(১)
অতনু কয়েকদিন হলো নতুন এসেছে এই শহরে চাকরি সূত্রে। জায়গাটা ভালো করে চেনার জন্যে অফিস থেকে হেঁটে ফেরে। জায়গা চেনা হয়,আর এখনো বাড়িতে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করতে পারে নি তাই হোটেল থেকে খাবার নিয়ে ফেরে।তবে অতনুর নিত্য নতুন রান্না করার খুব শখ। রান্নার মশলা, প্রণালী সব নিয়ে পরীক্ষা করে সে।এমন কি কোনো হোটেলের খাবার খেলেও সেটায় কি মশলা ব্যবহার হয়েছে,কি প্রণালীতে করা হয়েছে বোঝার চেষ্টা করে, নিজে বাড়িতে বানাতে চেষ্টা করে। কখনো সফল হয়, কখনো অসফল।
এখানে আসার পর বিভিন্ন হোটেলের খাবার নিয়ে এসে খেয়েছে।যে গুলো ভালো লেগেছে খাতায় নিজের মতো করে রেসিপি লিখে রেখেছে।পরে সে গুলো বানানোর ইচ্ছা।
আজ ফেরার পথে সঙ্গী হয়েছে মনু শর্মা। মনু এখানে অনেক আগে থেকে আছে। আজ আসার সময় অতনু বলল," মনু ভাই,রোজই যাওয়ার পথে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যাই, আজ ভাবছি, রুবি'স কিচেন-এ যাবো। আপনিও চলুন। আজ আর বাড়িতে নিয়ে যাবো না, এখানে খেয়ে যাবো।"
মনু বললেন,"এই হোটেলের বিখ্যাত একটি পদ আছে মাংসের, দূর দুরান্ত থেকে অনেক মানুষ আসেন সেটা খেতে। আমি কোনদিন যাইনি, চলুন আপনার সাথে সাহস করে আমিও আজ ঘুরে আসি।"
হোটেল-এর ভিতর খুবই অন্ধকার মতো। ছয়টি টেবিল ও তাতে চারটি করে চেয়ার। দেওয়ালে বরফে ঢাকা হিমালয়ের বড়ো ছবি আর প্রভু যীশুর ছবি। খুব মৃদু গান বাজছে---
"এক দিন ও মিলে,রোজ্ মিলনে লাগে,
ফির মোহব্বত হুয়ি,ফির ক্যয়ামত হুই..........."
অতনুর খুব প্রিয় ঋষি কাপুর-এর সিনেমার গান এটা।
রিসেপশনের ছেলেটি উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো তাদের কি লাগবে? মনু ভাই বললেন," এই হোটেলের স্পেশাল ডিশ সম্পর্কে শুনে তারা আজ এসেছেন।"
ছেলেটি অদ্ভুতভাবে তাদের দেখে বলল ," ম্যাডাম এই ডিশটি নিজে স্পেশাল ভাবে রান্না করেন। আজ ওনার শরীর ভালো নেই। তাই আজ ঐ ডিশটি হবে না,অন্য কিছু নিন।"
আর ম্যাডামকে সে জিজ্ঞেস করে এসে জানাচ্ছি কবে পাওয়া যাবে?
