স্ট্রীট পোয়েট্রি ও স্ট্রীট লিটারেচার
তপন মাইতি
একটি নির্জন রাস্তা, একটি নিঃসঙ্গ রাতে আমার জীবন এগোতে না চাইলেও আমার স্ট্রীট পোয়েট্রি ও স্ট্রীট লিটারেচার যেন রাস্তার ধারে দেওয়ালগুলোতে এঁকে রাখে তার স্থান কাল পাত্রের জীবন্ত ছবি। সে যেন ফার্ম হাউস বা খামার বাড়ির বাস্তবিক ছবির মতো। প্রান্তিক মানুষের অবরুদ্ধ স্থানগুলো সব খুলে দেয় চোখের সামনে এক নিমিষে। উদ্ভুত করে গ্রাম গঞ্জ শহরের মেহনতি মানুষের সংগ্রাম। তুলে ধরে তার লুক্কায়িত জাগতিক সৌন্দর্যের নাড়ি নক্ষত্র। যার কেন্দ্রবিন্দু হল অতীতের স্মৃতিকথা। যার শেকড়গুলি ছড়িয় রয়েছে বাস্তবিক ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্যের অন্দরমহলে। সে বারবার ফিরে আসে ভ্রাম্যমান পাখিদের মতো। প্রেম কাহিনী, লাভ ক্ষতির রহস্য, সাধারণ মানুষের কথাবার্তা, চাল চলন হালহকিকৎ বাজার বৃত্তান্ত। খুঁজে পায় জনজীবনের ত্রিভূবন। অতীতের পরিত্যক্ত ভবন। সমসাময়িক ফুটপাত জীবন ও তাদের চরম সত্যতা, তাদের আবেগ অনুভূতি, বালিশে মুখ গোঁজা কান্না। তাদের অবিচ্ছেদ্য এবং অপ্রকাশিত জীবনের কার্পণ্য। ভাঙা কাচে ভিজে ওঠে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের কার্ডবোর্ড। একাকীত্বে ভোগা রাস্তার নিঃসঙ্গ নিয়ন আলোর ব্যাথাতুর গল্প, আনন্দ, ক্রোধ, আনুষঙ্গিক পোশাক পরিধান করে বসে আছে যেন সদ্য। স্ট্রীট পোয়েট্রির কবিতাগুলো আর স্ট্রীট লিটারেচারের গল্পগুলো যেন রাস্তার ভাষায় কথা বলে। গালিগালাজ দেয়। আঞ্চলিক ভাষায় হেসে ওঠে। এলাকাভিত্তিক দুঃখগুলো সমবেত ভাবে কেঁদে ওঠে। নিত্যনৈমিত্তিক দান প্রতিদিনের কথোপকথন ছন্দে প্রতিবাদ করে ওঠে। হরতালের মতো শ্লোগান দেয়। পায়ে পায়ে পা মেলায়। তাদের ভাষায় অনুরণিত হয় ট্যাক্সি ড্রাইভার, ফল বিক্রেতা, মুটে মজুর কুলি, সেলুন থেকে শপিংমল। যেন পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকেদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রতিটি কোনে কোনে আয়না ধরে স্ট্রীট লিটারেচার ও স্ট্রীট পোয়েট্রি। যা গণতান্ত্রিক করে তোলে। এখানে ডিগ্রির কচকচানি নেই। এখানে নেই সাহিত্যের বাঁধাধরা নিয়ম। এখানে যে কেউ অংশগ্রহণ করতে পারে। এখানকার কবি সাহিত্যিকেরা বিভিন্ন ব্যাক গ্রাউন্ড থেকে উদ্ভুত হতে পারে। যেমন ঘরহীন ছন্নছাড়া মানুষ, সরকারি বেসরকারি যেকোন কর্মজীবি, শিক্ষানবিস, শিল্পী বা অন্যান্যরা যা সকলের ভাষা গ্রহন যোগ্যতা পায়।
কবিতা গল্প যখন রাস্তায় নামে আমাদের অবাক করে। রাস্তার কথা বলে। সমসাময়িক জীবনের কথা বলে। কল্পনার জগতকে বাস্তবের মাটিতে দাঁড় করায়। ফুটপাতে কেউ আবদ্ধ হয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। কেউ আপনাকে বিরক্তি করছে। একে অপরকে তিরস্কার বা সম্মান জানাচ্ছেন। সকলকে রসিকতায় মশগুল করাচ্ছে কেউ হয়তোএকজন। কেউ সকলের কাছে হাসির পাত্র হচ্ছে। এসব অনুভব প্রকাশ করায় স্ট্রীট লিটারেচার বা স্ট্রীট পোয়েট্রি।
