—"বাবা,দেখো,এই ধুতিটা তোমার জন্য এনেছি৷ খাদির৷ দামি ধুতি৷ তোমার পছন্দ তো?"
—"বাবা,দেখুন,আপনার পছন্দের বাটিচচ্চড়ি করেছি আজ৷ খেয়ে দেখুন তো নুন-টুন ঠিক আছে কিনা!"
নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না অশীতিপর বিশ্বম্ভর গড়াই ৷ এত আদর-যত্ন-ভালোবাসা যে হারিয়েই গিয়েছিল ওঁর জীবন থেকে ৷ পাঁচ বছর আগে গিন্নি গত হবার পর আরও একলা হয়ে পড়েছেন তিনি ৷ এখন গিন্নির গড়া সংসারের পারমানেন্ট কেয়ারটেকার বলতে এই বুড়োটা৷যে ছেলেকে মানুষ করার জন্য নিজের গোটা জীবনটা নিঃশেষ করে দিয়েছেন,আজ সেই ছেলেই কেমন যেন পর হয়ে গেছে৷কাছে থেকেও দেখা করে কথা বলারও সময় হয়না৷বিয়ের পর পর যে বৌমার আবদার মেটাতে দরাজ হাতে খরচ করেছেন,আজ তাকেই বুঝিয়ে দিতে হয় দৈনিক বাজারের খুঁটিনাটি হিসেব৷ তাই এমন যত্ন পেয়ে তিনি অবাকই হয়েছেন৷
অথচ এই বিশ্বম্ভর গড়াই দেশের স্বাধীনতার জন্য জান-প্রাণ দিয়ে লড়েছিলেন ৷ ৪২-র আগস্ট আন্দোলন,তারপর তেভাগা,সেখান থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলন—দেশকে গড়ার কাজে নিজের জীবনের অনেকটাই ব্যয় করেছিলেন তিনি৷স্ত্রী কল্যাণীর ওপর ছিল গোটা সংসারের ভার৷কিন্তু একদিন আর এই ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর পোষালো না বিশ্বম্ভরের৷তাই চেষ্টা-চরিত্র করে একটা কেরানীর চাকরি জুটিয়ে ছেলেকে মানুষ করার কাজে ব্রতী হলেন৷সেটাই হয়ে দাঁড়ালো তাঁর মিশন৷আর যত বিপদ-বাধাই আসুক,মিশন কমপ্লিট করে আসার শিক্ষাই তিনি আজীবন পেয়েছেন৷ তাই স্ত্রীকে মৃত্যুর আগে দেওয়া কথা তিনি ফেলতে পারেননি৷সংসারে ব্রাত্য হয়েও পড়ে রয়েছেন মুখ বুজে৷নিজের পেনশনের টাকা দিয়ে কোন ওল্ড এজ হোমে সসম্মানে না থেকে ছেলের হাতে সমস্ত টাকা তুলে তিনি বেছে নিয়েছেন এই অসম্মানের জীবন৷
—"এটা খেয়ে নিয়ে ধুতি আর পাঞ্জাবিটা পরে আমার সঙ্গে চলো বাবা৷
—"কোথায় রে?"
—"চলোই না,আজ স্বাধীনতা দিবস না!তোমাদের মতো স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সরকারী স্বীকৃতি দেওয়া হবে৷তোমার নামটা আমি এন্ট্রি করে দিয়েছি৷শরৎ সদনে অনুষ্ঠান৷"
ব্যাপারটা বুঝতে আর বাকি রইলনা বিশ্বম্ভরবাবুর৷সরকারী স্বীকৃতি,মানে কিছু টাকা,আর তাই এত আদরের ঘনঘটা৷
—"হা ঈশ্বর!কল্যাণী,এদের সাথেই থাকতে বলেছো আমায়!এরা!!যাদের নজর সবসময় বাপের টাকার দিকে!নাঃ,আর নয়,অনেক হয়েছে৷"
পাঞ্জাবিটা পরতে পরতেই মনস্থির করে ফেলেন বিশ্বম্ভর৷মনের মধ্যে কোথায় যেন বেজে ওঠে পুরনো বিউগল৷
---------------------------
নির্মলেন্দু কুণ্ডু
বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