নকীম সেখ সাধারণ ক্ষুদ্র চাষী। চাষের যেটুকু উৎপাদন হয়,তাতেই তার সম্বৎসর চ'লে যায়।কিন্তু সে খুব উগ্র মেজাজী রগচটা আর সামান্য সামান্য কারণে তার বৌকে ধ'রে পেটায়। পাড়া-পড়শীর কেউ আটকাতে পারে না।কারণগুলো খুব তুচ্ছ। যেমন--- সালুনে সামান্য নুন বেশী হয়েছে বা কম হয়েছে, হলুদ বেশী হয়েছে বা বাইরে পুকুরঘাটে তার শাড়ি গোড়ালির উপরে উঠে গেছে বা স্নানের পর খালি মাথা দেখা গেছে বা পাশের বাড়ির কারো সাথে দুটো কথা বলেছে,- - - - - এই সব গোত্রের। তার এই অমানুষিক অত্যাচারের জন্য প্রথম স্ত্রী তার ভাত খায়নি। তারা মামলা ক'রে তালাক করিয়ে নিয়েছিল বিয়ের প্রথম বছরেই। তখনো তাদের কোনো সন্তানাদি হয়নি। ভাগ্যিস্ ।
এর পরে ঘটক মারফত দেখাশুনা ক'রে পাশের গ্রামে দ্বিতীয় বিয়ে করে। এই স্ত্রী তার পরমা সুন্দরী, যেমন ধবধবে ফর্সা রঙ, তেমন সুঠাম শরীর, কোমরে-পড়া চুলের গোছা ; দেখে মনে হয় গা-গতর থেকে রূপ ঠিকরে বেরোচ্ছে।এক কথায় ডানাকাটা পরী। নাম আনেছা।কিন্তু তার বাপ সৎ-বাপ।ওর মায়ের আগের স্বামীর সন্তান। ওর মা দেখতে তেমন আহামরি কিছু নয়। তার পেটে এমন সুন্দরী মেয়ের জন্ম কেমন যেন অবিশ্বাস হয়। এই জন্যেই বলে, মায়ের পেট না কুমোরের পেট।কোন সন্তান কেমন জন্মাবে কেউ বলতে পারে না। তার ওপর তারা বেশ গরীব। এই হবু জামাইয়ের অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল। তাই তার সৎ-বাপ এখানেই বিয়ে দিয়ে দ্যায়।
এই আনেছার সাথেও নকীমের এক্ই আচরণ। দিনরাত মারাধরা গালিগালাজ লেগেই থাকে।আনেছাও সমান জেদী। এর মধ্যে তাদের সাত বছরের বিবাহিত জীবনে দুই ছেলে ও এক মেয়ে হয়।কন্যাটি কনিষ্ঠ। নকীমের ওই বেরহম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কতো বার সে কোলের বাচ্চাকে নিয়ে মায়ের বাড়ি পালিয়ে গেছে। মাস খানেক পর হয় তার সৎভাইয়েরা রেখে গেছে। বা রান্নাবান্না ক'রে না খেতে পেরে রাগ পড়লে নকীম আবার গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছে।মায়ের অভাবের সংসার। রাখতে পারেনি। যতোবার ফিরে আসে, কিছুদিন যায় ,আর তারপর তুচ্ছ কারণে আবার মারধর শুরু হয়। বাচ্চাগুলো থরথর ক'রে ভয়ে কাঁপে। কখনো কেঁদে ভেঙরুল করে ।
একদিন রাতে তাদের তুমুল ঝগড়া কথা কাটাকাটি। কারণ নাকি যে আনেছা পাশের বাড়ির একটা বৌয়ের সাথে কথা ব'লে তার সম্বন্ধে লাগিয়েছে বা নিন্দা করেছে। সেদিন সারা রাত নাকি মারাধরা করে। আনেছার জীবনটা দুর্বিষহ হ'য়ে যায়। সে নকীমকে শিক্ষা দিতে চায়। পরদিন সারাদিন সে রান্নাবান্না করলেও ,বাচ্চাদের খাওয়ালেও নিজে গুম হ'য়ে থাকে। তার দুধে-আলতা গায়ের রঙে কালশিটে দাগ দেখা যায়।