গল্প।। অন্ধকারে ভয়।। সৌমিক ঘোষ
তখন লক ডাউনের বিধি একটু শিথিল । এক শীতের সন্ধ্যায় তন্দ্রিমা আর সুস্মিতের বিয়ের পর্ব মিটে যায় । বন্ধু আর কাছের আত্মীয়ের আপ্যায়নে বৌভাতের রাত বেশ গভীর । তন্দ্রিমার বাবা , মা , ভাই আরও অনেকে চোখের জলে নতুন জীবনের শুভেচ্ছা আর আর্শীবাদ জানিয়ে যায় । সকলে নীচে নেমে গেলে অনিমা মেয়ের পাশে বসে হাতটা ধরে বললেন – তুই কিছু ভাবিস না । সব ঠিক হয়ে যাবে । সুস্মিত খুবই ভালো ছেলে । ঘরোয়া ধরনের । এখন তুই ঘরের বউ । সব মানিয়ে নিবি । দেখবি আদর ভালোবাসায় তুই সুখেই থাকবি ।
- এইটা তোমার থাকার ঘর । দাদা নিজে হাতে সাজিয়েছে । এসো , এসো । হাত ধরে সুস্মিতের বোনরাই তন্দ্রিমাকে ঘরে ঢোকায় । সঙ্গে হই হই করে আরও অনেক মহিলাও হাজির । গোলাপ আর রজনীগন্ধায় খাট আর ঘরটি রুচিসম্মত সাজানো । অহেতুক মালার জালে হুজুগে ভালোবাসার লোকদেখানি নেই । সুস্মিতের মা এসে আসন পেতে জায়গা করেন ।
-এই রাই , নিপা যা তো । মিনু মাসীকে বল্ ফুলসজ্জার জিনিসগুলো এখানে আনতে ।
নতুন পোশাক পাল্টানো , আসনে বসে একে অপরের সুতো খোলা , মিস্টিমুখ , মালা পরানো মিটিয়ে হাসিমুখে সকলের কথা শুনে সুস্মিত ঘর ফাঁকা করে । দরজায় ছিটকিনি দেয় । তন্দ্রিমাকে হাত ধরে খাটে বসায় । মুখের দিকে তাকিয়ে বলল – কি কেমন লাগছে এখানে ? নতুন জায়গা ।
-না,না । ঠিক আছে ।
সুস্মিত দাঁড়িয়েই বলল – ঠিক ভালো বুঝি না । যা অসুবিধা পার্সোনাল হলে আমাকে আর ফ্যামিলির হলে মাকে জানাবে । আরে ! ভুলেই যাচ্ছিলাম । - বলেই চাবী খুলে ড্রয়ার থেকে আংটির বাক্স বার করে ।
-হ্যাপি ফিউচার ! তন্দ্রিমার আঙ্গুলে আংটি পরিয়ে বুকে টেনে নেয় । সুস্মিত বলল – এভাবেই আমি সব সময় তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকবো । দেখে নিও ।
তন্দ্রিমা দেখে আংটিতে সাতটা সবুজ ছোট পাথরের 'টি' ও এনগ্রেভে তলায় 'এস' লেখা । মনটা বেশ ভালো লাগে ।
-চারিদিকে আজ অনেকে আছে ; - বলেই সুস্মিত আলো অফ করে দেয় ।
অন্ধকারে তন্দ্রিমাকে কাছে টেনে নিতে যায় । তন্দ্রিমার মনে হয় কুন্ডলি পাকানো সেই পুরোনো ভয় যেন দুটো রোমশ হাতে তার গলার কাছে । অবয়বহীন হাত এগিয়ে আসে । মুখের ওপর একটা চাপ । একটা ভয়ার্ত গোঙানি শুনেই ছিটকে সরে যায় সুস্মিত । ঝট্ করে বেড ল্যাম্প জ্বালে । দেখে তন্দ্রিমার মুখে ঘাম । উঠে বসেছে ।
-কি হল ? অন্ধকারে ভয় ? আমি আছি তো ।
-হ্যাঁ । নতুন জায়গা । অন্ধকার ---
-ঠিক আছে । অনেক ধকল গেছে । চলো শুয়ে পড়ি ।
-প্লিজ । আলোটা নিভিও না ।
সুস্মিত লক্ষ্য রাখে আলোয় সবাইয়ের মাঝে তন্দ্রিমা স্বাভাবিক । কিন্তু অন্ধকারেই কি যেন একটা ভয় ওকে ঘিরে ধরে । ঠিক যেমন রাই এখনও একা সিঁড়িঘরে যেতে আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায় ।
রাই ও নিখিলের বিয়ের পরে প্রথম সন্তানের খবরে সকলেই উচ্ছ্বসিত । তারপরেই ব্লিডিং , ফিটাল ডেথ । নিখিলের বন্ধুর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের জেরে ডিভোর্স । সেই থেকে এবাড়িতেই ।
