বিস্তারিত জানতে ছবিতে ক্লিক করুন :

উপন্যাস ।। ঝিঁ ঝিঁ পোকার কান্না ।। সুদীপ ঘোষাল





ঝিঁ ঝিঁ পোকার কান্না

সুদীপ ঘোষাল

সঞ্জীব আমি পার্শ্বশিক্ষক আমরা দুজনেই কালনা প্রাইমারী টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিউটে ডি.এল. এড ট্রেনিং নিচ্ছি কেতুগ্রাম থেকে কাটোয়া বাসে এসে কাটোয়া ব্যান্ডেল ট্রেনে কালনা  আসি  আরও অনেক বন্ধু, ভাই আছেন বিভিন্ন স্থান থেকে আসা যাওয়া করেন আমাদের ম্যাডাম যারা ট্রেনিং নিচ্ছেন সকলের সাথেই সকলের একটা হৃদ্যতার সম্পর্ক হয়ে গেছে যে সব স্যার, ম্যাডাম আমাদের শিক্ষা দিয়ে দক্ষ করছেন তাদের আদর, যত্ন আমাদের হৃদয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে

ম্যাডাম বললেন, বিরাজুল, নুর,জয়ন্ত শোনো সরকারের দেওয়া এই সুযোগ হাত ছাড়া কোরো না তোমাদের জন্য আলো অপেক্ষা করছে

আজ বুধবার কালনা স্টেশনে  বসে আছি কলেজের ক্লাস হয়ে গেলে টোটো গাড়িতে আমরা স্টেশনে চলে আসি তারপর একটু বসে সাসামান্য টিফিন করি গল্প হয় নিজেদের মধ্যে সেদিন ট্রেন লেট ছিলো  পাখার তলায় বসে ঘুমিয়ে পরেছি আমার বয়স বেশি বলে কোনো বন্ধু ডিসটার্ব করে নি তারা একটু দুরে বসেছিলো সেটা অবশ্য ঘুম ভাঙার পরে জানতে পেরেছিলাম

ঘুমিয়ে আমি দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম দেখছি আমি আর আমার বন্ধুদের আমাদের ইংরাজী ম্যাডাম আলোর পথে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন ঠিক তখনই আনন্দে আমরা পথে চলেছি  তারপর ম্যাডাম আরও অনেক ছাত্র ছাত্রীদের আলো দেখাতে চলে গেলেন তিনি তো দেবদূত একদলকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলে তো চলবে না

তারপর আমরা চৌরাস্তারমোড়ে থমকে গেলাম দেখলাম চারদিকের চারটি বড়ো বড়ো রাস্তায় বড়ো বড়ো গাড়ি হাইস্পিডে  চলছে আমরা কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছি না আমরা হারিয়ে গেছি সঞ্জীব পরোপকারী  পার্শ্বশিক্ষক, দিলীপ বাবুকে দেখতে পাচ্ছি  তারা অগ্রপথিক হয়ে আমাদের নিয়ে চলেছেন বড়ো রাস্তায় প্রসেনজিৎ বললেন, ওই দেখুন  এই রাস্তার শেষে সাগর বিরাজুল বললেন, আর একটু এগোলেই   জয়  মৃতুঞ্জয় বললেন, আপনাদের সামনের পথগুলো সুন্দর সাবধানে এগোবেন গানে ভুবন ভরানো তিন ম্যাডাম এবার এগিয়ে যাওয়ার গান গাইলেন গানের স্যার, বাংলা স্যার,আরও সব স্যারদের খুঁজে বেড়াচ্ছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না আর একটা পথে সকলে গেলাম,সেখানে নতুনএক আকাশ  শেষে সেক্রেটারি সাহেব এসে আমাদের কলেজে নিয়ে এলেন তারপর বললেন, জীবনের ধর্ম স্বপ্ন দেখা তিনি হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন এবার আপনাদের স্বপ্ন সত্যি হবে মা কে ডাকুন মা সাড়া দেবেন নিশ্চয়

ট্রেনের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলো বন্ধুরা ডাকছেন, উঠুন, উঠুন এবার ট্রেনে বসে ঘুমান ভালো ঘুম হবে আলো আঁধারি স্বপ্নের আনন্দে আমার আর ঘুম এলো না  আমার পুরোনো দিনের কথা মনে করতে ভালো লাগে তাই ট্রেনে বসেই আমি চোখ বন্ধ করে ভাবতে শুরু করলাম হারিয়ে যাওয়া দিনের কথা...

আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায় মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে  নিয়ে আসতেন তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক নগদ টাকর টানাটানি ছিলো চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা আবার কি চাই সামনেই শালগোরে সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু গল্প মনে হচ্ছে মোটেও না এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম লাল মাটি উঁচু উঁচু ঢিবি আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে সমতলের বাসিন্দা আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতোআমাদের মাটি লাল নয় কি বৈচিত্র্য ভূগোল জানতাম না জানতাম শুধু মামার বাড়ি মজার সারি দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন ডিসটার্ব হতোএকদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো আমরা দুপুরে খেলছি দাদু বার বার বারণ করেছিলেন তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে আমি খুব ভিতু ছিলাম আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু সবাইকে বললাম তখন বারো থেকে পনেরো  বছরের পালোয়ান আমরা সকলের ভয় হলো দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি পড়ে দেখ আমি বললাম,বোধহয় পারবো তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ নো অর ইয়েস ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে সাবধান সবাই ঘুমোবি দুপুরের রোদে বেরোবি না বাধ্য হয়ে শুলাম দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট একেবারে বাদাম তলায় চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো ঢিল মেরে পারছি এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির হাতে বস্তা বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই  বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো বীর মুর্মু সাঁওতাল বন্ধু ছেলেধরা তখন পগাড় পাড় আর দেখা নেই বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম আর তুই এক নম্বরের বোঙা একবারে অস্ত্র হাতে যদি মরে যেতো ছেলেটো বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায় তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো জমিদার বাড়িতে তখন ফোন ছিলো না জানাবার উপায় নেই পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না তারপর শুরু হলো লড়াই পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম ভগবান আপনার ভালো করবেন বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন বাকি লোকেরাও খেলেন দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে আপনাকে পেন্নামসাহসকে বলিহারি জানাই আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না দাদু বলেছিলে,  ছেড়ে দে ডাকাতি তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো

সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন আর আমার মামা শান্ত লোকগাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা দুটি বিটি তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো মাকে বলতো গীতু হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস,আই মিনে আয় সুদপে,রিলপে আয় আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতোআবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা,জল খা কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে কার সাধ্য আছে ফলে দেরি হতো অনেক ইতিম

ধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতেআঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে  হাজির আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরেদাদুর পরম বন্ধু সিরাজুল চাচা বাড়িতে গেলেই মিষ্টিমুখ করাতেন তার নাতি বিরাজুল আমার বড় উপকারি বন্ধু মানুষের সংজ্ঞা ওই বাড়িতে গেলেই খুঁজে পাই

তারপর সংসারের টানা পোড়েনরাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম দাদু কত গল্প বলতেন কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতরন,জানি না ভাই তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি তোর মঙ্গল হবে আমিও শান্তিতে যেতে পারবো হয়েছিলো তাই কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে মাথাটা ঠিক কর  বালিশে দি কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে ছেড়ে দে আমি বললাম, না ঠিক করো তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে 

অনেক বছর অপেক্ষা করেছি,দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি কথা শোনা তো দূর অস্ত  ট্রেন কাটোয়া ঢুকে পরেছে যে যার নিজের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো আমি বাড়ি এসেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পরলাম ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেতে বন্ধুরা সবাই বেড়াতে আসে মাঠে গল্প গুজব করতে করতেই সবাই বাড়ি ফিরলাম তারপর কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে তারা চলে গেলে সপরিবারে রাতের আহার সারি

সকাল হলেই বন্ধু আশীষের খোঁজ নিতে গেলাম ফিরে এসেছে ভেলোর থেকে

খবর ভালো নয়

আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা সারা  বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে পৃথিবীর রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায় কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন

তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া গঙ্গার ধারে গ্রামটি ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়াকারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন আশীষের বাবাকে আমি  জামাইবাবু বলতাম তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন তার দাপ ছিলো ভীষণ তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে আমার তাই মনে হয় সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম

কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায় বন্ধু অমিত বললো,তবু মানুষের এত অহংকার তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে সে ভোলে না হঠাৎ চলে আসে সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে

আবার আমার বন্ধু আর আমি শেয়ার করছি  নিজেদের মধ্যে পুরোনো ছেলেমানুষের কথা

কদতলার মাঠে এসে ঢিল মেরে পেরে নিতাম কাঁচা কদবেল কামড়ে কচ কচ শব্দে সাবাড় করতাম কদ বুড়ো বলতো, কদ খেয়ছিস আর খাবি কই তখন তো গলা জ্বলতো না এখন শুধু ওষুধ ভক্ত,ভব,ভম্বল,বাবু বুলা, রিলীফ সবাই তখন আমরা আমড়া তলায় গিয়ে পাকা আমড়া খেতাম জাম, তাল,বেল, কুল,শসা, কলা, নারকেল কিছুই বাদ রাখতাম না নারকেল গাছে উঠতে পারতো গজানন শুধু দুহাতের একটা দড়ি তাকে পায়ের সঙ্গে ফাঁদের মতো পরে নিতো গজানন তারপর কিছুক্ষণের মধ্যেই নারকেল গাছের পাতা সরিয়ে ধপাধপ নিচে ফেলতো আমরা কুড়িয়ে বস্তায় ভরে সোজা মাঠে বাবা দেখলেই বকবেন তারপর দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে মাঠেই খেয়ে নিতাম নারকেল একদম বাস্তব মনগড়া গল্প নয় তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা সারা রাত বোলান গান শুনতাম সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে

শীতকালে খেজুর গাছের রস গাছের কামান হতো হেঁসো দিয়ে মাথার মেথি বার করে কাঠি পুঁতে দিতো গুড় ব্যাবসায়ী আমাদের ভয় দেখাতো, ধুতরা ফুলের বীজ দিয়ে রাকবো রস খেলেই মরবে সে চুরি করা কাকে বলে জানতাম না একরাতে বাহাদুর বিশুর পাল্লায় পরে রাতে রস খেতে গেছিলাম বিশু বললো, তোরা বসে থাক কেউএলে বলবি আমি গাছে উঠে রস পেরে আনি তারপর গাছে উঠে হাত ডুবিয়ে ধুতরো ফুলের বীজ আছে কিনা দেখতো পেরে আনতো নিচে তারপর মাটির হাঁড়ি থেকে রস ঢেলে নিতাম আমাদের ঘটিতে গাছেউঠে আবার হাঁড়ি টাঙিয়ে দিয়ে আসতো বিশু সকালে হাড়ি রসে ভরে যেতো ভোরবেলা ব্যাবসায়ির কাছে গিয়ে বলতাম, রস দাও, বাড়ির সবাইকে দোবো বুক ঢিপঢিপ চাঁদের গর্ত দেবে কি দেবে না, জানিনা অবশেষে প্রাপ্তিযোগ যেদিন রস পেতাম না তখন মাথায় কুবুদ্ধির পোকা নড়তো তাতে ক্ষতি কারো হতো না বিশু ভালো মিষ্টি রস হলে বলতো, এটা জিরেন কাঠের রস মানে চারদিন হাড়ি না বাঁধলে রস মিষ্টি হতো জানি না আমরা গাছে  নিচে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম রস পরতো জিভে টুপ টাপ কতদিন ঘনটার পর ঘনটা কেটে গেছে রসাস্বাদনে মোবাইল ছিলো

 নাফেসবুক ছিলো না কোনো পাকামি ছিলো নাসহজ সরল হাওয়া ছিলো ভালোবাসা ছিলো   আনন্দ ছিলো জীবনে ব্লু হোয়েলের বাপ পর্যন্ত আমাদের সমীহ করে চলতো কোনোদিন বাল্যকালে আত্মহত্যার খবর শুনিনি সময় কোথায় তখন ছেলেপিলের যম পর্যন্ত চিন্তায় পরে যেতো বালকদের আচরণে, কর্ম দক্ষতায়

