Click the image to explore all Offers

গল্প।। বেস্ট ফ্রেন্ড ।। অঞ্জনা দেব রায়

 

 


 

 বেস্ট ফ্রেন্ড

অঞ্জনা দেব রায় 


 কুটি সকাল দশটা বাজতেই মাকে ডেকে বলল  ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়েছেমা রান্নাঘর থেকে বলল হ্যাঁ  হয়েছে টেবিলে চলে আয় আমি দিচ্ছি কুটি ড্রেস করে খাবার টেবিলের কাছে বসল কুটির মা ব্রেকফাস্ট টেবিলে দিয়ে কুটির দিকে তাকিয়ে বলল সকালবেলা ভাল জামা পড়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, লেখা পড়া নেই ? কুটি মাকে বলল 'তুমি তো জান মা দুদিন শিবানীদের বাড়ি না গেলে আমার ভাল লাগে না আর এখন কলেজ ছুটি আছে ,তাই যাচ্ছি তুমি চিন্তা করবে না,আমি বই খাতা নিয়ে যাচ্ছি  শিবানীদের বাড়িতে গিয়ে দুজনে একসাথে লেখাপড়া করব আর একটু আড্ডা দেব দেখবে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে আসব কুটির মা বলল' তুই শিবানীদের বাড়ি গেলে কখনো তাড়াতাড়ি বাড়ি এসেছিস? সেই দুটো না বাজলে তো বাড়ি ঢুকবি না কুটি  মাকে জড়িয়ে ধরে বলল ' মা  তুমি বেশ ভালোই জানো ছোটবেলা থেকে আমি বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে ভালোবাসি আর শিবানী হল আমার 'বেস্টফ্রেন্ড',  ওর সাথে কথা না বলতে পারলে আমার খুব মন খারাপ হয়ে যায় '  এই কথা শুনে  মায়ের প্রশ্নের শেষ নেই , সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বসল 'তোর তো অনেক বন্ধু, তাহলে শিবানী শুধু 'বেস্টফ্রেন্ডকেন ? আর অন্য বন্ধুরা বেস্ট নয় কেন ? মার কথা শুনে কুটি বলল " আমি এখন যে কথাগুলো বলছি সেই কথা শুনলেই বুঝতে পারবে শিবানী কেন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড

 আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যেমন অক্সিজেনের প্রয়োজন হয় ঠিক তেমনি প্রয়োজন হয় ভালো বন্ধুর  বন্ধুত্ব হলো বিশ্বাস , ভালবাসা, শ্রদ্ধা এবং সহযোগিতা দিয়ে তৈরি একটি পবিত্র সম্পর্ক বন্ধু মানে শুধু মজা করা বা আড্ডা করা নয় , বন্ধু মানে একে অপরের খুশিতে খুশি হওয়া , একে অপরের দুঃখে পাশে দাঁড়ানো বন্ধুত্ব হয় দুটো সুন্দর মনের মধ্যে  আর বন্ধু শব্দটার আমার কাছে একটা অন্য অর্থ আছে সেটা হল খুব খুব দৃঢ় একটা বন্ধন যেটা অনেক সময় নিজের ভাই বোনের থেকেও বেশি হয়ে থাকে আসলে বন্ধুত্বের বন্ধু কথাটাই হয়তো এসেছে বন্ধন থেকে যার অর্থ বেঁধে রাখা অর্থাৎ একে অপরকে ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধে রাখা বিপদে আপদে সাহায্য করা আর এইরকম বন্ধু কিন্তু সবার জীবনে আসে না হ্যাঁ মানুষের জীবনে অনেক বন্ধু আসে কিন্তু বেশিরভাগ বন্ধুই সত্যিকারের বন্ধু হয় না ,তারা হয় সুসময়ের বন্ধু কিন্তু আমার জীবনে এসেছে  সত্যিকারের বন্ধু  সত্যিকারের বন্ধুর সঙ্গে কথা বললে কখন যে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কেটে যায় বোঝা যায় না আর 'বেস্ট ফ্রেন্ডহল এমন একজন  যার কাছে সব সিক্রেট কথা বলা যায় আবার মন খারাপ হলে  বেস্টফ্রেন্ডের সাথে কথা বললে মনটা ভাল হয়ে যায় তাই শিবানীর সাথে দু'দিন কথা না বললেই মনটা ভাল লাগে না জেসিকা, পূর্ণিমা , জ্যোৎস্না এবং রত্না এরা আমার খুব ভাল বন্ধু তবে শিবানী হল আমার  স্কুল লাইফের বন্ধু আর ওর সাথে আমার মনের এতটাই মিল  যে অন্য কোনো বন্ধুর সাথে নেই এবং কোন শর্ত ছাড়াই দুজন দুজনকে ভালবাসি  জানো তো মা পৃথিবীতে বন্ধু অনেক পাওয়া যায় কিন্তু প্রকৃত বন্ধু কমই হয় নামেমাত্র বন্ধু সুসময়ে পাশে থাকে আর দুঃসময়ে ঠিক পালিয়ে যায়  প্রকৃত বন্ধু সুখে দুঃখে সবসময় পাশে থাকে আর যার বন্ধু নেই এ পৃথিবীতে  সে সত্যি  খুব একা একজন প্রকৃত বন্ধু মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয় যদিও বর্তমানে এই স্বার্থপরের দুনিয়ায় প্রকৃত বন্ধু পাওয়া খুব মুশকিল কিন্তু আমি খুব ভাগ্যবান যে শিবানীর মত সত্যিকারের বন্ধু আমার জীবনে আছে মা শুনে বলল  "ঠিক আছে বাবা ,এখন আমি বুঝতে পেরেছি শিবানী কেন তোর 'বেস্টফ্রেন্ড' তাহলে তুমি যেমন শিবানীদের বাড়িতে যাও তেমনি শিবানীকেও আমাদের বাড়িতে আসতে বলবে আমি তোমাদের ভাল ভাল খাবার বানিয়ে দেব আর তোমরা দুজনে একসাথে বসে লেখাপড়া করবে ও মাঝে মাঝে আড্ডা দেবে আমার তাহলে বেশ ভাল লাগবে "