রাই আর তন্দ্রিমার বন্ধুত্বটা সকালে টিফিনের পরে ও দুপুরে খাওয়া মিটিয়ে গল্প – আড্ডায় জমে যায় । দুজনেরই মনের ভয় – একলা সেই অন্ধকার । একদিন দুপুরে ঘন কালো মেঘে বৃষ্টির মাঝে হঠাৎ বাজের শব্দে বিছানায় জড়িয়ে ধরে একে অপরকে । ভরসা জাগে ভালোবাসায় । নিঃশ্বাস পড়ে তাড়াতাড়ি । পায়ে পায়ে আঁকিবুকি খেলা ।
-কি রে রাই । শুয়ে পড়েছিস ? এদিকে যে সব ভিজে গেলো ।
মায়ের গলা শুনে দুজনেই উঠে পড়ে । তাড়াতাড়ি জানলা , স্লাইডিং সব বন্ধ করে । বারান্দার গুটিয়ে যাওয়া জামা কাপড় মেলে দেয় । শাড়ির আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে তন্দ্রিমার মুখটা চেপে ধরে রাই সপাটে চুমু খায় । তন্দ্রিমা যেন এটাই চাইছিল । রাই একছুটে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আসে । উত্তেজনায় ওর বুকটা ওঠানামা করতে থাকে ।
-ওফ ! কি থ্রিলিং না । দ্যাখ আমার শরীরটা কেমন কাঁপছে , - বলেই তন্দ্রিমার হাতটা রাই নিজের বুকের ওপর চেপে ধরে । তন্দ্রিমা এবার চুমুতে ভরিয়ে দেয় রাইয়ের মুখ । জিভ নিয়ে খেলার পর ওর ঠোঁট কামড়ে দেয় । ওফ ! - বলে আশ্লেষে রাই এলিয়ে দেয় দেহ ।
সুস্মিতের দেহ যেন জাগে না দাম্পত্য সম্ভোগের 'ওম' আঁচে । বিরূপ বিছানায় মনে হয় তন্দ্রিমার মন অন্তর্লীন । আবেগের উষ্ণ স্রোতেও হারিয়ে যায় শিহরণ এক অজানা ফল্গুধারার গোপনে । প্রেমের কত কথা সাজানো হাসিতে শেষ করেই একটা স্নান । যে সময়েই হোক পুরুষের ছোঁয়া একটা বিতৃষ্ণায় তন্দ্রিমাকে আতঙ্কিত করে । সুস্মিত তার কাছের মানুষ হলেও তন্দ্রিমা নিজেকে মেলে ধরতে পারে না ।
-পারতে তোমাকে হবেই । সামনে জীবন পড়ে আছে । সুন্দর ভাবনায় বাঁচো ।
মনোবিদ ডঃ জয়ন্ত মিত্রের কথায় তন্দ্রিমা বলেছিল – আবার যদি ---
-সে সব অতীত । আজকের কথা । কালকের ভাবনায় নিজেকে মিলিয়ে দাও । আমাদের মনটা জলের মত । যে আধারে রাখবে তাতেই মানিয়ে নেয় । তুমি তোমার মধ্যে মনকে সময়ের তালে হারিয়ে যেতে দিও না । নতুন করে হোক শুরু ।
শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগে । পাড়ার প্রানেশকাকু প্রায়ই বাড়িতে আসতো । -'বৌঠান' –বলে একেবারে বাড়ির ভেতরে মায়ের কাছে রান্নাঘরে । বাবার দাবার সঙ্গী । চায়ের আড্ডার পাটর্নার । -মা , বাবা - বলে অহেতুক মাথায় গায়ে হাত দিত । ভাই বিরক্তে অনেকসময় হাত সরিয়ে দিলেও , তন্দ্রিমা লজ্জায় সরে যেত । বাবা , মায়ের আড়ালে এই উৎপাত চলতেই থাকে । একদিন মাকে ঘুরিয়ে তন্দ্রিমা এই বিষয়ে বলতে গেলে ; মা হেসে বলল – ধ্যাত ! বুড়ো মানুষ তোদের ভালোবাসে । তাই একটু আদর করে ।
সেদিন ছিল বিপত্তারিণী পুজো । সকাল থেকে আকাশ মেঘলা । দিনের আলো কমে এসেছে । মা ভাইকে নিয়ে মন্দিরে । বাবা বাজারে । হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টি । কলিং বেল বেজে ওঠে । -মা , তাড়াতাড়ি খোল মা । ভিজে কাক হয়ে গেলাম । তন্দ্রিমা ছুটে গিয়ে দরজা খোলে ।
-একদম ভিজে গেছি রে ! একটু গামছা দে না , মা। ওফ ! জানলাগুলোও বন্ধ করিসনি । জলের ঝাঁট ঢুকছে তো ।
জানলাগুলো কোনরকমে বন্ধ করি । গামছাটা এনে দি । অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালাতে যাই ।