ওর মেজো জা দেখে তাকে বাড়িতে ডেকে আনে।খাওয়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু না, কোনো কিছুই সে খায় না। বিকাল হ'তেই নকীম ওর গাঁজার আসরে চ'লে যায় । সন্ধ্যায় আগে সে বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।পাশেই মেজো ভাসুরের বাড়ি মুখোমুখি লাগালাগি সেখানেও যাওয়া বা কথা বলা তার বারণ ।
রাত দশটা এগারোটার পর নকীম বাড়ি আসে। ঘুমাতে যায়। গিয়ে দ্যাখে, ঘরে আনেছা নাই। বাচ্চাগুলো ঘুমিয়ে আছে। তার মাথায় আগুন ধ'রে যায়। এতো পেটালো তাকে, তবু সে তার আদেশ অমান্য ক'রে আবার পালিয়েছে ? আজ শালির একদিন কি আমার একদিন ! সে পাশের ঘরে ,উপরের কোঠা ঘরে ,মেজো ভাইয়ের বাড়িতে,পুকুরঘাটে খোঁজাখুঁজি করতে শুরু করে। বাচ্চাগুলোকে ঘুম থেকে তুলিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে,তাদের মা কোথায়। বাচ্চারা কী বলবে ? তারা থরথর ক'রে কাঁপে।বড়োটির বয়স বছর চার। সে বলে, মা তো আমাগো ঘুম পাড়াই দিয়াছে। আর কিছু জানে না। ওই রাতেই ওপাড়ায় তার বড়ো ভাইয়ের বাড়িতেও খুঁজতে যায়। কোথাও তাকে পাওয়া যায় না। যাই হোক সকালে ওর মায়ের বাড়িতে খুঁজতে লোক পাঠাতে হবে। এই মনস্থ ক'রে লম্ফু হাতে বাহির বাড়ির গলির মুখে সে পেচ্ছাব করতে যায়। গলির পাশে তাদের দাদোর আমলের একটা গোলাঘর ছিলো ,গরুর গাড়ির চাকা ফড় মই, লাঙল এই সব রাখা হতো ওই ঘরের মধ্যে । শিকল তোলা থাকতো বা ভেজানো থাকতো।অপ্রয়োজনে কেউ ওঘরে যেতো না। সে পেচ্ছাব ক'রতে বসতে যাবে ,এমন সময় তার মনে হলো --- আনেছা, চুল খোলা অবস্থায় ওই ঘরের থেকে বেরিয়ে আসছে।উলুঝুলু, দুই হাত সামনে বাড়িয়ে যেন ওকে ধরতে আসছে। নকীমের মাথায় রক্ত চ'ড়ে গেলো।-- শালি তু এখ্যানে লুকাই আছিস ,আর আমি সারা রাত দুনিয়া দুনিয়া খুঁজি মরছি ?
ব'লে সে পেচ্ছাবে না ব'সে ওই ঘরে ঢুকতে যায় তাকে ধ'রে পেটানোর জন্য। লম্ফু নিয়ে যেই ঘরে ঢুকে দ্যাখে কেউ ঘরে নাই, হঠাৎ তার মাথায় কিছু একটা টোকা লাগে। ওপরে তাকাতেই দ্যাখে,
আনেছা কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে। তার জিভ বেরিয়ে গেছে। তখন তার হাত থেকে লম্ফু প'ড়ে যায়। আনেছার পা দুটোকে জড়িয়ে ধ'রে হাউমাউ ক'রে জড়ানো গলায় কেঁদে উঠে, ভাই রহিম, কে কোথায় আছো,দৌড়ে এসো, আনেছা গলায় দড়ি - - - গলায় দড়ি---- সে ওখানেই অজ্ঞান হ'য়ে প'ড়ে যায়- - তার জড়ানো চীৎকারে তার মেজোভাই রহিম দৌড়ে আসে,পাশের বাড়ির ইনসানও দৌড়ে আসে। দ্যাখে সে গোলাঘরে অজ্ঞান হ'য়ে পড়ে গোঙাচ্ছে। আর আনেছা চুলখোলা অবস্থায় কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে । তার জিভ বেরিয়ে গেছে। পাশে দেওয়ালে মই লাগানো আছে।