মায়ের কথামত দুদিন কুটি শিবানীদের বাড়ি গেলে পরের দুদিন আবার শিবানী  কুটিদের বাড়ি আসত  এইভাবে বি এস সি, বিএড পর্যন্ত একসাথে পড়াশুনা করার পর শিবানী ওকালতি পড়তে চলে গেল আর আমি  কুটি  চাকরির জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম দুজনে যতই ব্যস্ত থাকতাম  সপ্তাহে তিনদিন দেখা করতাম আর রবিবার যে কোনো একজনের বাড়িতে বসে আড্ডা দিতাম , কখনো একসাথে সিনেমা দেখতে যেতাম এইভাবে বেশ চলছিল বন্ধুত্ব আমাদের কিন্তু হঠাৎ করে আমার বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলল শিবানী আমাদের বাড়ির প্রত্যেকটা অনুষ্ঠানে থাকত আর আমার বিয়েতে তো সবসময় আমার পাশে ছিল আমার শ্বশুরবাড়িটা খুব দূরে ছিলো না বলে বিয়ের পরেও আমরা দুই বন্ধু দেখা করতাম শিবানী আমার শ্বশুর বাড়িতেও আসত এইভাবে আমাদের বন্ধুত্ব একইভাবে চলছিলো কিন্তু বিয়ের পাঁচ বছর হতে না হতেই আমার বর বদলি হয়ে গেল শিলং এ ফলে আমাকে বরের সাথে শিলঙে চলে যেতে হল কিন্তু দুর্ভাগ্য  শিলং যাওয়ার পর থেকে শিবানীর সাথে  আমাদের দেখা কিংবা  কথা হয় নি তখন আমাদের কারোর কাছে মোবাইল ফোন ছিল না ফলে যোগাযোগ ছিল না কিন্তু যেখানেই থাকতাম শিবানীকে কখনো ভুলি নি , সবার কাছে শিবানীর গল্প করতাম শিলং থেকে চার বছর পর কলকাতায় ফিরে শুনলাম শিবানীর বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু তখন মোবাইল ফোন হয়েছে আমার তবুও যোগাযোগ করতে পারি নি বেশ কয়েক বছর পর  আমার বাবা চলে গেল না ফেরার দেশে বাবা চলে যাওয়ার কিছু বছর পর মাও চলে গেল না ফেরার দেশে  তারপর বেশ কিছু বছর বাদে শিবানীর ভাইপোর কাছ থেকে ফোন নাম্বার জেনে ২০২০ সালে শিবানীর সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম   দীর্ঘ ২০ বছর পর ২০২০সালের এপ্রিল মাসে যখন শিবানীকে ফোন করলাম তখন ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে শিবানী বলে উঠলো হ্যালো কে বলছেন ? যেই না আমি বললাম কুটি বলছি , কেমন আছিস ? আমি যেমন খুশি হয়েছি তেমনি শিবানীও খুব খুশি দুই বেস্ট ফ্রেন্ড মিলে কত কথা এক ঘন্টা ধরে কথা যেন শেষ হতেই চায় না প্রতি মাসেই আমরা অনেক সময় ধরে স্কুলজীবন, কলেজ  জীবনের কত স্মৃতির কথা বলেই চলতাম এরমধ্যে কলেজের বন্ধু জ্যোৎস্নার সঙ্গে যোগাযোগ হল আমরা তিনজনে ঠিক করলাম 'করোনা' কমে গেলে দেখা করব ও খুব আড্ডা দেব কিন্তু দুর্ভাগ্য শিবানীর সাথে আর দেখা করা হলনা মানে দেখাকরা যাবে না কারণটা বলতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তবু বলছি , ২০২১সালের এপ্রিল মাসের শেষে আমরা কত গল্প করলাম কিন্তু মে মাসের প্রথম দিকটায় করোনার ভ্যাকসিন দেব বলে ব্যস্ত থাকায় শেষের দিকে ২৬ কি ২৭ তারিখ নাগাদ শিবানীর কথা খুব  মনে পড়ছিল মেয়েকে বলছিলাম শিবানীকে একটা ফোন করব, কতদিন কথা হয় না .২৯ তারিখ রাতে ভাবলাম ৩০তারিখ রবিবার ফোন করবই কিন্তু ভাগ্য আমার এতই খারাপ ২৯ তারিখ শনিবার রাতে ঘুমানোর সময় আমার মেয়ে ফোনে ম্যাসেজ দেখে বলে '' মা শিবানী আন্টি আর নেই লেখা আছে ম্যাসেজে '' সঙ্গে সঙ্গে ওই রাতেই ভাইপোকে ফোন করে জানতে পারলাম ২৭ তারিখ  বৃহস্পতিবার দুপুরবেলা  করোনাতে আমার বেস্টফ্রেন্ড শিবানী না ফেরার দেশে চলে গেছে সেই রাতে আমার আর ঘুম তো হলই না , পরের দুদিন আমি কোন কাজ কতে পারলাম না শুধু চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগল আর সব স্মৃতি মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল আর দেখা করা হল না সত্যি মিস করব আমার প্রিয় বন্ধুটিকে শুধু মনে মনে মনে খুব রাগ হল ঈশ্বরের প্রতি বহু বছর পর যোগাযোগ হওয়ার পর আমার বেস্টফ্রেন্ড হারিয়ে গেল মনে মনে প্রার্থনা করলাম আর প্রিয় বন্ধুর জন্য শান্তি কামনা করে বললাম যেখানেই থাকিস শিবানী ভালো থাকিস তোকে আমি কখনো ভুলতে  পারবো না

ছবিঋণ- ইন্টারনেট ।

 

------------------------ 

  ৫৫৩ পি মজুমদার রোড , কলকাতা৭৮

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.