মধ্যরাতের আগন্তুক
দীপক পাল
পার্কের কোনার বেঞ্চে বসে তিন মূর্তি গোগ্রাসে গরম গরম ঘুগনি পরম নিশ্চিন্তে ও তদপেক্ষা তৃপ্তিতে শালপাতায় কাঠি দিয়ে খেতে খেতে নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল।সামনে নিচে বসা এক ঘুগনিওয়ালা। একটু নিভু নিভু আঁচে বসানো এক ডেকচিতে ঘুগনি তার ওপর ধারে ধারে বসানো কাটা নারকেলের টুকরো, আর অন্য জায়গায় রাখা শসা, পেঁয়াজ কাটা, মশলা। সে আরো দুজনকে ঘুগনি দিতে ব্যস্ত। বেঞ্চে বসে বিশ্বরূপ, সৌম্য ও বাবলা খুব মনোযোগ দিয়ে ঘুগনি সাটাচ্ছে। এটা ওদের দ্বিতীয় দফার ঘুগনি খাওয়া। বেশ চেটেপুটে খেয়ে সৌম্য ও বিশ্বরূপ শালপাতাগুলো দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বাবলা শালপাতাটা তখনও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে আর কোণের পড়ে থাকা ঘুগনিটাকে জিভ দিয়ে টেনে আনার চেষ্টা করছে। অবশেষে বলেই ফেললো, ' হ্যাঁরে আর এক পাতা করে খেলে হতো না?' ওরা দুজনেই বললো, ' না আর খাবোনা '। একান্ত অনিচ্ছায় শালপাতাটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, ' তোরা না, কি আর বলবো '।
সৌম্য ও বিশ্বরূপ দুজনেই বি কম অনার্স ফার্স্ট ক্লাস পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এলো গতকাল। বাবলা বি কম শুধু পাস করে কোথাও ভর্তি হবার চেষ্টা করে নি। বললো শুধু, ' আমিতো কোথাও চান্স পাবোনা তাই অন্য কোনো কোর্স করে একটা চাকরির চেষ্টা করবো। দেখা যাক কি হয় '। তারপর এক দৃষ্টিতে প্রস্থানরত ঘুগনি ওয়ালার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ তারপর বললো, 'আমি একটা প্ল্যান করেছি বুঝলি? তোরা কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার অনারে।' ওরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল, ' কি প্ল্যান বাবলাদা?' বাবলা ওদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,' ধর আমরা যদি কদিনের জন্য হিমালয়ে বেড়াতে যাই তবে কেমন হয়? দার্জিলিং, কালিম্পং ডিস্ট্রিক্টে এমন সব অফ বিট জায়গা আছে যার সৌন্দর্যই অপরিসীম। সে সব জায়গায় হোমস্টেতে থাকার একটা অন্যরকম আনন্দ আর অভিজ্ঞ্যতা হবে বুঝলি?' ওরা দুজনেই হৈ হৈ করে উঠলো। সমস্বরে বলে উঠলো, ' নিশ্চয় বাবলাদা, খুব মজা হবে একচোট। তুমি যাবার ব্যবস্থা করো।' বাবলা বললো, ' তবে টাকার ব্যবস্থা করে কালকে সন্ধ্যেবেলায় ঠিক এই জায়গায় দেখা করবি। আমিও সব খোঁজ খবর করে কালকে এখানেই দেখা করবো তোদের সাথে, এখন উঠি চল, সময় নষ্ট করে লাভ নেই।' উঠে পড়ল সবাই।
কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় ওরা চেপে বসলো নিউ জলপাইগুড়ি যাবার ট্রেনে। কার কোন বার্থে পড়েছে সেটা দেখে নিয়ে মালপত্র রাখলো নিজেদের। নিচের সিট গুলো সব সিনিয়র সিটিজেনদের দখলে। ওদের সব ওপরে। ওরা নিচেই কাছাকাছি বসে গল্পে মগ্ন হলো। এই আলোচনায় বাবলাই প্রধান। ট্রেনের রিটার্ন টিকেট থেকে হোমস্টে বুকিং, কনডাকটেড ট্যুরের বিবরণ ইত্যাদি সব আলোচনা সেরে ফেললো। প্রথম যাবে তাবাকোষি, এক দিন থেকে তারপর যাবে তাগদা ওখানে থাকবে দুদিন, এরপর যাবে মিম টি এস্টেট। ওখানে থাকবে একদিন | তারপর নিউ জলপাইগুড়ি হয়ে কলকাতা। তাবাকোষিতে থাকা খাওয়া ১৭০০ টাকা, তাগদা আর মিম ১৮০০ টাকা।
বাবলা বললো, ' নে নে অনেক আলোচনা হলো এবার খাবার ব্যবস্থা কর দেখিনি। খিদে পেয়েছে বড়ো। কে কি এনেছিস বার কর এইবার।' বিশ্বরূপ বলে,' সেকি বাবলাদা রাত নটা অন্তত বাজুক। এই সময়তো আমরা পার্কে জমিয়ে আড্ডা মারি তাইনা?' সৌম্য বললো, ' এত তাড়াতাড়ি খেলে মাঝরাতে আবার খিদে পেয়ে যাবে।' বাবলা হাত পা নেড়ে বললো, ' তা পায় পাবে, সে তখন দেখা যাবে, এখন আমার খিদে পেয়েছে আমি এক্ষুনি খাবো ব্যাস। নে তাড়াতাড়ি বার কর দেখিনি কে কি এনেছিস। আমারটাও আমি বার করছি।'
