ধারাবাহিক উপন্যাস ।। পরজীবী ( পর্ব -১০) ।। অভিষেক ঘোষ
পরজীবী (পর্ব -১০)
অভিষেক ঘোষ
দশম পরিচ্ছেদ
২০১৫
পৃথিবীটা ক্রমশঃ তারই মতো সুযোগসন্ধানী লোকজনে ভ'রে যাচ্ছে, আজকাল এই ব্যাপারটা খুবই অনুভব করে সূর্যকান্ত । জীবন অন্যদের জন্য যে ঘুঁটিগুলো সাজিয়েছে, তাতে হামেশাই সে হস্তক্ষেপ করেছে । কেউ কেউ অত্যন্ত সজাগ বলে, ধরে ফেলেছে, যেমন - মাধবী । কিন্তু সূর্যকান্তকে মোকাবিলা করার মতো বুদ্ধি বা, ক্ষমতা - কোনোটাই ওই চরের মেয়েটার ছিল না । আরে অত সহজ নাকি ! সূর্যকান্তর সব মাস্টারপ্ল্যান বাওয়া ! তুমি ভাববে, ধরে ফেলেছো ! কিন্তু বুঝতেও পারবে না, ওটাও প্ল্যানের মধ্যেই ছিলো, ধরে ফেলবে এবং তারপরই কিছু একটা ভুল করে বসবে ।
'সদানন্দ... গায়ে গন্ধ' যে মাধবীর নোংরা ছবি আঁকছে, সেটা কেউ ধরতে পারতো না, যদি না সে কোনো একদিন মেয়েটাকে ফলো করে করে সদানন্দর ঘরে যেতো । দাদাকে অর্থাৎ রাধাকান্ত মিত্তিরকে হালকা করে খবরটা সেই দিয়েছিলো । কিন্তু কায়দা করে - "জানো দাদা, কাকাবাবু না ওই মেয়েটার ছবি আঁকে !"
"কোন্ মেয়েটার ?"
"আরে ওই চরের মেয়েটার গো !"
"মারবো এক গাট্টা ! বলেছি না, ওকে চরের মেয়ে বলবি না । মাধবীদিদি বলবি ।"
"আচ্ছা সে না হয়... বলবো !"
"তোকে কে বললো ছবি আঁকে ?"
"আমি তো দেখলুম সেদিন, দরজাটা একটু হালকা করে খোলা ছিল, মাধবীদিদি উপরের জামা-কাপড় সব খুলে পোজ দিচ্ছে !"
"কীই.. ?" হেঁকে উঠেছিলো রাধাকান্ত, তারপর শাসিয়েছিলো, বানিয়ে বললে, কঠিন শাস্তি হবে । সে তো সূর্যকান্ত জানেই । খেলার মাঠে তুমি কম মেরেছো ? নিজের ভাই বলে কখনও রেয়াত করেছো ? সেই যে সেবার ক্রিকেট খেলার সময় আউট হলেও কিছুতেই রাধাকান্ত ব্যাট দিচ্ছিলো না, তখন প্রতিবাদ করায় হাঁটু দিয়ে তার পেটে এক প্রবল গোঁত্তা মেরেছিলো সে ! একবার রাগ করে ক্যাম্বিসের বল পুকুরে ছুঁড়ে দেওয়ায় সূর্যকান্তর মাথার দু'পাশে কানের কাছে দু-হাতে চেপে ধরে, মাটি থেকে অনেকখানি উঁচুতে তুলে ধরেছিলো রাধাকান্ত । সেবার সূর্যকান্তের মনে হয়েছিলো, তার গলা থেকে যেকোনো মুহূর্তে মাথাটা আলাদা হয়ে যেতে পারে । সেসব কথা ভোলে নি সূর্যকান্ত । তোমায় ছাড়বে সূর্যকান্ত ? বাবার প্রিয় পাত্র হয়ে বসে আছো ! এদিকে বুদ্ধির ঢেঁকি ।
তারপর সেই যে মাধবীকে নিয়ে, সদানন্দকে নিয়ে, রাধাকান্তর মনে সন্দেহ ঢুকে গেলো, সে চেঁচামেচি করে সদানন্দকে তাড়িয়েই ছাড়লো। বাড়ির অন্দরমহল সেই অবিশ্বাসের চোরাবালিতেই ক্রমে দুর্বল হলো । এতদিনের এত অঘটন যা পারে নি, সেদিন মাধুরী দেবীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তাই হলো... বাড়ি ছাড়তে হলো সদানন্দকে । কিন্তু ওই যে ছেলের কথায় ভাইটিকে তাড়ালেন কৃষ্ণকান্ত মিত্তির, সেই থেকে তিনি মাধবী আর রাধাকান্তর উপরও চটে রইলেন । কিন্তু কৌন এসব কিয়া রে ? সূর্যকান্ত নে... চাণক্য কা মানস-শিষ্য ! - আপন মনেই বলে সূর্যকান্ত, কৃতকর্মের জন্য ঈষৎ গর্বও বোধ করে সে ।
ওই 'চরমারানি' মেয়েটার অতিরিক্ত দম্ভই ওর জন্য কাল হলো... ও ভাবতো, যা করছে, ঠিক করছে । তাই বুক ফুলিয়ে পেরেম করতো । আরে কোথায় ছিলি বে তুই অ্যাদ্দিন ? রাধাকান্ত তোকে পুরোপুরি পেয়ে গেলে ছুঁড়ে ফেলে দিতো, গ্যারান্টি । গ্রাম আর গ্রামের বাইরে, ওর কতো গোপিনী আছে, তার খবর সূর্যকান্ত রাখে । আরে, সাধে বলে 'নলেজ ইজ পাওয়ার' ? কিন্তু রাধাকান্ত মাধবীর প্রতি নিজে থেকেই উদাসীন হয়ে গেলে, তখন খেলা বদলে যেতো । মাধবীও হয়তো খেলাটা ততদিনে ধরে ফেলবে, তার আগেই তাই পাশাটা উলটে দিয়েছিলো সূর্যকান্ত । 'জানালায় ঢিল ছুঁড়েছিলে না, মাধবী ? এইবার দেখো, তোমায় কোথায় ছুঁড়ে ফেলি...' - এমনটাই ভেবেছিলো সূর্যকান্ত ।
