গল্প ।। কল্পলোকের রোমাঞ্চরা ।। উৎস ভট্টাচার্য
ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা ভাবলেই এক অবর্ণনীয় আনন্দে আমাদের মনটা ভরে যায়৷ ঠোঁটের কোণে একটা মিষ্টি হাসির রেখা নিজের অজান্তেই কখন যেন ফুটে ওঠে৷ ছোট্ট ছোট্ট ঘটনাগুলোর টুকরো স্মৃতিরা। গতানুগতিক রোজনামচার মাঝেও এক ঝলক খুশির হাওয়া নিয়ে হাজির হয় মন কেমনের অলস দুপুরে, অথবা, ঘুম না আসা রাতের একাকিত্বে৷এমনই এক নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর অথচ অমূল্য স্মৃতিকথার গল্পই হোক তবে আজ ৷ আসুন সকলে! আজ আমরা পাড়ি দেবো কল্পলোকের রোমাঞ্চ সন্ধানে ৷
ছোটোবেলায় অনেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়ও মনের ক্যানভাসে কল্পনার রঙ মিশে রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠে—সকলের কাছে না হলেও সেই শিশুশিল্পীটির কাছে তো বটেই! ব্যক্তিগত একটি দু'টি উদাহরণ দিয়েই আজকের গল্পের মূলপর্বে আসছি৷ আমাদের পাড়ায় একটি বেশ পেল্লাই মাপের বাড়ি ছিলো—পোড়ো বাড়ি! পাশেই তার একটা মস্ত পুকুর আর বাড়ি ও পুকুরের মাঝে বেশ বড় একটা বাগান৷ বহুদিন অযত্নে পড়ে থাকায় ঝোপঝাড় বাড়িটিকে অনেকাংশে গ্রাস করেছে, সারা গায়ে বটের চারা শিকড় ছড়িয়েছে; বাড়িটির অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বার্ধক্যের জীর্ণতা স্পষ্ট ৷ সেই ছেলেবেলার দিনগুলোতে আঁকার খাতায় ক্ষুদ্র পরিসরে অত বড় বাড়িটিকে ধরাতে পেরে মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করতাম, এ কথা অস্বীকার করবো না; সাথে সাথেই কল্পনাপ্রবণ শিশুমনে বাড়িটিকে ঘিরে নানারকম আধিভৌতিক গল্প ভেবে ভেবে নিজের মনেই রোমাঞ্চিত হতাম ৷
এইরকমই আর একটি রোমাঞ্চকর কল্পনার আশ্রয়স্থল ছিলো আমাদের প্রাইমারী স্কুলের একটি বিশেষঘর৷ দিদিমণিরা ভয় দেখাতেন, কেউ বেশি দুষ্টুমি করলে তাকে ঐ বিশেষ ঘরটাতে আটকে রাখবেন! আমাদের প্রাইমারী স্কুলটা আসলে একটি হাইস্কুলেরই একতলায় সকালের দিকে হত ৷ ঐ ঘরটা ছিলো তিনতলায় ৷ বায়োলজির প্র্যাক্টিকাল রুম হওয়ায় ঘরটায় ছিলো আস্ত একটা কঙ্কাল! আর ঐ কারণেই ঘরটি হয়ে উঠেছিলো শিশুমনের ভয়মিশ্রিত রোমাঞ্চবিলাসের অবলম্বন!
