গল্প।। অর্থাৎ,বান্তু... ।। উপেক্ষিৎ শর্মা
নানু আর মতি দুজনে দুদিক থেকে হন হন করে আসছিল। মুখোমুখি হতেই দুজনে থমকে দাঁড়াল। দুজনে দুজনের চোখে চোখ রেখে ছবি হয়ে গেল। দুজনেই হয়ত কিছু বলবে কিন্তু কে বলবে, নানু না মতি? মতি না নানু? হঠাৎ নানু নড়ে উঠল। মতিও নিঃশ্বাস টানল। নানু বলল,
নানু - এই, দেখেছিস?
মতি- কি?
নানু - আজ আকাশে একটাও তারা নেই!
মতি - তা, কি হয়েছে?
নানু – কি হয়েছে, কি রে! আমার যে এক্ষুনি একঠোঙা তারা চাই, নইলে...
মতি – নইলে..., নইলে কি......?
প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে উঠল মতি এই 'নইলে'-র উত্তর শোনার জন্যে। যেন এই 'নইলে'-র ওপর পৃথিবীর থাকা-না-থাকা নির্ভর করছে। যেন নানু, ওর একান্ত আত্মবন্ধু নানুর এই 'নইলে'-র উত্তরে কিছু বেমেনান শুনলেই ......। শুনলেই কি যে হবে মতি জানে না অথচ মতির অস্থিরতা যেন ওর চোখ কান মুখ ছাড়িয়ে থলথলে হৃদয়ের রক্তের ছলাৎকারে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দেবে। অথচ নানু মৌন এবং অধিকতর বিষন্নতা নিয়ে অত্যন্ত দীন কণ্ঠস্বরে বলল,
নানু - ......নইলে...নইলে, বান্তু ......
মতি –বান্তু? তোর ছেলে? বান্তু কি? বলবি তো, বান্তু কি?
নানু – এই দেখ! এই দেখ, গা টা কেমন ছমছম করছে! কেমন থেমে গেছি আমি! বলে নানু মতির বাঁ-হাতটা দুহাত দিয়ে ধরে নিজের বুকে টেনে আনল। মতি নানুর বুকে আলতো হাত রেখে শিউরে উঠল। আরে, সত্যিই তো! নানুর বুকের কোন স্পন্দন নেই! নানুর দেহের কোন জৈবিক উত্তাপ নেই! নানুর শরীরে রক্তের বহতার কোন লক্ষণ নেই! তাহলে, তাহলে নানু কি বেঁচে নেই! তাহলে নানু কি নানু নয়, প্রেতাত্মা! তাহলে, তাহলে নানু......! অথচ নানু আর থাকতে পারল না, হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। ওর চোখ থেকে ঝরঝর করে উষ্ণ তরল গড়িয়ে পড়তে লাগল। ওর মুখ দেখে মনে হল কেউ যেন ওর গলায় এক মগ চোখের জল ঢেলে দিয়েছে। সেই নোনা ভিজে গলায় নানু বলল,
নানু – কি রে, কিছু বলছিস না যে? কিছু বলবি তো, নাকি?
মতি – কি বলব?
নানু – কি আবার, কোথায় পাব, কোথায় পাব এক ঠোঙা তারা? কোথায়? কোথায়?
বলতে বলতে (আসলে কাঁদতে কাঁদতে) নানু থেমে গেল। ঢোক গিলল। হাঁচল। নাক টানল। চোখ রগড়াল। হাত কচলাল। আরও কি সব করত হয়ত কিন্তু মতি ওকে সান্ত্বনা দিল,বলল,
মতি – দাঁড়া না। অত উতলা হলে চলে? কি হয়েছে কি বল তো? বলে মতি নানুর কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিল। নানু তিরতির করে কেঁপে উঠে ফোঁচফোঁচ করে নাকি সুরে কেঁদে উঠল, বলল,
নানু –তুই তো দেখে গেলি বান্তু সেই কাল থেকে বেঘোরে পড়ে আছে! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছিল। গায়ে হাত দিতে পারছিলাম না। গায়ে হাত দিলে রুটি সেঁকা তাওয়ার মত ছ্যাঁকা লাগছিল। আর আজ! আজ সকাল থেকে গায়ে হাত দিলেই হাতটা ছ্যাঁৎ করে উঠছে। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে না। নিঃসাড়ে ঘুমচ্ছে। শুধু মাঝে মাঝে যেন বলে উঠছে, 'বাবা, এক ঠোঙা তারা এনে দাও না। কাকা,এক ঠোঙা তারা এনে দেবে?' বল, বল আমি এখন কি করি? কোথায় পাই তারা? কোথায়? কোথায়?