কিছুক্ষণ পর রুবি আসেন ,লাল স্কার্ট- সাদা শার্ট-এ অসামান্য সুন্দরী। অতনুর মনে হয় এতদিন এরই জন্য অপেক্ষা করছিল সে। চোখ ফেরাতেই ভয় করছিল,যদি স্বপ্নের মতো চোখ খুললেই হারিয়ে যায়।
রুবি বলেন," আপনাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এই স্পেশাল ডিশটির জন্য যে উপকরন টি জরুরি,সেটি আমাদের কাছে আজ আসেনি, আপনারা কাল আসুন অবশ্য ই পাবেন। আজ অন্য কিছু ডিশ অর্ডার করতে পারেন।"
মনু অতনু র দিকে ফিরে বললো," কি অর্ডার করবো বলো?" অতনু তখনও একদৃষ্টে রুবিকে দেখছে,মনু কনুই দিয়ে ঠেলা দেয় ।
অতনু লজ্জিত হয়ে বলে," যা হোক দিয়ে দিন, আমরা কাল আসবো " রুবি হেসে ফিরে যায়।
ডিনার সেরে বেরিয়ে মনু বলে," চলো আজ শর্টকার্ট রাস্তায় ফিরি, অনেকটা লেট হয়ে গেছে।"
হোটেল এর পেছনের রাস্তায় চড়াই পাহাড়ি পথ ভেঙে উঠতে লাগলো দু-জন। অতনু আজ বড়ো অন্যমনস্ক, বারবার রুবি র অসামান্য সুন্দর মুখ ভেসে উঠছে। হঠাৎ মনু কনুই ধরে টান দিলো,' দাঁড়াও, দেখো হোটেল এর পেছনের দরজায় রুবি ম্যাডাম ।" আপাদমস্তক কম্বলে মুড়ি দেওয়া একটা লোক একটা বড়ো বস্তায় কি যেন দিল,আর টাকা দিলেন রুবি। কিছু বুঝতে চেষ্টা করেও লাভ হলো না অন্ধকারের কারণে। অপেক্ষা না করে বাড়ির পথ ধরলেন ওরা।
পরদিন কাজে আর মন বসে না অতনুর, কতক্ষণে সে যাবে , রুবি র দেখা পাবে সেটা ভাবতে থাকে।মনু বিকেলে বলেন আজ তার অসুবিধা আছে যেতে পারবে না। অতনু একাই চললো ,যেন কোন পতঙ্গ আগুনে র দিকে প্রবল বেগে উড়ে যাচ্ছে।আজ হোটেলে র রিসেপশনে ছেলেটি নেই, কিন্তু আজ ও কালকের গান বাজছে ,
"উস্ হাসিন নে কহা,শুনো জানেবফা,
ইয়ে ফলক্,ইয়ে জমিন,তেরে বিন কুছ নেহি........"
গান শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল অতনু।
" শুনছেন" .. সুরেলা স্বর শুনে তাকিয়ে দেখতে থাকে কালো পোশাক গোলাপী ঠোটের অপরূপাকে। "আজ আপনি খুব ভাগ্যবান জানেন,আজ ডিশটি বানানোর যাবতীয় উপকরণ পেয়েছি আর খুব মন দিয়ে রান্না করেছি। আপনি অপেক্ষা করুন আমি নিয়ে আসছি।"
অতনু আপ্লুত,কোন হোটেলের সুন্দরী মালকিন তার জন্যে নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করছে এ যেন ভাবা যায় না।
সুদৃশ্য প্লেটে ডিশ টি আনেন রুবি ,সাথে রুটি আরও কিছু রয়েছে। সামনে র চেয়ারে বসে বলে,' আজ হোটেলে আর কেউ আসে নি,তাই আমি আপনার সাথে আজ ডিনার করবো।" অতনু কৃতার্থ হয়ে যায়। তাকে পরিবেশন করেন রুবি।
প্রথম খাবার মুখে নিয়ে অতনু বুঝতে চেষ্টা করে তার স্বভাব মতো ,এটা কি দিয়ে তৈরি? অদ্ভুত স্বাদ,মাংসটা একবার ,দু বার খায়, কিছুতেই বুঝতে পারে না, রুবিকে বলে," গ্ৰেভিতে ছোট পেঁয়াজ,টমেটো,সাথে মিক্সড হার্বস,আর কি আছে বুঝতে পারছি না, কিন্তু বুঝে নেবো। মাংসটা কিসের সেটা একবারে বুঝতে পারছি না!!"