এখনও সেই রাতের কথা মনে আছে তার । ১৯৮৮ সাল বোধহয় । তার জন্মদিনের রাত, ঝড় শেষের রাত, কিন্তু বৃষ্টির রাত । উফ্ সে একটা ঝড় হয়েছিলো বটে, খালি ঝনঝন আর শনশন ! তারা তিন ভাই, সূর্য-মণি-চন্দ্র একসাথে দোতলার ঘরে শুতো তখন । তিনজনের মধ্যে সূর্য-চন্দ্রর জন্য একটা বড়ো খাট, পাশেই আর একটা খাটে বারো মাস নানান অসুখে ভোগা মণিকান্ত । বেচারা ঘুমোচ্ছিলো । সে আর চন্দ্র - দুজনেই ছোটো তখন । তার বোধহয় বছর ষোলো বয়স আর চন্দ্রকান্তর বছর বারো... অতো খেয়াল নেই তার । তাও দেখতে দেখতে সাতাশ-আঠাশ বছর পার হয়ে গেলো । বন্ধ জানালার কাচে ওপাশের পেয়ারা গাছটার একটা ডাল মাঝে মাঝে বাতাসে ধাক্কা খেয়ে পাতাগুলো-সমেত ছুঁয়ে যাচ্ছিলো । যেন ভূতে আঁচড় কাটছে জানালায় । চাঁদ ভয় পাচ্ছিলো তাই দেখে, আর সেও বানিয়ে বানিয়ে কীসব বলে তাকে ভয় দেখাচ্ছিলো... এখন আর মনে নেই । কিন্তু ভূতগুলো তো এলো তার পরে । জায়গা-জমি হারিয়ে প্রেতের মতো, দক্ষিণের চরের জলা-জমি থেকে উঠে এসে গোটা তিরিশ-চল্লিশটা ভূত নীচে দাঁড়িয়ে ছিলো । তার হঠাৎই চোখ পড়ে যায় । তাদের সদরে সারারাত আলো জ্বলতো তখন । একটা দারোয়ান ছিলো সেই সময়ে তাদের । সে অবশ্য গেটের ভেতর তার চৌকো ঘরে বসে বসে ঘুমোচ্ছে তখন । তাছাড়া পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোটাও ছিলো । সে জানালাটা খুলে দেখেছিলো, হালকা বৃষ্টির ঝাঁটে সব দাঁড়িয়ে ভিজছে । হতশ্রী, ছেঁড়াখোঁড়া জামা-কাপড় পরা... ওগুলো মানুষ.. ? ভূত... সব ভূত । তবে একটা ছিলো ডাকিনী । দোতলার জানালায় সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়েছিলো ওই মাধবী । সে ভয় খেয়ে জানালাটা সশব্দে বন্ধ করে দিতেই, ঢিলটা এসে পড়লো । আরেকটু হলে চাঁদের কপালে লাগতো । বেচারা সেজো মণিকান্ত চেঁচিয়ে উঠলো ধরা গলায় । তারপর তো কতো কান্ড ! ভূতগুলো ক'দিন পর আবার স্বাভাবিক হয়েছিলো । কেমন ঠুঁটো জগন্নাথের মতো বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে প্রতিবেশীদের বাড়ির সামনে দিন নেই রাত নেই, দাঁড়িয়ে থাকতো - নট্ নড়নচড়ন, নট্ কিচ্ছু । ভূত না তো কী ? কে জানে বাবা ! জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি সব হারালে হয়তো মানুষেরা ভিতরে ভিতরে ওইরকম মরে যায় - সন্দেহ হয় সূর্যকান্তর ।
সূর্যকান্ত তার বাবা কৃষ্ণকান্ত মিত্রকে কোনোদিনই ভালোবেসে উঠতে পারেনি । তার বা, চন্দ্রকান্ত - কারো সাথেই কৃষ্ণকান্তর সেই অর্থে কোনো সদ্ভাব ছিল না । ছেলেদের উপর নজরদারি আর চাট্টি হুকুম জারি, এছাড়া আর কিইবা করেছেন তিনি ? হ্যাঁ এটা ঠিক যে তিনি চাইতেন, সূর্যকান্ত মোটামুটি আঠেরো পেরোলে, তাঁর সাথে জমিজমা, পুকুর লিজ দেওয়া, ধানকল, কাঠকল ইত্যাদি ব্যাপারগুলো একটু দেখাশোনা করুক । কিন্তু সেটা কেন ? তার কারণ কিন্তু এই নয় যে, তিনি সূর্যকান্তকে এবার একটু প্রায়োরিটি দিচ্ছেন, ছেলেকে বুঝতে চাইছেন বা, তাকে মর্যাদা দিচ্ছেন, সেসব নয় । তিনি রাধাকান্তকে ছেড়ে সূর্যকান্তর দিকে একটু ঝুঁকেছিলেন তার কারণ হচ্ছে রাধাকান্ত তখন স্বাভাবিক ছিলো না, তারপর একেবারে মানচিত্রের বাইরে চলে গেছিলো । একে তো হসপিটালাইসড্ ছিলো কিছুদিন, রেপ কেসে ফেঁসে তার বছর দুয়েকের জেল হয়েছিলো তারপর, কিন্তু সেই অর্থে পুরোপুরি সেরে উঠতে সে কোনোদিনও পারেনি । ওই ঘটনার পর থেকেই কৃষ্ণকান্তর ও শরীর ভাঙতে থাকে । কিন্তু অদ্ভুত লোক এই কৃষ্ণকান্ত ! বাবা হয়ে বড়ো ছেলের সাথে লোকটা যা করেছিলো, ভাবতে অবাক লাগে সূর্যকান্তর । রাধাকান্ত জেল থেকে ফিরে আসার পর প্রায় উন্মাদ গোছের হয়ে যায় । কিন্তু বাড়ির কেউ জানতো না যে, রাধাকান্তকে গোপনে কৃষ্ণকান্ত বাড়িতে নিয়ে এসেছেন, এমনকি মাধুরী দেবীও জানতেন না । আর সেই সময় সূর্যকান্ত তাকে হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করে বাড়ির গোপন ঘরে ! মুখটা একবারে রোগাটে আর লম্বা হয়ে গেছে, খোলা পিঠে বেডশোরের মতো কীসব হয়ে আছে, হাত পায়ের শিরাগুলো কীর'ম নীলচে হয়ে আছে, এমন ভয়াবহ লেগেছিলো সূর্যকান্তর, যে সে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিলো । এই গোপন ঘরটা শশীকান্ত মিত্র, অর্থাৎ তার ঠাকুরদা বহুদিন আগে বানিয়েছিলো এসকেপ রুট হিসেবে । অর্থাৎ যদি কোনোদিন কোনো কারণে বিষয়-সম্পত্তি