Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প ।। বিদেশী পাখি ।। ঋভু চট্টোপাধ্যায়

            
       

            

  বিদেশী পাখি  

  ঋভু চট্টোপাধ্যায় 


   সৌমেন্দু গ্যারেজের চাবিটা খুলতে খুলতেই একবার বাঁদিকটাতে তাকালোবোসকাকুর বাড়ি না! এই সময় তো  পাড়াটাতে এত লোক থাকে নাএতদিন এই পাড়াটাতে আসছে, দিনে হোক বা সন্ধে বেলা, পাড়াটাতে কেউ কারোর সাথে মেশে নাকথাগুলো মনে এলেও আর বেশি এই সব কথা চিন্তা না করে রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকল যাক এখনো কেউ আসেনি,এলেই সব বসা নিয়ে ঝামেলা করতে আরম্ভ করবেআসলে ওদেরও দোষ দেওয়া যায় না এত বড় গ্যারেজেও মাত্র একটা টেবিল ফ্যানেরই অ্যারেঞ্জ করতে পেরেছে, তাও একটা টিনের চেয়ারে বসিয়ে রাখা আছে, কোন দিকেই এখন আর ঘোরে না সোজা যে বসতে পারে সেই হাওয়া পায়, না হলে ঘেমে মরে কখনো কখনো নিজেই উঠে নিজের মত ফ্যানটা ঘুরিরে নেয়মাঝে মাঝে কয়েক জন চেল্লায়ও খুবএই তো কয়েকদিন আগেই ক্লাস নাইনের প্রিয়াঙ্কা বলেই দিল,'স্যার আপনি খুব কিপটে, কবে থেকে একটা ফ্যান কিনতে বলছি শুনছেনই না' সৌমেন্দু আর তাকে বলতে পারেনি, মাসের প্রথমে আর কিছু হোক আর না হোক বাবার ওষুধের জন্য মায়ের হাতে আগে পাঁচটি হাজার টাকা তুলে দিতে হয়, তারপরে তো সংসার খরচ আলাদা আসলে টিউসনের তো কোন নির্দিষ্ট দিনে মাইনের ব্যবস্থা নেই তাই আসুবিধা হয়ই। কিছু টাকা আগে থেকে আপদ বিপদের জন্যেও রাখা থাকে। মাসের শেষে মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে সিগারেট কেনারও পয়সা থাকে না। তবে একটা ভরসা আছে, একটা চাকরি পাকা হয়ে আছে, কোর্ট কেসের জন্য এই মুহুর্তে নিয়োগটা হয় নি। সৌমেন্দু এই সব ভাবতে ভাবতেই গ্যারেজের মেঝেতে একটা শতরঞ্জি পেতে বাইরে দাঁড়াতেই কয়েকজন ছাত্র এসে গেটের কাছে সাইকেল রাখতে রাখতে বলে উঠল, 'স্যার শুনেছেন, ঐ বুড়োটা মরে গেছে।'

সৌমেন্দু অবাক হয়,'কোন বুড়ো?'

–সেই যে এদিক দিয়ে পেরিয়ে যাবার সময় আপনাকে একবার 'কি মাস্টার' বলে ডেকে যেতেন।  

সৌমেন্দুর এবার ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। ঐ জন্য ওখানটাই কয়েকজন  ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন

–তোকে কে বলল?

-আমি তো ওখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম।

সৌমেন্দু একবার ভিড়টার দিকে দেখে গ্যারেজের ভিতর ঢুকলবাকি ছাত্র ছাত্রীরা একে একে ভিতরে যাওয়ার পরেও সৌমেন্দু পড়ানো আরম্ভ করেনিতবে বেশ কয়েক জন পেমেন্ট দিল, সৌমেন্দু প্রতিবারের মত সবাইকে পেমেন্টের খাতাতে মাস, এমাউন্ট, ডেট সব লিখিয়ে একবার গুনে নিলচারহাজার বাবার টেস্টগুলো হয়ে যাবেবাবার রিটার্য়াডমেন্টের পর টিউসনির এই পেমেন্টগুলোই যা ভরসা, তাও ভগবানের আশির্বাদে এই অঞ্চলে পড়ানোতে সৌমেন্দুর খুব নাম কয়েকবছর ধরেই বেশ ভালো রেজাল্টের পাশে অনেকেই এঞ্জিনিয়ারিংএ চান্স পেয়েছে কিন্তু আজ পড়ানোতে ঠিক মন এল না শেষ কবে বোসকাকুর সাথে দেখা হলও গত বৃহস্পতিবারগ্যারেজের পাশ দিয়ে পেরিয়ে যাবার সময় প্রতিবার সৌমেন্দুকে দেখতে পেলেই,'কি মাস্টার?'বলে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেনই। গত বৃহস্পতিবারেও দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন। অবশ্য কথা বললে তার বেশির ভাগটাই ছেলের কথাই থাকত।

