শ্যামা, আমি 'ক' দেখতেই কালী ব'লে নাচি দিয়ে করতালি'।  

 

 নজরুলের শ্যামাসংগীতগুলি ভক্তিরসে জারিত। 'ভক্তি' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভজ্ (ধাতু) থেকে, যার অর্থ শ্রদ্ধা করা বা পূজা করা। সম্ভবত 'ভক্তি' শব্দটি সর্বপ্রথম শ্বেতাশ্বতর উপনিষদেই পাওয়া যায়। এই উপনিষদের সর্বশেষ শ্লোকটি —'যস্য দেবে পরাভক্তির্যথা দেবে তথা গুরো।/ তস্যৈতে কথিতা হ্যর্থা প্রকাশন্তে মহাত্মন' ('পঞ্চোপাসনা' : শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পৃঃ-৩)। নজরুলের বিভিন্ন শ্যামাগানের মধ্যেও ভক্তিভাবের প্রকাশ লক্ষণীয়। ভাবতে অবাক লাগে, প্রাত্যহিক জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপাদান তার লেখনি গুণে হয়ে উঠেছে অমূল্য রতন। ভক্তি প্রসঙ্গে একটি গানে তিনি বলেছেন — 'ভক্তি আমার ধূপের মত / ঊর্ধ্বে ওঠে অবিরত / শিবলোকের দেব দেউলে / মার শ্রীচরণ পরশিতে' কত সুন্দর দার্শনিকচেতনা ও রূপককের দ্যোতনা। ভক্তি ধূপের ধোঁয়ার মত ঘুরতে ঘুরতে উঠে গেছে একেবারে অমৃতলোক শিবলোকে। এবং আশ্রয় নিয়েছে মায়ের আলক্তচরণে। ভক্ত হৃদয়ের আকুলতা তার প্রায় প্রত্যেকটি পদে কম-বেশি রয়েছে, 'তোর রাঙা পায়ে মে মা শ্যামা / আমার প্রথম পূজার ফুল' অথবা 'থির হয়ে তুই বস মা / দেখি খানিক আমার আঁখির আগে।'

 

 কাজী নজরুল ইসলাম বরাবরই নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। 'বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর'। এই নারীরাই পারে জগতের যা কিছু অমঙ্গলকে বিনাশ করে শুভ শক্তির জাগরণ ঘটাতে। 'শিখালি কাঁকন চুড়ি পরিয়াও নারী, / ধরিতে পারে যে উদ্ধত তরবারি।' তাই কবির চোখে এই নারী মহাকালী করালবদনা। জাগরণের প্রতীক। মুক্তির দূত। এই নারী ইংরেজ শাসনের ভিতকে ধ্বংস করে সমস্ত বঞ্চনা পরাধীনতার অবসান ঘটিয়ে 'অনাগত স্বাধীনতা' আনতে। এই নারী কখনও হয়ে উঠেছে 'ছিন্নমস্তা' কখনও বা 'রক্তখেপী' 'আমার মা আছে রে সকল নামে' ,'আমি কি তোকে ডাকিতে পারি' ইত্যাদি নানান গানে কবি নারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন। আবার 'আমার কালো মেয়ের পালিয়ে বেড়ায়' এই ধরনের গানে কবি নারী-মুক্তি ও সম-অধিকারের বার্তা দিয়েছেন।

 

 তন্ত্রসাধনার বিভিন্ন দিক নজরুলের বেশ কিছু গানে ধরা পড়েছে। তন্ত্র মতে দেহই হল সাধনার আধার। উর্ধ্বমুখী কুণ্ডলিনী বা সর্পশক্তিকে জাগরিত করাই হল প্রকৃত সাধনা। গীতিকার নজরুল বিভিন্ন শ্যামাগানে লৌকিক উপমা ব্যবহার করে এই দূরূহ বিষয়টিকে সহজভাবে ব্যক্ত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ 'শ্যামা নামের লাগল আগুন আমার দেহ ধূপ-কাঠিতে', 'ধূলোয় ভরল ধরণী' ইত্যাদি গানের কথা বলা যেতে পারে।

 

