ধারাবাহিক গল্প ।। পোড়ো বাড়ির ইতিকথা'।। স্তুতি সরকার
পোড়ো বাড়ির ইতিকথা
স্তুতি সরকার
তখন আমার কতো বয়স হবে? সাত কি আট। চম্পাহাটীতে আমাদের বাবার বাবা অর্থাৎ ঠাকুরদার দেশের বাড়ী।
বাড়ীটার বয়স প্রায় একশো সত্তর বছর। বেশ বড়ো বাড়ী। তখনকার দিনের মজবুত বাড়ী। তবুও বয়সের ভারে কোথাও কোথাও চুন পলেস্তরা খসে পড়েছে। ভিতরের কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। পায়রা বাসা বেঁধেছে এখানে সেখানে।
নোংরা আবর্জনায় ভরে আছে যায়গাটা।এইটুকুই স্মৃতি আছে। বাপি-মামণির সঙ্গে মাঝে মাঝেই যেতাম দেশের বাড়ীতে। ছুটি কাটাতে। আমার দাদু নিজেকে জমিদার বলতে খুব গর্ব অনুভব করতেন। কোলকাতার বাড়ীতে থাকতেন। কিন্তু যখন দেশের বাড়ীতে যেতেন, দূর দূরান্ত থেকে প্রজারা এসে ওনার সঙ্গে দেখা করে সুখ দু:খের গল্প করতে চলে আসতেন। আমার কাকা পিসিরা দলবেঁধে একটু দূর দিয়ে মাতলা নদী বয়ে গেছে, সেখানে বেড়াতে যেতো। শীতের দিনে বাড়ীর খেঁজুরের গাছ থেকে পাড়া খেঁজুরের রস খাওয়াটা একটা বিশেষ আকর্ষণ ছিলো। বছরের এই সময়ে খেঁজুরের গুড়, পাটালি সব তৈরী হতো। কালে কালে সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে। আজ তো জমিদারি প্রথা ও বিলুপ্ত। দাদু ঠাকুরমা, কবেই মারা গেছেন। আমার বাবা মাও আজ
আর নেই।দুপুরে যখন হাওয়া দেয় শন শন করে, মনে হয় যেনো পুরনো দিনের কথা ওরা দাপাদাপি করে বলে যায়। শুধু শুনতে জানার কান থাকা চাই । যে সময়টার কথা দিয়ে শুরু করেছি, সেই সাত আট বছরের আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের দেশের বাড়ীর বৈভবের কথা। কতো লোকজন থাকতো তখন ওই বাড়িতে। কতো আশ্রিত মানুষজন থাকতো। কালের গতিতে তারা মারা গেছেন বা কর্মসূত্রে কে কোথায় চলে গেছেন। বাড়ীটা আজ ভগ্নপ্রায় পোড়ো বাড়ী। এতো বড়ো বাড়ীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ২/৪ ঘরপ্রজা বাস করেন বাড়ীর আউট হাউসে। মূল বাড়ীর থেকে অনেকটাই দূরে। মাঝে আছে অনেক বড়ো বাগান। যা এখন ঘন জঙ্গলের চেহারা নিয়েছে। ২ পাশে খান দুই বড়ো পুকুর।
মূল বাড়ীর একেবারে পিছনের দিকে অনেকখানি জমি আর তার পরে বেশ বড় বড় ২টো জোড়া পুকুর। তার পিছনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ শেষ হয়েছে মহা শ্মশানে। মড়া পুড়লে কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া আর আগুন দেখা যায়। এখন আমার বয়স ও প্রায় ষাটোর্ধ্বর কোঠায়। এবার শীতে ঠিক হলো আমাদের দেশের বাড়ীতে যাওয়া হবে দল বেঁধে সব আত্মীয়স্বজন বন্ধু বান্ধব মিলে। সেই মতো কিছু দিন আগে আমার দুই কাকা লোক পাঠিয়ে দিলো দেশের বাড়ীতে কএকটা ঘর, জঙ্গলের কিছুটা পরিষ্কার করে আসার জন্য। ৩/৪ জন যোগাড়ে টাইপের জানাশুনার মধ্যে লোক এখনই চলে যাবে ওখানে থাকবে আর যতোটা সম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে কিছুটা কাজ গুছিয়ে রাখবে। যথাসময়ে সদলবলে গিয়ে পৌঁছনো গেলো বড়ো একটা বাস, ২/৩ টে গাড়ী বোঝাই করে পোঁটলা পুঁটলি নিয়ে । ৪/৫ দিন থাকা হবে। শীতের দিনে জিনিস পত্র একটু বেশিই থাকে।