মইয়ের দড়ি কড়িকাঠে। গলায় ফাঁস লাগিয়ে মইকে পা দিয়ে ঠেলে দিয়েছে ।আর ঝুলে প'ড়ে আবার নাগাল পাওয়ার জন্য আঁচাপাঁচা করেছে দেওয়ালে তার দাগ স্পষ্ট। ভয়ঙ্কর ঘটনা ! দেখে মনে হয়, সে দিনের বেলাতেই সব ব্যবস্থা ক'রে রেখেছিল। রহিম হাত দিয়ে দেখলো, পা একেবারে ঠান্ডা।অনেক আগেই মারা গেছে। রহিম খুব কুশলী বুদ্ধি ধরে। সে সাথে সাথে ইনসানকে তার বড়ো ভাই ও মেজো মামাকে ডেকে আনতে ওপাড়ায় পাঠালো। আর নকীমকে ঘর থেকে টেনে বের ক'রে এনে তার মুখচোখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরালো।।।বড়োভাই মুনীম ও মামা এলে পরামর্শ ক'রে তারা ঠিক করলো,ওই ঘরের কোনো কিছুতেই হাত দেওয়া যাবে না। আগে থানায় খবর দিতে হবে। ওই রাতেই থানায় খবর দিতে তাদের দুই চাচাতো ভাইকে পাঠিয়ে দিলো।থানা যাওয়ার রাস্তায় আনেছার মায়ের বাড়ি।ওদের মাধ্যমেই আনেছার মায়ের বাড়িতেও খবর পাঠালো।আর নকীমকে জিজ্ঞাসাবাদ ক'রে জানলো,সে কেমন ক'রে ঐ গোলা ঘরে আনেছাকে খুঁজে পেলো । নকীম বললো, আমি রাত দুটা নাগাদ পেচ্ছাপ করতে গলির দিকে আসতেই মনে হলো ওই ঘর থেকে চুল খোলা অবস্থায় আনেছা বাইর হুই আমাকে ভয় দেখানোর মতো ভঙ্গী করছে। তাই আমি ওকে ধরতে ঘরে ঢুকি। সকলে বললো, ওর রুহু তোকে দেখা দিয়ে ভয় দেখাতে এসেছিলো।মুহূর্তে যেন ঐ বাড়িটা একটা ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হলো ।
খবর পেয়েই আনেছার সৎভাইয়েরা ওর বাপ মা সবাই এসে হাজির হলো। কাউকেই ওই ঘরের ধারেকাছে যেতে দেওয়া হলো না । পুলিশ বেলা দশটা নাগাদ এলো ।তার আগেই গোটা গ্রামে আনেছার গলায় দড়ি দেওয়ার খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছিল। গোটা গ্রাম যেন ঐ বাড়িতে ভেঙে পড়লো। সবাই ওই ঘরে ঢুকতে চায়। ভিড় সামলাতে পুলিশ হিমশিম। পুলিশ আনেছার বাপ মা আর ভাই ও নকীম,তার মেজো ভাই ও এক মামাকে সঙ্গে নিয়ে থানার বড় বাবু সহ একসাথে ঘরে ঢুকলো, ঘরের ও আনেছার ঝুলন্ত ছবি তুললো। তারপর তারা অনেক কষ্টে কড়িকাঠ থেকে লাশ নামালো। আর ঘরের বাইরে আঙিনায় এনে শুইয়ে দিলো। সরেজমীন বিবরণ লিখলো। নকীমকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো।