 সৃষ্টিতত্ত্ব জটিল ও রহস্যময়। পুরুষ সূক্ষ্ম, অব্যক্ত, নিত্য ও চৈতন্যরূপ সত্ত্বা। আর প্রকৃতি তার দোসর। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের দশম মন্ডলের ১২৯-নং সূক্তে এই ভাবনারই প্রকাশ রয়েছে। বিদ্রোহী কবির একটি গানে দেখা যায় মহাকাল শিব বুক পেতে গ্রহণ করেছেন মহাকালীর শ্রীচরণ — 'কালো মেয়ের পায়ের তলায় / দেখে যা আলোর নাচন' — এই গানটির মধ্যে মহাকালী পায়ের নিচে শুয়ে রয়েছেন মহাকাল। একজন শক্তি আরেকজন তার আধার। একজন প্রকৃতি। একজন পুরুষ। মহাকাল ও মহাকালী এ সংসারের আধার। কালের নিয়ন্ত্রক। এলোকেশী ঘোর তমসার প্রতীক। কালিমার সঙ্গে শ্যামার নীলিমা এখানে এক হয়ে গেছে। সমগ্র কালকে বস্ত্র দিয়ে ঢেকে রাখার ক্ষমতা পৃথিবীর কারোর নেই তাই তিনি দ্বিগম্বরী। কত সহজ সরল শব্দে গভীর তত্ত্বকে পরিবেশন করেছেন তিনি। 

 

 এ জগৎ প্রপঞ্চময়। এই মায়ার আবরণ থেকেই মানুষ মুক্ত হতে পারে না। তাই সংসারের জালে আবদ্ধ হয়ে কলুর বলদের মতই কেবল ঘুরে মরে। এই জীবনবোধ ও চিরন্তন সত্যকে কত খুবই সুন্দরভাবে চিত্রিত করেছেন গীতিকার নজরুল —'জগৎ জুড়ে জাল ফেলেছিস মা শ্যামা কি তুই জেলের মেয়ে / (তোর) মায়ার জালে মহামায়া বিশ্বভূবন আছে ছেয়ে।' এখানে 'জাল' শব্দটি মায়া বা মোহ অর্থে প্রযুক্ত। এই মায়া কিভাবে মানুষকে মোহিত করে রাখে তার বর্ণনার পাশাপাশি রয়েছে এই জাল থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়। 'চতুর মীন' বা প্রকৃত সাধক এই জালে ধরা পড়ে না। কারণ প্রথম থেকেই সে মহামায়ার চরণে আশ্রয় নিয়েছে। কবির শব্দে , 'মা সে লুকায় জেলের পায়ের কাছে।'

 

 লৌকিক জগতকে আশ্রয় করে লোকোত্তর আর জগতের দ্যোতনা সৃষ্টি করায় তার সংগীতের মূল নান্দনিক রূপ। যেখানে থাকে অদ্বৈতবাদের পরমসত্তা এবং অতীন্দ্রিয় স্বপ্ন-সুখ। শ্যাম ও শ্যামা তার কলমে একাত্মতা হয়ে গেছে। শ্যামকে শ্যামামায়ের কোলে বসিয়ে তিনি দেখিয়েছেন একই অঙ্গে দুটি রূপ। 'আমার শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে / জপি আমি শ্যামের নাম।' কিংবা 'আমার মনের দো-তারাতে শ্যাম ও শ্যামা দুটি তার।' পরমাত্মা কখনই ভিন্ন নয় এক ও অদ্বিতীয়। জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ যেন এক প্রেম। এ বিষয়ে নজরুলের একটি বিখ্যাত গজল রয়েছে—- 'মোর ঘুম ঘোরে এলে মনোহর/ নমো নম নমো নম নমো নম।'

 

 নজরুলের শ্যামা সঙ্গীতে শ্মশানের অনুষঙ্গ ঘুরে ফিরে এসেছে। তবে ভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন অনুষঙ্গে। কখনও শান্ত হাসি নিয়ে পরিশ্রান্ত ভদ্রকালী শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকে। পাশে রয়েছেন মহাকাল। তবে এ মহাকালের হাতে রয়েছে বাঁশি। চিরশান্তির জায়গা শ্মশানে ঘুমিয়ে আছে সংসার-ক্লান্ত শত শত মানুষ। 'শ্মশানে জাগিছে শ্যামা অন্তিমে সন্তানে নিতে কোলে/ জননী শান্তিময়ী বসিয়া আছে ঐ/ চিতার আগুন ঢেকে স্নেহ-আঁচলে'। আবার গাঁজাখোর, শ্মশানবাসী, মহাদেব সতীন গঙ্গাকে মাথায় স্থান দিয়েছেন। স্বামীর এ রকম আচরণে অভিমানী মেয়ে দুর্গা হয়েছেন শ্মশানবাসিনী। এখানে কবির মধ্যে এক শাশ্বত পিতার আবহমানকালের আর্তি প্রকাশিত হয়েছে।