-থাক না । শুধু শুধু কারেন্ট খরচা । এঃ ! তুইতো একদম ভিজে গেছিস ; - বলেই গামছাটা গায়ে ঘসতে থাকে । তারপরেই কৈশোর পেরোনো যৌবনে পরিণত স্তন বিকারগ্রস্ত হাতে যন্ত্রনায় দেহকে কুঁকড়ে দেয় । প্রচন্ড জোরে তন্দ্রিমাকে চেপে ধরে লুঙ্গিতে চাপা জেগে ওঠা পৌরুষ ঘষতে থাকে । ছাড়ানোর চেষ্টায় ঠোঁট , গাল , গলায় বিড়ির গন্ধওলা মুখের লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয় । ঘন অন্ধকারে ঠান্ডা একটা ভয় দেহকে যেন অবশ করে দেয় । প্রানেশকাকু একটানে অন্তার্বাস নামিয়ে নারীত্বের চরম অপমান শুরুতেই আবার কলিং বেল বেজে ওঠে । - ধ্যাত্তরি ! এই নিয়ে মুখ খুলবি না । – বলেই কোনরকমে লুঙ্গি সামলে দরজা খুলতে চলে যায় ।
-কি ব্যাপার রে ? চা না খেয়েই তোর কাকু আজ চলে গেলো । মায়ের চোখে সবই ধরা পড়ে । মা প্রসাদের ডালাটা দিয়ে ভাইকে ভেতরে পাঠিয়ে দেয় ।
আমি মাথা নিচু করে বসে থাকি । মা মাথাটা ধরে তোলে । চোখ বন্ধ রাখি । অন্ধকারে সেই ভয়টা যেন এখনও ঘিরে রাখে । আমি সজোরে মাকে জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে উঠি ।
-বুঝেছি । আর বলতে হবে না । চল্ আগে চান করে নে । বাবাকে কিছু বলবি না । এরপরে মায়ের প্রশ্নে না না করে আমি কোলে মুখ লুকোই ।
লুকোলে তো হবে না । আমি দেখে ফেলেছি – বলেই অনির্বান একেবারে বেডরুমে । নিখিলের একদম বেস্ট ফ্রেন্ড ।
-তুই পাত্তা দিতিস কেন ? রাইকে জিজ্ঞাসা করে তন্দ্রিমা ।- বন্ধু যখন থাকবে তখন এসো । ফাঁকা ঘরে তুই ---
-আরে যখন তখন চলে আসতো । বাড়ির সবাই ওকে খুব বিশ্বাস করতো । বাড়ির ছোটখাটো কাজও করে দিত ।
-ছাড় । তুইও সময় কাটাতিস ।
-ছাদে একদিন অনেক জামাকাপড় মেলা ছিল । সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল । সব নিয়ে নামছি । অন্ধকার সিঁড়ি ঘর ।সামনে কাপড়ের বোঝায় আমার মুখ ঢাকা ।ধাপ ছুঁয়ে ছুঁয়ে পা ফেলছি । হঠাৎ 'ধাপ্পা' বলতেই কাপড় সমেত অনির্বানের ওপর । আমাকে ধরেই চুমু । কাপড় তুলে দেবার অছিলায় সারা দেহেই হাত চলে । সেই শুরু । আমি এড়িয়ে চলতে থাকি । তখন প্রেগন্যান্সি চলছে । ভালো লাগছে না । বারান্দাটা অন্ধকার । একটু হাঁটছি । সিঁড়ি ঘরের আলোটা জ্বলছে নিভছে । কাছে গিয়ে আলো বন্ধ করতেই অন্ধকারে সিঁড়িঘর থেকে অনির্বান নেমে এসে কোলে তুলে নেয় । সোজা বেডরুমে । দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বলে – আজ তো নিখিলের মিটিং । আমি মেমসাহেবের সঙ্গে মিটিংটা সেরে ফেলি । প্রাণপণে বাধা দিতে গিয়ে চাপ আর সজোরে মিলন রক্তাক্ত হয়ে যায় ।
-বাঃ! তাহলে হয়েই গেলো । অনেকদিন ধরে ভাবছি এতো কেন পিরিত ।- নিখিলের গলা শুনে অনির্বান চমকে প্যান্ট আর জামা নিয়ে হাওয়া ।
-আমাকে জোর করে ---
-থাক আর বলতে হবে না ।
-আর কি বলবি ? বাকিটাতো জানি ।-বলেই তন্দ্রিমা কাছে টেনে নেয় রাইকে । শরীর নিয়ে চলে আদরের খেলা ।
-এই বেশ আছি ।-বলেই চন্দ্রিমাকে জড়িয়ে ধরে রাই ; - ছেলেগুলোকে দেখলে কেমন যেন
লাগে ।
-তোর দাদাকে ঠকাচ্ছি না তো । শরীর আর মনের এই ফাটলটা আমি সারাতে পারলাম না । স্কুলের শেষের দিকে , কলেজে ছেলেগুলোকে আর বিশ্বাসই করতে পারিনি । আজও যেন মনটা বাইরেই পড়ে আছে ।
আজ অফিসের কাজে সুস্মিত বাইরে । রাই আর তন্দ্রিমা বিছানায় । নাইট ল্যাম্পটা জ্বলছে । দুজনেরই যে অন্ধকারে ভয় ।
------------------------------------