নিয়ে পালিয়ে যেতে হয়, তাহলে পথটা কাজে লাগবে, এই ভেবে বানানো । কৃষ্ণকান্তের ঘরের একেবারে ডান কোণে মেঝের উপর সব সময় একটা দামী কার্পেট পাতা থাকে । যাতে কেউ সন্দেহ না করে, সেই কারণে ওই কার্পেটের ওপরেই একটা বসার টেবিল আর তিনটে কাঠের চেয়ার পাতা থাকে । গোপনে কৃষ্ণকান্তকে ফলো করে হঠাৎই এক রাত্রে ভেজিয়ে রাখা জানালার কাঠের পাল্লার ফাঁক দিয়ে স্তম্ভিত সূর্যকান্ত দেখতে পায়, কৃষ্ণকান্ত টেবিল টেনে, ওই কার্পেট উঠিয়ে নীচে গোপন ঘরটায় নামছে । শশীকান্তর আকস্মিক মৃত্যুর পর কৃষ্ণকান্ত কোনো এক সময় ঐ ঘর থেকে বাইরে যাবার যে গোপন পথ, সেটাকে বন্ধ করে দিয়েছিলো ভিতর থেকে । ফলে ঘরটা তখন আর পালিয়ে যাবার রাস্তা নয়, ঘরটা পুরোদস্তুর একটা বেসমেন্টে পরিণত হয়েছিলো । উপরে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে, গভীর রাতে হাতে একটা হ্যাজাক নিয়ে কৃষ্ণকান্তকে ওই অন্ধকার ঘরটায় সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখে সূর্যকান্ত নিশ্চিত হয়েছিলো কোনো রহস্য আছে । সেই মুহূর্তে বাড়িতে কোনো গোপন কাজে তাকে বাধা দেওয়ার কেউ ছিলো না । পরেরদিন দুপুরে কৃষ্ণকান্ত কাঠকলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যেতেই, সূর্যকান্ত চুপিসারে বাবার প্রমাণ সাইজের শোবার ঘরে ঢুকে যথারীতি টেবিল-চেয়ার সরিয়ে, কার্পেট তুলে, নীচে গোপন কক্ষে নামে । হাতে ছিল জাস্ট একটা টর্চ । টর্চটা জ্বালাতেই সে বুঝতে পেরেছিল, ঘরটায় সোজাসুজি প্রবেশ করতে পারবে না সে । কারণ একটা মোটা লোহার গেট বসানো, এটা আবার কখন, কবে তার অজান্তে বসানো হয়েছে সত্যিই সে জানতো না ! হয়তো যখন কলেজ ট্যুরে বা, বন্ধুদের সাথে কোথাও সে গিয়েছিলো, তখন কৃষ্ণকান্ত তার গোপন ঘরে এই সমস্ত ব্যবস্থা পাকাপাকি করেছে ! অদ্ভুত ব্যাপার সে আঁচটি পর্যন্ত পায়নি ! চোখে অন্ধকার কিছুটা সয়ে যেতে সে অনুভব করেছিলো গেটের ওপারে অন্ধকারে সাদা মতো কিছু একটা নড়াচড়া করছে ! সে তখন বিস্ময়ে অভিভূত । তারপর সে টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ভালো করে ঠাহর করে বুঝতে পারে, ওই সাদা মতো জীবটি একটা মানুষ । সে মুখে নানা রকম শব্দ করতে থাকে, ওই লোকটার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে । সেই ফাঁকে সে খেয়াল করেছে, বন্ধ লোহার গেটের ওপরে ঘরটার মধ্যে একটা লোহার খাট আছে, পেচ্ছাপ-পায়খানার একটা মোটামুটি ব্যবস্থাও আছে, ঠিক ঘরটার মাঝখানে উপরে সিলিংয়ে ঝুলছে একটা বাল্ব, আলোর ব্যবস্থা বলতে ওই একটিই, এবং সেটাও বন্দীর ইচ্ছামতো জ্বলবে না, জ্বলবে কৃষ্ণকান্ত মিত্রের ইচ্ছামতো । কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে নানা রকম ভাবে চেষ্টা করেও বন্দির কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নিরাশ হয়ে, অবশেষে সে যখন ফিরে আসার কথা ভাবছে, ঠিক তখনই সে অনুভব করে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে উবু হয়ে বসে থাকা বন্দী নিজের হাতটা নামিয়ে এবার উঠে দাঁড়িয়েছে । বন্দী আবছা, অস্পষ্ট, মৃদু গলায় 'বাবা ! বাবা !' বলতে বলতে এগিয়ে আসে সূর্যকান্তর দিকে । ভয়ার্ত সূর্যকান্ত মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে । এবং তখনই টর্চের আলোটা সরাসরি বন্দির মুখে গিয়ে পড়ে এবং এবং সেই আলোতেই সে বুঝতে পারে এই বন্দী আর কেউ নয়, তার দাদা, জেল ফেরত রাধাকান্ত মিত্র । একটা চাপা প্যান্ট পড়ে আছে সে, সেটাও কোমরে আলগা হয়ে গেছে, গায়ে কোনো জামা নেই । কী নিদারুণ আর ভয়াবহ চেহারা হয়েছে রাধাকান্তর ! কিন্তু সূর্যকান্ত অভিভূত হয়ে এটাই ভাবছিলো যে কীসের শাস্তিস্বরূপ তার বাবা, দাদাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছে ? তার মাথায় কিছুই ঢোকে নি । কিন্তু এত বছর পরেও এখনো সূর্যকান্তের মনে আছে, সেদিন রাধাকান্ত তাকে চিনতে পারে নি । কেমন ঘোলাটে দৃষ্টি ! যেন সে রাধাকান্তকে দেখছে না, অন্ধকারটাকেই দেখছে ! খুব কি