Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প।। ত্রিধারা।। সুতপা ব‍্যানার্জী (রায়)



চন্দ্রা বছর পাঁচেক হল এই লাইনে ট্রেনে যাতায়াত করছে। কোনোদিনও একটু স্বস্তি পেল না। একটা না একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। কোনোদিন লাইনের গণ্ডগোল, কোনোদিন বা বিক্ষোভের জন্য ট্রেন লেট।
কিছু না থাকল তো পকেটমারি হয়ে হইচই কাণ্ড। একেবারেই যখন কিছু থাকে না তখন চুলোচুলি, মারামারি। এই যেমন সেদিন এক মহিলার পা আর এক মহিলার গায়ে লাগায় সে চিৎকার করে উঠল-
"আমায় লাথি মারছেন?" প্রথম জন-"গায়ে একটু পা ঠেকেছে,ওটা লাথি মারা হল?" এবারে ঝগড়ার বহিঃপ্রকাশ তুই তুকারিতে নেমে এল। "কখন থেকে লাথি মারছিস আর বলছিস লাথি নয়।" "যা না,লোকাল ট্রেনে উঠেছিস কেন মহারাণী ভিক্টোরিয়া,গাড়ি করে যা না।" প্রথম জন নেমে যেতে সেই ঝগড়ার ইতি ঘটল। তবে যাতায়াত করতে করতে ভাল কিছুও ঘটে চন্দ্রার সঙ্গে। যেমন হঠাৎই ও আবিষ্কার করল ওর প্রাইমারী স্কুলের বান্ধবী লীনাকে। ও দুবছর হল এই লাইনে চাকরি সূত্রে যাতায়াত করছে,তবে চন্দ্রার সঙ্গে এই প্রথম দেখা হল। দুজন দুজনকে এতদিন পর দেখা হওয়ার জন্য ট্রেনের ভিড় উপেক্ষা করে আবেগে জড়িয়ে ধরল। "কী রে চান্দু,কতদিন পর দেখা, তুই এখন কী করছিস?" লীনার প্রশ্নে-"আমি সরকারী অফিসের কেরাণী,তোরটা বল।" লীনা হাসতে হাসতে-"সেই ছোটবেলায় দিদিমণি দিদিমণি খেলাটা খেলতে খেলতে জীবনে সত্যি হয়ে গেল। আমি এখন সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা।" চন্দ্রা লীনার কাছাকাছি এসে-"বিয়ে করিস নি?" "হয়েছিল টেকে নি,তোর বিয়ে কবে হল?"-লীনা সহজভাবে উত্তর দিয়ে চন্দ্রার দিকে তাকাতে চন্দ্রা-"আমার এই দুবছর হল,আমার আর সুচিন্তর অ্যাডজাস্টমেন্ট ভালোই ,তাই কেটে যাচ্ছে ঠিকঠাক।"এভাবেই চন্দ্রার জীবনের অনেকটা সময় পথেই কেটে যায়। যাতায়াতের পথে আলাপ হয় নতুন কতজনের সঙ্গে। একসঙ্গে ওঠাবসায় সবাই সবাইয়ের জন্মদিনের খবর রাখে,বিবাহবার্ষিকী পালন করে। গতিময় জীবন বেশ কেটে যায়। একদিন এইভাবে ওর মামার বাড়ির যৌথ সংসার থেকে চলে যাওয়া ছোটমামার সঙ্গে ট্রেনেই দেখা হল। মামার চেহারা অনেক ভেঙে গেছে,কথায় ঝরে পড়ছে হতাশা। চন্দ্রার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল,ছোটমামাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করতে করতে ওর নামবার সময় হয়ে গেল। বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের অবিরাম বয়ে চলা দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিনের একটা ঘটনা চন্দ্রাকে রীতিমতো নাড়িয়ে দিল। লীনার সঙ্গে আবার একদিন দেখা,চেহারায় ওর সেই কাহিল হয়ে পড়া ভাব নেই। অনেক উজ্জ্বল,ঝকঝকে তকতকে হয়েছে ও। চন্দ্রা লীনাকে দেখে-"বাবা!কতদিন পর আবার তোর সঙ্গে দেখা হল।" লীনা-"হ‍্যা‍ঁ রে,আমিও ভাবছিলাম কবে তোর সঙ্গে দেখা হবে।" চন্দ্রাও উৎসাহভরে-"তারপর বল,খুব ভাল আছিস মনে হচ্ছে, নতুন কোন খবর টবর?"-চন্দ্রার এই কথা শুনে লীনা ওর কাছে আরো এগিয়ে এসে একটা ফটো বার করে-"দেখ,এর সঙ্গে নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছি।"ছবি দেখে চন্দ্রার হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে আসল,গলা পিপাসায় শুকিয়ে গেল,পায়েও কাঁপুনি বোধ করল। চন্দ্রার এরকম প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব‍্য কারণগুলো সকলের ভাবনার জন‍্য উন্মুক্ত করলাম।

ছবিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে ডুকরে কান্না এলো চন্দ্রার। এই যে দুবছর ধরে শৈবালকে ও একভাবে বিশ্বাস করে এসেছে তার কি কোন মূল‍্য নেই শৈবালের কাছে। অফিস ট‍্যুর বলে কতদিন কত জায়গায় গেছে,কই কোনদিন তো কোন প্রশ্ন আসে নি চন্দ্রার মনে। নিজের মাইনের টাকা দুহাতে খরচা করেছে শৈবাল, কোনদিন কোন হিসেব না চেয়ে সংসার চালিয়ে নিয়েছে চন্দ্রা। শ্বশুরবাড়ির সব কর্তব‍্যকর্ম সামলে গেছে একা হাতে। এই তার প্রতিদান,আজ বাড়ি ফিরেই মুক্তি দেবে শৈবালকে। কোন মিথ‍্যের আশ্রয়ে চন্দ্রা বাঁচতে চায় না।

একি অবিশ্বাস্য ঘটনা! এ তো ওর একমাত্র ভাই বিভাসের ছবি। সবে এক বছর হল ভালোবেসে বিয়ে করেছে ওর কলেজের বান্ধবী দিয়াকে। এরমধ্যেই দিয়ার আকর্ষণ চলে গেল বিভাসের। কী দেখল ও লীনার মধ্যে যা দিয়ার নেই। চন্দ্রা ভাইয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে শঙ্কিত হল। বিভাসের সঙ্গে একান্তে কথা বলতে হবে,লীনাকে কিছু বলল না। যদিও চন্দ্রা লীনার ওপর ওর রাগকে কিছুতেই চেপে রাখতে পারছিল না।

শেষপর্যন্ত ওর আটচল্লিশ বছর বয়সী বাবা এই বয়সে এসে লীনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল, এ কথা ভেবে চন্দ্রার চোখ জলে ভরে উঠল। ও ওর মৃতা মায়ের কথা ভাবছিল।তাহলে জীবনের মতো প্রেমও নশ্বর। সাতাশ বছরের সুখস্মৃতি ধুয়ে মুছে ম্লান হয়ে গেল। বাবার সামনে এরপর কিভাবে কোনরকম শ্রদ্ধা ছাড়া দাঁড়াবে চন্দ্রা।শেষপর্যন্ত লীনা ওর মায়ের জায়গা নেবে তা মনে মনে কিছুতেই মানতে পারছিল না চন্দ্রা। কল্পনার জাল প্রসারিত করে চন্দ্রার চিন্তার অভিমুখ এরপর কোন্ পথে গেছিল তা একমাত্র চন্দ্রাই বলতে পারবে।

                         ....................................................................


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.