হঠাৎ যেন রুবি র মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। আবার অতনু মাংস মুখে দেয়, জিভের মধ্যে মাংস রেখে চোখ বুজে বোঝার চেষ্টা করে। কখনো শূকরের মাংস,কখনো গরুর আবার কখনো ভাপা মাংসের মতো স্বাদ মনে হয়। রুবিকে খেতে খেতে বারবার বলতে থাকে সে কথা। লক্ষ্য করে রুবি র মুখের রং বদলাচ্ছে। কঠিন আর ক্রূর হয়ে উঠছে।
হঠাৎ ই অতনুকে বলে ," আমার শরীর টা খারাপ লাগছে। আমি রেস্ট নেব।" বলে উঠে চলে যায়। খুব অবাক হয় অতনু এই ব্যবহারে। কিন্তু তার মন তখন অস্থির, কিছুতেই সে বুঝে উঠতে পারছে না কি তাকে খাওয়ানো হচ্ছে।
"স্যার হোটেল বন্ধ করবো।" রিসেপশনের ছেলেটি হঠাৎ যেন কোথা থেকে এসে বলল।
অতনু খাওয়া শেষ করে বেরিয়ে এলো।অন্যমনস্ক ভাবে হোটেল এর পেছনের রাস্তা দিয়ে যেতে হঠাৎ দেখলো পাগল এর মতো দেখতে একটা লোক হোটেল এর পিছনের ডাস্টবিন ঘেঁটে খাবার খেতে গিয়ে পুরো ডাস্টবিন উলটে ফেলেছে। কি মনে হতে অতনু এগিয়ে দেখলো ডাস্টবিনের ভেতর একটা প্যাকেট। সন্দেহ হতে খুলতে গেল আর তখনই হঠাৎ সব অন্ধকার।
(২)
অতনুর খোঁজ দু- দিন না পেয়ে মনু ভাই পুলিশের দ্বারস্থ হলেন। হোটেল এ এসে পুলিশ খোঁজ- খবর করতে লাগলো। কারণ সেখানেই অতনুকে শেষ দেখা গেছিল। কিন্তু কোন সূত্র কিছুই পাওয়া গেল না। অস্বাভাবিক কোন কিছুই কোথাও চোখে পড়লো না কারো।
" এক হাসিনা থি,এক দিওয়ানা থা,
ক্যায়া উমর,ক্যায়া সমা,ক্যায়া জমানা থা....."
রোজকার মতো গান বাজছে , রুবি র হোটেলে। আজ অনেক লোক আসবে, বুকিং করেছে স্পেশাল ডিশের। রুবি আজ ব্যস্ত ।ফ্রিজে রাখা মাংস বের করলেন এবার কাটবেন।
মাংস কাটার যে লোক আছে সে আজ দিয়ে গেছে, যাওয়ার সময় বলে গেছে ," এবার আর বিশেষ অসুবিধা হবে না।আর বেশি মাথা কেউ ঘামাবে না।যার মাথা বেশি চলছিল সে এই প্যাকেট এ বন্দী।" রুবির মুখে ক্রূর হাসি এসে মিলিয়ে যায়।
সঠিক সময়ে তার সবসময়ের সঙ্গী বুঝে গেছিল কি করতে হবে,নইলে অতনু সেদিন বুঝে যেত যে প্যাকেট এ কিসের মাংস ছিল? নিজেদের ভুলে মাংস কাটার পর একটা আঙ্গুল ঐ প্যাকেট এর মধ্যে সবজি র খোসার সাথে চলে গেছিল। রুবি র সন্দেহ হতেই তার লোক পাঠান দেখতে , ঠিক তখনই প্যাকেট খুলে দেখতে গেছিল অতনু ,হয়তো ওতে মানুষের হাতে র আঙ্গুল দেখতে পেয়ে যেত সে। অতিরিক্ত মাথা খাটানোর শাস্তি হিসেবে আজ অতনু নিজে খাবার টেবিলে খাদ্য হিসেবে যাবে।
"খো গ্যয়ে তুম কাঁহা,শুনকে ইয়ে দাস্তান,
লোগ হয়রান হ্যায়,কিঁউ কে আনজান হ্যায়.........."
গান বেজে চলে । অতনুর কথা হয়তো কোনদিন কেউ জানবে না।। রুবি'স কিচেনের খাবার টেবিলেই মুছে যাবে।।
----------------------
সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত--