ধারাবাহিক উপন্যাস ।। সামান্য মেয়ে(পর্ব-২)।। রনেশ রায়
পর্ব -২
প্রেমের জোয়ারে
বুড়ি আর কারও চোখে না পড়লেও নীলুর চোখে পড়ে। পুকুরের পর বুড়িও বাবা মা ছাড়া আর যাকে আপন করে চিনেছে এই গ্রামে সে হল নীলু। এই পুকুরকে সাক্ষী রেখেই দুজনের আলাপ। এক অসম বন্ধুত্ব। কি আর্থিক অবস্থা কি সামাজিক মর্যাদা কি আনুষ্ঠানিক বিদ্যা বুদ্ধি সব কিছুর বিচারেই এ এক অসমস ম্পর্ক। তাও সম্পর্কটা গড়ে ওঠে। সহায়তার হাত বাড়িয়ে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার আগেই নীলু বুড়িকে আবিষ্কার করেছে তার রূপে গুনে তার সৌন্দর্যে। শরীরের রূপে চলন বলনে সৌন্দর্যে। এই অসম দুই কিভাবে একে রূপান্তরিত হলো সেটা জেনে নেওয়া যাক।
পরস্পরের মধ্যে পরিচয়টা ঘটে কোন এক বৈশাখী বিকেলে কাল বৈশাখীর হানায় নীলু যখন বিপদের মুখে বুড়ির সাহায্য
প্রার্থী হয়ে ওঠে। ওদের জীবনে সে এক বিরল মুহূর্ত। নীলুর জীবনে বলতে গেলে এক সংকট মুহূর্তে এ
যেন এক মধুর সমাপন। কেউ প্রস্তুত ছিল না এমন একটা অম্ল মধুর মুহূর্তের জন্য যা তাদের পরস্পরকে
চিনিয়ে দিতে সাহায্য করে এক অদ্ভুত নীরবতায় যার সাক্ষী বুড়ির সই সেই পুকুর ছাড়া কেউ নয়।
বিকেলে বুড়ি যখন সব কাজকর্ম ছেড়ে পুকুর পাড়ে বসে পুকুরের সাথে গল্প করে তখন এখানে থাকলে
নীলুকে প্রায়ই দেখা যায় উদাস মনে পুকুর পাড়ে। পুকুর ঘাট থেকে অদূরে সুন্দরী গাছ আর গরান গাছে
আচ্ছাদিত রূপসী দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে। মাঝে মাঝে আড়চোখে বুড়ির দিকে তাকায়। উদাস মনে কি যেন
ভাবে। বোধহয় ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী গাছ তার কাছে বুড়ির ছিমছাম দেহ বৈশিষ্ট্য। আর সবুজে সবুজে
গরানের গুল্ম যেন তার মুখাবয়ব যা হাসির চ্ছটায় প্রস্ফুটিত। নীলুর রোমান্টিক মনে মান্না দের একটা
গানের কলি ভেসে আসে: সে কেন এত সুন্দরী হল---
নীলু আবিষ্কার করে বুড়িকে কেবল দেহ সৈষ্ঠবে নয়, তার মানসিক সৌন্দর্যেও সে তাকে চিনেছে। বুড়িও
উদাসিন এই যুবকের মধ্যে এক প্রেমিককে যেন খুঁজে পায়। যে শুধু দেহের নয় তার মনেরও পিয়াস। কিন্তু
কারও সঙ্গে কারও পরিচয় নেই। একজন আরেকজনের কাছে যেন আকাশের মেঘদূত। মেঘের বার্তা নিয়ে
উপস্থিত হয়। সে বার্তায় লেখা থাকে বৃষ্টির খবর। তৃষা মেটে চাতকের। অথবা একজন আরেকজনের কাছে
গরান গাছ যার শিকড় লুকিয়ে থাকে মাটির গভীরে। সেই শিকড়ের টানেই দুজনে দুজনের কাছে। একে অপরের শিকড়ের রস পেতে উদগ্রীব।
কিছুদিনের জন্য নীলু এসেছে এ গ্রামে। গ্রীষ্ম কাল। বৈশাখ শেষ হয়ে জৈষ্ঠ। গ্রীষ্মের দহনে শরীরে
জ্বলন। এ জ্বালা শুকোতে সময় লাগে। যতক্ষণ না বর্ষা নামে। দিনের শেষ বেলাতে তাপ কিছুটা কম। পুকুর
পাড়ে বাতাসের শীতল হাওয়ায় শরীরের জ্বালা মেটে। সঙ্গে মনের জ্বালাও কমে। বিকেলে যথারীতি বুড়ি
এসেছে তার সইয়ের কাছে। এরই মধ্যে বুড়ি লক্ষ্য করেছে নীলুও এসেছে। এখন নীলু শুধু যে প্রকৃতির টানে
আসে তা নয়। তার মানসে এক মানস সুন্দরী। সেই হয়তো এখন তার প্রকৃতি। সে টান সে উপেক্ষা করতে
পারে না। কিন্তু হঠাৎ এক বিপত্তি। আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। আকাশে ধূমায়িত মেঘ যেন আছড়ে
পড়বে। সুন্দরবনের বৈশাখ শেষের বা জ্যৈষ্ঠের শুরুর এই বিকেলটাকে নীলু চেনে না। মাতাল হয়ে ওঠে
বাতাস। আছড়ে পড়ে ঝড়। সব যেন লন্ড ভন্ড। এখান থেকে কুশলবাবুর বাড়ি বেশ দূরে। এদিকে নীলু পুকুরের পাড়ে ঢালের কাছে। বুড়ি প্রকৃতির এই চরিত্র জানে। এরপর কি হতে পারে সে আন্দাজ করে। এই অবস্থায় নীলু টাল মাটাল হয়ে যেতে পারে। ঝড়ের ধাক্কায় হয়তো পড়ে যাবে পুকুরের জলে। ভালো সাঁতার না জানলে বিপদ। এর মধ্যে অন্ধকার হয়ে এসেছে। বিপদ বুঝে বুড়ি এগিয়ে আসে। সে আসতে আসতে যে ভয় পাচ্ছিল তাই হয়। নীলু নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। বুড়ি এগিয়ে এসে ওকে ধরে। নীলু বুড়িকে ধরে ওঠে। খুব জোড়ে বৃষ্টি নামে। দুজনে কাছেই একটা ছাউনিতে আশ্রয় নেয়। এই প্রথম দুজনে দুজনের চোখাচুখি। কার কি নাম কে কি করে কোথায় থাকে ইত্যাদি। তবে এতে পরস্পরকে চেনার আগ্রহের তেষ্টা কারও মেটে না।
এরই মধ্যে বৃষ্টি ভেজা নারী দেহ নীলুকে চিনিয়ে দেয় বুড়ির দেহ সৈষ্ঠব। নামের সঙ্গে চেহারার কি অমিল।
এ যেন পুকুরের ছায়ায় দেখা এক যুবতী। সিক্ত স্নিগ্ধ। দিনের রোদের দহন আর পরিশ্রমের ক্লান্তিতে
রিক্ত শরীরটা বৃষ্টিতে ভিজে আর স্নিগ্ধ বাতাসে সিক্ত হয়ে ওঠে।আর ওর কথাবার্তা সম্ভ্রব বোধ
নীলুকে আকৃষ্ট করে। বুড়ি বোঝে নিলু শিক্ষিত মার্জিত এক পুরুষ। সে কৃতজ্ঞ তার সাহায্য পেয়ে। সে বার
বার বলে আজ বুড়ি তার প্রাণ রক্ষক। তবে দুজনেই এই প্রথম আলাপে মনের টানটা যতটুকু অনুভব করে
শরীরের টানটা ততটা নয়। সংযত দুই পুরুষ নারীর প্রথম পরিচয়টা জনমানব শূন্য এই রহস্যময়ী আলো
আঁধারেও মানসিক যোগাযোগের মধ্যেই সীমিত থাকে।
কথা বলার সুযোগ হয়।বর্ষণ সিক্ত বসনে বুড়ি আনত মুখে নীলুর কথার উত্তর দেয়।পরস্পরকে
আনুষ্ঠানিকভাবে চেনা। এই প্রথম সাক্ষাতে দুজনেই যেন কথা হারা। কিভাবে কে কাকে সম্বোধন করবে তা
কেউ জানে না যদিও মনে মনে দুজনে আগে দূর থেকে দেখে আড়ালে যে যার সম্বোধনটা ঠিক করেছে।
প্রিয়তম বা প্রিয়তমা। তবে সে সম্বোধনে তো সমাজে ডাকার রীতি নেই। সেটা অসভ্যতা আদেখ্যাপনা। তাই
নামটা জানতে হয়। দুজনেই একজন আরেকজনের নাম পরিচয় জানতে ইচ্ছুক। কিন্ত একটা আড়ষ্ট ভাব
দুজনেরই। এটা শহরের পথ ঘাট হলে অসুবিধে হত না নীলু বোঝে। রাস্তায় বেরিয়ে হামেশাই একটা না
আরেকটা ছুতোতে ছেলে মেয়েদের মধ্যে মুহূর্তে পরিচয় ঘটে যায়। কার কি নাম জানা যায়। তারপর দুজনের
সায় থাকলে বাড়িতেও প্রবেশদ্বার খোলা। কিন্তু এখানে এই পাড়াগাঁয়ে বিশেষ করে আজের এই পরিবেশে !
ভেজা সিক্তকেশা সিক্তবসনা একটা এই বয়সী মেয়ে একটি ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাটাই লজ্জার,
অস্বস্তিকর। গ্রাম্য এই সমাজের কাছে ব্যভিচার। কোন মেয়ের পক্ষে অশোভন। তাই পালিয়ে বাঁচতে হয়।
মন না চাইলেও বুড়ি যখন সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে গুটিয়ে যায় তখন তার কানে নীলুর গলা ভেসে আসে।
এর জন্যই বোধ হয় বুড়ি অপেক্ষা করে। নীলু প্রশ্ন করে:
তুমি কে? কোথায় থাক?
