ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সামান্য মেয়ে (পর্ব -১) ।। রণেশ রায়
সামান্য মেয়ে
রণেশ রায়
১
অমাবস্যার চাঁদ
সুন্দরবনের এক প্রান্তিক গ্রাম। ছোট্ট একটা দ্বীপ। সুন্দরী গাছ আর গরান গাছে ঘেরা এক সবুজ বনানী। সেখানে গড়ে উঠেছে কিছু মানুষের বাস। জমিতে চাষ, জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহ আর মাছ ধরাই এখানকার মানুষদের প্রধান জীবিকা। যাদের জমি আছে তাদের জমিতে শাক সবজি ধান যা উৎপাদন হয় তাদিয়ে পরিবারের পেট চলে। যারা মধু সংগ্রহ করে বা মাছ ধরে তারা তা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে।
উৎপাদন কাজ চালিয়ে নেওয়ার জন্য মহাজনের ঋণের কারবার চালু থাকে। এখানে হরবছর ঝড় বন্যা লেগেই থাকে। সাগরের নোনা জল ঢুকে জমির চাষের বারোটা বাজিয়ে দেয়। মানুষের খাওয়া পড়ার অভাব চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। আর তখন গরিব মানুষকে খাওয়া পড়ার জন্য মহাজনের দ্বারস্ত হতে হয়। তাই গরীব মানুষ সারা বছর ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকতে বাধ্য হয়। গ্রামের চল্লিশ পঞ্চাশটি পরিবারের মধ্যে কেউ কেউ যথেষ্ট বর্ধিষ্ণু। তাদের জমিজমা বেশি থাকায় উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয় যা তাদের বাড়তি লাভ।
এছাড়া এরা ব্যবসা মহাজনী কারবারের সঙ্গে যুক্ত। মহাজনী কারবার ব্যবসাই এদের সমৃদ্ধির কারণ। এ গ্রাম ছাড়াও এদের শহরে ব্যবসা বাড়ি সম্পত্তি থাকে । ধরুন এই অজ পাড়াগাঁয়ের নাম ‘অমাবস্যার চাঁদ।
ভ্রমণ রসিক মানুষের কাছে এই গ্রাম থেকে দেখা জ্যোৎস্না রাতের চাঁদ এই ছোট্ট দ্বীপের সবুজ বনানী এক মনমোহিনী আনন্দলোক। এই ধরনের প্রান্তিক গ্রামের সঙ্গে মূল স্রোতের দেশের মানুষের সম্পর্ক সবটা তেমন মধুর নয়। দুর্গম এমন গ্রামে বাইরের মানুষের আসা যাওয়া নিয়মিত নয়। ভ্রমন রসিক মানুষরা নৌকো বা লঞ্চে গ্রামের সংলগ্ন নদীপথে যায়। গ্রামের ভেতর তেমন ঢোকে না।তবে কিছু পরিব্রাজক বা সাহিত্য রসিকের দেখা পাওয়া যায় কখনও সখনও।
নদীর কলোকল সবুজ বনানী আকাশে জ্যোৎস্নার ছন্দ যতই মনোরম যতই সুন্দরী রহস্যময়ী মনে হোক
না কেন এখানে বসবাসকারী রোজ জীবিকার জন্য যুদ্ধরত মানুষগুলোর কাছে ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। বোধহয় এটাই উপলব্ধি করেন কোন কালে কোন এক পরিব্রাজক বা সাহিত্যিক। এই গ্রামের আপাত
সৌন্দর্যের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষের ভয়াভয় দারিদ্রের জীবনটা দেখেন তিনি। এই গ্রাম সমাজকে তিনি এ ভাবেই দেখেছিলেন যেখানে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার নীচে মানুষের জীবনটা অন্ধকারে ঢাকা থাকে। সেই
উপলব্ধি থেকে তিনি বোধ হয় গ্রামটার নামকরণ করেন। ঠিক যেমন কবি সুকান্ত দেখেছিলেন: পূর্ণিমার
চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।