সময় পেলেই সংসারের কাজ করি নর্দমা পরিষ্কার, টয়লেট পরিষ্কার, ব্লিচিং পাউডার ছেটানো এইসব আমি করি অবসর সময়ে বাজার আমি আর গিন্নি দুজনেই করি ছেলে পড়াশোনা আর কলেজ নিয়ে ব্যস্ত

এবার বয়স বেড়েছে নিয়ম কলে চলা বাকি জীবন তবু বেড়া ডিঙিয়ে নদীর ওপাড়ে যেতে মন চায় বারেবারে কিন্তু পারি না নিয়ম রীতির বেড়ি দিয়ে ঘেরা জীবনে আর কোনো ইচ্ছা হয়তো মুক্তি পাবে না ভালো মন্দের দোলা দিয়ে চলুক জীবন তরী

সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে  কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে আমার টোনা মাসিকে  টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে  শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়

শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়

মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল সে জানত ফুল ঝরে গেলেও

তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে  সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়  মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায় শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়  শিমূল ফুলের মত রূপ সর্বস্ব মানুষের নয় শরত আমাদের তাই শিউলি উপহার দেয় শিমূল নয়

 বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে  কিন্তু আমাদের গ্রামে বেশিরভাগ লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে, বুড়ো ঢ্যামনার ভিমরতি হয়েচে  সখ দেখো এখনও রঙীন জামা পড়ে ব্যায়াম করে মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে

একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে, মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না

সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি  নিজের মনে গুমরেওঠে যত স্মৃতি  শেয়ার করার কেউ নেই  তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ 

তবু সব কিছুর  মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি  সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই  তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর  আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে  সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ

সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক

আমার দুই বোন তিন ভাইঝি  বোনেদের নাম রত্না স্বপ্না  রত্না হলো কন্যারত্ন সব অভাব অভিযোগ তার কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার  ভাইঝিরা তানুশ্রী, দেবশ্রী,জয়শ্রী এরা বড়দার মেয়ে আর মেজদার মেয়ে পৃথা,ছেলে ইন্দ্র  এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়  বাবুর মেয়ে তিন্নি আমার ছেলে সৈকত

ভরা সংসারে সবাই সুখে আছি কিন্তু কতদিন?

রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই  কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায়

অচেনা বলয়,মাকড়সার জালের মতো জটিল সবাই এত অচেনা অজানা রহস্য ময় বুকটা ধকধক করছে,হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে, চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা আর আমি একা নই,কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়...

সঞ্জীব বলেন,জল তুমি ডুবিয়ে রাখো মানুষের দুর্গতির কারণ তুমি ছাড়া আমরা ভালো থাকতামমরুভূমি দর্প করে  আমি সমগ্র পৃথিবী শাসন করবোসমগ্র জীবন প্রতিবাদ করে  সৃষ্টি হয় প্রকৃতি সবুজ বন  নামে বৃষ্টিধারা  সঙ্গে জীবন  জিত হয় জলের তাই জলের অপর নাম জীবন জলের মত সহজ হওবাউল হবে

সঞ্জীবের ছাত্র বলে,আপনার কথাগুলো কবিতার মতবেশ লাগে শুনতে

- শুধু শুনলে হবে নাপালন করতে হবে

- হ্যাঁ স্যার,চেষ্টা করব

এইভাবে জীবন এগিয়ে চলে সুখেদুখে

সঞ্জীবের মনে পড়ে রাম আর রমার কথারাম রমা বিয়ের পর  থেকেই ভাড়া বাড়িতে থাকে তাদের সন্তান হলো ভাড়া বাড়িতে স্বাধীনতা নেই তারা দুজনে বসে নিজের বাড়ি বানানোর স্বপ্ন দেখলো রোজগার কম রমা তার গহনা দিলো রামের কিছু নগদ সঞ্চিত সম্পদ মিলিয়ে ছয় মাসের মধ্যেই স্বপ্ন সফল করলো এখন তারা শিশুকন্যাকে নিয়ে নিজের বাড়িতে থাকে দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অসম্ভবও সম্ভব হলো