দুজনের আলাপের দরজা খুলে যায়। আর এ আলাপ তো গোপন আলাপ নয় যে লুকিয়ে করতে হয়। বুড়ি
সপ্রতিভ হয়ে ওঠে। বলে:
----- আমার নাম অদৃশ্যা। বাড়িতে বুড়ি বলে ডাকে।
নামটা শুনে নীলুর মজা লাগে। ভালো নাম আর ডাক নামের মধ্যে কি অমিল। অদৃশ্যা যেমনি একটা সুবেশী
আধুনিক নাম তেমনি বুড়ি একটা সাবেকি ছা পোষা নাম। ডাক নামটা যেন তাকে নিয়ে যায় আকাশ পারে
চরকা কাটা বুড়ির দুয়ারে তেমনি এই বৃষ্টি ভেজা নারী শরীর তাকে সুযোগ করে দেয় সেই বর্ষা রাতে
বিরোহিনীর ঘরে উঁকি মারতে। আবার এ গ্রামে এমন একটা আধুনিক নাম! তাও একটা গরিব ঘরে যেখানে
আধুনিক শিক্ষার অন্ধকার। নীলুর অবাক লাগে। সে জানতে চায় ভালো নামটা কে দিয়েছে। নামটা নিয়ে বুড়ির
মনেও কৌতূহল ছিল। এর মানেটা সে বড় হয়ে জেনেছে। তার কৌতূহল মেটায় তাঁর বাবা। সে জানতে পারে
গ্রামের মানি মাস্টার তার এই নামটা দেয়। সে জন্মেছিল খুব ছোট অপুষ্ট। চোখে পড়ার মত নয়। গলায়
জোর এমন ছিল না যে নিজের উপস্থিতি জানান দেবে। সেই দিক থেকে অদৃশ্য এক জন্ম লগ্ন। তাই
মাস্টারমশাই ওর নাম রাখে অদৃশ্যা। নীলু বোঝে মানি মাষ্টার মানে তার দাদু। আর এই দাদুই তার নীলাশীষ
নামটাও দেয়। কি গ্রহের ফের, এক ঘটনা চক্র যা দুজনকে আজ অন্তত এক জায়গায় মিলিয়েছে। ও নিজের
নাম পরিচয় বুড়িকে জানায়। ওর আরও পরিচয়ে জানতে পারে ও গরিব ঘরের মেয়ে। পড়াশুনায় তেমন এগোতে
পারে নি। গ্রামের বাইরের জগৎটাকে তেমন চেনে না। অর্থাৎ আর্থসামাজিক দিক দিয়ে নীলুর সঙ্গে খাপ
খায় না। তাও ওই একটা ব্যাপারে বিধাতা তুলির টানে তাদের সম্পর্কের ছবিতে এক আশ্চর্য মিল রেখে
গেছে। আর সেই বিধাতা পুরুষ আর কেউ নয় নীলুর দাদু মানি মাষ্টার। বেশ কিছু পর বৃষ্টি থামলে প্রায়
অন্ধকারের মধ্যেই একজনকে আরেকজনের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়। দুজনেই সঙ্গে নিয়ে যায় শরীর ও
মনের এক অচেনা অথচ কাঙ্খিত স্পর্শের রেশ।
নীলু জামা কাপড় ভেজা অবস্থায় বাড়ি ফেরে। বাড়িতে সবাই চিন্তায়। কোথায় আটকে গেল কি হলো। দাদু তো
ঘর বার করছেন। এ ঝড় ঝঞ্জায় নাতি বিপদে পড়লো নাকি। নীলু ঢুকতেই প্রশ্ন করেন: কি রে কোথায়
ছিলি? একেবারে ভিজে নিয়ে একশেষ। অসুখে পড়বি। যা জামাকাপড় ছেড়ে আয়।
নীলু কথার উত্তর না দিয়ে জামা কাপড় ছাড়তে যায়। দিদা চা খাবারের ব্যবস্থা করেছে। ছেলেটা কোথায় যে
ঘুরতে যায়। গাঁয়ের পথ ঘাট জানা নেই। সাপ ঘোষের উৎপাত। তার ওপর এই জল ঝড়। কখন যে কি বিপদ
হয়। দিদা ভাবে। নীলু দিদার কাছে এসে বসে। তৃপ্তি করে খায়। ওর জন্য লুচি আর মুরগির মাংস। এখানে
নীলুর আসার একটা টান দিদুর হাতে রান্না। এটাও বলতে গেলে প্রকৃতির টান। ক্ষিধের নিবৃত্তি আর রসনা
দুটোই তো প্রকৃতি। ওর জন্য আর যে অপেক্ষা করছিল সে হলো সোমা। নীলুর মামার মেয়ে। নীলু এলে ও
যেন একটু উপেক্ষিত থেকে যায়। দিদা দাদুর ওর দিকে থেকে মন সরে যায়। দিদা নিলুদাকে যেমন খেয়ে নে
পরে নে করে ওর জন্য ততটা করে না। ও দাদা এলে খুব আনন্দ পায়। দাদার ভালোবাসা আর গ্রামের
বাইরের জীবন সম্পর্কে গল্প। কলেজের বন্ধু বান্ধব সব নিয়ে সোমার মনে অন্য এক জগতের ছবি। নীলু
সে জগতের ছবি আঁকার আঁকিয়ে যে ছবিটা সোমার মনের প্রচ্ছদে আঁকা হয়ে থাকে। সে এক অন্য জগৎ।
কত বুদ্ধিমান শিক্ষিতের আনাগোনা সে জগতে। দুজনে খেতে বসে সেই গল্প কাহিনী। নীলুর বন্ধুরা যেন
সোমার স্বপ্নের রাজপুত্র। আর বান্ধবীরা ! ঝকঝকে তকতকে। কত সপ্রতিভ। ওদের গল্প শুনে শহরে
মেয়েদের জগৎ সম্পর্কে সোমা একটা ছবি আঁকে। কত পার্থক্য। ও ভাবে ও কবে পড়াশুনা করে ওখানে
যেতে পারবে। নিজেকে ওদের মত করে তুলতে পারবে। হয়ে উঠবে নিলুদার বন্ধুদের কারও উপযুক্ত।
নীলু আর নীলুর বোন সোমার মধ্যে এক পরস্পর বিরোধী মন যেন কাজ করে। নীলু এলেই সোমা দাদার সঙ্গে