সিটে বড় করে কাগজ পাতা হলো। অবশ্যই নিচের সিটের দুই সিনিয়র সিটিজেনদের পারমিশন নিয়ে। সবার টিফিন কৌটো বার করা হলো। লুচি পরোটা, আলুর দম, শুকনো শুকনো আলুর তরকারি, আলু -ফুলকপির তরকারি, আচার আর মিষ্টি। সবাই মিলে ভাগাভাগি করে খাওয়া হলো। ঘড়িতে তখন নটা বাজে। তারপর একটা কফিওয়ালাকে ডেকে আরাম করে কফি খেতে খেতে বাবলা বললো, ' পাহাড়ে বেড়াতে যাবার মেজাজটা শুরু হলো এইবার, কি বল।'
এরপর ওরা বানকে বিছানা করে শুয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে আর ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ল। সকল বেলা বাবলার ডাকে সৌম্য আর বিশ্বরূপ উঠে বসলো। বাবলা বললো, ' বাপরে বাপ কি তোদের ঘুম। চাওয়ালা এসেছে , চা খেয়ে ঘুমটা কাটিয়ে নে ত একটু। এই চা তিনটে চা দাও তো এখানে।' হাত বাড়িয়ে চা নিল সব। চা খাওয়া সেরে সব গুছিয়ে নিয়ে গামছা, পেস্ট ব্রাশ নিয়ে দুজন ব্যাংক থেকে নেমে বাথরুমে গেলো। বাবলার আগেই সব সারা হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনের কামরায় মানুষ আর হকারদের চিৎকারে জমজমাট। ঝালমুড়ি সহযোগে আর একদফা চা খেয়ে ওরা মালপত্র সব গুছিয়ে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের জন্য। সকল নটার পরেই ট্রেন নিউ জলপাইগুড়িতে এসে দাঁড়ালো। মুহূর্তে স্টেশনটা মানুষের ভীড়ে গিজ গিজ করতে লাগলো। সবারই ভীষণ ব্যস্ততা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ির স্ট্যান্ডে গিয়ে একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে মালপত্র গাড়ির ওপরে তুলে দিয়ে টপা টপ গাড়িতে উঠে বসলো। ভাড়া তাবাকোশি হোম স্টে পর্যন্ত ১৪০০ টাকা। গাড়ি স্টার্ট দিল। পাহাড়ে চড়ার ঠিক মুখে এক জায়গায় একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামলো। সেখানে ব্রেকফাস্ট করে আবার গাড়িতে উঠলো সবাই। গাড়ি পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে উঠতে লাগলো। ড্রাইভার হিন্দি ফিল্মের গান চালিয়ে দিলো। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া গাড়ির জানালা দিয়ে ঢুকে একটা বুনো গন্ধ নিয়ে এলো। গলায় মাফলার জড়িয়ে নিলো সবাই। সৌম্য আর বিশ্বরূপ ওদের প্রথম হিমালয় ভ্রমণ বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে লাগলো। বাবলা বললো, ' কিরে, কেমন লাগছে তোদের?' ওরা
সমস্বরে বললো, ' দরুণ লাগছে বাবলাদা, চিয়ার্স।'
বেলা বারোটার পরে গাড়ি পৌঁছলো তাবাকোশী হোমস্টে। ফটক পেরিয়ে হোমস্টেতে গাড়ি ঢুকিয়ে দিলো ড্রাইভার। হোম থেকে দুজন লোক এসে সব মাল্পত্রাগুলো নিয়ে বারান্দায় জড়ো করলো। তারপর ওদের নিয়ে গিয়ে একটা রুমের দরজা খুলে দিলো আর মালপত্র সব ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো যে সে চা আর গরম গরম পকৌরা নিয়ে আসছে। কিন্তু কোথায় দেবে চা রুমে, বাগানে না খাবার জায়গায়। ওরা বাগানেই দিতে বললো। উঠে ওরা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বেশ অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা রিসোর্ট। সামনে একটু ডানদিক ঘেঁষে একটা ঘরের বাইরের দেওয়ালে পুরনো অচল সব যন্ত্রপাতি নানা রকম স্পেয়ার পার্টস ইত্যাদি দিয়ে এমন ভাবে সাজানো যে বেশ সুন্দর লাগছে। তার পরেই আছে খাবার জায়গা। কাঠের তৈরি সুন্দর কারুকাজ করা গোটাটা। এমন কি খাবার চেয়ার টেবিল গুলও এত সুন্দর কারুকাজ করা যে চোখ জুড়িয়ে যায়। তার ডান দিকে একটা জলাশয়ে কত রকম মাছ খেলে বেড়াচ্ছে। মধ্যিখানে আছে এক ফোয়ারা। জলাশয়ের ঠিক পেছনে রান্নার জায়গা। ওখানে একটা খাবার জায়গাও আছে। এদিকে একটু বাম দিক করে একটা দেওয়ালে ঝোলানো খুব পুরনো মোটর সাইকেল, সাইকেল আর একটা স্কূটার। তার পাশ দিয়ে বাগানে যাওয়ার রাস্তা গেছে। ওরা বাগানে গিয়ে বসতে না বসতেই চা আর গরম গরম পকোড়া এসে গেলো। টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম নামিয়ে দিয়ে বললো, 'সাব, হাম এক এক বালতি করকে গরম পানি আপ লোগোকে নাহানেকে লিয়ে লায়েঙ্গে। আপ সব নহানেকে বাদ রসুইখানামে আ যাইয়েগা, সমঝে?' মাথা নাড়িয়ে সবাই বললো যে ঠিক আছে। পাকোড়া সমেত চা খেতে খেতে এবার ওরা চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখলো। নিচে দিয়ে রংভাং নদী বয়ে চলেছে। ভারী সুন্দর লাগছে চতুর্দিকে পাহাড় বেষ্টিত নদীটিকে এই উপর থেকে। ডানদিকের ওপরে চা বাগান দেখা যায়। সব মিলিয়ে এক দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ। ওরা মুগ্ধ হলো।