সৌমেন্দুর কয়েকমাস আগের কথা মনে এল।পড়াতে পড়াতে কোন কারণে খুব ঘুম আসবার জন্যে বাইরে চা খেতে বেরিয়েই প্রথম বার ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়। সৌমেন্দুকে দেখে একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন,'এই পাড়াতে আগে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না, কোথায় থাকা হয়?'

–আমি এইপাড়াতে থাকি না, পড়াতে আসি

-পড়াতে! কাদের বাড়ি?

-কারোর বাড়ি নয় আমি একটা রুম ভাড়া নিয়ে পড়াই, বাইরের স্টুডেন্ট আসে

কাদের বাড়ি ?

- আচার্যকাকুদের, রুম মানে গ্যারেজটা ভাড়া নিয়েছি

–অ, ভিড় দেখিতা কোন সাবজেক্ট পড়ানো হয়?

-ফিজিক্স।

–ফিজিক্স! চাকরি বাকরি জোটেনি নাকি?

–একটা চাকরি পেয়ে আছি এখনো কাউস্নিলিং হয় নি, কেস হয়ে আছে।

–কেস তো, ও হবে না।

–যত দিন না হয় ততদিন টিউসন করে যেতে হবে।

-আমার ছেলের নাম শুনেছ? এপাড়াতে সবাই চেনে। বিদেশে থাকে, কয়েকবছর জার্মানিতে আছে, তার আগে ফ্রান্সে ছিল। আই.আই.টি, ফাস্ট বারেই চান্স পেয়েছিলএখন কত বেতন জানো, কোন ধারনা নেই তোমাদের।

–না আমি ধারনা করতেও চাইছি না। ঠিক আছে আমি আসি, স্টুডেন্টরা বসে আছে তো।

এরপরেও যতবার দেখা হয়েছে ঘুরে ফিরে সেই এক কথা, ছেলে ছেলে আর ছেলে।তবে আজ সব শুনে সৌমেন্দু একবার গ্যারেজের বাইরে বেরিয়ে মাকে ফোন করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে মা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, 'এরকম তো কোনদিন জিজ্ঞেস করিস না, কিছু হয়েছে?'

আমতা আমতা করে সৌমেন্দু পুরো ঘটনা বলতেই মাও একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল,'ওরকম ছেলের মুখে আগুন, বাবা-মাই তো বড় করেছে, শেষ জীবনটা ছেলে মেয়ে না দেখলে কে দেখবে?'

 এক জন বাদে সব ছাত্র ছাত্রী এসে গেছে। সৌমেন্দু আর কথা না বাড়িয়ে আস্তে আস্তে পড়ানো আরম্ভ করলএক  ছাত্রী ভদ্রলোকের মারা যাবার কথা শুনে বলে উঠল, 'স্যার ঐ বুড়োটা মরেছে তো? বেশ হয়েছে, খালি আপনাকে পিন করে কথা শোনাতো।'

কথাগুলো সত্যি হলেও বাবার বয়সি একজন এরকম ভাবে মারা যাওয়ার ঘটনা খুব দুঃখজনক, ছাত্রীটিকে বোকল কিন্তু সৌমেন্দুর পড়ানোতে মন এল না। থার্মোডায়নামিক্সের কয়েকটা প্রবলেম দিয়ে গ্যারেজের বাইরে বেরিয়ে আসতেই দেখল বাড়িওয়ালা আচার্য কাকু সেই সময়ে  বাড়িতে ঢুকছেনসৌমেন্দুকে দেখে বলে উঠলেন,'দেখেছো, কি রকম সমস্যা, সুস্থ সবল মানুষ, আজ শুনছি মারা গেছেন'

-কি হয়েছিল কিছু বোঝা গেল?