গল্প করতে গেলে জানতে চায় শহরের জীবন যাপন সম্পর্কে। ওয়াকিবহাল হতে চায় ওখানকার
ছেলেমেয়েদের বিষয়ে। পড়াশুনার সুযোগ সুবিধা নিয়ে ওর নানা প্রশ্ন। নীলু সেসব নিয়ে উত্তর দিলেও শহর
জীবন সম্পর্কে ও যেন উদাসীন কিছুটা বিরক্ত। সেটা ওর কাছে একঘেয়ে এক যান্ত্রিক জীবন। কিন্তু
সোমা ভাবে ওখানে কতরকম বৈচিত্র। কত সুযোগ সুবিধা। কলকাতা সারা ভারতের এক আনন্দ উৎসব
কেন্দ্র। ওখানে থাকলে ভারতকে চেনা যায়। তাছাড়া যন্ত্র তো জীবন যাপনকে কত উন্নত সহজ করে
দিয়েছে। ওখানে পড়তে বসলে আলোর অভাব হয় না। বিনোদনের জন্য সিনেমা নাটক কত কি। বেড়াতে যাবার
কত জায়গা কত সুবিধা। যান বাহন গাড়ি। শিক্ষার কত সুবিধা। স্কুল কলেজ কম্পিউটার কোনটার অভাব
নেই। আর এই গাঁয়ে ! লণ্ঠনের আলোয় পড়া সন্ধ্যের পর কাজ। স্কুলের অভাব। ইংরেজি শেখার পথে বাঁধা।
তাই চাকুরীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাছাড়া আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জীবনের সব কিছুতেই এক
প্রাচীনত্ব। সভ্যতার আলো এখানে পৌঁছয় না। কিন্তু নীলু বলে এই সবুজে ঘেরা গ্রামের জীবনে এক
সরলতা এক স্বাভাবিকতা। মানুষের মন প্রকৃতির মতোই সরল অকৃত্রিম। এখানকার বাতাস নির্মল। নদীর
কলকল প্রবাহ। বনানীর স্নিগ্ধ ছায়া। আর গ্রামই তো শহরের মানুষকে খাবার যোগায়, প্রাকৃতিক উপাদান
আসে গ্রাম থেকে প্রকৃতির আশীর্বাদে। মানুষ বড় হয় প্রকৃতির কোলে। দুজনের এই বিপরীত মনন যেন
বলে:
নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস
ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।
ওদিকে দাদু নীলুকে ডাকে। খাওয়া শেষে নিলু দাদুর কাছে উপস্থিত।দাদুর সঙ্গে নীলুর খুব দোস্তি। সব কিছু
নিয়ে। পড়াশুনা বন্ধুবান্ধবী খেলা ধুলো সব নিয়ে। দাদু গ্রামে কানাঘুষোয় বুড়ির সঙ্গে নীলুর সাম্প্রতিক
ভাব নিয়ে ব্যাপারটা জানে। ওকে এ নিয়ে এতদিন কোন প্রশ্ন করে নি। এখন বিষয়টা নিয়ে দাদুকে ভাবতে
হয়। এখানে থাকাকালীন এই সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই তার দায়িত্ব থেকে যায়। আর সম্পর্কটা তো সমানে
সমানে নয়। জামাইকে মানিবাবু ভালই চেনেন।সে মেনে নেবে না। এর ফল ভোগ করতে হবে মেয়েকে। দাদু
নীলুকে প্রশ্ন করে:
------কিরে কোথায় গিয়েছিলি? কোন বনে বাঁদাড়ে ? আর তোর তো ঐ পুকুরপাড় ! কিসের সন্ধান পেলি? পাখি
না গাছ না মেঘ? না কি কোন সুন্দরী মেয়ের দেখা পেলি? গাঁয়ের পেঁচিদের পছন্দ হবে? তা ওদের নিয়ে
কবিতা লেখা যায়।কোনটা নিয়ে কবিতা লিখবি? নাকি একটা গল্প।
নীলু দাদুর ইঙ্গিতটা বোঝেন। বোধ হয় বুড়ির সঙ্গে ওর ব্যপারটা জানেন বা সন্দেহ করেন। হাসতে হাসতে
ইয়ার্কির ছলে নীলু বলে:
----- তুমি বুড়ো তোমার এত কি? আমরা বড় হয়েছি। আমাদের তো কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে। তবে এটা
ঠিক তোমাদের এখানে দেখার বোঝার অনেক কিছু আছে। কবিতার উপাদান ভর্তি।
দাদু বলেন:
------শুধু কবিতা কেন এখানে গদ্যের উপাদানও কম নয়। অনেক কবিই এখানে এসে কবিতাকে ছুটি দিয়ে
গদ্যে মন দিয়েছেন। গ্রামটার নাম দেখে বুঝিস না। অমাবস্যার চাঁদ। বা পাশে বিধবা পাড়া ! এসবের সঙ্গে
কি কবিতা আসে। তারপর ধর গ্রীষ্মের দহন বৈশাখী তুফান শ্রাবনের ধারা বা হিমেল ঠান্ডা। কোথায়
বসন্তের ছোঁয়া পাস। বসন্ত তো মাত্র দুমাস। এই গাঁয়ের সুখ দুঃখের মধ্যে জীবনটা যে গদ্যময়। তা তোর
খবর বল? জানিস তো বুড়ির বাবা আমার খুব প্রিয়পাত্র। আমার বাড়ির খাট আলমারি সব ওর হাতের।
নীলু বোঝে এবার দাদু সরাসরি তাঁর প্রশ্নে আস্তে চায়। ওই দাদুকে পথ করে দেয়। বলে:
----- আরও জানি ওর একটা দুরূহ নাম তুমিই দিয়েছ যার মানে ওই জানে না।
------ তুই এত জানলি কি করে? হ্যাঁ, নামটা যেন কি?