স্নান সেরে ওরা কথামত রান্নাঘরে গিয়ে পৌঁছলো। দেখলো ভেতরে দুজন মহিলা রান্নায় ব্যস্ত। পাশে একজন পুরুষ বসে আর একজন দাঁড়িয়ে। একটা বাচ্চা মেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ডানদিকের দেয়াল বেয়ে তিনদিকে খাবার ব্যবস্থা। একদম ঘরোয়া পরিবেশ। সিট গুলোতে নিচু হয়ে বসতে হয়। জলচৌকির হাইটের মতো। আরো চারজন বসেছিল। একজন মহিলা ওভেনে বেগুনি ভাজছে আর একজন থালায় ভাত বাড়ছে আর পেছনের ভদ্রলোক বাটিতে ডাল ও তরকারি রাখছে। আর যে দাড়িয়ে ছিল সে এক এক করে থালা পরিবেশন করছে। সবার মুখেই হাসি আর কথা। যেন ওরা সবাই নিজেদেরই লোক। বাচ্চাটাও উম উম করে কথা বলতে চাইছে সবার সঙ্গে হামাগুড়ি দিয়ে। খাওয়াটা যেন এই পরিবেশের সাথে মধুর হয়ে উঠলো। রাধুনির রান্নাও ভারী চমৎকার তার আন্তরিকতার সাথে একদম খাপ খেয়ে যায়।
খাওয়া দাওয়া সেরে বেরিয়ে আসতেই একজন এসে বললো যে তাদের অফিস রুমে ডাকছে। মনে পড়লো ওখানে ওদের আধার কার্ড জমা আছে অফিসে। অফিস রুমে ঢুকে রেজিষ্টারে সই করে আধার কার্ড সব ফেরত নিয়ে নিলো। অফিস ঘরে একজনের সাথে কথা হলো কন্ডডাক্টেড টুরের ব্যাপারে। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন এই টুরের। পাঁচ হাজার টাকায় এখান থেকে বেরিয়ে মিরিক, পশুপতি মার্কেট হয়ে জোড়বাংলা, জোর পোখরি, পথে যেতে যেতে চাবাগান গুলো দেখিয়ে দেবে। তারপর তাগদা হোম -'স্টে অ্যান্ড হলট। পরেরদিন নিয়ে যাবে লেপচাজগত, লামহাটা হয়ে তিস্তা ভিউ পয়েন্ট অ্যান্ড ব্যাক টু তাগদা হোম। কথা বার্তা ফাইনাল করে এসে ওরা ফটক পেরিয়ে বাইরে পাথুরে রাস্তায় এসে পড়লো। এই রাস্তায় হাটা খুব পরিশ্রমের। দম বেরিয়ে যায়। বাবলা বললো, ' যা হেভি খাওয়া দাওয়া হলো না, একটু না বসলে আমি একদম হাঁটতে পারছি না সৌম্য।' সৌম্য বললো, ' এখানে কোথায় বসবে? তার চেয়ে একটু কষ্ট করে চল, নদীর ওপর যে বাগানটা আছে তার মধ্যে ওই বসার জায়গাটায় গিয়ে বসি।' হাঁটতে হাঁটতে ওরা পিচের রাস্তায় উঠলো। তারপর উল্টোদিকের বাগানে ঢুকে শেডের ভিতরে একটা বেঞ্চে বসলো। বসে বসে গল্পে
গল্পে জমে উঠলো। একসময় বিশ্বরূপ বললো, ' আমরা নদীর কাছে আছি, কিন্তু অনেক ওপরে। কিন্তু বেড়াতে এসে কেন নদীর একদম কাছে যাবো না আর নদীর জল ছুঁয়ে দেখবো না।' বাবলা বললো, ' ঠিক বলেছিস বিশ্ব, এই সৌম্য চল নিচে গিয়ে নদীকে একটু ছুঁয়ে দেখি।' ধাপে ধাপে ওরা নিচে নেমে এলো একদম নদীর কাছে। নদীর জল ছুঁয়ে দেখলো, জল ছোড়া ছুড়ি করলো একটু নিজেদের মধ্যে। ছবিতে তুললো সবাই। তারপর হাফিয়ে গিয়ে একটা বড়ো পাথরে বসলো। বাবলা বললো,' তোরা জানিস, এই রং ভং নদীর নামটা হলো স্থানীয় নাম। এই নদীর জলের রং কিছুটা তামাটে বর্ণ। তাই এই গ্রামের নাম একসময় ছিল তামাকোষি, ক্রমে ক্রমে তা হয়ে যায় তাবাকোশী। কোশী মানে নদী। তাবাকোশী গোয়ালধারা টি এস্টেটের অন্তর্গত। এখনকার চাপাতা অতি উপাদেয়।' অনেকক্ষণ ওরা বসে বসে কত রকমের পাথর দেখলো, কত পাখির ডাক শুনলো, বিশাল আকাশের নিচে পাহাড় আর বনে ঘেরা পটে আঁকা এক নদীর সৌন্দরয প্রাণ ভরে উপভোগ করলো। একসময় উঠে পড়লো। ধাপে ধাপে আবার উঠলো রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে আর একটু ওপরে উঠে পাহাড়ের কোলে একটা সুন্দর মন্দির দেখলো। চারিদিকে বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে মন্দিরকে ঘিরে কত রকম, কত রঙের ফুল ফুটে আছে তার ইয়াত্তা নেই। এ যেন মন্দিরের দেবতার জন্য অর্ঘ সাজানো রয়েছে। রেলিংয়ের ধারে ধারে পাতা আছে বেঞ্চ মানুষের খানিক বিশ্রামের জন্য। এরপর ওরা কিছুক্ষন চা বাগানে ঘুরে বেড়িয়ে হোম স্টে তে নেমে এলো। চায়ের অর্ডার দিয়ে ওরা বাগানে এসে বসলো। খানিক পরে চা আর গরম গরম সিঙ্গাড়া এসে হাজির। এদিকে গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে হাজির। চুক্তি হলো, কাল সকাল সাড়ে নটায় গাড়ি ছাড়বে। চা খাবার কিছু পরেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো।