-কি ভাবে বুঝবো, ওনার মিসেস তো কয়েক বছর আগেই গত হয়েছেনএকমাত্র ছেলে সে বাবু এখন বিদেশে একটি মেয়ে প্রতিদিন সকালে এসে একবেলা রান্না করে যেত, তাই দুবেলা খেতকোন দিন রাতে হোম ডেলিভারির থেকে খাবার নিতঐ রান্নার মেয়েটাই এসে দেখে দুদিনের পেপার দরজার বাইরে পড়ে আছে, একদিন নাকি মেয়েটি আসতে পারেনি, তবে সব রান্না ফ্রিজে রেখে গেছিলআজ এসে কয়েক বার ডাকার পর সাড়া না পেয়ে পাড়ার লোক ডাকেএখন দেখি ডাক্তার আসে, নাকি পুলিশ এসে বডি নিয়ে যায়

আর কোন আত্মীয় স্বজন নেই ?

-এটা ঠিক জানি না, তবে পাশের বড়ির রায় বাবু বলছিলেন কে নাকি এক বোন আছে, মাঝে মাঝে আসেও, কিন্তু পুলিশ না এলে তো কিছু বলা যাবে না

পুলিশ এখনো আসে নি ?

-না গো, আজ কোথায় একটা বড় অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে, থানাতে ফোন করা হয়েছিল, আসতে একটু দেরি হবে বলল সৌমেন্দু আর কিছু না বলে একটা লম্বা শ্বাস ফেললআচার্য কাকু বাড়ির ভিতরে চলে গেলে সৌমেন্দু আস্তে আস্তে গেটের বাইরে  এসে দেখল ভিড়টা একটু পাতলা হয়েছেমোড়মাথাতে একটা চায়ের দোকানে সৌমেন্দু চা বিস্কুট খেতে গেলদোকানটাতেই বোস কাকুর সাথে প্রথম আলাপ হয়তারপর মাঝে মাঝেই কথা হতসৌমেন্দু দোকানির থেকেও কিছু খবর পেলফিরে আবার গ্যারেজের ভিতর ঢুকতে যাবে এমন সময় দেখে ঘর থেকে আচার্য কাকু খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসছেনসৌমেন্দুকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করবার আগেই বলে উঠলেন,'কাউন্সিলার এসেছেন, তাই সবাই ডাকছে দেখি পুলিশ আর কাটা ছেঁড়াটার হ্যাপাটা আটকানো যায় কিনা?'

সৌমেন্দু, কাকুর রাস্তা ছেড়ে গ্যারেজটাতে ঢুকে প্রবলেম গুলো চেক করতে আরম্ভ করলকিছু সময় পরে আচার্য কাকু বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে সৌমেন্দুকে দেখে বলে উঠলেন,'পুলিশের ঝামেলাটা মিটল বুঝলে, আমাদের কাউন্সিলার নিজের দায়িত্বে সবকিছু ব্যবস্থা করলেন পাশেই এক ডাক্তার বাবু থাকেন উনিই ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দেবেন'