কন্যা যখন চার বছরের তখন থেকে মা স্কুলে নিয়ে যান আর রাম গৃহশিক্ষকতা করে অর্থ জোগান রমা বাড়ির কাজ করেন এইভাবে ওদের যৌথ প্রচেষ্টায় শিশুকন্যা আজ বড়ো হয়ে স্কুল শিক্ষিকা হয়েছে তাদের স্বপ্ন সফল হয়েছে

নর নারীর শক্তি একত্রে নতুন স্বপ্ন গড়ে তোলে  যুগে যুগে তার প্রমাণ মেলে

পার্শ্বশিক্ষকতা থেকে  অবসর নেওয়ার পর থেকে আমি আমার স্ত্রী কাছাকাছি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি ঘুরে দেখিছেলে চাকরি করে, কোলকাতায় থাকেমাঝে মাঝে বাড়ি আসেআমরা বাসে চেপে কড়ুই গ্রামে এলামএখানে কবিশেখর কালিদাস রায়ের বাড়িএকজন বললেন,১৮৮৯ সালের ২২ শে জুন পূর্ব বর্ধধমানের কড়ুই গ্রামে কালিদাস রায়ের জন্ম তাঁর লেখা ছাত্রধারা পড়ে আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম ছোটবেলাতে আমার এক দাদা স্বপন ঘোষাল নিয়ে গিয়েছিললন তাঁর জন্মভিটে কড়ুই গ্রামে খুব ভাল লেগেছিল সে সময়ে আমি যখন গেছিলাম তখন খড়ের চালের একটা ঘর দেখেছিলাম তাঁর ভিটেতে এখন হয়ত সংস্কার করা হয়েছে বাসভূমি তিনি ছিলেন চৈতন্যদেবের জীবনীকার লোচনদাসের বংশধর কালিদাসের শৈশব কেটেছিল মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর শহরে সেখান থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি শিক্ষকতার বৃত্তি গ্রহণ করেন কলকাতার ভবানীপুরের মিত্র ইনস্টিটিউশনে দীর্ঘকাল শিক্ষকতা করেছিলেন তিনি ১৯৭৫ সালে টালিগঞ্জে 'সন্ধ্যার কুলায়' নামক নিজস্ব বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কালিদাস রায়কালিদাস কাশিমবাজার আশুতোষ চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত শেখেন এবং পরে কাশিমবাজারের খাগড়া লন্ডন মিশন স্কুলে অধ্যয়ন করেন ১৯১০ সালে তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করে স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনশাস্ত্রে এমএ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন; কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেই পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন রংপুরের উলিপুর মহারানী স্বর্ণময়ী হাইস্কুলের সহশিক্ষক (১৯১৩) হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় পরে কিছুদিন (১৯২০-৩১) চবিবশ পরগনার বড়িশা হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার পর রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় তিনি কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশনের ভবানীপুর শাখায় প্রধান শিক্ষকরূপে যোগদান করেন এবং ১৯৫২ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পদে অধিষ্ঠিত ছিলেনকালিদাস 'রসচক্র' নামে একটি সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং রবীন্দ্র-ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে তিনি কাব্যচর্চা শুরু করেন রোমান্টিকতা, প্রেম, পল্লিজীবন, সমাজ, ঐতিহ্যপ্রীতি এবং বৈষ্ণবভাব তাঁর কবিতার প্রধান বিষয় তাঁর মোট কাব্যগ্রন্থ ১৯টি; তন্মধ্যে কুন্দ (১৯০৭) তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্য ছাড়া পর্ণপুট (১৯১৪), ঋতুমঙ্গল (১৯১৬), রসকদম (১৯২৩), হৈমন্তী (১৯২৪), লাজাঞ্জলি, ব্রজবেণু (১৯৪৫), চিত্তচিতা, পূর্ণাহুতি (১৯৬৮) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ তিনি কালিদাসের শকুন্তলা, কুমারসম্ভব এবং মেঘদূতের অনুবাদ করেন প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য পরিচয়, প্রাচীন বঙ্গ সাহিত্য, পদাবলী সাহিত্য, শরৎ-সাহিত্য সাহিত্য প্রসঙ্গ তাঁর সমালোচনা গ্রন্থ তাঁর রচিত শিশুতোষ গল্পকাহিনীও আছে 'বেতালভট্ট' ছদ্মনামে রচিত তাঁর রম্যরচনাগুলি পাঠকসমাজে খুবই সমাদৃত হয়েছেসাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কালিদাস বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি রংপুর সাহিত্য পরিষদের 'কবিশেখর' উপাধি (১৯২০), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' (১৯৫৩) 'সরোজিনী স্বর্ণপদক', বিশ্বভারতীর 'দেশিকোত্তম' উপাধি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'রবীন্দ্র পুরস্কার' (১৯৬৩) এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি (১৯৭১) লাভ করেন ১৯৭৫ সালের ২৫ অক্টোবর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়

স্ত্রী সোমা বললেন, বর্ধমানের এই স্বনামধন্য কবিকে শ্রদ্ধা  জানাই এই জেলার অধিবাসী হিসেবে এই জেলা   তথা সমগ্র বাংলার পক্ষ থেকে অসংখ্য  কুর্ণিশ তাঁর প্রতিভাকে

 এবার সিঙ্গি গ্রামে গেলাম কাশিরামদাসের জন্মস্থানেজনৈক মাষ্টারমশাই বললেন, কাশীরাম দাস   মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবি তাঁর রচিত বাংলা  মহাভারত সর্বাধিক জনপ্রিয় আনুমানিক ষোলো শতকের মধ্যভাগে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার ইন্দ্রাণী পরগনার সিঙ্গি গ্রামে এক  কায়স্থ পরিবারে তাঁর জন্ম পিতা রমাকান্ত দাস উড়িষ্যার পুরীতে  জগন্নাথ দর্শনে গিয়ে সেখানেই বসতি স্থাপন করেন কাশীরাম মেদিনীপুরের আওয়াসগড় রাজার শাসনাধীন কোনো এক স্থানে পাঠশালা খুলে শিক্ষকতা করেন হরহরপুরের অভিরাম মুখুটি ছিলেন কাশীরামের গুরু তিনি তাঁরই নির্দেশে মহাভারত রচনা করেনকাশীরামের নামে আঠারো পর্বে সমাপ্ত বিশাল মহাভারত প্রচলিত আছে তবে তিনি আদি, সভা, বন বিরাট চার পর্ব রচনা করে মারা যান; পরে তাঁর পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্র অন্যান্য আত্মীয়স্বজন মিলে কাব্যখানি সমাপ্ত করেন এটি ১৮০১-১৮০৩-এর মধ্যে  শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে আংশিকভাবে প্রকাশিত হয় তারপর ১৮৩৬ সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় একই প্রেস থেকে সম্পূর্ণ আকারে মুদ্রিত হয় পরবর্তীকালে আরও অনেকেই কাব্যটি সম্পাদনা করেনকাশীরামের পূর্বে পরে আরও অনেকে পূর্ণ খন্ডিত আকারে মহাভারত রচনা করেছেন; কিন্তু সেগুলির মধ্যে কাশীরামের গ্রন্থই শ্রেষ্ঠ বেদব্যাসের সংস্কৃত মহাভারত অন্য অনেক উৎস থেকে উপাদান নিয়ে কাশীরাম প্রায় স্বাধীনভাবে বাংলা মহাভারত রচনা করেন বাঙালির কাছে কৃত্তিবাসের  রামায়ণ কাশীরামের মহাভারত সমান গুরুত্বপূর্ণ উভয় কাব্য যুগ যুগ ধরে হিন্দুদের ঘরে ঘরে পঠিত হচ্ছেমহাভারতে নানা বিষয়ের সমাহার আছে, যেমন শাস্ত্র,  পুরাণ, ইতিহাস,  দর্শন, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি মহাভারত ছাড়াও কাশীরামের নামে ভারতপাঁচালী, সত্যনারায়ণের পুথি, স্বপ্নপর্ব, জলপর্ব নলোপাখ্যান নামক গ্রন্থগুলি প্রচলিত তাঁর অগ্রজ কৃষ্ণদাস অনুজ গদাধর যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণবিলাস জগন্নাথমঙ্গল কাব্য রচনা করেন থেকে প্রমাণিত হয় যে, কাশীরাম পারিবারিক ঐতিহ্যসূত্রেই কবিত্বশক্তি অর্জন করেছিলেন বর্তমানে কাটোয়ার সিঙ্গি গ্রামে প্রতিবছর কাশীরাম দাসের স্মৃতিবার্ষিকী পালিত হয়  কাশীরাম দাস রচিত অনুবাদটি কাশীদাসী মহাভারতনামে জনপ্রিয় যদিও কবি এটির নামকরণ করেছিলেন ভারত-পাঁচালী এই কবিকে আমাদের প্রণাম জানাই