আর পুলিশই বড়োবাবুর হুকুমে লাশের গলার ফাঁস খুললো। তখন তার শরীর থেকে একটা অবরুদ্ধ শ্বাস ফঁস্- স্-স্ শব্দ ক'রে বেরিয়ে এলো। পুলিশ সাব্যস্ত করলো, ওটা আত্মহত্যাই। তবে এর পিছনে কারণ কি ? আনেছার মা বাপ ভাই -রা তার উপরে নকীমের অত্যাচারের ঘটনাগুলো তুলে ধরলো। পাড়া পড়শী লোকজন্ও কমবেশী তার উপর নির্যাতনের কথা বললো । আনেছার ছেলেগুলোকে ওর বড়ো চাচার বাড়িতে নিয়ে রাখা হয়েছিলো যাতে ওরা ওদের মাকে গলায় দড়ি-দেওয়া অবস্থায় না দ্যাখে । আনেছার বড়ো ছেলেটাকে আলাদা ডেকে বড়ো বাবু জিজ্ঞাসাবাদ করলো। সেও তার মাকে যে তার বাপ মারা ধরা করতো তা অকপটে বললো। থানার বড়ো বাবু যা বুঝবার বুঝলেন। নকীমের মেজো ভাই রহিম বড়ো ভাই মুনীম আরো পাড়া পড়শী নাবালক বাচ্চাতিনটাকে দেখিয়ে বড়ো বাবুকে খুব অনুরোধ উপরোধ করলো নকীমকে অ্যারেষ্ট না করার জন্য। নকীমের এক মামাতো ভাই শিক্ষিত, সে বড়োবাবুকে আড়ালে ডেকে কিছু শলা পরামর্শ করলো।হয়তো টাকা-পয়সা দিয়ে কোনো রফা ক'রে থাকতে পারে। নকীমকে আপাততঃ পুলিশ গ্রেফ্তার করলো না। লাশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে গেল। কারোর কাকুতিমিনতি শুনলো না। তার নাবালক তিন ছেলেমেয়ের কথা বিবেচনা ক'রে তারা নকীমের নানান অত্যাচার সত্বেও বেশ কয়েকটা ডান্ডার বাড়ি মেরে তাকে ছেড়ে দিলো। বললো কেস তারা দিবেই।পুলিশ গোলাঘরটাকে তালা দিয়ে সীল ক'রে দিয়ে গেল।
পরদিন দুপুরে থানা থেকে লাশ ছাড়া হলো দাফনের জন্য। সন্ধ্যার আগেই তাড়াহুড়ো ক'রে দাফন করা হলো , কারণ অপমৃত্যুর রুহুকে সবার ভয়। তারপর বহুদিন ঐ বাড়ির কেউ ঐ গোলা ঘরের দিকে যেতো না। বা বাইরের লোকজনও ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যেতো না।এমনকি বাড়ির লোকজন সন্ধ্যা হলেই ওদিকে তাকাতে ভয় পেতো। সারা রাত বাহির বাড়িতে হারিকেন জ্বালিয়ে রাখতো। বলতো,ওর অতৃপ্ত রুহু ওর বাচ্চাদের কাছে আসবে। অনেক সময় ওর ছোট বাচ্চাটা সন্ধ্যা রাতেও ভেঙরুল ক'রে কেঁদে উঠতো। মা,মা ,মা ক'রে আঙুল তুলে দেখাতো ওর মায়ের চ'লে যাওয়া। পরে নকীম সবার কথায় আনেছার রুহুর মাগফেরাতের জন্য বাড়িতে মিলাদ ,কোরানখানি ও লোকজন খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলো। ছোট মেয়েটাকে কিছুদিন ওর নানী নিয়ে গেছিল। সবাই বললো আনেছা গলায় দড়ি দিয়ে নিজে তো মরলো ,বাচ্চা গুলোকেও লসিয়তে ফেলে গেল।
বদরাগী নকীম তবুও গাঁজার আসর ছাড়েনি।স্বপ্নে নাকি আনেছা নকীমকেও তার বাচ্চাদের ওপর অত্যাচার করলে প্রতিশোধ নিবে ব'লে শাসায়। হয়তো সেই ভয়েই সে আর নতুন বিয়ে করেনি। আর আনেছার গলায় দড়ি দেওয়ার দৃশ্য সে ভুলতে পারে না, যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
----------------------
বদরুদ্দোজা শেখু , বহরমপুর
--------------------------------‐-
• সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত
----------------------------
বদরুদ্দোজা শেখু 18 নিরুপমা দেবী রোড , বাইলেন 12 ,
বহরমপুর ,
মুর্শিদাবাদ,
পঃ বঙ্গ , ভারত ।