মেরেছিলো ওর মাথায় ? সেই জন্যই কি বুদ্ধিশুদ্ধি সব গুলিয়ে গেছে ? নাকি জেলে ওর ওপর কোনো অত্যাচার করেছে ? আর তার বাবাই বা গোপনে এভাবে তাকে আটকে রেখেছে কেন ? ওর তো এক্ষুনি চিকিৎসা দরকার ! তাহলে সে এখন কী করবে ? কৃষ্ণকান্তের কাছে কৈফিয়ত চাইবে ? কিন্তু সে তো আজ অব্দি কখনো কৃষ্ণকান্তের কাছে কোনো কিছুর জন্য কৈফিয়ত চায় নি । নাহ্ কোনো জবাব সেদিনও সে চায় নি । বরং তার এই আকস্মিকভাবে জেনে ফেলা সত্যিটাকে সে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে এতদিন । এই এতদিন, এই এতগুলো বছর ! তার ভাবতে অবাক লাগে রাধাকান্ত এখনো বেঁচে আছে ! সে দেখেছে তার বাবা কীভাবে তিল তিল করে উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে এই ভয়ানক সত্যিটা লুকিয়ে রাখতে গিয়ে । এ তো হওয়ারই ছিলো ! কিন্তু এইবার সময় এসেছে, এতদিনের গোপন সত্যিটা প্রকাশ করে দেওয়ার । হ্যাঁ এটা ঠিক যে, সত্যিটা প্রকাশ হয়ে পড়লে হয়তো তার বাবা সেই ধাক্কাটা সামলাতে পারবে না । কিন্তু তা হলেও । ২০০৩-এ যখন আচমকা একদিন ওই বেজন্মা রজত বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো, তখন প্রথম প্রথম সূর্যকান্তর খুব লোভ হতো, মনে হতো একদিন বাবাকে ঠেলে সরিয়ে ওই গোপন ঘরে ঢুকে রজতকে তার বাবার সামনে হাজির করে । দিয়ে দেখে, ছেলে বাপকে বা, বাবা ছেলেকে চিনতে পারে কিনা ! অবশ্য চিনতে না পারারই কথা । নিজের ভাইকেই সে চিনতে পারে না । রাধাকান্ত কিন্তু ওই ঘরটায় দিব্যি মানিয়ে নিয়েছে । কিন্তু তার সেই দিব্যকান্তি চেহারাটা আর আকর্ষণীয় মুখটা সেই কবেই চিরতরে হারিয়ে গেছে । আজকাল ওই গোপন ঘরটায় নামলে মনে হয়, ওই ঘরটাই তার পৃথিবী । তার কোনো আপত্তি নেই, কোনো প্রতিরোধ নেই, সে দিব্যি নিশ্চিন্তে রয়েছে ! রাধাকান্তর এই পরিবর্তন কবে যেন সূর্যকান্ত মধ্যেও কিছু কিছু পরিবর্তন এনেছে । সে আর আগের মতো আক্রমণাত্মক নেই, তার মাথার মধ্যে ক্ষতিকর পোকাটা আর সেরকমভাবে জ্বালায় না তাকে । সে এতদিন ধরে মাকে বা, সীমাকে পর্যন্ত কিছুই বলেনি ! ভাবা যায় ! আচ্ছা এরকম কি হতে পারে যে, সত্যিটা বাবার মতোই গোপন রাখতে রাখতে তার মধ্যেও পাগলামি এসে যাবে ? না না সে তা হতে দেবে না । আর যাই হোক্, সে কৃষ্ণকান্ত মিত্তির হয়ে যেতে চায় না । ইদানিং সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে সূর্যকান্ত আর কৃষ্ণকান্ত একসাথে বসে মাঝে মাঝে দুপুরের খাবার খায়, রাতেরটা নিতাই সরবরাহ করে । এই বয়সে এসে, অবশেষে বাবার সঙ্গে তার বেশ কিছুটা সময় একান্তে কাটে । আর অদ্ভূত স্বভাব হয়েছে তার বাবার ! আজকাল কোনো কোনোদিন কৃষ্ণকান্ত রীতিমতো তদবির শুরু করে সূর্যকান্তর সাথে খেতে বসার জন্য, একা বসে খেতে চায় না । সূর্যকান্ত বুঝতে পারে, বাবা বোধহয় ভিতরে ভিতরে ভীষণ একলা হয়ে গেছে । অ্যাটাচড্ বাথরুমে গিয়ে জল ঢেলে ঢেলে দেওয়াল ধোয়া, মিনিট পনেরো অন্তর অন্তর পেচ্ছাপ করতে যাওয়া, বালতিগুলো কানায়-কানায় ভর্তি করে রাখা, হাত বা পায়ের নখগুলো সামান্যতম বেড়ে উঠলেই সেগুলোকে কেটে যতটা সম্ভব ছোটো করে ফেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে থাকা ছাড়া কৃষ্ণকান্ত মিত্তির আজকাল বেশিরভাগ সময় শুয়েই থাকে নিজের ঘরে, না হলে ওই ইজি চেয়ারটায় বসে থাকে বারান্দায় । কথাবার্তা কেমন অপ্রকৃতিস্থ, দুম্ করে পুরনো কোনো কথা মনে পড়ে গেল সেই প্রসঙ্গে বকবক করতে থাকে আবার আপন মনেই বকবক্ থামিয়ে চুপ করে যায় । বিড়ি খাওয়াটা কমেছে আগের থেকে । কাকে কী বলছে, কেন বলছে, সেসব বোধ আর নেই । ক্রমশ জড়বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে যাচ্ছে তার বাবা ! সূর্যকান্ত অনুভব করতে পারে, ডক্টর মুখার্জিও সমস্ত চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছে । তার মা আগে মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করতো, বাবার শরীর কেমন আছে, সময় মতন খায় কিনা বা, সে ঠিকঠাক দেখাশোনা করছে কিনা, ইত্যাদি । কিন্তু মাধুরী দেবী নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ার পর থেকেই বাবার উপর সূর্যকান্তর দখল সম্পূর্ণ হয়েছে । মায়ের কাছে এখন সে খুব কমই যায় । সেজো ভাই মণিকান্তর মৃত্যুর জন্য সূর্যকান্তর মনে একরকম চাপা অপরাধবোধ রয়েছে, সে নিজে সেটা কখনো প্রকাশ্যে স্বীকার করে না । কিন্তু অপরাধবোধটা রয়েছে । ওই অনুভূতিটাই মায়ের সাথে তার স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি করেছে, আর সেটা তৈরি হয়েছে মণিকান্তর অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরেই । মাধুরী দেবী মাঝে তাকে প্রায়ই বলতেন, "তুই তো আর আসিস না রে ! আগে তো মাকে এসে কত কথা বলতিস ? এখন কি মাকে ভুলে গেছিস ? তোদের অন্ধ মা-টা যে তোদের চোখ দিয়েই পৃথিবীটা দেখে এখন, ভুলে গেলি ? আজকাল আর কিছু বলিস না কেন ?" কিন্তু সেও প্রায় বছর তিনেক হলো বন্ধ হয়েছে, অবশ্য মাধুরী দেবী আজকাল কথা বলার নতুন লোক খুঁজে পেয়েছেন । ওই বোকাচোঁদা রজত-টা । আজকাল যখন তখন সে ব্যাটা মাধুরী দেবীর ঘরে ঢুকে যায়, সে শুনেছে মা এখন নিজের চোখে একেবারেই দেখতে পায় না বলে, প্রায়ই মা-কে খাইয়ে দেয় রজত ! থাকেও তো মায়ের বড়ো ঘরের পাশেই সিঁড়ির ঘরটায় । মাঝেসাঝে নাকি গল্পের বই থেকে গল্প পড়ে শোনায় । কথাটা অবশ্য সীমা, অর্থাৎ তার বউ চন্দনা সূর্যকান্তকে বলেছে । চন্দনাকে সূর্যকান্ত সীমা বলে ডাকে, তার বউয়ের বাপের বাড়ির নাম । সীমা যখন বলেছে সে নিশ্চিন্ত । সীমা বলেছে সে নজর রাখছে রজতের উপর, পান থেকে চুন খসলেই তাকে খবর দেবে । এই একটা ব্যাপারে সূর্যকান্ত নিশ্চিন্ত, তার স্ত্রী যতই গোমড়ামুখো আর দাম্ভিক হোক্ না কেন, সীমা বেশ কাজের মেয়ে । তার জন্য পারফেক্ট । সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কৃষ্ণকান্তের সম্পত্তি সূর্যকান্তের হাতে এনে দিতে সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে ।
সত্যি বলতে সীমা সূর্যকান্তর জীবনে না এলে, তার মাথার মধ্যেকার পোকাটা কোনোদিনই তার নিয়ন্ত্রণে আসতো না । ওই পোকাটাই তাকে দিয়ে অনেক অকাজ কুকাজ করিয়েছে । প্রথম প্রথম তার মনে যে কোনো দ্বিধা ছিল না তা নয়, কিন্তু সেই দ্বিধা কেটে যেতে বেশি দেরী হয় নি । বছর পনেরো বয়স থেকেই সে পুরোপুরি তার নিজের ভেতরের শয়তানটার নিয়ন্ত্রণে চলে যায় । তখন একটা অসহায় ছটফটানি ছিল বটে, কিন্তু সেটা কেটে যেতে দেরি হয়নি । যে রাতে তার দাদার উপর হামলা হয়, সেই রাতের অনেক ঘটনারই সাক্ষী সে । জলে ঢিলটা সেই ছুঁড়েছিলো, কিন্তু তাতে যে ঢেউ উঠেছিলো, যে আবর্ত তৈরি হয়েছিলো, সেগুলোর উপরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিলো না । আশপাশের অনেক বাড়ির ঝি-গিরি করে সংসার চালানো মেয়েদের প্রতিই রাধাকান্তর বরাবর একটা লোলুপ নজর ছিলো । সে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো । আর অদ্ভুত ব্যাপার তার ফাঁদে পা-ও দিত নানাবয়সের মেয়েরা । এমনকি সূর্যকান্তর নিজেরই এক স্কুলের বান্ধবী তার মুখে রাধাকান্তর স্বভাব ও গুণের কথা জেনেও একবার বলেছিলো, ওকে পেলে নাকি তার লাইফটাই বদলে যাবে ! সূর্যকান্তদের এক দুঃসম্পর্কের বোন পর্যন্ত রাধাকান্তর প্রেমে মজেছিলো, তা দাদা-ও কি আর সুযোগ না নিয়েই ছেড়ে দিয়েছে ? হাতে আসা শিকার সে কখনো ছেড়ে দেয় নি, অন্তত যতদিন তার চেতনা ছিলো । গত সাত-আট বছর কৃষ্ণকান্ত মিত্তির শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ায়, দাদা রাধাকান্তর অনেক দায়িত্বই নিতে হয়েছে সূর্যকান্তকে । আর তাই বাধ্য হয়েই তাকে কাজের লোক নিতাইকে কাজে লাগাতে হয়েছে । এছাড়া সূর্যকান্তর অন্য কোনো উপায় ছিলো না । নিতাইয়ের এখনো বোধহয় ষাট হয় নি, আরো কিছুদিন তাই সে টেনে দিতে পারবে ! রাধাকান্তকে স্নান করানো, খাওয়ানো - এই কাজগুলো এখন প্রতিদিনই করে থাকে নিতাই, এবং সে প্রচন্ড বিশ্বস্ত লোক । তাই তার উপর সূর্যকান্ত ভরসা করতে পারে ।