পরদিন সকাল সাড়ে নয়টায় গাড়ি ছাড়লো। সকালের সূর্যের নরম রোদ গায়ে মেখে গাড়ি ছুটলো পাহাড়ের গা বেয়ে। টুকটাক কয়েকটা স্পট দেখে ওরা পৌঁছলো মিরিক। খুব সুন্দর একটা লেক, তাকে ঘিরে এক পাহাড়ের উপত্যকা। ছোট বড় দোকানপাট আর লোকজনের ভীড়ে রাস্তাটা একেবারে জমজমাট। কোনো এক অজানা কারণে পশুপতি মার্কেট বন্ধ। কি আর করা. গাড়ি ফিরে চললো। এক দিকে পাহাড় গায়ে বনাঞ্চল আর কখনো চা বাগান আর অন্য দিকে গভীরখাদ। এই সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে ওরা আনন্দে সব কোরাস গাইতে লাগলো। পথে এক জায়গায় লাঞ্চ সেরে নিলো। মনে হয় সেটা বিজনবারির কাছে কোথাও এক জায়গা তারপর সোজা সুখিয়া পোখরি। এইখানে সিনিক বিউটি অসাধারণ। এইখানে ওরা সময় কাটালোঅনেকক্ষণ। ঘুরল ফিরলো, ছবি তুললো জলের ধারে, ভিউ পয়েন্টে। হুহু করে বয়ে আসছে ঠাণ্ডা হাওয়া। কাপুনি লাগে শরীরে। একপ্রস্থ চমৎকার গরম চা খেয়ে গা গরম করে গাড়িতে উঠে বসলো। এবার গনতব্য তাগদা হোম -স্টে। বাবলা বললো, ' আমি যে হোমসটে এখানে বুক করেছি সেটা ছিল একসময় ব্রিটিশদের গ্রীষ্মকালীন আবাসস্থল। অতএব এটা ভালো হওয়া উচিত। আমি ছবিও দেখেছি নেটে। সত্যি ভারী সুন্দর।সন্ধ্যার অনেক আগেই ওরা পৌঁছে গেলো তাগদা। কিন্তু হোমটা খুঁজে পেতে কিছুটা সময় গেলো। পাহাড়ের কিছু ওপরের দিকে এই হোম। গাড়ি পুরোপুরি পৌঁছলনা। দুজন লোক এসে মালপত্র নামিয়ে ওদের ওপরে নিয়ে গেলো। চড়াই বেশ। ওপরে উঠে ওদের চক্ষু চড়গাছ। দারুণ সুন্দর এই হোমস্টে। তিন দিকে বারান্দার নিচ দিয়ে সব বিদেশী বহু বর্ণের ফুলগাছ দিয়ে সাজানো। এমনকি বারান্দার ওপরেও ঝোলানো টবে, সিঁড়িতে নানা রঙের বাহারি ফুল গাছের সারি। যেন আস্ত এক নার্সারি। প্রশস্ত লম্বা বারান্দায় দেয়ালের গায়ে পর পর সোফা মধ্যে মধ্যে স্ট্যান্ডে বসানো ফুলগাছের টব সামনের দিকে বসানো বড় একটা টেবিল আর তাকে ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। পাশা পাশি কয়েকটা ঘর। পাশের বাড়িতে খাবার ব্যবস্থা। ওই বাড়ির দোতলায় মালিক তার পরিবার নিয়ে থাকেন। মালিক একজন নেপালি বয়স্ক লোক। দেখা গেছে রোজ সকালে বিকালে উনি এত সব গাছের পরিচর্যা করেন। কখনো কখনো ওনার স্ত্রীও নেমে আসেন তার সাহায্যে।সামনে দূরে পাহাড়ের সারি। নিকটে বন ফায়ারের ব্যবস্থা আছে।
ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে আবার সবাই বারান্দায় এসে বসলো। তাকিয়ে থাকলো সামনে পাহাড়ের দিকে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। একটা একটা করে পাহাড়ের বিভিন্ন জায়গায় আলো জ্বলে ওঠায় ভারী সুন্দর লাগছে এই দৃশ্য। সৌম্য বললো, ' ইংরেজদের দৃষ্টি ভঙ্গির সত্যিই প্রশংসা করতে হয় এমন একটা অপূর্ব সুন্দর জায়গা বেছে নিয়ে বাসস্থান বানিয়ে থাকার জন্য। আর বাবলাদা তোমাকেও অজস্র ধন্যবাদ দিচ্ছি এটা বুক করার জন্য।' বিশ্বরূপও বললো, ' আমিও রীতিমতো মুগ্ধ, তাই বলি থ্রি চিয়ার্স ফর বাবলাদা।' ঠিক এই সময় গরম গরম মোমো আর চা এসে পড়লো। বাবলা বলল,' নে এটাও আমার অর্ডার।' বিশ্বরূপ বললো, ' সত্যি বাবলা দা তোমার কোন তুলনা হয় না।' প্রবল শীত। বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেয়ে ঘরে ঢুকে গেলো ওরা।
ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ঘরের ভেতরে কি আরাম। পাশাপাশি দুটো বিছানা। একটাতে বাবলা একা আর অন্যটাতে সৌম্য ও বিশ্বরূপ শোয়ার ব্যবস্থা করলো নিজেরই। একদিকে ফায়ার প্লেস আছে। অন্যদিকে দুটো সোফা, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল আর একটা উচুতে দেয়াল টিভি। ডান দিকে একটা দরজা বাথরুমে যাবার জন্য। বাবলা বিছানায় কম্বলটা টেনে তার মধ্যে ঢুকে টিভির রিমোট চাপ দিলো। টিভি চলতে শুরু করলো। হলিউডের কোনো সিনেমা চলছে মনে হয়। । কয়েকটা গোরা সাহেব কোট হ্যাট পরে ঘোড়ায় করে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠছে। চুপচাপ, কথা বলছেনা কেউ। খালি ঘোড়ার খুরের আওয়াজ কানে আসে। একটা ছোট লাফ দিয়ে একটু ওপরে উঠে ফটক পেরিয়ে একটা ব্যারাকের মতো বাড়ির কাছে এসে ঘোড়াগুলো দাড়ালো। সারি সারি ঘোড়াগুলো একটা জায়গায় বেঁধে ওদের ঘাস খেতে দিলো। তারপর তারা ব্যারাকের টেন্টে ঢুকে গেলো। এবার একটা টেন্টের ভিতরে দেখাচ্ছে একটা লালমুখো সাহেব মাথার হ্যাট ঝুলিয়ে রেখে ফায়ার প্লেস জ্বালালো। একটা চুরুট ধরিয়ে চেয়ারে বসলো। কোটের পকেট থেকে এক গোটানো বড়ো কাগজ বার করে টেবিলের ওপর রেখে অতি মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলো। ওটা একটা ম্যাপ। হঠাৎ টিভি বন্ধ হয়ে গেলো। বাবলা বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে,' যাচ্চলে এযে দেখি বন্ধ হয়ে গেলো।' অনেক চেষ্টাতেও আর চললো না। দরজায় টোকা পড়লো। ভিতরে আসতে বললে একজন এসে দুটো গরম জলের জাগ আর তিনটে কাঁচের গ্লাস টেবিলে নামিয়ে রাখলো। বললো, ' আট বাজে কে বাদ খানা খানে আপ সব ডাইনিং টেবিলে মে জাইয়েগা ' ওকে টিভির কথা বলতেই বললো ও, ' য়ে টিভি সাব খারাব হো চুকা হ্যায়। কাল রিপ্লেস কর দেঙগে।' একটু আগে চলছিল বলতেই ও চেষ্টা করে দেখলো কিন্তু চললো না। তারপর একটু হেসে চলে গেল।
সোয়া আটটার সময় ঘরে তালা দিয়ে ওরা খেতে গেলো। বাইরে কনকনে শীত। ডাইনিং রুমে ঢুকতেই মাংসের গন্ধ নাকে লাগলো। বড় বড় দুটো টেবিল পাতা। তিনজনের এক কোণে খাবার জায়গা হয়ে গেলো। পুরো টেবিল দুটো ভরে গেলো। হালকা জোরে কথাবার্তায় ঘর গরম। সার্ভ করা শুরু হলো। ভাত রুটি দুটোই আছে। এছাড়া ডাল, ফুলকপির তরকারি, মুরগির ঝোল,স্যালাড শেষ পাতে গোলাপজামুন। ডিনার সেরে ঘরে ফিরলো। বিছানায় উঠে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়তেই টিভিটা ফের চালু হয়ে গেল। সেই লাল মুখো সাহেব চেয়ারে বসে চুরুট টানছে আর একমনে ম্যাপের দিকে চেয়ে আছে। তারপর ম্যাপটা গুটিয়ে কোটের পকেটে রেখে উঠে দাড়িয়ে হ্যাটটা পড়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গেলো। ওরা যেন শুনতে পেলো বাইরে ঘোড়ার খুরের আওয়াজ দূরে কোথাও মিলিয়ে গেলো। ওরা পরস্পরের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। তারপরেই একসাথে অনেকগুলো অ্যালুমিনিয়াম ফাঁপা রড বারান্দায় রাখার শব্দ হলো। বাবলা বললো, ' ওরে সৌম্য ওরে বিশ্ব চুপ চাপ শুয়ে থাক আর লাইট জ্বালানো থাক।' তারপর বহুখন আর কোনো শব্দ নেই। ওরাও একসময় ঘুমিয়ে পড়লো।
রাত কত কে জানে। হটাৎ জোরে জোরে আঘাত দরজায়। চমকে গিয়ে তিনজনেই একসাথে ' কে কে ' করে উঠলো। বাইরে থেকে কে যেনো রাগত স্বরে জোরে চিৎকার করে উঠলো, ' হু আর ইউ অল ব্লাডি। প্লিজ ওপেন দি ডোর অ্যান্ড লিভ দিস রুম ইমিডিয়েটলি, ইট ইজ মাইন ওনলি, আন্ডারস্ট্যান্ড?' ওরা তিনজনে ভয়ে ভয়ে দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখলো টিভিতে দেখা সেই সাহেবই আপাদমস্তক সেই একই পোশাকে মুখে একটা নিভনত চুরুট নিয়ে ঘোড়ার ওপর বসে অগ্নি দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সৌম্য আর বিশ্বরূপ ভয়ানক ভয় পেয়ে গেল। বাবলা ভয় পেলেও পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য কোনোমতে বললো, ' সাহেব, ওনলি টু নাইট স্যার, আফটার দেট উই মাস্ট লিভ দিস রুম ইন দি মর্নিং।' ' নোও ..