রাস্তার কবিরা প্রায়শই বিদ্রোহী চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। তাদের কর্তৃত্ব প্রশ্নে বিদ্ধ করে। দৈনন্দিন নিয়মাবলি এবং প্রান্তিক কন্ঠে প্রশস্তকরণ হয়। তাদের ক্ষেত্রগুলি প্রতিরোধের কাজগুলিতে পরিনত হয়। প্রতিকূলতার মুখে স্ট্রীট পোয়েট্রি বা স্ট্রীট লিটারেচার অব্যাহত রয়েছে।
বোরিং, অনুপ্রেরণা, স্ট্রোর ফ্রন্টের স্প্রেতে আঁকা ইস্তাহার। ফিসফিসানি ছড়া! কিংবা একটি অন্ধকার গলির আলোতে সবার সাথে ভাগ করে নিতে পারে অতিসাধারণ কিছু লোককথা। ভাগ করে নিতে পারে ক্যাফের কথ্যভাষা। বৃষ্টিতে ভেজা যাওয়া নিঃসঙ্গ কোন শষ্যকর্তনকারী মেয়ের শীষ ধ্বনি। ভরদুপুরে ঘেমে যাওয়া আইসক্রিম দোকানির হার্টবিট। দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ মানুষের অভাব অভিযোগ অনুনয় বিনয় সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, বেকারত্ব, অবক্ষয় সমাজের উত্তরনের দিশা দেখায় স্ট্রীট লিটারেচার বা স্ট্রীট পোয়েট্রি।
জটিল দুর্বোধ্য সময়ের মধ্য দিয়ে যাওয়া ক্লান্ত পথিকের জীবন বেতান্ত। এক ঝলকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া সহজ সরল জীবনের ইতিবৃত্ত। তাৎক্ষণিক খুঁজে পাওয়া অবসর সময়ের নাম। দাসত্ব পরাধীনতা অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার জন্ম দেয়। জেঁহাদ ঘোষণা করে। হাঁটতে হাঁটতে পথের কণ্ঠস্বর তোলে। হৃদয় গ্রাহী প্রাসঙ্গিক অসাধারণ সব না বলা কথা। মনছোঁয়া অভিব্যাক্তি। আবার ভাবতে শেখায় নতুন করে। অনুভব করতে শেখায় মূল্যবোধ। দেখতে শেখায় রাস্তায় ঘেমে ওঠা মানুষের কথা। এক নিমিষে বলে চলে বলমান বাস ট্রাম ট্রেন মেট্রো আকাশযানে সংগ্রামের কথা। সকলের মতো সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা। তাদের দুঃখ প্রকাশের কথা। ব্যক্ত করে তাদের মনের কথা। স্ট্রীট পোয়েট্রি বা স্ট্রীট লিটারেচার হল জনযানের বলার ভাষা। স্পষ্ট সত্য বলার প্ল্যাটফর্ম। চোখ রেখে কথা বলার সাহস দেখায়। বিচারহীন মানুষের বিচার চাওয়ার আবেদন নিবেদনের মাধ্যম হল স্ট্রীট লিটারেচার বা স্ট্রীটপোয়েট্রি। ক্ষমতা দম্ভের বিরুদ্ধেই প্রতিবাদের ভাষা হল রাস্তার কবিতা। ভাল মানুষের উত্তরণের পথ বলে দেওয়ার অপর নাম হল স্ট্রীট লিটারেচার। ব্যর্থ মানুষের সাফল্যের প্রবল প্রচেষ্টার নাম হল রাস্তার গল্প। নিপীড়িত শোষিত বঞ্চিত মানুষের দিশা দেখায় স্ট্রীটপোয়েট্রি বা স্ট্রীট লিটারেচার। খুঁটে খুঁটে তুলে আনে বাস্তব জীবনের রুজিরোজগার। জীবনের দায় বর্তায় তাই অনেকটাই। এলিয়েট সম্প্রদায়ে এসব কথা বলে। অস্থির দিশাহীন বাগ স্বাধীনতার কথা বলে। সুখ দুঃখের শরীখ হয়। লড়াই ও সংগ্রামের বীজমন্ত্র বপন করে। বুক চিতিয়ে বেঁচে থাকবার চাবিকাঠি হল স্ট্রীটলিটারেচার বা স্ট্রীট পোয়েট্র। যাদের হারাবার কিছু নেই তাদের সব কিছু বুঝে নেওয়ার সাক্ষ্য বা দলিল স্বরূপ স্ট্রীট লিটারেচার বা স্ট্রীট পোয়েট্রি
তাই আমার মনে হয় এই অবক্ষয় জটিল বহুমুখী অস্থিরতার যুগে স্ট্রীট লিটারেচার বা স্ট্রীট পোয়েট্রি এক বিপ্লব বা নবজাগরণ ঘটাতে পারে।
=====================
ছবিঋণ - ইন্টারনেট।