লোকজন এখানে ২/৩ দিন আগে থাকতেই রয়েছে। তারা রান্না বান্না ফাইফরমাইজ খাটতে ব্যস্ত। শহরে থাকা সব আত্মীয় স্বজনে এখন ঘর ভর্তি। যারা সাঁতার শিখেছে। তারা দুপুরে পুকুরের জলে নেমে জল ছোঁড়াছুঁড়ি করে সাঁতার কাটতে লাগল। ক্রমে লাঞ্চ কম্প্লিট করে দুপুরে একটু গড়িয়ে নেওয়া। দলবেঁধে পাড়ায় বেড়াতে যাওয়া। দেখতে দেখতে সন্ধ্যে গড়িয়ে আসলো।
দেশে অনেকের বাড়ীতেই এখন লাইট এসেছে। কিন্তু আমাদের বাড়িতে হ্যারিকেনের আলোয় মোটা মুড়ির চালের ভাজা দেশের মুড়ি, হুড়ুম ভাজা, বেগুনি আলুরচপ আর চা সহযোগে খাওয়া চলতে লাগলো। সঙ্গে অবধারিত ভাবে এসে পড়লো ভূতের গল্প। গা ছমছমে পরিবেশে সবে ভূতের গল্প জমে উঠেছে, ঠি ক তখনি ছোটপিসি চেঁচিয়ে উঠলো, বাবুদা, ভালো হচ্ছে না বলছি। ভয় দেখাবেনা বলেদিচ্ছি! বাকীরা হাঁ হাঁ করে উঠলো- কি হয়েছেরে রুমু! বলতে বলতেই বাবুদার ঘরে আগমন আর যথারীতি বলা- আমিতো বাইরে বাথরুমে গিয়েছিলাম। ছোটপিসি হাসতে হাসতে বলল- ঘরের বাইরে বারাণ্ডায় কালো কাপড়ে মুড়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে এ দিক থেকে ওদিকেচলে যাওয়া- আবার ওদিকের থেকেই ফিরে আসলে। কি ছেলেমানুষী করছে দেখো- বাবুদা যতো বলে ওরে, বিশ্বাস কর, আমি সত্যি সত্যিই কিছু করিনি। তখন সকলে মিলে হাসতে থাকে। রাত বাড়ছে ক্রমে। তাড়াতাড়ি খাবার পাট চুকিয়ে আবার গল্পের শুরু হয়। কিন্তু এবার তিন্নি বল্ল- ওর চুল ধরে কে টানছে। তখন সকলের খুব বিরক্তি।সকলেই জোরের সঙ্গে বলেন ফেয়ার গেমখেলতে। কিন্তু কেউ স্বীকার করেনি কে ওর চুল টানলো আর ধরাও পড়লোনা কেউ। বড় হলঘরে লাইন দিয়ে বিছানা পড়েছে।অন্য ঘরগুলোতেও যে যার ফ্যামেলি নিয়ে ঘুমনোর ব্যবস্থা।প্রত্যেক ঘরে একটা করে হ্যারিকেন কমিয়ে মেঝের একপাশে রাখা আছে। চাকর শ্রেণীর যারা ফাইফরমাইস খাটতে এসেছে কলকাতা থেকে, তারা বাহির মহলের লম্বা দালানে শুয়েছে।দালানটাএতো বড়ো যে ১০ টা হ্যারিকেন এর আলোতেও আলোআঁধারি ভাব দূর হয় না।
ভোর থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়লো সকলে। বেড়াতে বেরুলো আশেপাশে। ইস্কুলের বড়ো মাঠটায় সকলে ঘুরতে গেলো।তারপর খেঁজুরের রস খাওয়া। চা তৈরী হয়ে গেছে এর মধ্যে ২ বার। পাতার জালের ধরা গন্ধ চায়ে মিশে একটা নস্টালজিয়া ভাবএনে দিয়েছে। কাকিমা বিস্কুটের প্যাকেট খুলে সবাইকে দিচ্ছে। নীমের দাঁতন করে নিয়েছে সবাই। দেশে আসলে এটাই সকলে করে। যদিও পেস্ট, ব্রাস সকলের সঙ্গে থাকে, তাও নিম দাঁতন যেন স্বাস্থ্য রক্ষার স্বার্থে করা হয়েছে। আজ সকালে ডিমের অমলেট, পাওরুটি, ছানার গজা, কলা কফি বা দুধ কিংবা চা দিয়ে জলখাবার টা সারা হলো। বাড়ীর ছেলেরা দলবেঁধে চলে গেলো বাজারে টাটকা মাছ কি উঠেছে দেখবার জন্য। ভালো বড়ো চিংড়ি, গুড়জাউলি, তোপসে মাছ আনা হয়েছে। ক্রেটে করে প্রচুর ডিম গতকালই আনা হয়েছে। মোওয়া, পাটালি, নলেন গুড়ও কেউ কেউ এনেছে। বাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য এখন থেকে অনেকে কিনে এনে জড়ো করছে। মুড়ির মোওয়া, নতুন গুড়ের মুড়কি, পাটালি প্রভৃতি।