যাক সেসব কথা ৷ এবারে মূল কাহিনীটিতে আসা যাক ৷ একবার আমরা হরিদ্বার-মুসৌরি দেরাদুন বেড়াতে গেছি৷ তখন আমার বয়স কত হবে? সাত কিমবা আট! ঘোরার পর ফেরবার সময় দেরাদুন স্টেশনের ওয়টিং রুমে অপেক্ষা করছি সকলে; দেরাদুনহাওড়া দুন
এক্সপ্রেস স্টেশনে আসতে বাকী বেশ কিছুটা সময়৷ অনেকক্ষণ বসে থাকতে বেশ বোর হচ্ছি৷ এমন সময় আরো একটি বাঙালী পরিবারের সাথে আলাপ জমে উঠলো৷ ঐ পরিবারটিতে আমার প্রায় সমবয়সী একটি মেয়েও ছিলো৷ বাবা মায়েরা নিজেদের মধ্যে গল্পে মেতে উঠলেন আর আমিও একটি বন্ধু পেয়ে গেলাম৷ অপেক্ষার সময়টা বেশ ভালো ভাবে কাটতে লাগলো৷
নানা রকম গল্প করতে করতে মেয়েটি অদ্ভুত কিছু কথা বলতে লাগলো৷ সে নাকি ছায়াছায়া কাদেরকে যেন প্রায়ই তার চারপাশে দেখতে পায়, শুনতে পায় তাদের অস্পষ্ট ফিসফিস শব্দও৷ ওয়েটিং রুমটাতেও নাকি তাদের দেখতে পাচ্ছে! আমি অবশ্য তার ইঙ্গিত অনুসারে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে কিছুই দেখতে পেলাম না! মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে সে নাকি দেখতে পায় ঘরের টুলটায় বসে আছে অচেনা একটা লোক৷ ওর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভাবে হেসে ওঠে সে! সে হাসিতে কোনো শব্দ থাকে না, তবু নাকি ওর কানে তালা ধরে যায়, চোখ হয়ে যায় ঝাপসা! ওয়েটিং রুমের এ.সি.-র কারণে এমনিতেই একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিলো আমার, তার মধ্যে ওর কথাগুলো শুনতে শুনতে গাটা কেমন যেন শিউরে উঠেছিলো—আজও বেশ মনে পড়ে!
মেয়েটি বলতে থাকে৷ বয়সের বিচারে বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে মেয়েটি—ঐ বয়সে ওর কোনো কথা অবিশ্বাস করা কঠিন ছিলো সেই কারণেই৷
ওরা নাকি একটা নতুন বাড়িতে উঠেছে বেশ কিছুদিন হলো৷ বাড়িটার চারপাশে অনেক গাছপালা! সেই সব গাছে নাকি অনেক বাদুড় ঝুলে থাকে৷ তারপর সে দেখায় তার চিবুকের নিচে গলার কাছটায় একটা সেলাই এর দাগ! সে সেটা ইঙ্গিত করে জানায় একদিন ঘুমের মাঝে বেশ যন্ত্রণা অনুভব করে সে জেগে উঠে দেখতে পায় গলার ক্ষতটা—বেশ রক্ত ঝরছিলো সেটা থেকে! রোমহর্ষক 'অভিজ্ঞতা'-র কাহিনী শুনতে শুনতে বড়দের ডাকে চমকে উঠলাম৷ আমাদের ট্রেনের সময় হয়ে এলো; বড়রা নিজেদের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় সেরে নিলেন৷ আরো কত কথা বাকী থেকে গেলো, শোনা হলো না আমার কিছুক্ষণের বন্ধুটির থেকে! বিদায় জানিয়ে ট্রেনে উঠলাম৷
রাতে ট্রেনের মধ্যে অস্বস্তিতে বারংবার ঘুম ভেঙে যেতে লাগলো; লাইট অফ করে সকলেই ঘুমাচ্ছে৷ একটা স্টেশনে ট্রেনটা থেমেছে, বাইরে থেকে হালকা আলো ঢুকছে; সেই আলোতে হঠাৎ চমকে উঠলাম— বার্থের পাশে, জানলার নিচে ওটা কী? বাদুড়ের মত দেখাচ্ছে না? ভয়ে ভয়ে ভালো ভাবে চেয়ে দেখলাম ভিতরের দিকের দেওয়ালটায় হয়ত ক্রমাগত ঘষা লেগে, খানিকটা জায়গা ক্ষয়ে গেছে; সেইটা অনেকটা বাদুড়ের মত দেখতে লাগছে! গলার কাছটায় কেমন ব্যাথা ব্যাথা করছে যেন! একটু ভিজে ভিজেও কি লাগছে? গলায় হাত দিয়ে দেখলাম, সত্যিই ভিজে—তবে রক্তে নয়, ঘামে!
*********** সমাপ্ত **********
১৬/৫৮৭ ৩নং ফিঙ্গাপাড়া (অরুণাচল),
উত্তর চব্বিশ পরগণা,কাঁকিনাড়া,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।