রিভিউ ।। পত্রিকা: নবদিশারী ।। পর্যালোচনা: গোবিন্দ মোদক
পত্রিকা: নবদিশারী
পর্যালোচনা: গোবিন্দ মোদক
নবদিশারী একটি ত্রৈমাসিক বিশুদ্ধ সাহিত্য পত্রিকা যেটি ৩৭ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে নদীয়া জেলার রানাঘাট থেকে। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক লক্ষ্মণ চন্দ্র মল্লিকের প্রয়াণের পর পত্রিকা সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন বর্তমান সম্পাদক রাজেশ দাস। রাজেশ দাসের সুযোগ্য সম্পাদনায় সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে নবদিশারীর বর্ষা সংখ্যা- ১৪৩১। ৪২টি সুনির্বাচিত কবিতা, ছ'টি গল্প, তিনটি অণুগল্প এবং দু'টি মূল্যবান প্রবন্ধ নিয়ে সেজে উঠেছে নবদিশারীর বর্তমান সংখ্যাটির (বর্ষা সংখ্যা-১৪৩১) সাড়ে তিন ফর্মার অবয়ব।
যেহেতু এটি বর্ষা সংখ্যা সেইহেতু বর্ষা এবং বৃষ্টি বিষয়ক কবিতা বেশি প্রাধান্য পেলেও অন্যান্য স্বাদের কবিতাও কম নেই। শুরুতেই 'দূরের বর্ষা' কবিতায় কবি হীরক বন্দ্যোপাধ্যায় বৃষ্টির সুরকে বেঁধে দিয়েছেন অনন্য আঙ্গিকে –
ভিজে ভিজে কতবার বৃষ্টি হয়েছি
দেখেছি বৃষ্টির চলে যাওয়াটুকু
যাওয়া যে এতোই কঠিন
পাওয়ার চেয়েও তার তীব্র অভিলাষা।
কবি শ্রাবন্তী বিশ্বাসের কবিতায় তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের ওপর সে বৃষ্টিদানা জোনাকি হয় আর বৃদ্ধ রাত শান্ত হয়ে দেখে উপকূল ভাঙার আলপনা।
কবি অমিত কাশ্যপের 'মায়াজাল' কবিতায় আবার অন্য স্বাদ –
শ্রাবণের মেঘে আকাশ ছাওয়া, তুমি আনমনা হও
ঝুরুঝুরু বৃষ্টির একটা ঘ্রাণ, হাত রাখো
এখন শ্রাবণের, বৃষ্টির কত গান মনে ভাসছে
রবীন্দ্রনাথ সব ঋতু সাজিয়ে রেখেছেন …
কবি অনিন্দ্য সরকার তাঁর 'স্মৃতির শহর' কবিতায় আবার বৃষ্টি দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন অনন্য ভঙ্গিতে –
ঝমঝমিয়ে বর্ষা এলো এই শহরের বুকে
একটু না হয় ভাঙলে তুমি ধনুর্ভাঙ্গা পণ,
কষ্টগুলো যাক না ধুয়ে, একটু থাকি সুখে
এই শহরের বৃষ্টি দেখার রইলো নিমন্ত্রণ!
এভাবেই কবি গৌতম ঘোষ দস্তিদার, তন্ময় কবিরাজ, সুতপা রায় চক্রবর্তী, শ্যামল দাঁ, বিজুরিকা চক্রবর্তী, অষ্টপদ মালিক, প্রশান্ত কুমার মন্ডল, সঞ্জয় চক্রবর্তী, অমিতাভ দে, মিলন হাঁড়া, গৌরীশংকর দাস প্রমুখ কবি তাঁদের বলিষ্ঠ কলমে উপহার দিয়েছেন ফিরে পড়বার মতো বর্ষা বিষয়ক কবিতাসমূহ। কবি হরিসাধন জোয়ারদারের 'বর্ষার কড়চা' শীর্ষক কবিতাটিও পাঠকের মন জয় করতে সক্ষম হবে।
এছাড়াও কবি শুভজিৎ মাইতির অনবদ্য দু'টি বর্ষা বিষয়ক কবিতা পত্রিকাটিকে প্রকৃত অর্থই ঋদ্ধ করেছে। বিশেষ করে কবি যখন তাঁর দ্বিতীয় কবিতায় লেখেন –
"তেমন করে কোন কিছুই চিরকালীন নয়
আটকে রাখার চেষ্টাও করেনি কেউ
তবু আমি ভুলে যেতে চাইলেই
ঘরের ভেতর সর্বনাশী বৃষ্টিতে তুমুল ভিজিয়ে দিচ্ছে
জানলা গলে ঢুকে আসা প্রপঞ্চক মেঘ!
আমার অগোছালো মায়াকাব্যের
পান্ডুলিপি জুড়ে যখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে
মাটির নিজস্ব অ্যারোমায়
আরোও বেশি গাঢ় হচ্ছে পাথর প্রতিমা …"
তখন তা ভিন্নমাত্রা পায়।
বর্ষা বিষয়ক কবিতা ছাড়াও অন্যান্য বিভিন্ন ছাঁদের এবং স্বাদের কবিতায় বলিষ্ঠ লেখনীর স্বাক্ষর রেখেছেন কবি সুভব্রত আচার্য্য (কম্বোজ), কবি স্নিগ্ধা দে রিঙ্কু (বারবার জন্ম নিতে পারি), কবি শঙ্খজিৎ (বাতাসে উড়ন্ত খই), কবি ডঃ কল্যাণ কুমার সরকার (মৌমিতা তোমাকে), কবি সুতপা দাস (একাকীত্ব), কবি অমিত পাল (তোমার প্রেমের স্বাদ), কবি সবুজ মোদক (স্বাধীনতা), কবি সবুজ পরিমল (অনন্যোপায়), কবি রবীন্দ্র কুমার হালদার (প্রকৃতি হোক ধন্য), কবি সুব্রত আচার্য (মুদ্রা ভাঙার শব্দ), কবি অরুণ কুমার সরকার (অনাকাঙ্খিত ছদ্মবেশ), কবি রতন দেবনাথ (অন্য কিছু অন্য কেউ), কবি অমিতাভ ঘোষ (জীবনতলি), কবি শ্যামল গোস্বামী (আসবে নতুন ভোর), কবি রণজয় মালাকার (গোপন হিসাবের খাতা), সৌভিক রায় (জৈবনিক) প্রমুখ।
পত্রিকার গদ্য বিভাগটিও অত্যন্ত বলিষ্ঠ। কবিরুল রঞ্জিত মল্লিক উপহার দিয়েছেন মুক্তি শীর্ষক একটি অনবদ্য গল্প। স্বপন জাইদারের হীরের নাকছাবি, শাশ্বত বোসের বিপ্লব একটি পাখির নাম, পিন্টু সর্দারের দিনের শেষে – গল্পগুলি পাঠকের মন কাড়বে। গল্পকার সুদাম কৃষ্ণ মন্ডলের সে সুর গল্পটিও পাঠক বহুদিন স্মরণে রাখবেন। একই কথা প্রযোজ্য সূর্যোদয় রায় রচিত আনন্দধাম গল্পটির ক্ষেত্রেও। অণুগল্পের আঙিনায় বলিষ্ঠ লেখনীর জাত চিনিয়েছেন সুভাষ বসু (ভাগ্যলিপি), বিদ্যুৎ ভান্ডারী (শেষ প্রহর) এবং সুমিতা চৌধুরী (দগ্ধ শ্রাবণ)।
পত্রিকায় রয়েছে দু'টি মূল্যবান প্রবন্ধ যে দু'টি পত্রিকার অন্যতম সেরা সম্পদ। রবিব্রত ঘোষের কলমে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বর্ষা শীর্ষক প্রবন্ধটি প্রকৃত অর্থেই মূল্যবান যা সর্বস্তরের পাঠককেই মুগ্ধ করবে, সৌমেন্দু দত্তের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ প্রবন্ধটিও অত্যন্ত মূল্যবান এবং সুপাঠ্য।
পত্রিকাটির ভিন্নধর্মী প্রচ্ছদটি এঁকেছেন পুষ্পেন্দু রায়, তাঁকে অনেক ধন্যবাদ। আর উৎকৃষ্ট কাগজে ঝকঝকে নির্ভুল ছাপা সংখ্যাটির জন্য অবশ্যই ধন্যবাদার্হ হবেন সম্পাদক রাজেশ দাস মহাশয়। পত্রিকার পরবর্তী সংখ্যার (শারদীয়া) জন্য তাকিয়ে থাকাই যায়।
পত্রিকা: নবদিশারী
(বর্ষা সংখ্যা - ১৪৩১)
সম্পাদক: রাজেশ দাস
প্রকাশিকা: সুবাসনা মল্লিক
মূল্য - ৩০ টাকা
===============================
প্রেরক: গোবিন্দ মোদক।
সম্পাদক: কথা কোলাজ সাহিত্য পত্রিকা।
রাধানগর, ডাক- ঘূর্ণি, কৃষ্ণনগর, নদিয়া।
পশ্চিমবঙ্গ, ডাকসূচক - 741103