সূর্যকান্তের এখনো সেই রাতের কথা মনে পড়লে, চাপা অস্বস্তি হয় । সেদিন সারাটা দিন সূর্যকান্তের অনেক খাটুনি গেছিলো । হারামজাদা হারান গয়লা বেশ কিছুদিন ধরে দুধে ভালোই জল মেশাচ্ছিলো, তাকে একটু কড়কে দেওয়ার জন্য সে পালপাড়ার ভিতরের রাস্তায় ঢুকেছিলো । তখনই একটা খাঁজকাটা, হাঁড়িবাঁধা খেঁজুর গাছের নিচে ঝোপ থেকে সে দুটো গলা শুনতে পায়, গলাদুটো তার দাদাকে নিয়েই কথা বলছিলো । একটু অপেক্ষা করে সূর্যকান্ত ওদের ফলো করে এবং বুঝতে পারে ওরা অনেকদিন ধরে একটা সুযোগের অপেক্ষায় আছে । আর সেই সুযোগটা আর কিছুর নয়, রাধাকান্তকে উত্তম-মধ্যম দেওয়ার । ওদের মধ্যে একজনকে সে আবছা চিনতেও পেরেছিলো, সম্ভবত ছেলেটি তার দাদারই ক্লাসমেট ছিলো । কিন্তু তখন ছেলেটা কাজ করতো কৃষ্ণকান্তর হয়ে । রাধাকান্তর সঙ্গে একবার প্রচন্ড মারপিট হয়েছিল ওর, এমনকি ছেলেটার দুটো দাঁত পড়ে গিয়েছিলো । তাতে ছেলেটা রীতিমতো জখম হয়েছিলো, এবার সে একটা বদলা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে - এরকমই একটা আলোচনা চলছিলো তাদের মধ্যে । কিন্তু তারা কেউই সে অর্থে লড়াকু বা, বেপরোয়া নয়, সাহসেরও বেশ ঘাটতি আছে । তাই রাধাকান্তর উপর আক্রমণের জন্য তারা সঙ্গে নেবে হাফিজুল বলে একটা লোককে, সে নাকি দাগী আসামী । সূর্যকান্ত পরে জেনেছিলো, ওই হাফিজুলও এক সময়ে কৃষ্ণকান্তের ধানকলে কাজ করতো । লোকটার একটা পায়ে চারটে আঙুল ছিলো । রাধাকান্ত নারী-সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারেই মিথ্যে চুরির দায় চাপিয়ে, তাকে তাড়িয়ে ছিলো প্রতিযোগিতা কমাতে । সুতরাং রাধাকান্তর সমূহ বিপদ, বুঝতে পেরেছিলো সূর্যকান্ত ।
কিন্তু সূর্যকান্তর স্বভাব হলো কখনোই সে পুরো সত্য বলে না । সেদিনও বাড়ি ফিরে সে বাবা কৃষ্ণকান্তকে অর্ধসত্য বলেছিলো । হাফিজুলের কথা সে বেমালুম চেপে যায় । এবং কথা বলতে গিয়ে জানতে পারে, এই ঘটনায় পরোক্ষভাবে সেও জড়িত । কারণ ছাদের চিলেকোঠার ঘরে এবং বাড়ির পাশের গুদাম ঘরে মাধবী ও রাধাকান্তর ফষ্টিনষ্টির খবরটা সেই কৃষ্ণকান্তকে পাকে-প্রকারে জানিয়েছিলো । কৃষ্ণকান্তই রাধাকান্তকে একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন । এবং কৃষ্ণকান্ত মিত্তিরই পালপাড়ার কাঁচারাস্তায় দেখা ওই দুই শলাপরামর্শকারীকে গোপনে নিয়োগ করেছেন, সেই কাজের বরাত দিয়ে । এখন ভাবতে বসলে সূর্যকান্তর মনে হয়, তার বাবা বোধকরি সম্পর্কটা মেনে নিতে পারছিলো না । কারণ মাধবী যদি সত্যিই কৃষ্ণকান্তর অবৈধ সন্তান হয়, তাহলে রাধাকান্তর সঙ্গে মাধবীর এই সম্পর্কটাও পুরোপুরি অন্যায্য । এইরকমই কোনো একটা গোপন সংশয় বা মনোকষ্ট থেকে কৃষ্ণকান্ত সেই চরম ভুলটা করে বসেছিলেন । তবে একটা খচখচানি বরাবরই তার মনের মধ্যে ছিলো ওই রেপ কেসটা নিয়ে... রাধাকান্তকে কায়দা করে কেউ ফাঁসিয়েছিলো ! কিন্ত কে ? সদানন্দ মিত্তির ? শালা ওই হারামিটারই ওটা করার চান্স বেশি । রাধাকান্তর ওপর ওর হালকা করে রাগ ছিলো, পাতলা করে তার শোধ নিয়েছিলো । পুলিশের তো শুধু একটা সাক্ষী দরকার ছিলো । কৃষ্ণকান্ত বেআইনি কারবার করতো, পুলিশ জানতো । কিন্তু প্রমাণের অভাবে কিছুই করতে পারে নি । তাই ওই পড়ে পাওয়া সুযোগটা ওরা ছাড়তে চায় নি ! তবে যেহেতু সে লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও, রাধাকান্ত আর মাধবীকে মিলিত হতে দেখেছে সে-সময়, তার দৃঢ় ধারণা উভয়ের সম্মতিতেই দুজনে শুয়েছিলো । এবং যেহেতু সূর্যকান্ত বাবার কানে উভয়ের মিলনের বার্তাটি তুলে দিয়েছিলো, তাই কৃষ্ণকান্তও খচে বোম্ হয়েছিলো । তাই দুজনকে টাইট দিতে লোক লাগিয়েছিলো । এবার উভয়ের দুর্বলতম মুহূর্তটাকেই হাফিজুলরা বেছে নেয়, রাধাকান্ত বা মাধবী নিশ্চয় স্বপ্নেও ভাবে নি । মেয়েটা তারপর ওই 'সদানন্দ গায়ে গন্ধ'-র কাছেই ছিলো । ওখানেই ওই বেজন্মা রজতটাকে বিলিয়েছিলো । শুয়োরটার এখন এতো সাহস বেড়েছে যে, চাঁদের মেয়েটার সাথে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় ! মালটা আবার