------ অদৃশ্যা। ধোপদুরস্ত কেতাবি নাম। কবিতায় মানায়। তবে তুমি বললে যে এ গাঁয়ে কবিতার ছুটি। তুমি
অংকের মাষ্টার। এ গাঁয়ে কবি হয়ে গেছ।
------ এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে ওকে তুই পেলি কোথায়? এত কথা হল কি করে ?
নীলু দাদুকে সব বলে। আজ বিপদে বুড়ি ওকে রক্ষা করেছে তাও জানায়। ওর সঙ্গে বুড়ির সম্পর্কটাও
গোপন করে না।
দিদা পাশের ঘরে থেকে সব শোনেন। দৌড়ে এসে বলেন:
------ তবে যা শুনছি সব সত্যি? আমাদের মানটা রাখবি না দেখছি।
নীলু উত্তর দেয়:
------- তোমাদের মান যাবে কেন?
------ জানিস না পাড়াগাঁয়ে এই প্রেম টেম চলে না। তাছাড়া ওদের বাড়ির সঙ্গে কি আমাদের মানায়? না না
এসব চলবে না।
দাদু বলেন:
------- তুমি বললেই কি চলবে না? এসব মনের ব্যাপার। তোমার ইচ্ছের সিঁড়ি ধরে এর ওঠা নামা নয়। ওঠা
নামা করে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে।
-------- তোমার প্রশ্রয়ে ও আরও প্রশ্রয় পাবে। আর তোর বাবা জানলে কি হবে বলতো? দিদা বিরক্ত
হয়ে বলেন।
-------- তোমার এতে আপত্তি তাই তো? কি দাদু তোমারও? ওদের অপরাধ ওরা গরিব নিম্ন
বর্গের মানুষ তাই তো?
দিদু খোলাখুলি বলেন:
------ হ্যাঁ তাই তো। আর গরিব বড়লোক ছাড়াও শিক্ষা দীক্ষা বলে একটা বিষয় তো আছে? সামাজিক
মর্যাদাটাও তো দেখতে হয়?
দাদু পড়েন বিড়ম্বনায়। তিনি বলেন:
------ এভাবে বলছ কেন? গরিব তো কি। মেয়েটা ভালো। ওর বাবাকেও দেখেছি ভালো মানুষ। তাও জানিস তো
বাবা সমাজ বলে একটা ব্যাপার থাকে। সেটা আমাদের ব্যক্তি ইচ্ছে দ্বারা পরিচালিত হয় না। দীর্ঘ কালের
একটা সংস্কৃতি যেটাকে রাতারাতি অস্বীকার করা যায় না। আর দুপক্ষের মানিয়ে চলার ব্যাপারটার সংগে
ভালো মন্দ সব সময় যুক্ত নয়। সমানে সমানে না হলে মানিয়ে চলা মুশকিল। দীর্ঘদিনের একটা অভ্যাস
অনাভ্যাসের বিষয়।
নীলু অধৈর্য হয়ে পড়ে। বলে:
----- দাদু তোমারও এতে আপত্তি! তোমাকে একটু অন্য ভাবে জানি। গরিব বড়লোক সমাজের মর্যাদা
অমর্যাদার ব্যাপারটা তুমি এভাবে দেখ জানতাম না।
দাদু বেশ অস্বস্তিতে পড়েন। তিনি বলেন:
------ দেখ এটা আমার ব্যক্তিগত বিষয় না। আমি কি বিশ্বাস করি কি করি না সমাজ তা নিয়ে চলে না।
একজনকে পছন্দ করে বউ করে নিয়ে আসার পেছনে একটা সামাজিক ইচ্ছে শক্তি কাজ করে। সে ইচ্ছা
শক্তিকে মর্যাদা দিতে গেলে সবাই কি বলে সেটা বুঝতে হয়। সেটাকে অস্বীকার করে পরিবার জীবন চলে
না। দেখ পরিবারের প্রয়োজনে বিয়ে আর ছেলে মেয়ের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক এক না। আর আমি বাঁচবো
কদিন! বলতো তোমার বাবা মা মেনে নেবেন !