মতি – দাঁড়া, দাড়াঁ, অত ছটফট করলে হবে না। ডাক্তার ডেকেছিলি? ডাক্তার কি বলল?
নানু – ডাক্তার! ডাক্তার তো ফী নিয়েই ধাঁ।
মতি – সে কি, রে? বলে মতি কেমন থম মেরে গেল। প্রচণ্ড হতাশা আর উদাসীনতা ওকে পেয়ে বসল। ভীষণ দুঃখের ভারে ও মাথা ঝুঁকিয়ে নিল, তারপর আবার নানুর দিকে তাকাল। নানুও মতির দিকে তাকাল। দুজনে দুজনের মুখোমুখি বাড়ির সামনের চাতালটা জোড়া করে দাঁড়িয়ে ছবি হয়ে গেল। কেউ কোন কথা বলল না। কেউ না। কিন্তু দুজনেই হয়ত কিছু বলতে চায় অথচ কে বলবে, নানু না মতি? মতি না নানু? এসময়ে হঠাৎ একটা চার চাকার শব্দযান 'ভোঁ' করে বেজে উঠল। ওরা দুজন আচমকা নড়ে উঠল। দুজনেই নিঃশ্বাস নিল জোরে। নানু মতির দিকে তাকাল। মতি নানুর দিকে। হঠাৎ মতি মুখ খুলল, বলল,
মতি – এই, দেখেছিস?
নানু – কি?
মতি – গাড়িটা কেমন নাকের ডগা দিয়ে 'ভুস্' করে জটায়ূর মত উড়ে গেল?
নানু – তাই তো! চল, চল তো ব্যাটাকে ধরি!
মতি – কেন? ওটা ধরে কি হবে?
নানু – যদি ওটাকে দিয়ে এক ঠোঙা তারা আনা যায়!
মতি – হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস! চল, চলতো! দৌড়ো। দৌড়ো। বলে দুজনে ছুটতে শুরু করল জটায়ূর পেছন পেছন। জটায়ূ হঠাৎ পেছনে ধুপ ধাপ আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে গেল। জোরে পাখা ঝাপটাল। নানু আর মতি আরও জোরে পা-চালাল। জটায়ূ আরও জোরে পাখা ঝাপটাল।নানু আর মতি আরও জোরে...। জটায়ূ আরও...। নানু-মতি আরও...। জটায়ূ আরও...। অবশেষে জটায়ূ জিতে গেল কেননা নানু বা মতি কারুর কাছে তলোয়ার নেই আর তাছাড়া এটা রামায়ণের জটায়ূ নয়। তাই প্রায় নাগালের মধ্যে পেয়েও জটায়ূর ডানা কাটা গেল না। নানু-মতি থেমে গেল। ওরা হাঁপাচ্ছিল দুজনেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ 'হা' 'হা' করে দম নিল। তারপর নানু মতির দিকে তাকাল। মতি নানুর দিকে। মুখে পরাজয়ের গ্লানি মাখা হাসি ফুটিয়ে দুজনে মুখোমুখি ছবি হয়ে গেল। অথচ ওরা দুজনেই হয়ত কিছু বলতে চায়, কিন্তু কে বলবে, নানু না মতি? মতি না নানু? হঠাৎ নানু একটু নড়ে উঠল। মতিও। নানু এক দলা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মতিও। তারপর নানু আচমকা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। মতি প্রায় কেঁদে ফেলতে গিয়েও নানুর কান্না ভেজা মুখটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে নিজেকে সামাল দিল এবং বলল,
মতি – কি আর করবি বল? অনেক তো চেষ্টা করা হল। এবার বাড়ি চ'। ওরা ফিরে এল। নানুর কান্না থামেনি ওর কান্নার করুণ ধ্বনিতরঙ্গে মতির হৃদয় গহ্বরের অনিয়ন্ত্রিত তোলপাড় কোনক্রমে সামাল দিয়ে নানুকে নিষ্ফল সান্ত্বনা দিল,
মতি – দেখ, কিছু কিছু জিনিস আছে যা সত্যিই মানুষের সাধ্যের বাইরে। এটাই মানুষের সীমাবদ্ধতা, মানুষের চিরন্তন অসহায়তা। সৃষ্টি যেমন প্রকৃতির স্বাভাবিকতা, বিনাশও। সে অর্থে বিনাশ বলে কিছু নেই, সৃষ্ট আর বিনাশ হচ্ছে নিয়মানুবর্তী চক্র। একটা আবর্তনচক্রও বলতে পারিস। যাওয়া আর ফিরে ফিরে আসা......,আরও কিছু বলছিল মতি, শুনতে শুনতে নানু আরও জোরে কেঁদে উঠল। মতি অতএব সপ্রীত স্নেহে নানুর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলল,
মতি – নানু, ওঠ। ওঠ। শোন! শোন একটা কথা। দেখ, এদিকে তাকা। নানু আস্তে আস্তে নিজের দেহের ভারটা মতির বুকের ওপর থেকে তুলে নিল কিন্তু মুখ তুলল না। মতি আর কিছু বলল না কেননা মতি জানেনা আর কি বলতে হবে। এত কথা বলার পর আর কিই বা বলার আছে। আপাতত মতির শব্দ ভাণ্ডার নিঃশেষিত। মতির নিশ্চুপ বিহ্বলতা ঠাহর করতে পেরেই বোধহয় নানু মতির ওপর থেকে নিজের ভার তুলে নিল। মুখ নীচু করে খুব সাবধানে চোখ মুছল। এখনকার বাস্তব অবস্থার উত্তাপ সম্যক উপলব্ধি করে তাৎক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে শান্ত গলায় বলল,
নানু - চল, মতি। আয়।
মতি – কোথায়?