সদানন্দর কাছে আঁকতেও শিখেছে । আর এমনই দুর্ভাগ্য যে, নিজের ছেলে পর্যন্ত তার সাথেই ওই শাড়ির দোকানে বসে থাকে । শ্রীকান্তর হালের ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদটাও ওই শালা এঁকেছে । সেই এক দুপুরে সূর্যকান্তই মালটার চোখদুটো দেখে চিনেছিলো । চোখের উপরে ভ্রু-দুটি আশ্চর্যরকম পাতলা, ঠিক রাধাকান্তর মতো । অস্বস্তিকর চোখের দৃষ্টি, ঠায় চেয়ে থাকে, ঠিক ওর মা 'চরমারানি' মাধবীর মতো ! এসব জিনিস সূর্যকান্তর চোখ এড়ায় না । সেদিন প্রখর রৌদ্রে মালটা একদম চুপ মেরে ছিলো । একটা কথাও বলে নি । 'মাধবী কোথায় ?' - এই প্রশ্নের উত্তরও মেলে নি । তারপর স্নান-টান করে, দু-গ্রাস গিলে বাবু স্বাভাবিক হলেন । তারপর শুয়োরটা মুখ খুললো । বললো, সদানন্দ গত হয়েছে । আর তারপরই তার মা-টার মাথা নাকি কেমন গোলমাল হয়ে গেছে । সে নাকি শিয়ালদার ট্রেনে চেপে বসেছে ! তা ভালো, গেলি তো গেলি, অকালকুষ্মাণ্ডটাকে নিয়ে যেতে পারলি না ? গছিয়ে দিয়ে গেলি সেই মিত্তিরবাড়ির গলায় ! নির্ঘাত মিথ্যে বলেছিলো । এই ব্যাপারটাতেই সূর্যকান্তর কিরকম খটকা লাগে । হঠাৎ করেই রজতের সাথে তাদের এই যোগাযোগ, মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না । মালটার এখনও কোনো প্ল্যান আছে ।
রজতের কথা ভাবতে ভাবতেই সূর্যকান্ত আবার সেই বিশেষ রাতটিতে ফিরে যায় - দুর্ঘটনার রাত । সেদিন মাঝরাতে বাড়ির সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেতেই সূর্যকান্ত সজাগ ছিলো, সতর্ক পায়ে সে নেমে এসেছিলো উপরের ঘর থেকে । তারপর কৃষ্ণকান্তের ঘরের দরজার বাইরে আড়ি পেতে ছিলো । তখনই সে জানতে পারে, রাধাকান্ত মারাত্মক আহত এবং যে দুজন রাতের অন্ধকারে কৃষ্ণকান্তকে খবরটা দিতে এসেছে, তারা এর দায় নিতে নারাজ । তারা ওই হাফিজুলের ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দেয় এবং জানায়, চতুর্থ একজন লোক অন্ধকারের মধ্যে দেওয়াল বেয়ে লালুবাবুদের দোতলা থেকে আচমকা ঘটনাস্থলে নেমে না পড়লে, রাধাকান্ত হাফিজুলের হাতে মার খেয়ে মরেই যেতো । চতুর্থ লোকটি কে, সেটা তারা বলতে পারে নি, তবে জানিয়েছিলো লোকটার কাঁধে একটা ঝোলা আছে । তারা ভয় পেয়ে দুজনে রাধাকান্তর বাইকটা নিয়েই পালিয়ে আসে, রাধাকান্ত আর মাধবীকে ওই গলিতে ফেলে রেখে । লুকিয়ে তাদের কথা শুনে সেই রাতে সূর্যকান্তর যা ধারণা হয়েছিলো, সেটা হলো - সঙ্গমরত অবস্থায় মাধবী-রাধাকান্তকে জখম করেছিলো ওই হাফিজুল । তার দাদা আর ওই মেয়েটা কোথায়, কীভাবে ওইসব করছিলো, বাবা হয়ে আর সেইসব ডিটেলস্ জিজ্ঞাসা করতে পারেন নি কৃষ্ণকান্ত । তবে তিনি প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং তৎক্ষণাৎ থানায় ছুটে যান । কারণ ভোর রাতে সরাসরি ঘটনাস্থলে গিয়ে তিনি মাধবী বা, রাধাকান্ত - কাউকেই দেখতে পান নি । এই ব্যাপারটা আজও সূর্যকান্তর কাছে একটা রহস্য । সে তখনই সেই খবরটা গিয়ে মা-কে জানিয়েছিলো এবং বুঝেছিলো কত বড়ো ভুল হয়েছে ! মাধুরী দেবী সেই রাতেই ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন । এবং আরো আশ্চর্যের ব্যাপার, সদানন্দ মিত্তিরও এই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত । কারণ কৃষ্ণকান্ত যখন পুলিশ নিয়ে গিয়ে আহত, রক্তাক্ত রাধাকান্তকে আবিষ্কার করেছিলো, তখন সদানন্দ নাকি রাধাকান্তর মুখের কাছে আর্ট পেপার আর রং-তুলি নিয়ে বসে তার ছবি আঁকছিলো ! পাগলাগেঁড়ে আর কাকে বলে ! ভাইপো মরতে বসেছে, কাকা ছবি আঁকছে ! পাগলও জুটেছে কিছু মিত্তিরবাড়িতে ।