নীলু বোঝে দাদু বিড়ম্বনায় পড়েছেন তাই সবার কথা বলে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন, নিজের
বিশ্বাসটাকেও মর্যাদা দিতে পারছেন না। সত্যের চেয়ে বেশি কমের সংখ্যাগত হিসেবটা বড় হয়ে উঠেছে। সে
বলে:
----- সংখ্যা গরিষ্ঠতার হিসেবে কি ভুলটা ঠিক হয়ে যাবে? সমাজ চায় না সেটাই বড় হলো ! মানুষগুলো বড়
না তাদের আর্থিক প্রতিপত্তি আর তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সামাজিক মর্যাদা বিষয়গুলো বড়। দাদু তুমিই
বলেছ ওরা ভালো তবে আর প্রশ্ন থাকে কেন? আমাদের পরস্পরের ভালো লাগাটা কি মিথ্যে হয়ে যাবে?
আর বাবার কথা তুলছ কেন? জান তো বাবার সঙ্গে আমার অনেক ব্যাপারেই মত মেলে না। জানি বাবা এটা
মেনে নেবে না। তাই বলে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে? মাকে এর জন্য চাপে পড়তে হবে। তাও আমি আমার মত
চলব।
দাদু আর কথা বাড়ান না।
এরপর নীলুর জেদটা যেন আরও বেড়ে যায়। বুড়ির সঙ্গে দেখা হলে ওকে সব বলে। বুড়িও ওদের অবস্থাটা
বলে। বাস্তব পরিস্থিতিতে দাদু যে খুব ভুল বলেছেন তা নয়। তার বিয়ের কথা বাড়িতে উঠছে। সে জানতে
চায়:
------ আচ্ছা তুমি বলত এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কোথায় দাঁড়াবে? আমার জন্য তুমি তোমার
পরিবার সমাজ সব কিছু অস্বীকার করতে পারবে? দেখ পরস্পরকে পছন্দ করা ভালোবাসা আর বিয়েটা এক
নয়। আর গরিব ঘরের মেয়েদের অবস্থা কি সেটা বুঝবে না। বিয়ের পর দুপক্ষেরই মানিয়ে নেওয়ার প্রশ্ন
থাকে। তোমাদের পরিবার তোমাদের সমাজ যেমন আমাদের সঙ্গে মানাতে পারে না তেমনি আমরাও পারি না।
এরপর থেকে দুজনকে দেখা যায় গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিরালা খুঁজতে। নীলুর এখানে আসার আকর্ষণ
বেড়ে যায়। ও এলে ওরা দুজন দেখা করে। নির্জনে বসে গল্প করে। কখনও বনে বাদারে কখনও পুকুর পাড়ে।
দুজনের শিক্ষা দীক্ষা চাল চলনে ব্যাপক ফারাক থাকলেও যখন ওরা আলাপে প্রলাপে তখন এই
আনুষ্ঠানিক বৈপরীত্য দূর হয়ে যায়। একজন আরেকজনকে কাছে টেনে নেয়। পরিবেশের বন্যতা তাদের
সভ্য সমাজের কৃত্রিমতাকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করে। সুন্দর বনের আদিমতা তাদের আলো আঁধারে
ঢেকে দেয়। সুযোগ করে দেয় একজনকে আরেকজনের কাছে পেতে। দুজনের একান্ত আলাপে সব সময় যে
প্রেমের জোয়ার বয় তা নয়। মত পার্থক্য দেখা যায়, সংশয়ের কালো মেঘ উঁকি মারে। বিশেষ করে
আলোচনা প্রসঙ্গে উভয়ের পরিবারের সামাজিক মর্যাদার প্রশ্ন যখন ওঠে। বাড়িতে কে কি করে সে সব
আলোচনা হয়। বুড়ি সবসময় যেন দ্বিধাগ্রস্ত শঙ্কিত থাকে। একেই সে গাঁয়ের মেয়ে। গাঁয়ের আঁচার আচরণ
চাল চরণ শহরের শিক্ষা সংস্কৃতি থেকে আলাদা। দুটো পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি শিক্ষা দীক্ষা দুজনকে
সামাজিক মর্যাদায় দুই প্রান্তে দাঁড় করিয়েছে। এই অবস্থায় সমস্যাটা মেয়েদের বেশি বিশেষ করে অর্থে
শিক্ষায় সামাজিক মর্যাদায় মেয়েরা যদি বুড়ির মত শতছিন্ন পরিবারভুক্ত হয়। ছেলের পরিবার যদি
বিত্তশালী হয় তবে সাধারণত সেই বিত্তশালী পরিবার থেকে চাহিদাটা আকাশ প্রমান। বিয়ের যৌতুক যদি
থাকে তবে তো প্রশ্নই ওঠে না। সাধ্যাতীত। তাছাড়া লেখাপড়া চাল চলন কিছুতেই খাপ খায় না। এসব ভেবে
বুড়ি শঙ্কিত হয়। প্রাথমিক আবেগটা কেটে গেলে নীলু কি ওকে সেভাবে গ্রহণ করতে পারবে? নীলু পারলেও
ওর পরিবার ! বুড়ি জানতে চায়। এতে নীলু বিড়ম্বনায়। সত্যি কথাটা পুরো বলতে পারে না। জানে বাড়ি মানিয়ে
নিতে পারবে না। ও নিজেও কি পারবে? উত্তরটা সবটা জানা নেই। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ
ডিগ্রিধারী সমাজে মর্যাদাসম্পন্ন একজনের পক্ষে বাস্তবে ব্যাপারটা এত সহজ নয়। নীলু সেটা জানে।
জানে বলেই আলাপ চারিতায় তার ব্যবহারে অসঙ্গতি ধরা পড়ে। আর বুড়ির মত মেয়েদের বাস্তব বোধ অতি
তুখোড় কারণ বাস্তবকে তাদের মত মেয়েদের মুখোমুখি প্রাত্যহিক জীবনে মোকাবিলা করতে হয়। তাই সে
সেটা বোঝে। তাও প্রেমের আমেজে বিষয়গুলো চাপা থাকে। এক ধরণের স্পর্ধা মাথা চাড়া দেয়। স্পর্ধা
নিয়েই বুড়িরা বেঁচে থাকে। কিন্তু নীলুরা কি পারবে শেষ রক্ষা করতে, প্রেমের নিগড় আঁকড়ে ধরে রাখতে।
নাকি আর দশটার মধ্যে ন‘টায় যা ঘটে তারই এখানে পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সেই বিচ্ছেদ বিরহের খেলা !
ওদের এই মেলামেশায় অসম সম্পর্কে গ্রামের মানুষের মধ্যে আলোড়ন ওঠে নি যে তা নয়। ব্যাপারটা আর
এখন গোপন নয়। ওরা দুজন চলা ফেরা মেলা মেশায় আগের থেকে অনেক বেশি স্পর্ধিত। অনেকটাই খোলা
মেলা। বলতে গেলে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলে। এটা যে সবাই মেনে নেয় তা নয়। তবে এ ধরণের
অজপাড়াগাঁয়েও আজ শহরের ছোঁয়া। ছেলে মেয়েরা আগের তুলনায় অনেকটাই লাগাম ছাড়া। ছেলে মেয়েরা
একসঙ্গে স্কুলে পড়ে। মেয়েদের উপস্থিতি স্কুলে রাস্তা ঘাটে খেলার মাঠে বেড়েছে। পরস্পর বন্ধুত্ব গড়ে
ওঠে । তাই এসব নিয়ে এখন আর তেমন হৈ চৈ হয় না। ঘরে ঘরে এর প্রভাব। অন্যের ঘরের আলোচনা
আনতে গেলে সবারই নিজের ঘরে চোখ পড়ে। তাই এ ধরণের সম্পর্ক নিয়ে আসর বসিয়ে তা নিয়ে গুলতানি
হয় না আগের মত। তবে এ নিয়ে আড়ালে আগডালে কথা হয়। বিব্রত হয় বাড়ির অভিভাবকরা। যেমন মানি
মাস্টারমশায়ের কাছে নাতি নিয়ে নালিশ এসেছে। তিনি রীতিমত অস্বস্তিতে। আজকের দিনে প্রেম
ভালোবাসা আর অভিভাবকের অভিভাবকত্ব মেনে চলে না। সেটা মাস্টারমশাই জানেন। এ নিয়ে তিনি নাতিকে
শাসন করতে ভরসা পান না। আবার চিন্তা আছে ব্যাপারটা মেয়ে জামাই কিভাবে নেবে। আর এই অসম
সম্পর্কটা তিনি জানেন জামাই মেনে নেবে না। তাদের যে আর্থিক অবস্থা আর জীবন ধারণ তাতে দুস্থ
প্রায় অশিক্ষিত পরিবার আর সে বাড়ির মেয়েকে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। উনার স্ত্রী কিভাবে সে
ব্যাপারটা সামাল দেবে। এর জন্য তাকেই দায় নিতে হবে। তিনি যে কি করবেন ভেবে পান না। ওদিকে বুড়ির
বাবার অবস্থা আরও খারাপ। তিনি জানেন ব্যাপারটা একদম মানান সই নয়। সমাজ একে গ্রহণ করে না।
অনেকে ইতিমধ্যে বলা শুরু করেছে যে রুনু বাবু মানে বুড়ির বাবা সুযোগ নিয়ে মেয়েকে এক বোকা ভালো
ছেলের ঘারে চাপিয়ে দিতে চাইছে। অথচ রুনু বাবু কিন্তু মেয়ের বিয়ের কথা ভাবছেন। দুচারজনের সঙ্গে
কথাও বলেছেন। তবে একটা গরিব পরিবারে মেয়ের বিয়ে ব্যাপারটা অত সহজ নয়। তিনি মেয়ের এই বিষয়টা
একেবারেই পছন্দ করেন না। বরং তাঁর মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা কাজ করে। ধনি পরিবারের সুখী ছেলে।
সেখানে মেয়ের সুখ কি সইবে? ওদের কখন কি মর্জি হয়। ঘোর ভাঙলে ছেলে সরে যেতে পারে। এর মধ্যে
কোন অঘটন না ঘটে! উনার নানা দুশ্চিন্তা। তিনি মেয়েকেও বকাবকি করেছেন। কিন্তু তার আর কি করার
আছে ? আরও একটা ব্যাপার তলায় তলায় পাকাচ্ছে। সে আর এক সমস্যা। এ গ্রামের এক মহাজন
নিধিবাবু তাঁর ছেলের জন্য বুড়িকে পাত্রী হিসেবে পেতে চান। মহাজন মানুষটাকে রুনুবাবুর একেবারেই পছন্দ
নয়। শুধু টাকা বোঝে। আর গরিব মানুষকে পায়ের তলায় রাখতে চেষ্টা করে। ছেলেটাও তথৈ বচ। গুণের শেষ
নেই। জুয়া মদ তো আছেই। তাছাড়াও অনেক। রুনুবাবু নিজেও একজন মাতাল। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে মাতালের
বিয়ে দিতে আপত্তি। আবার গ্রামের এরকম এক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রস্তাব মুখের ওপর অস্বীকার
করা মুশকিল। অথচ জানেন এমন জামাইয়ের সঙ্গে মেয়ে বেশিদিন ঘর করতে পারবে না।