এন্ড নেভার, ইউ ওফ অল মাস্ট লিভ দিস প্লেস ইমিডিয়েটলি।' সাহেবের হুংকার। বাবলা তবু নাছোড়। বললো, ' অল রাইট, টুমরো উই শ্যাল লিভ দিস রুম। বাট নট টুডে নাইট স্যার, বিকজ নাইট ইজ ভেরি কোল্ড নাউ স্যার।' সাহেব একটু নরম হলো। ' ওয়েল, কল্য ইন আর্লি মর্নিং ইউ অফ অল এই প্লেস ছাড়িয়া চলিয়া যাইবে, নটুবা টোমরা মজা দেখিতে পাইবে নচেৎ মরিয়া যাইবে।' বলেই ঘোড়ার লাগাম টেনে মুখ ঘুরিয়ে ঝড়ের গতিতে কোথায় চলে গেলো। দরজাটা বন্ধ করে দিলো ওরা। বন্ধ করার আগে দেখলো বারান্দায় কোন রড পরে নেই। 'ব্যাপারটা কি হলো বল দেখিনি। রডের আওয়াজ পেলাম বারান্দায় অথচ দেখি নেই। পুরোটাই দেখছি ভৌতিক ব্যাপার।' বাবলার চোখে মুখে ভয় আর ভাবনা। সৌম্য ও বিশ্বরূপ ভয়ে একেবারে কাঁটা। কথা বেরোল না মুখ দিয়ে।
বাকি রাতটা ওরা জেগে ই কাটিয়ে দিলো আর আলোচনা করে ঠিক করলো কাল সকালে চা টা খেয়ে অফিসে সব হিসাবপত্র বুঝিয়ে দিয়ে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। কালকের সাইট সিনটা করে নেবো। তারপর ঠিক করবে কোথায় যাবে আর কোথায় থাকবে বিশ্বরূপ বললো, ' তাড়াহুড়োর কোনো দরকার নেই।গাড়ি যখন আসবে তখন আসুক। আমরা বরং সকালে স্নান করে এখানেই ব্রেকফাস্ট করে মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়বো। ' কথাটা সবারই মনঃপুত হলো।
পরদিন যখন ওরা গাড়িতে উঠলো তখন সকাল নটা। মালিক অনেক করে বলেছিল দুদিনতো বুক করা আছেই, দুপুরেই এই বাড়িতে একটা রুম খালি হবে, টুর করে ফিরে আসলে সেই রুমে ট্রান্সফার করে দেবে। কিন্তু ওরা রাজি হয় নি। গাড়ি চলতে লাগলো উচু নিচু পথে। ওরা মন খারাপ করে সব চুপ চাপ। গাড়ি ঘুম ছাড়িয়ে লেপচাজগত দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ সৌম্য চিৎকার করে উঠলো, ' এই রে আমার মোবাইলটা হোমে ফেলে এসেছি। কি হবে এখন?' বিশ্বরূপ বললো,' আরে আমি ও বাথরুমে আমার টাওয়েল রেখে এসেছি।' সৌম্য রেগে বললো, ' রাখ তোর টাওয়েল, টাওয়েল আর মোবাইল কি এক হলো? জানিস ওর মধ্যে কত কি দরকারই ডাটা আছে যা না হলে চলবেই না।' বাবলা বলে ওঠে, ' দাঁড়া নারে তোরা, চুপ করে আমি কি বলছি মন দিয়ে শোন। আমরা আর কোনো দুঃখ না করে ভয় ডর হীন ভাবে নির্দিষ্ট সাইট সীন করতে থাকি নিশ্চিন্ত মনে। এরমধ্যে আমি টাগদা হোমের অফিসে ফোন করে জানিয়ে দি যে রুমটাতে আমাদের শিফট করে দেবে বলেছিল, আমরা বিকেলে সেই রুমে ই শিফট করবো। ভুলবশত কিছু জিনিষ আমরা রুমে ফেলে এসেছি ওগুলো যেন গিয়ে ঠিকঠাক পাওয়া যায়
কারণ ওগুলো খুব দরকারী। কি বল তোরা?। কথাটা দুজনেরই পছন্দ হলো।
গাড়ি লামহাটায় পৌঁছে গেলো। গাড়ি থেকে সব নেমে দাঁড়ালো। সামনে মস্ত বড় এক পার্ক। বড় বড় করে লেখা ' ইকো পার্ক ' । পার্কের ভিতরে ঢোকার জন্য বাবলা দৌড়ে গিয়ে তিনটে টিকেট কেটে আনলো। ফি পনেরো টাকা করে। টিকেট নিয়ে পার্কে প্রবেশ করলো। শীতের সোনালী রোদে গোটা পার্কটা ঝলমল করছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা একটু প্রশস্ত জায়গায় ছোটাছুটি করে খেলে বেড়াচ্ছে। বড়রা ও কেউ কেউ ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। কেউ কেউ বেঞ্চে বসে তাদের খেলা দেখছে নচেৎ চতুর্দিকের দৃশ্য দেখছে। কিন্তু বেশিরভাগ দর্শক ই দুদিকের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। উপরে সিঁড়ির রাস্তাটা পাইন বোনের ভিতর দিয়ে এঁকে বেঁকে আরো ওপরে উঠে হারিয়ে গেছে। এটি একটি ট্রেকিং রুট। মোটা মুটি ছ হাজার আটশো ফুট উঁচু সী লেভেল থেকে। ওপরে একটা পবিত্র জলাশয় আছে আর তার পাশে একটা মনাস্ট্রি। সেটা দেখে ফিরতে ফিরতে বেশ খানিকটা সময় কেটে গেলো। পার্ক থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে ওরা একটা চায়ের দোকানে ঢুকলো। ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। গাড়িটা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। এত গাড়ির লাইনের মধ্যে থেকে নিজেদের গাড়িটা খুঁজতে হবে। চা আর ডিম ভাজা খেয়ে নিল। কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়লো। বাইরে সারি সারি দোকান। গাড়িটা খুঁজে পেলো। কিন্তু ড্রাইভার নেই। ড্রাইভার আসার পর সবাই উঠে পড়লো। এরপরের টুর প্রোগ্রাম ' লাভারস ভিউ পয়েন্ট '। তিস্তা ও রঙ্গীতের মিলন স্থল। অনেক উপর থেকে অনেক নিচে একদিকে তিস্তা আর একদিক থেকে বয়ে আসা রঙ্গীতের মিলন দৃশ্য নয়ন ভরে দেখার মত। সত্যি নয়নাভিরাম দৃশ্য যাকে বলে। এখানে ও ওরা বেশ কিছুক্ষণ কাটালো। কিছু খাবার মত এখানেও একটা দোকান আছে। কিছু খেলো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে রাস্তায় নেমে এলো। গাড়িতে ওঠার আগে তাগদায় আবার ফোন করলো বাবলা। ফিরে গিয়ে রাতে বর্নফায়ার করবে সবকিছু যেন রেডি থাকে। তারপর সৌম্য আর বিশ্বরূপ কে বললো, ' আশা করি ভয় তোদের কিছুটা কাটবে।'
সন্ধ্যার অনেক আগেই ওরা পৌঁছে গেলো হোম স্টেতে। সৌম্য দৌড়ে গিয়ে রুমের ছবিটা এনে তালা খুলে অপেক্ষা করতে লাগলো সবার আসার। একা দরজা খোলার সাহস পাচ্ছে না। বাকি দুজন আসতেই দরজা ঠেললো। কিন্তু দরজা খুললো না। সবাই চেষ্টা করেও দরজা কিছুতেই খুলতে পড়লো না। অফিসে ঘরে খবর দিতে একজন এসে ঠেলা দিতেই দরজা খুলে গেল। সে বলে, ' খুলাইত হ্যায় সাব।' বলে সে চলে গেল। পরস্পরের হয় মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। সৌম্য বলে,' কি হলো এটা।' ঘরে অতি সন্তর্পণে ঢুকলো একে একে। ভেতরে ঢুকতেই দরাম করে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেলো। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখে সেই গোড়া সাহেবটা বন্ধ দরজাটাতে পিঠ লাগিয়ে জ্বলন্ত চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর এক হুংকার ছেড়ে বললো, ' ইউ অল ব্লাডি নিগার, হওয়াই অল ইউ রিটার্ন ব্যাক এগেইন? ' বাবলা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আবার এক হুংকার ছারলো সাহেব, ' ইউ শাট আপ ব্লাডি ফুল লয়ার। আই উইল টিচ ইউ এ হার্ড লেসন নাউ অ্যান্ড লুক আট মি হাউ ক্যান আই চেঞ্জ মি এ নটরিয়াস ম্যান ফর ইউ।' ভয়ে ওরা তখন কাপছে। মনে ক্ষীণ জোর এনে বাবলা জোর হাতে বললো, শুনুন সাহেব উই আর লিভিং দিস রুম ইমিডিয়েটলি। দিস ইজ সৌম্য হু হাস লেফট হিস মোবাইল ইন দিস রুম টুডে অনফর্চুনেটলি। মোস্ট প্রবাবলি দ্যাট ইস আন্ডার দিস পিলো। আফটার কালেকটিং মোবাইল উই আর লিভিং
দিস রুম। হোপ ইউ উইল আন্ডারস্ট্যান্ড দি সিচুয়েশন। ' হঠাৎ বালিসগুলো এদিক ওদিক ছিটকে পড়তে লাগলো আর মোবাইলটা উড়ে এসে সৌম্যর কপালে এসে আঘাত করে বিছানার ওপরেই পড়লো। সৌম্য ' বাবারে ' বলে মাথায় হাত দিয়ে বিছানার ওপরেই বসে পড়লো। হাতটা সরাতে দেখা গেলো কপালটা কিছুটা ফুলে গেছে। কিন্তু ঘরে সাহেব নেই দরজা খোলা। বিশ্বরূপ টাওয়েল জলে ভিজিয়ে সৌম্যর কপালে চেপে ধরলো। বাবলা অফিস থেকে একজনকে ডেকে এনে মালপত্র গুলো শিফট করতে লাগলো। বলল, ' চল এইবার আস্তে আস্তে ওই বাড়িতে '
জামা প্যান্ট চেঞ্জ করে বসতে না বসতেই চা ও গরম পকোড়া এসে গেলো। যে চা দিলো সে বললো, সাব মেরা নাম রামপ্রসাদ। ম্যায়নে হি নিচে যাকে লাকড়ি উকরি সব কুছ লিয়ায়া বনফায়ার কে লিয়ে। কিতনা বাজে লাকড়ি সজয়েঙ্গে বাতাইয়ে সাব।' বাবলা বললো, ' এই সাত বাজে কে বাদ।' ' তো ঠিক হ্যায়, ম্যায়নে লাকড়ি সাজাকে অপ লোগো কো বুলায়েঙ্গে, ঠিক হ্যায়?' সবাই মাথা নেড়ে সায় দিলো। ও চলে গেলো। সৌম্য, বললো, যাই বলো বাবলাদা আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে।' বিশ্বরূপ বললো, ' আমারও।' বাবলা বললো, ভয় কি আমারও করছে না, কিন্তু তোদের মত না। আর তো মাত্র দু রাত। কালকে সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়বো মিম টি এস্টেটের হোমস্টে ভায়া দার্জিলিং ঘুরে। এই হোমের মালিক গাড়ি ঠিক করে দেবে বলেছে কাল সকাল নটায়।'