এই অজপাড়াগাঁয়ের এক সামান্য মেয়েকে নিয়েই আমাদের এই উপাখ্যান। যেদিন এর কথা দিয়ে আমাদের শুরু সেদিন মেয়েটির বয়স হয়তো বছর কুড়ি ছিল । হয়তো বলতে হল কারণ এ ধরণের গ্রামে গরিব মানুষের ঘরে জন্মানো সন্তানের জন্মদিন লিপিবদ্ধ থাকে না। অনেক সন্তানের সবার নাম বাবা মায়ের মনে থাকেনা। যদি জন্মের পর থেকে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ থাকত তবে জন্মদিনটা মনে থাকত। সেটা এই গ্রামীণ জীবনে গরীব ঘরে তেমন চালু নেই। তাও গ্রামে একটা স্কুল থাকায় একটা দিনকে জন্মদিন বলে নথিভুক্ত করার রীতি চালু হয়েছে এখন। গরিব বাবা আমাদের গল্পের এই মেয়েকে আদর করে বুড়ি বলে ডাকে। ওই ডাকেই সবাই ওকে চেনে। আর ওদের অপর্ণা বা সুপর্ণার মত মন ধরানো ভালো নাম দিয়ে কি হবে ! যারা স্কুলের গন্ডি টপকাবার সুযোগ পায় না গ্রামের বাইরের জগৎটা যারা চেনে না তাদের ভালো
নামে কাদের সঙ্গে পরিচিতি ঘটবে ! তার চেয়ে গাঁয়ের মেয়ের গেঁয়ো নামে পরিচিতিটাই ভালো। সেটা অনেক আন্তরিক। বুড়ির বয়স বছর কুড়ি । পড়াশুনার ইচ্ছে থাকলেও বেশিদূর এগোতে পারে নি। স্কুলের বেড়া ডিঙানো সম্ভব হয় নি। সামান্যের মধ্যে যদি অসামান্য কিছু থাকে তার তা হল মিষ্টি মুখ, মুখে লেগে থাকা হাসি আর শরীরের ছিপছিপে গড়ন। সে যখন হাসে কাশ ফুল ফোটে। সে যখন হাটে কবিতার ছন্দ তাতে।
কবির ভাষায় কালো মেয়ের কালো হরিণ চোখ। তবু সে সুন্দরী নয়। ঘরে অভাব, সে অভাবের ছায়া চেহারায়। তেমন চাকচিক্য নেই। ঘরে বাইরে তার কাজ। মায়ের সাথে ঘরে সংসার আগলানো। ছোট ভাই বোনেদের দেখাশুনা। দোকান পাট সবই। তারপর বাড়তি কাজ বাবাকে সামলানো। একজন কাঠ মিস্ত্রি দিন মজুর বাবা সারাদিন খেটে খুটে বেসামাল হয়ে ঘরে ফেরে। তখন মাকে পাহারা দেওয়ার কাজ মেয়ের। বাবা বাড়িতে মেয়েকেই ভয় করে। ভয় বললে হয়তো ভুল বলা হয়। স্নেহবশত সমীহ করে। মেয়ে বাবার আদরের দুলালী।
অন্ধ স্নেহ তার প্রতি। মায়ের ওপর বাবার যত হম্বি তম্বি। কিন্তু মেয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলার
সাহস তাঁর নেই। বেসামাল অবস্থাতেও নিজেকে মেয়ের সামনে যতটা পারেন নিজেকে সামলে রাখেন। মেয়ে ঘরে বাইরে এত সামাল দেওয়ার মুখে নিজে বেসামাল হয়ে পড়ে যার ছোঁয়া লাগে শরীরে মুখে। তাও যা অবশিষ্ট তাতে চেহারার ওই মাধুর্য। হলপ করে বলা যায় জীবনযাপনের এই বেয়ারাপনা না থাকলে সে সুন্দরী বলে খ্যাতি পেত। তবে তাতে তার কিছু আসে যায় না। বরং গরিব মানুষের সেটা খ্যাতির বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিতে পারত গ্রামের উচ্চবিত্ত কিছু ভদ্রলোকদের কল্যানে। মানুষের চোখে পড়ার ভয় থাকত। তাও যে মধ্যে মধ্যে সে গ্রহে তাকে পড়তে হয় না তা নয়। তবে তাকে এড়িয়ে চলার কায়দা সে বাস্তবের ঘাত প্রতিঘাতে শিখে গেছে।
সুন্দরবনে বিদ্যাধরি নদী থেকে দক্ষিণে বয়ে যাওয়া একটা খারির মুখে ছোট্ট একটা দ্বীপ বুড়িদের এই
গ্রাম। সেই গ্রামে গরীব মানুষের সঙ্গে কয়েকটি বিত্তশালী পরিবারেরও বাস। শহরে ব্যবসা আর গাঁয়ে
জমির মালিকনার দৌলতে তাদের বিত্ত।এরকমই একটা বিত্তশালী পরিবারের কর্তার নাম কুশল মানি।
ভদ্রলোক নিজে গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। গ্রামে তাঁর যথেষ্ট প্রতিপত্তি। কুশল বাবুর ছেলে
মেয়েরা কেউ কেউ ভিন প্রদেশে চাকুরীরত আর কেউ কেউ শহরে থাকে চাকুরী বা ব্যবসা সূত্রে। মেয়েরা