ভুলে যাওয়া অনেক কথাই সূর্যকান্তর নতুন করে মনে পড়ছে, কারণ সম্প্রতি সে মাধবীকে দেখেছে । অনেকদিন পরে এবং দূর থেকে, তবু চিনতে তার ভুল হয়নি, হতে পারে না । মাধবীর মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে যথারীতি, শরীরটাও অনেক ভারী হয়েছে আগের তুলনায়, স্থূলই বলা চলে । বয়স তো প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হলো ! তবে চুলগুলো কালোই, নির্ঘাত কলপ করে ! কারণ সূর্যকান্তর নিজেরই মাথার সামনের দিকে, কানের পাশে বেশ কিছু পাকা চুল দেখা দিয়েছে । সূর্যকান্ত মাধবীকে দেখেছিলো গত আগষ্টের শেষদিকে রাখি পূর্ণিমার দিন, জহর শিশুভবনে 'অ্যাসোসিয়েশন অফ ভল্যান্টারি ব্লাড-ডোনার্স' আয়োজিত রক্তদান শিবিরে । এক বন্ধুর সাথে সেখানে রক্ত দিতে গিয়েছিলো সূর্যকান্ত । এমনিতে এসব রক্ত-টক্ত দেওয়ার ব্যাপারে তার চূড়ান্ত অনীহা রয়েছে । কিন্তু বন্ধুর জোরাজুরিতে তাকে যেতে হয়েছিলো । উক্ত সংস্থার শিয়ালদহে প্রাচী সিনেমার গায়ে অফিস রয়েছে । সূর্যকান্তর বন্ধুটি ওদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে । রক্ত দেবে না বলে, নানা অজুহাত দিয়েছিলো সে, এমনকি বলেছিলো তার লো-ব্লাডপ্রেসার ! কিন্তু শীর্ষেন্দু তা বিশ্বাস করেনি, সূর্যকান্তর সাথে কলেজে পড়তো শীর্ষেন্দু । তার মুখেই শোনা, ওই সংস্থা বছরের বিভিন্ন সময়ে এরকম রক্তদান শিবির আয়োজন করে থাকে, শুধু তাই নয়, সেই রক্তদান শিবিরগুলোকে রীতিমত মাস-ইভেন্টে পরিণত করে । ১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছিলো ভারত, অধিনায়ক নরি কন্ট্রাক্টর । সেখানে প্রথম টেস্টে হারের পরে দ্বিতীয় টেস্টের আগে, একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিলো ভারতীয় ক্রিকেট দল । চার্লস গ্রিফিথের একটি বল হঠাৎ করেই সোজা গিয়ে নরি কন্ট্রাক্টরের মাথায় লাগে, হেলমেট-বিহীন মাথায় চোট লাগায় সেই মুহূর্তে দিশেহারা অবস্থা ! তখন ত্রিনিদাদ থেকে আনা হয় এক বিশিষ্ট চিকিৎসককে, দীর্ঘক্ষণ ধরে চলে অপারেশন । প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়, সফররত ভারতীয় দলের চাঁদু বোরদে, পলি উমরিগড়, বাপু নাদকার্নির রক্তের গ্রুপ কন্ট্রাক্টরের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মেলে নি । সে সময় ফ্র্যাঙ্ক ওরেল ও তাঁর সতীর্থরা এগিয়ে আসেন ভারত অধিনায়কের জীবন বাঁচানোর জন্য । তাঁদের এই মানবিক উদ্যোগে অপারেশন সফল হয়, ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন কন্ট্রাক্টর । ফ্র্যাঙ্ক বেশিদিন বাঁচেন নি, লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে তিনি মারা যান । ১৯৮১ সাল থেকে, সি.এ.বি.-র প্রতিষ্ঠা দিবসে অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের নামাঙ্কিত রক্তদান শিবির আয়োজন করা হচ্ছে সেই ঘটনাটি স্মরণ করে । এছাড়াও ক্ষুদিরাম অনুশীলন সমিতিতে ফুটবলপ্রেমী দিবসে একইভাবে রক্তদান শিবির আয়োজন করে ওরা । এসব শীর্ষেন্দুর মুখস্ত । সেদিন শীর্ষেন্দুর সাথে সূর্যকান্ত নেহেরু চিলড্রেনস্ মিউজিয়ামের জহর শিশুভবনে পৌঁছাতেই তার নাম-ঠিকানা লিখে নেওয়া হলো । হিমোগ্লোবিন টেস্ট হলো । ডক্টর প্রেসার দেখলো, ওজন মেপে চোখ টেনে টেনে দেখলো, ওষুধের কথা জেনে নিলো, তবেই ডোনারদের জন্য নির্ধারিত বেডে পাঠালো । সকাল ন'টা থেকে দুপুর তিনটে অব্দি চললো সেই শিবির । দেখা গেল রক্ত দিলে খাবার-দাবার দেয় মন্দ নয় ! পনির কাটলেট, পোলাও, কাশ্মীরি আলুর দম, আইসক্রিম - ব্যুফেতে এলাহি আয়োজন ! পছন্দ মতো খাবার নাও আর টেবিল-চেয়ারে বসে পড়ো । সেদিন গান্ডে-পিন্ডে গিলে যখন বাড়ি ফিরবে বলে বেরোচ্ছে সূর্যকান্ত, দেখেছিল মানিকতলা ব্লাড ব্যাংকের গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, মনে হয় ব্লাড কালেক্ট করতে এসেছিলো । এমনিতেই ওখানে এন.আর.এস., মেডিকেল কলেজ, এস.এস.কে.এম., আর.জি.কর. ইত্যাদির ডক্টরেরা আসেন । সেসময় নার্সের পোশাক পরা একজন মহিলাকে সূর্যকান্ত দশ সেকেন্ডের জন্য দেখেছিলো । অতদিন পরে মাধবীকে দেখে সে চমকে গিয়েছিলো ! তার ধারণা ছিলো, মাধবী বেঁচে নেই । কিন্তু এ যে বহাল তবিয়তে নার্সের পোশাক পরে ঘুরছে ! আচ্ছা... সে ফিরে আসবে না তো ? চিন্তিত মুখে সূর্যকান্ত আপন মনেই কথাটা বলে ওঠে আবার, "মাধবী সুন্দরপুরে ফিরে আসবে না তো ? রজত গোপনে তার মায়ের সাথে যোগাযোগ রাখে নি তো ?"
ক্রমশঃ-----------
১০/১০
উত্তরমুছুন