 

 কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতাবাদী কবি। তাই তিনি প্রশ্ন করতে পেরেছিলেন মনের পশুর পরিবর্তে কেন বনের পশুকে বলি দেওয়া হবে? পশুবলি দিয়ে পূজা করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। পাষাণ দেউল , স্বর্ণবেদির পরিবর্তে তিনি হৃদয়-বেদিতে মাকে স্থাপন করেছেন। পূজা দিয়েছেন ভক্তির ডালি সাজিয়ে। তিনি বিশ্বাস করতেন মন্দিরের বদ্ধ পরিবেশে মা থাকেন না। তিনি জগৎমাতা। জগতের সর্বত্র তার অবাধ বিচরণ। 'পূজা করে পাইনি তোরে মাগো / এবার চোখের জলে এলি / বুকের ব্যথায় আসন পাতা / বোস মা সেথা সুখ দুলালী।'

 

 'মহাকালের কোলে এসে / গৌরী হল মহাকালী' — এই গানটির মধ্যে একটা পৌরাণিক চেতনার পরিচয় নিহিত রয়েছে। গৌরী (অর্থাৎ দেবী দুর্গা) মহাকাল শিবের প্রভাবে মহাকালী রূপে আবির্ভূতা হন। যখন রক্তবীজ নামক অসুর দেবগণের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছিল, যাগ-যজ্ঞে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিল, হবি বন্ধ হবার উপক্রম তখন দুর্গার ক্রোধের ফলে তাঁর ভ্রু-যুগলের মধ্য থেকে দেবী কালীর জন্ম হয়। এই মহাকালী দেবী দুর্গার সংহারক রূপ। তিনি শ্মশানের ভস্ম ও রুদ্রাক্ষের মালা ধারণ করেন। মহাকালের কোলে এসে তিনি মহাকালী রূপে আবির্ভূত হন। দেবীর মাতৃরূপ থেকে সংহাররূপের এই পরিবর্তন কাজী নজরুল ইসলাম তার বিভিন্ন গানে তুলে ধরেছেন।

 

 শুধু মাতৃরূপে নয় কন্যারূপেও মা কালীকে দেখেছেন তিনি। এ কন্যা আমাদের সাধারণ ঘরে। এ কন্যা হেসে খেলে নেচে বেড়ায়। আমাদের আদরের দুলালী। কবিও বলেছেন — 'আদরিনী মোর শ্যামা মেয়েরে / কেমনে কোথায় রাখি'

 

  পরাধীন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য কাজী নজরুল ইসলামের কলম বারবার তরোয়াল হয়ে উঠেছে। তিনি দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের জন্য দেবীকে আহবান করেছেন। 'সদা শিবের মনোহরা' দেবী দুর্গার রূপককে কবি বিপ্লবীদের জাগরণের মন্ত্র তৈরি করেছেন। 'মন্দিরে দুর্গে রহে না সে বন্দী / সেই দুর্গারে দেশ চায়।' এই মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি মহামায়া , যিনি সর্বশক্তির আধার। এই পরমা প্রকৃতি জগদম্ভা। তিনি কখনও মহাসরস্বতী কখনও বা মহালক্ষ্মী। কবি নজরুল কখনও তাকে ভগবতীরূপে আবার কখনও ষোড়শীরূপে কল্পনা করেছেন। এই মা অচিন্ত্য পরমাত্মারূপিনী। তিনি অশুভনাশিনী। তিনি আবার মঙ্গলসাধিকা। মা তারা।

 

 কাজী নজরুলের সমগ্র জীবন সংগ্রামে পরিপূর্ণ। অভাবের সঙ্গে লড়াই করে তিনি বড় হয়েছেন। বিভিন্ন জায়গায় তাকে অপমানিত হতে হয়েছে। শুনতে হয়েছে শ্লেষ বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য। তিনি তার দুঃখের কথা দেবীর কাছে নিবেদন করেছেন। এই নিবেদন কখনও আবেগ, কখনও বা অভিমানে পরিপূর্ণ- 'আমায় যারা দেয় মা ব্যথা / আমায় যারা আঘাত করে/ তোরই ইচ্ছায় ইচ্ছাময়ী / আমায় যারা দেয় মা ব্যথা।' আবার 'আমার ভাবের অভাব লয় হয়েছে / শ্যামা ভাব সমাধিতে', 'তুমি সন্ধ্যা তুমি গায়ত্রী / তুমি জগদ্ধাত্রী গো মা / অকুলের ত্রাণকর্ত্রী'