যার যার শশুর বাড়িতে। ছয় ছেলের মধ্যে দুজন কুশলবাবুর সঙ্গে থাকে। এখানকার ব্যবসা জমি জমা
দেখাশোনা করে। তাদের যথেষ্ট বয়স হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। কুশলবাবু রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় ছেলেদের বা নাতীদের মিশনে ভর্তিতে অসুবিধে হয় না। পড়াশুনার
দৌলতে প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত। কুশলবাবুর বড় মেয়ে কলকাতার দক্ষিণ প্রান্ত গড়িয়ায় থাকে। স্বামী
প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মেয়ের ঘরের নাতিটি কুশলবাবুর নেওটা। দাদুর কাছে ছোট বেলা থেকে আসাযাওয়া।
একটু ভাবুক প্রকৃতির ভালো ছেলে। ছেলেটির নাম নীলাশীষ, সবাই নীলু বলে ডাকে। লেখাপড়ায় ভালো। এখন ইংরেজি নিয়ে এম এ পড়ে। এই গ্রামের জীবনের প্রতি একটা টান আছে। মধ্যে মধ্যে চলে আসে। একুশ বাইশ বছর বয়স। প্রকৃতি ওকে টানে। ওর প্রকৃতি প্রেম ওকে লেখার উপাদান যোগায়। আর প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক বজায় রাখা এখানকার মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কে ওর উৎসাহ। তবে প্রকৃতির প্রাচুর্য আর তার মধ্যে মানুষের কঠিন জীবন যাপন, এই বৈপরীত্য তাকে পীড়িত করে। প্রকৃতি একদিকে যেমন উদার অন্যদিকে তেমনি নিষ্ঠুর। আর তার নিষ্ঠুরতার শিকার প্রধানত গরিব মানুষ। প্রকৃতির দানের সবটাই লুঠ করে নেয় বিত্তশালী মানুষ। গরিব মানুষ প্রকৃতিকে ছেঁচে যে সম্পদ সৃষ্টি করে তার কণামাত্র তারা পায় না। দিনে দিনে একদিকে প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে আর তার ফলে একটা ক্ষুদ্র অংশ
লাভবান হচ্ছে। অপরদিকে মানুষের জীবনযাপন আরও কঠিন হচ্ছে। প্রকৃতির রোষের শিকার হয় গরিব
মানুষ। তাদের খাদ্য বস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য সবই নাগালের বাইরে। নীলুর ভাবুক মন এই স্ববিরোধতার
কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। এর প্রতিকারই বা কি ভেবে পায় না।
বুড়িদের বাড়ির কাছেই একটা পুকুর। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এ গ্রামের সবচেয়ে কাছের কিছুর মধ্যে
বুড়ির কাছে পুকুরটাই সবচেয়ে আপনজন। পুকুরের কাছেই সে তার যা কিছু নির্দ্বিধায় সমর্পণ করে। সেই শিশুকাল থেকে তার শরীর মন উৎসর্গ করেছে এই পুকুরকে। তার কাছে বুড়ির কোন লজ্জা নেই। বুড়ির সুখ দুঃখের সাথী এই পুকুর। নিজের নগ্ন শরীর সে এই পুকুরের বুকে ভাসিয়ে দিতে কখনও কার্পণ্য করে নি।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সে তার নারীত্বকে আবিষ্কার করেছে পুকুরের সঙ্গে জলকেলিতে। পুকুর তার সব
চাহিদা মেটায়। পুকুরের জলই তার জীবন। পুকুরের জলে তার জ্বলন্ত শরীর শীতল হয় মন শান্ত হয় পিপাসা মেটে। বাসন বসন ধোয়া মোছা সবেতেই পুকুর তার বন্ধু। তাই দিনের একটা বড় সময় বুড়ির কাটে পুকুরে, কখনও জলে কখনও পুকুর পাড়ে। সে পুকুরের সঙ্গে নিভৃতে সুখ দুঃখের কথা বলে। পুকুর তাকে তার বারোমাস্যার কথা তুলে ধরে। গ্রীষ্মের দহনে তার ভরাট বুক ক্ষীণকায় হয়ে যায়। সে চেহারায় তাকে চেনাই যায় না। বর্ষায় তার ভরা যৌবন। শীতে সে আবার মজে যায়। ঝড় তুফান পুরুষাকারে ঝাঁপিয়ে পড়ে কখনো