ছেলেরা কেউ কেউ খেলার সরঞ্জাম নিয়ে এসেছে। খেলা শুরু হয়ে গেছে এবার সামনের পরিষ্কার করা যায়গাটায়। ছোটো মেয়েরা খেল্লাবাটি খেলছে। কখনো বা এক্কাদোক্কা।
স্কিপিংও কেউ নিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যেই পড়ে গিয়ে পা কেটে রক্ত বার করে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে শম্পা।ফাস্টেড বক্স বার করে ওকে ড্রেসিং করে দেওয়া হলো। শম্পা বলল কেউ ওকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। সকলেই বলল ওরকম বলতে নেই মা! খেলতে গিয়ে ধাক্কা লেগে যেতেই পারে।
শীতের বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। আবার সন্ধ্যা নামছে। সকলেই যেনো একটু অন্যমনস্ক আজ। এবার বেড়াতে আসাটা যেনোকেমন গা ছমছমে পরিবেশে। স্পষ্ট কোনো কারণ নেই। শুধু মনের মধ্যে একটু খচখচানি লেগে রয়েছে সকলেরই। আজ সকালে ছন্দা সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেলো। সামনের পাটির দাঁতের একটা টুকরো ভেঙে গেলো। সঙ্গে কিছুটা রক্তপাত। ও একই ভাবে বল্ল- ওকে কে যেনো ঠেলা দিলো মনে হলো। আজ আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে নয়- বড়ো ঘরটায় মেঝেতে একেবারে বিছানা পেতে নিয়ে তার ওপর আলগা একটা চাদর পেতে সকলে বেশ ঘ্যাঁসাঘেঁসি করে গোল হয়ে বসে সকলে রুমাল চোর খেলতে লাগল।বিপত্তি কিন্তু বাঁধলো প্রায় সাথে সাথেই। স্নিগ্ধা চোর হয়েছিলো- হাতে একটা বড়ো জেন্টস্ রুমাল- যেই ও কারুর একটা পিছনে ফেলে রাউন্ড টা দিতে শুরু করলো, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একসঙ্গে ৪ জন উঠে দাঁড়িয়ে দেখালো তাদের সকলেরই হাতে একই রকমের রুমাল। সত্যি বলছি, সকলেরই তখন ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা। অনেকেই কান্নাকাটি করতে লাগলো। বাড়ীর সিনিয়ররা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন আমাদের মধ্যে কেউ ম্যাজিক জানে কিনা। বাড়ীর সম্বন্ধে ও তো কোনোও বদনাম কেউ কখনোশোনেনি! তবে এসব কি ভাবে ঘটছে? যাইহোক, এ নিয়ে বেশী আলোচনা না করাই শ্রেয় বল্লেন বড়োরা। সকাল
সকাল খাওয়াদাওয়া সেরে শুতে চলে গেল সকলে। রাতটুকু নির্বিঘ্নে কাটলো। সকালে উঠেই কিন্তু হুলুস্থুল কাণ্ড। বাড়ীতে কারোর জুতো নেই। মিসিং। সবাই যে যার জিনিস গুছিয়ে নিতে থাকলো। আরোও বড়ো কিছু অঘটন ঘটার আগেই মানে মানে বাড়ী ফিরে যাওয়াই ভালো।
================
ক্রমশঃ-----------------
গল্প কেমন লাগছে জানালে ভালো লাগবে॥
উত্তরমুছুনলেখিকা- স্তুতি সরকার।