গ্রামীন সমাজে মানুষগুলোর মধ্যেকার বাদ বিবাদ হিংসা প্রতিহিংসা পরস্পর সহযোগিতা আনন্দ নিরানন্দ
কোন আভিজাত্যের আড়ালে আড়াল থাকে না। তা খোলাখুলি অনেকসময় দৃষ্টিকটুভাবে প্রকাশ পায়। সভ্য
সমাজে যা একধরনের অসভ্যতা। এই গ্রামের পারস্পরিক সম্পর্কেও এটা ব্যতিক্রম নয়। সেই জন্যই
দেখি মানি মাস্টারমশাইকে তার নাতিকে নিয়ে নানা রকম বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয়। মাস্টারমশাই এর
সঙ্গে নিধিবাবুর বিরোধটা প্রকাশ্যে আসে। গ্রামের মানুষের যে শ্রদ্ধা মাস্টারমশাই পান সেটা নিধিবাবু
পান না। যদিও নিধিবাবুর আর্থিক প্রতিপত্তি মানি বাবু থেকে কম নয়। আর মাস্টারমশাই দারিদ্রের
সুযোগ নিয়ে নিধিবাবুর মহাজনী কারবার ফেঁপে ওঠাটাকে পছন্দ করেন না। সে নিয়ে পরষ্পর দ্বন্দ্ব
বিদ্বেষ। নিধিবাবুর মধ্যে একটা প্রতিহিংসা স্পৃহা কাজ করে। মাষ্টার মশাইয়ের নাতির বুড়ির সঙ্গে
সম্পর্কটা নিয়ে নিধিরাম ঘোট পাকানো শুরু করেন। তার দুটো উদ্দেশ্য। মাষ্টার মশাইকে অপদস্ত করা
আর একই সঙ্গে নাতিকে বুড়ির থেকে দূরে সরিয়ে বুড়ির বাবাকে বাধ্য করা নিজের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে।
উনি জানেন উনার পরিচয়ে আর ছেলের গুণের জন্য এখানে সক্ষম পরিবারগুলোর ঘরের মেয়েকে বউ হিসেবে
পাওয়া মুশকিল। আবার উনার ছেলে আর তার নিজ গুনেই আসে পাশে গ্রামে তারা পরিচিত হয়ে গেছে। আর
উনি তো তার বড় পরিবারের জন্য একজন বউ আর একই সঙ্গে বাদী চান যে তাঁর ঘরে দিনরাত মুখ বন্ধ
রেখে গতরে খেটে যাবে আর একই সঙ্গে ছেলের সব অপকীর্তি মেনে নিয়ে তার রাতের সঙ্গিনী হবে।সেটা
সম্ভব রুনুবাবুর মত গরিব মানুষের মেয়েকে বউ হিসেবে পেয়েই। নিধিবাবু তার এই দ্বিমুখী লক্ষ্য
অর্জনের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। বলে বেড়াচ্ছেন মানিবাবুর প্ৰশ্রয়ে গরিব অশিক্ষিত মানুষগুলো
বেড়ে উঠছে। তাদের ঘরের মেয়েরা বেপরোয়া। এটাকে আটকাতে না পারলে গ্রামের জীবনে উশৃঙ্খলা দানা
বাঁধবে। গ্রামের বেশ কিছু মানুষ নিধিরামের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে তাকে সমর্থন করে। মানি
মাস্টারের সামাজিক সম্মানের হানি ঘটতে থাকে বলে উনি আশংকিত হয়ে ওঠেন। উনি গরীব মানুষের প্রতি
সহানুভূতিশীল হলেও উনার আর্থিক প্রতিপত্তি সামাজিক মর্যাদা উনাকে নাতির সঙ্গে বুড়ির প্রেম ঘটিত
ব্যাপারটা মন থেকে মেনে নিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তাই নাতি এ পথ থেকে সরে আসুক সেটা তিনি
চান। আর তার একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে যার সঙ্গে রুনুবাবুর পরিবারের আত্মীয়তা সম্পর্কটা
মোটেই খাপ খায় না। তাই তিনি বুঝেও নিধিরামের আক্রমণের মুখে নিজেকে কম জোরি বলে মনে করেন।
তার কাছে এ লড়াই নিজের সন্মান রক্ষার লড়াই বলে মনে হয় যেটাতে জয় সম্ভব ওদের বিচ্ছেদে। যদি
নাতি সরে আসে তবে তা নির্বিগ্নে ঘটে যায়। নিধিরামের মত একটা লোকের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে যেতে
হয় না। নিজের সন্মান বাঁচিয়ে এ যুদ্ধে জয় সম্ভব।
ক্রমশঃ---------