কখনো। ক্ষত বিক্ষত করে তাকে। সমুদ্রের নোনা জল যেন তাকে ধর্ষণ করে। আবার বসন্তের সবুজ
বনানী তাকে হাতছানি দেয়। পুকুরের এই সুখ দুঃখের বারোমাস্যার সঙ্গে বুড়ির নাড়ীর যোগ।
বুড়িদের বাড়ির অবস্থা আগে এত খারাপ ছিল না। বাবাকে এখন দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতে
হলেও প্রথম জীবনে তার ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল। ব্যবসা মানে গ্রামে একটা ছোট চালু দোকান। আর
ছিল বিঘা পাঁচ ছয়েক জমি একটা পুকুর শুদ্ধ। তাতে যা আয় হত তাতে বড় একটা পরিবার চলে যেত। বুড়ির
ওপরে দুই দাদা আর ছোট দুই বোন। মা সংসারের দেখ ভাল করেন। বড় দাদা অনেক বড়।আর ছোড়দা ওর
থেকে কিছুটা বড়। এ ছাড়া ওর এক কাকা যিনি লঞ্চ চালান। ওর বড়দাও ছিল লঞ্চ চালক। যাকে বলে সারেঙ্গি।কাকার দুই ছেলে। ওরা পাশেই থাকে। তাও যেন একান্নবর্তী পরিবার। সবাই মিলে মিশে অনেকে।
খুব বর্ধিষ্ণু না হলেও তেমন অভাব ছিল না। বাবা আর দাদার রোজগারে বুড়িদের সংসার চলতো। কাকার
এক ছেলে সে বুড়ির সমবয়সি।কিন্তু বছর দশেক হলো ওদের সংসারে এক বিপর্যয় নেমে আসে। বুড়ির বয়স
তখন বছর দশেক।দাদা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার চিকিৎসার পেছনে বলতে গেলে বাবার
জমানো যা ছিল সব চলে যায়। জমি জায়গা কিছুটা বিক্রি করে দিতে হয়। তাও দাদাকে বাঁচানো যায় না। তখন
বুড়ি আর ওর ঠিক ওপরের দাদা স্কুলে পরে। ছোড়দা পড়াশুনায় খুব ভালো ছিল। বাবা দাদাকে বেশিদূর না
পড়ালেও ছোড়দাকে পড়াশুনায় উৎসাহ দিতেন। দাদা মারা যাওয়ার পর সংসারে অভাবের ছায়া দেখা যায়।
তাও চলতে থাকে। ছোড়দার তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা। বুড়ির বাবা সংসারে অভাবের মধ্যেও ছেলে ও মেয়েপড়াশুনা চালিয়ে যান। নিজে প্রয়োজনে দিন মজুরি করেন। উনি ভালো কাঠের কাজ করেন। এখানে একটা কাঠের দোকানে দরজা জানালার মত বাড়ি ঘরের দ্রব্যাদি তৈরি হয়। সেখানে যখন কাজ পান তখন করেন।তাছাড়া সামান্য যতটুকু জমি আছে তাতে নিজে খাটেন।দোকানটা দেখাশুনার কাজে বুড়ি, সময় পেলে ছোট ছেলে কিছুটা সাহায্য করে। তবে ছেলের পড়াশুনায় যাতে ক্ষতি না হয় তার দিকে বাবার নজর। তাই চাপটা বুড়িকে নিতে হয়। আর আমাদের গ্রামীন সমাজে মেয়েদের বেশি পড়াশুনায় দরকার কি? বিয়েই তো ওদের জীবনের একমাত্র সম্বল। তাই বুড়ির মত মেয়েদের লেখাপড়ায় ইতি দিতে হয়।
গরিব ঘরে কোন বিপর্যয় একবার নামলে সে বিপর্যয়কে অনুসরণ করে অন্য কোন এক বিপর্যয়। বুড়িদের পরিবারে যেমন দাদা মারা যাওয়ায় যে সংকট নামে তা আরো ঘনীভূত হয় বছর তিনেক যেতে না যেতেই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। বৈশাখ জৈষ্ঠ মাসে প্রায় প্রতি বছরই ঝড় তুফান তার সঙ্গে গ্রীষ্মের নিম্নচাপের বর্ষার দুর্যোগ বছর অন্তরের ঘটনা। আর কিছু দিন অন্তর অন্তর এই আতংক প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত হয়। কখনও এ এক ভয়ংকর দুর্যোগ। এক