নানু – একটু দোকানে যেতে হবে। আনুষঙ্গিক জিনিসগুলো কিনে আনতে হবে তো?
মতি – তুই? তুই কোথায় যাবি? তোকে কোত্থাও যেতে হবে না। তুই এখানে শান্ত হয়ে বোস, আমি দেখছি। বলে মতি নানুকে বাড়ির সামনের চাতালটার একটা ফাঁকা জায়গায় টেনে বসিয়ে দিল। নানু থপাস করে বসে দু-হাঁটু তুলে দু-পায়ের ফাঁকে মুখ গুঁজল। মতি সামনে যাকে পেল তাকেই নিয়ে দোকানে চলে গেল।
আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে ফিরে এল মতি। নানু তখনও একই ভাবে বসে। মতি ডাকল,
মতি – নানু, নানু। নানু কোন সাড়া দিল না। মতি আরেকটু আবেগ মাখা ব্যথা ভেজা স্বরে আবার ডাকল,
মতি – দেখ, দেখ নানু! বান্তুর জন্যে কি এনেছি দেখ? বলে মতি একটা বড় ঠোঙা নিজের কাঁধের কাছে তুলে ধরল। নানু তবুও কোন কথা বলল না শুধু মতির দিকে চোখ তুলে ফ্যাল্ফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইল। মতি এবার আরও আবেগমথিত কান্না সামাল দেওয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল,
মতি – জানিস, জানিস নানু, বান্তু না প্রায়ই বলত, 'কাকু, দেখ, দেখ আকাশে কত তারা, তাই না? আমাকে, আমাকে এক ঠোঁঙা তারা এনে দেবে কাকু? আমি না ওই তারাগুলো ভীষণ ভালোবাসি। ভীষণ', বলে মতি গলার কাছে আটকে থাকা একদলা কফ ঢক করে গিলে ফেলল। নানু নিথর বসে রইল, কোন কথা বলল না। মতি বাঁ-হাতের উল্টো চেটোটা চোখে বুলিয়ে নিয়ে ঠোঙার ভেতর হাত ঢোকাতে ঢোকাতে বলল,
মতি – জানিস নানু, বান্তু না প্রায়ই এরকম এক ঠোঙা তারা চাইত আমার কাছে। হ্যাঁ রে! সত্যি বলছি, বলে ঠোঙার ভেতর থেকে এক মুঠো খৈ বের করে ওপরের দিকে ছুঁড়ে দিল। তখনি মতি নানু দুজনেই চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। খৈগুলো আকাশের তারার মত মাটিতে ঝরে ঝরে পড়তে থাকল। মতি বিজয় গর্বের উচ্ছল হাসি হাসতে হাসতে বলতে লাগল,
মতি – দেখ, দেখ, আকাশের তারাগুলো কেমন ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে। যা না, যা না নানু, বান্তুকে নিয়ে আয় না, বান্তুকে... বলতে বলতে আবেগের উচ্ছাসে আচমকা বিষম খেল। তারপর খুকখুক করে কাশতে কাশতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল মতি। মতির কান্না সংক্রমিত হল নানুর চোখে। ককিয়ে কেঁদে উঠল নানুও। তারপর দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ছবি হয়ে গেল।
এই বিষণ্ণ দুপুরে দুজন উদ্ধত যুবকের কান্না দেখে একটা কাক চিলেকোঠায় বসে ঘাড় ঝুঁকিয়ে ডেকে উঠল, 'কাআআ' অর্থাৎ
অর্থাৎ, বান্তু...
-------------------------------
উপেক্ষিৎ শর্মা
৬২, আর এন গুহ রোড,
দমদম, কলকাতা–৭০০০২৮