-ওনার আত্মীয় স্বজনদের ফোন করলেন, ঐ যে কে বোন আছে বলছিলেন

ও তো অনেক দূরে থাকে, আসতে পারবে না, জানিয়ে দিল

আর ওনার ছেলে

-ওকেও ফোন করা হয়েছিল, আসবে না, তবে টাকা পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে দেবে বলেছেকাজ কর্মের যাতে কোন ত্রুটি না হয় সে ব্যাপারটাও দেখতে বলেছে কিন্তু মুশকিল হল এত দূর থেকে সব কিছু কিভাবে সামলাবে,  কিভাবে টাকা পাঠাবে, কারোর অ্যাকাউন্টে অতগুলো বিদেশী টাকা পাঠানোও সম্ভব নয়কিন্তু এখানেও বা কে কাজ কর্ম করবেধর আজকেই গাড়ি ভাড়া, পুরোহিত, দশকর্মা, তারপর চুল্লির খরচ, সব মিলে হাজার তিন, কে দেবে? তাছাড়া একটা আধটু শ্রাদ্ধ শান্তিও করতে হবে পাড়া থেকে কিছুটা না হয় চাঁদা তোলা হবে, কাউন্সিলার কিছু দেবেন বললেন, কিন্তু বাকি? সেটা কে দেবে? আবার আরেকটা সমস্যাও আছে, একজন গরিব মানুষ মারা গেলে তার কাজের জন্য লোকে দু এক টাকা দেবে কিন্তু বোসদার জন্য কেউ কেন দেবে? আমরাও বা কাউকে কিভাবে বলব? যার ছেলে বিদেশে থাকে, মাসে যার কয়েক লক্ষ টাকা রোজগার তার কিনা পারলৌকিক কাজ হচ্ছে পাড়ার লোকের কাছে চেয়ে চিন্তে, এটা খুব ভাবনার ব্যাপার।

সৌমেন্দু সব কথাগুলো এক ভাবে শুনতে শুনতে বাবার কথা মনে পড়ল।ও নিজেও একমাত্র ছেলে, বাড়ির অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু নিজেও মা বাবাকে ছেড়ে চাকরি নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবার ব্যাপারে ভাবতে পারেনিএই কথাগুলো শুনে আবার বোসকাকুই একদিন হেসে হেসে বলে উঠেছিলেন,'তুমি একটা বোকা ছেলে, এই দেশে কিছু আছে নাকি, বিদেশে যাও, এই তো বয়স, দু'হাতে রোজগার কর, তবে তো ভবিষ্যৎ তৈরী করতে পারবে?'

–অর্থাৎ ভবিষ্যৎ মানে শুধু টাকা রোজগার?

 'এই দ্যাখো, আবার মোবাইলটা ভুললাম।' কথাগুলো বলেই আচার্যকাকু তাঁর নিজের বাড়ির ভিতর যেতেই সৌমেন্দু সব ছাত্র ছাত্রীদের ছেড়ে গ্যারেজের চাবি দিয়ে বাইরের গেটে দাঁড়াতেই আচার্যকাকু তাড়াতাড়ি নেমে বোসকাকুর বাড়ির দিকে যেতেই পিছন থেকে সৌমেন্দু বলল, 'কাকু, একটা কথা বলছিলাম, আমি যদি ওনার জন্য কিছু টাকা দি,  নেবেন?'

-আচার্যকাকু একটু চমকে উঠলেন,'তুমি দেবে! কেন?'

–আসলে কাকু আমার সাথে খুব কথা বলতেন, কাকিমার কথা, ওনার ছেলের কথা সব আলোচনা করতেন, আমার খুব খারাপ লাগছে।

-ঠিক আছে তোমার যখন এতই ইচ্ছে, যা পারো দাও।

সৌমেন্দু পকেট থেকে সেদিনের ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া পেমেন্টের টাকাগুলো বের করে আচার্যকাকুর হাতে দিয়ে বলল, 'এই যে কাকু।'

–কত দিলে গো?

–চার হাজার টাকা,এর মধ্যে আজকের খরচ আশা করি হয়ে যাবে।

আচার্য কাকু কিছুসময় চুপ থেকে বলে উঠলেন,'কিন্তু তোমার বাবাও তো অসুস্থ, তাঁর ওষুধের খরচা সব সামলানো যাবে তো?'

-সে আপনি ভাববেন না, আপনাদের আর্শীবাদে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে কাউকে কিছু বলবেন না। আপনারা এগোন আমিও যাচ্ছি, কাকুকে তো আর কোন দিন দেখতে পাবো না।

আচার্য কাকু আরো কিছু বলতেন কিন্তু ততক্ষণে বোসকাকুর ঘরের সামনে দাঁড়ানো সবাই  বলে উঠলেন, 'আচার্যদা আসুন এবার তো বেরোতে হবে।'

সৌমেন্দু বাইকটা স্ট্রার্ট করতে যাবে এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল পকেট থেকে বের করেই দেখল,   'মা কলিং।'

***************************************************************************************

Sougata Chatterjee

B1-85/1, V.K.Nagar, M.A.M.C, Durgapur-713210

Paschim Bardhaman

Phno-9002157241/9732381127

Email-wribhuwriter.dgp@gmail.com

 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.