অজানা দুর্যোগ সুন্দরবনকে তছনছ করে দেয় সে বছর। বুড়ির দাদার মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতে প্রকৃতির এই আক্রমণ। সেদিনের এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের নাম সে জানে না। হরবছর দুর্যোগ গুলোর নাম তখন কেউ আজের মত জানত না। বাবা মায়ের দেওয়া ছেলে মেয়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর নাম থাকতো না আজের মত। তখনও আজের মতই প্রকৃতির তাণ্ডবে বাড়ি ঘরদোর তছনছ হয়ে যেত।যেমন বুড়িদের হয়েছিল। তবে কোন হিসেব থাকত না। সরকার তেমনভাবে পৌঁছত না সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য। গ্রামের মানুষকে একসঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে চেষ্টা করতে হত। কেউ পারত কেউ পারত না। জমিতে নোনা জল ঢুকে চাষ বরবাত হয়ে যেত। বেঁচে থাকত শুধু মহামারি দুর্ভিক্ষ আর ক্ষুধা তৃষ্ণা।সেবারের সে দুর্যোগে তলিয়ে যায় বুড়িদের পরিবার।এই তাণ্ডব সেদিন যখন আসে তখনও বুড়ির বাবার আগের বারের দুর্যোগের রেশ কাটে নি। মহাজনের ঋণ শোধ হয় নি।
সেদিনের সে তাণ্ডব এমনি যে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গাঁয়ের স্কুল বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়।ভরপেট খাওয়া দাওয়া দুবেলা জোটে না। সরকারি বা অন্য কোন সেবাপ্রতিষ্ঠানের সাহায্য কিছুটা নিস্তার দেয়।পরিবারের দারিদ্র্য তলানিতে। এর থেকে উদ্ধার পাওয়া অসম্ভব। জমি জমা যা ছিল হাতছাড়া হয়। দোকানটার অবস্থা সঙ্গীন। বিক্রিবাট্টা নেই। মহাজনের শোধ মেটাতে বিক্রি করে দিতে হয় জমি যা ছিল সেটাও। বুড়িকাকাদের অবস্থা আরও খারাপ। ওদের তো একমাত্র ভরসা কাকার রোজগার। জমিজমা তাদের নেই।
দোকানের রোজগারও নেই।ওদের যা সামান্য জমিতে বাড়ি তা ঝড়ের প্রকোপে লন্ডভন্ড। মহাজনের ঋণ।
উপায় না থাকায় কাকাকে বাড়ি বিক্রি করে পাশের গ্রামে চলে যেতে হয়। সেই গ্রামের নাম বিধবা পাড়া।
কাকার লঞ্চ চালিয়ে যে দৈনিক রোজগার তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া দেওয়া সংসারের ভরণ পোষণ প্রায় অসম্ভব হয় ওঠে।কাকার ছেলে বিলু বুড়ির সমবয়সী। ওরা গ্রামে একই স্কুলে একসঙ্গে পড়ত।সেও পড়াশুনায় মোটামুটি ভালো। কিন্তু এই আর্থিক অবস্থায় বিলুর পড়াশুনো আর এগোয় নি। ও রোজগারের পথ খুঁজে বেড়ায়। গ্রামে সুবিধা করতে না পারায় কলকাতায় চলে যায়। মধ্যে মধ্যে গ্রামে আসে। তবে বেশ কিছুদিন ওর খবর পাওয়া যায় না।
বুড়ির থেকে একটু বড় ওর নিজের দাদা কানু খুব ভালো ছাত্র। বুড়ির আর পড়াশুনো না এগোলেও কানু
মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করে নদীর ওপারে ক্যানিং শহরের কাছে ট্যাংরা খালি বলে একটা
ছোট আধা শহরে একটা কলেজে পড়ে। ওটাতে তফসিলি ছাত্রছাত্রীদের বিনা খরচে পড়া থাকা খাওয়ার
ব্যবস্থা আছে। কানু সেখানে হোস্টেলে থেকে রসায়ন অনার্স নিয়ে পড়ে।ও পাশ করে কোথাও ভালো চাকুরী
পেলে পরিবারের অভাব মিটবে। এই ভেবে বুড়িদের পরিবার বুক বাঁধে। বুড়ি মধ্যে মধ্যে কাকার বাড়ি যায়।