 

নজরুল-রচিত 'আনন্দময়ীর আগমনে' মাতৃবন্দনা হলেও এর মধ্যে এক রাজনৈতিক চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। তার আর্তি —'দেব শিশুদের মারছে চাবুক,/বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,/ভূভারত আজ কসাইখানা/আসবি কখন সর্বনাশী?' 

 

 শ্যামা মায়ের প্রতি তারই শ্রদ্ধা, ভক্তি কেবল  কাগজে কলমে থেমে থাকে নি। তিনি প্রত্যক্ষভাবে শ্যামা মায়ের পূজা অংশ নিতেন। পুরুলিয়ার ভটচাজ বাড়ির কালীপুজোতে (৪০০ বছরের বেশি পুরোনো) তিনি প্রতি বছর আসতেন। বসে থাকতেন। গাইতেন শ্যামা সংগীত। 

 

 আসলে নজরুলের ছিলেন একজন উদারপন্থী মুক্তমনা স্বাধীনচেতা একজন মানুষ। তার কাছে ধর্ম-বর্ণ-বিভেদের উর্দ্ধে ছিল মানবিকতা। তার এই সমন্বয়পন্থী মনোভাবের জন্য বারে বারে মৌলবাদীরা তাকে আঘাত করেছে। অপমান করেছে কট্টর হিন্দুরাও। একসময় পূর্ববঙ্গে রেডিওতে নজরুলের শ্যামাসংগীত বাজানো নিষিদ্ধ ছিল। এত কিছুর পরেও নজরুলের ভাবাদর্শকে কেউ বিন্দুমাত্র টলাতে পারে নি। আজও বাংলার শিউলি ফুল পড়ে থাকা, নিকানো উঠানে নজরুলের এই মহামিলনের গান শোনা যায়। বাংলার ঐতিহ্যবাহী সুরের মিশ্রণে তার শ্যামাসংগীত অনেক বেশি আদ্রিত ও নন্দিত। তবে বর্তমানে কিছু বিভেদকামী, বিচ্ছিন্নবাদী মানুষ যখন সাম্প্রদায়িক বিভাজনে  মত্ত হয়ে, তখন কবি নজরুল যেন গুন গুন করে গেয়ে ওঠেন — 'ওমা, তোর ভুবনে জ্বলে এত আলো, আমি কেন অন্ধ হয়ে দেখি শুধু কালো?' আসলে এই ধরনের গানে এক হৃদয়-সংবেদী আবেদন রয়েছে। শ্যামাসংগীতকার নজরুলের অভিনবত্ব এখানেই। শ্রদ্ধেয় আজহারউদ্দীন খানের মন্তব্য দিয়েই শেষ করা যাক — "শ্যামাসঙ্গীতে রামপ্রসাদের পর যদি কাউকে স্থান দেওয়া যায় তাহলে তিনিই নজরুল।" ('বাংলা সাহিত্য নজরুল' : আজহারউদ্দীন খান পৃঃ-১৯০) 

                                       __________

 

ঋণ স্বীকার 

 

১। 'কাব্যগীতির ধারায় কাজী নজরুল ইসলামের স্থান':  করুণাময় গোস্বামী

২। 'পঞ্চোপাসনা' : শ্রীজিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়,

৩। 'বাংলা সাহিত্য নজরুল' : আজহারউদ্দীন খান

. শক্তি সাধনা ও শাক্ত গান: আঠারো শতকের সমাজ ইতিহাসের দায়বদ্ধতা : অরিন্দম অধিকারী

৫। 'নজরুল ও বাংলা শাক্ত-সংগীত' : পল্লব চট্টোপাধ্যায়

৬।  'নজরুল গীতি প্রসঙ্গ' করুণাময় গোস্বামী

৭। উইকিপিডিয়া 

 ----------------------------- 

ছবিঋণ - ইন্টারনেট।   

_____________

শৌনক ঠাকুর
 

গ্রাম + পোঃ - দক্ষিণখন্ড 

থানা - সালার 

জেলা  - মুর্শিদাবাদ 

ফোন - 8617899946




Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.