রামপ্রসাদ দরজায় টোকা দিয়ে বলল, ' সাব ব্রনফায়ার রেডি আইয়ে জলদি। ঘড়িতে তখন সাতটা বেজে কুড়ি। তিন জনেই মাফলার জড়িয়ে শাল গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো। ওরা গিয়ে চেয়ারে বসলো। রাম সাজানো কাঠের ওপর কেরোসিন ঢেলে দেশলাই কাঠিজ্বেলে দিতেই দপ্ করে কাঠ ধরে উঠলো। কিছুক্ষণের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো বর্ণফায়ার। বাবলা বললো, 'আঃ কি আরাম রে সৌম্য।' আনন্দে সবাই হাত তালি দিয়ে কোরাস গাইতে লাগলো, ' ব্যার্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো, আগুন জ্বালো।' রামপ্রসাদ একটা একটা করে কাঠ দিয়েই যাচ্ছে। একটু পরে সে বললো, ' সাব ইধার দেখিয়ে জেরা আগ বুদ না যায়। আপ তিনোকে লিয়ে কফি লাতে হ্যায়।' বাবলা উঠে মাঝে মাঝে কাঠ দিয়ে আসছিল। কফি ও দিয়ে গেল রামপ্রসাদ। এদিকে দুজন লোক এসে ওদের সাথে আলাপ করলো। ওরা এসেছে ঢাকুরিয়া থেকে। দিব্যি জমে গেলো আড্ডা। একজনের নাম সরোজ আর একজনের নাম সোমেন। দুজনেই খুব জমাটি। বনফায়ার জ্বালিয়ে রাখতে সাহায্য করলো। একসময় কাঠ ফুরিয়ে গেলো আগুন নিভু নিভু প্রায়। ঢাকুরিয়ার লোকেরা ফিরে গেল বিদায় নিয়ে। উড়াও উঠলো। কিন্তু হঠাৎ একটা কনকনে তীব্র হাওয়া এসে আগুনটা ঝুপ করে নিভিয়ে দিলো। আধ পোড়া কাঠ গুলো ইতস্তত ছাড়িয়েপড়লো। পোড়া কাঠের ছাইগুলো উড়ে এসে ওদের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। চোখে মুখে মাথায় ছাইতে সাদা হয়ে গেলো। হাওয়ায় যেন ফিস ফিস করে কেউ বলছে, ' লিভ দিস প্লেস লিভ দিস প্লেস। কোনোমতে ছুটে দুম। করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। কেউ কোনো কথা বলতে পারলোনা। সবার মধ্যে আতংক ছড়িয়ে গেছে।একটু ধাতস্থ হবার পর বাথরুমে গিয়ে জামা কাপড় খুব করে ঝেড়ে গিজার চালিয়ে গরম জলে চোখ মুখ হাত পা ধুয়ে মুছে বিছানায় গিয়ে উঠলো। রামপ্রসাদ আসলে তাকে বললো বাবলা রাতের খাবার ঘরে দিয়ে যেতে। শুধু মাংস রুটি আর পর্যাপ্ত জল খেয়ে লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লো। রামপ্রসাদ এসে এঁটো বাসন গুলো নিয়ে যেতেই দরজা জানলা ভালো করে এঁটে শুয়ে পড়লো। কিন্তু সহজে কি ঘুম আসে। কেন জানি মনে হয় জানলার ওপারে বারান্দায় কে গট গট করে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বাইরে কুকুরগুলো সমানে ঘেউ ঘেউ করছে। এসব শুনতে শুনতে একসময় ওরা। ঘুমিয়ে পড়ল।
দরজায় টোকা পড়তেই ঘুম ভেংগে গেল সবার।চেয়ে দেখে পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো ঢুকেছে ঘরে।দরজা খুলতে রামপ্রসাদ বললো, ' বেড টি চাহিয়ে সাব?'সবাই প্রায় একসাথে বললো, ' হ্যাঁ চাহিয়ে।' ঘরে ঢুকে চা ঢেলে দিলো কাপে রামপ্রসাদ। চা খেতে খেতে বাইরে শুনতে পেলো মানুষের কথোপকথন। শাল জড়িয়ে ওরা বাইরে বেরিয়ে এলো। ' গুড মরনিং ' সামনে দাড়ানো ঢাকুরিয়া থেকে আসা কেউ একজন ওদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো। ওরাও বলল, ' গুড মর্নিং।' সারোজ বাবু বলল, দেখুন বাবলা বাবু কালকে রাতে আপনারা ঠিক এইখানে বনফায়ার করেছিলেন তো, কিন্তু দেখুন তার কোন চিহ্নই বোঝা যাচ্ছে না।' সোমেনবাবু বললেন, ' আধপোড়া কাঠ গুলো দেখুন চতুর্দিকে ছাড়ানো।' ওরা এই সম্বন্ধে কিছু বললোনা। শুধু বললো, ' সত্যি খুব আশ্চর্য্য। জানিনা কি করে এমন হলো।' পরে একসময় বাবলা বললো, জানিস হোমের মালিক আমার হাত ধরে মিনতি করেছে আর বলেছে কাউকে যেন কিছু না বলি। না হত ব্যবসা ওর খুব ক্ষতি হবে। তারপর ফোন করে আজকে আমাদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এমনকি রুম ভাড়াটাও নিতে চায় নি। আমি জোর করে দিয়েছি। উনি একটু কমিয়ে দিয়েছেন। উনি নাকি ওই পোরসন্টা ভেঙে আরো খুব বড়ো করে বাড়াবেন।'
রুমে ফিরে স্নান ব্রেকফাস্ট সেরে মালিকের সাথে হাত মিলিয়ে গাড়িতে চরে বসলো। গাড়ি চলতে লাগলো মিম টি এস্টেট ভায়া দার্জিলিং। সে অন্য ঘটনা। এ ঘটনা এখানেই শেষ।
===================
Address & Mobile No.:-
Dipak Kumar Paul,
DTC Southern Heights,
Block - 8, Flat - 1B,
Diamond Harbour Road,
Kolkata - 700104.
9007139853.