কাকার ছেলে বিলুর সঙ্গে বুড়ির শহরের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। আর কাকার কাছে বুড়ি খুবই
আদরের। ভ্রমণ প্রেমীরা সুন্দরবন বেড়াতে আসে। কাকা যে লঞ্চ চালায় সে লঞ্চের খুব কদর ভ্রমণ
প্রেমীদের কাছে। কখনও কখনও বুড়ি কাকার সঙ্গে এ ধরনের ভ্রমণে যায়। সে সূত্রে গ্রামের বাইরে
সুন্দরবনের সঙ্গে বুড়ির অল্পবিস্তর আলাপ। বুড়ির অনুসন্ধিৎসু মন এই আলাপকে গভীর করে তোলে।
দাদা কানু কলেজে বন্ধুবান্ধবের কাছে খুব জনপ্রিয়। কলেজের খোলা আবহাওয়ায় সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে
ওদের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। ওই কলেজে ছেলে মেয়েরা নিম্ন বর্গের প্রধানত তফসিলি ভুক্ত।
গ্রামের প্রভাবশালী পরিবারের ছেলেমেয়ে যেমন পড়তে আসে তেমনি গরিবঘরের মেধাবী ছেলেমেয়েরা আসে।
সংখ্যায় গরিব পরিবারের ছেলে মেয়ে বেশি। তারা বর্ণ বর্গের বিচারে যেমন সমাজে ব্রাত্য তেমনি রুটি
রুজির প্রশ্নে অক্ষম অবহেলিত। আর্থিক ভাবে সম্পন্ন পরিবারের ছেলেমেয়েদের কাছে সমাজের আর্থিক
নিপীড়ন তেমন সমস্যা নয়। তবে সমাজে বর্ণ ধর্মের বৈষম্য তাদের উচ্চবর্গের থেকে বিচ্ছিন্ন করে
রাখে। একধরনের নিপীড়ন তাদের পীড়া দেয়। সে বিষয়ে তারা গরিবদের সমগোত্রীয়। তবে আর্থিক বৈষম্য
পিছিয়ে পড়া বর্গের গ্রাম্য জীবনে উচ্চবর্গ আর নিম্নবর্গের বিভেদটাকে কিছুটা আড়াল করে। কলেজে
এসে কানুরা এটা বোঝে। তাদের মধ্যে আলোচনা হয় এই দ্বিমুখী নিপীড়ন নিয়ে। একে কেন্দ্র করে
অধিকারের আন্দোলনকে যে দুটো বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় করার প্রয়োজন সেটা বুঝতে সাহায্য করে। দেখা
যায় যে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিশেষ করে আর্থিকভাবে সম্পন্ন পরিবারের ছাত্ৰ ছাত্রদের মধ্যে বর্গ
ভিত্তিক সমাজের বঞ্চনা যতটা গুরুত্ব পায় আর্থিক বঞ্চনা বৈষম্যের বিষয়টা ততটা গুরুত্ব পায় না।
আবার আর্থিক দিক থেকে দুর্গত পরিবার থেকে আসা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বর্গ বৈষম্য বিষয়টা ততটা
গুরুত্ব পায় না। ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নিতে গিয়ে কানু এ বিষয়টা কিভাবে ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রভাব
ফেলে তাদের বিভেদ করে রাখতে সাহায্য করে সেটা দেখেছে। ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়ে কানু
মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হয়েছে। মার্কসের শ্রেণিবিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে বিষয়টাকে দেখার চেষ্টা করে।
ছাত্রছাত্রীদের অধিকারের সংগ্রামে সমাজ ও সমাজ ব্যবস্থা ব্যাপারটা কানুর কাছে গুরুত্বপূর্ন হয়ে
ওঠে। সেদিক থেকে সে ছাত্র আন্দোলনকে সমাজ পরিবর্তনের বৃহত্তর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিচার
করে। যাই হোক কলেজের ইউনিয়ন কানুদের দখলে। সে ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক। কানুর কাছে ছাত্র
আন্দোলন সমাজের বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ। একটা রাজনৈতিক সংগ্রাম যা সমাজ পরিবর্তনের
সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত। আর এটা একটা সশস্ত্র সংগ্রাম যা তার কাছে তার পড়াশুনো করে আর্থিক
ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সংগ্রাম থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সেজন্য দরকার আত্মস্বার্থ ত্যাগ করা।
আজকাল কানু বাড়িতে বিশেষ আসে না। কলেজে পড়াশুনা নিয়ে খুব যে ব্যস্ত তাও না। জানা যায় যে ও
হোস্টেলে প্রায়ই ফেরে না। রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়েছে। বলা চলে চরমপন্থী রাজনীতি। সেই
কারণে গ্রামে গঞ্জে তার যাতায়াত। সব কিছু জানা না গেলেও এটা বোঝা যায় যে সে কলেজের কর্তৃপক্ষ
আর রাজ্যে সরকারের কুদৃষ্টিতে পড়েছে। বাড়িতে ওর খবর পেতে গ্রামের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ তৎপর।
বিশেষ করে নিধিবাবুর মত লোকেরা। এদিকে কিছুদিন হল কাকা অসুস্থ। নিয়মিত কাজে যেতে পারেন না।
রোজগার অনিশ্চিত। কাকিমা মারা গেছেন। বিলুর বাবা অসুস্থ বলে সে বাড়ি ফিরে এসেছে। কাকার বাড়ি ভাড়া
বাকি থাকে, সেটা দিন দিন বাড়তে থাকে । মালিক তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে বলে। এই অবস্থায় ক্ষমতা না
থাকলেও বুড়ির বাবা কাকাকে তার কাছে নিয়ে আসে। বিলু উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আর পড়াশুনা করতে
পারে নি। দোকান দেখা শোনা করে। কিন্তু এখন কাকা আর কাকার ছেলে নিয়ে বাবার সংসারে এতগুলো পেট
যে চলে না। বাবা এই বয়সে এখন নিয়মিত কাঠের দোকানে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। তবে বলতে গেলে
সেটাও চলে না। বিলু রোজগার বাড়াবার জন্য কলকাতায় স্থায়ী ভাবে যাবে বলে ঠিক করেছে। ওখানে কিছু
একটা জুটিয়ে নেবে ভাবে। কিন্তু দোকান কে দেখবে। বুড়ি এখন কিছুটা দেখে। তবে এ দোকান উঠে যাবার
মুখে। আর বুড়ি আর কতদিন! ওর তো বিয়ের বয়স হয়েছে। কিন্তু অর্থের অভাবে আর বাড়িতে ওর
প্রয়োজনের জন্য সেটা সেভাবে কেউ ভাবতে পাচ্ছে না। এর জন্য বুলির একটা অপরাধবোধ। সে ভাবে
দোকানের পাট চুকিয়ে দিয়ে বেশি রোজগারের পথে আবার কলকাতায় পা বাড়াবে।
খবর আসে বুড়ির দাদা কানু পুরোমাত্রায় সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছে। এখন কোন এক
গ্রামে থাকে। সেখানে কৃষকের জমি রক্ষা আন্দোলনে যুক্ত। পুলিশ তাকে খুঁজছে। বাড়িতেও পুলিশ এসেছিল।
বাবাকে শাসিয়ে গেছে। বলে গেছে ও এলে যেন খবর দেয়। কিন্তু ও তো হাওয়া। বাড়িতেই আসে না। কে কার
খবর দেবে। বাড়ির লোক ওর খবর পাওয়ার আগে পুলিশই পাবে। যে ভাবে ধর পাকর চলছে। বাড়িতে সবাই
ভয়ে মরে। ও পাশ করে বাবার আর্থিক অবস্থা ফেরাবে তা নয়। বরং অবস্থা আরও তলানিতে। ওর চিন্তায়
সবাই মরে। সে ওই যে গেছে এখন আর আসে না। প্রথম প্রথম আসত। এখন আসা বন্ধ। বুড়ি দাদার খবর
পায় না। বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে সবটা বলে না। মনে হয় কিছু একটা গোপন করে। এর মধ্যে কে একজন
কলকাতা থেকে এসেছিলেন। বাবার সঙ্গে কিছু কথাবার্তা হয়। তবে সেটা কি তা বুড়ি জানে না।
ক্রমশঃ--------
===================