সোমা বলে,সবার কাছে ভালোবাসা পেতে চায় মনএকটু স্নেহ,একটু বন্ধুত্ব আর কিছু নামন, পুরষ্কার তো দূর অস্ত জীবনে কোন প্রশংসা পায় নি জীবনে প্রেম পায় নি বন্ধুর প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল সে ছিল পত্রবাহক সুন্দরী কোন মেয়ে ফিরেও তাকায় নি সংসারে সকলের হাসির পাত্র ছিল সে খুব মজা পেত সকলে তাকে পেলেই হাসি ঠাট্টায় হেরে যেত তার মন মনের কোণে ভালোবাসার জায়গা হয় নি সে নাকি ভালবাসার যোগ্য নয় ইন্টারভিউয়ে পাশ করেছি অনেক কিন্তু চাকরি পাশ কাটিয়ে হয়েছে অধরা সে শিক্ষকতা করে কিন্তু শিক্ষক নয়তার নামের পাশে  থাকে গৃহশিক্ষক সংসারে সাহায্য করেও কোন মূল্য পায় না তার সম্মান মেলেনি ভালবাসার খাবার পায় নি কেমন যেন সিঁটিয়ে গেছে সে খোলা হাওয়ায় বুকটা হাল্কা হলেও ভারি হয়ে থাকে বাকি সময় এক অপরাধির মত জীবন বয়ে যায় তার জানে না কি সেই অপরাধ যা নিয়তির দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায় আত্মীয় স্বজন ভালবাসতে জানে তার কথায় কেউ ব্যথা পেলে বুকে বাজে ভালবাসা দিলেও অবজ্ঞা জোটে লিখতে জানি না পড়তে পড়তে বইয়ের পাতা ঝাপসা হয় অন্ধকার নেমে আসে পরাজিত  হয়েও অন্তরে তার আলো জ্বলে ওঠে মনে হয়, এই বুঝি ভালবেসে এল সত্যের শেষ আলো এই আলোয় নিষিক্ত হবে দেহ মন আর কেউ না হোক ভালবাসে অরূপরতন

আমি মনে পড়ে, আদুরি ছোট থেকেই গ্রামেই মানুষ তার বাবা-মা তার জন্মের পরেই মারা যায় এবং সে তার দাদা বৌদির কাছে মানুষ হয় ছোটবেলায় মাত্র তের বছর বয়সে তার বিয়ে হয় আর দুবছর পরেই তার স্বামী মারা যায় অর্থাৎ সে বাল্যবিধবা হয়ে জীবন কাটায়

এখনো কুসংস্কার সমাজে এমন দানা বেঁধে আছে যে বিদ্যাসাগর মহাশয়  বিধবা বিবাহ প্রচলন করলেও তার প্রয়োগ সমাজে এখনও স্বীকৃত নয় নানাজনে নানা কথা বলে তার ফলে অনেক বাল্য বিধবা আর বিয়ে করতে চায় না

সুখে দুখে শোকে আদুরি আধুনিক জীবন কাটায় এইভাবে এই মধ্য বয়সে পৌঁছে যায়

যখন তার পঁয়তাল্লিশ  বছর বয়স তখন তার শরীরে ধরা পড়ে, স্তন ক্যান্সার

পাঁচবাড়ী কাজ করে আদুরির কিছু টাকা পয়সা জমেছে সেই পয়সাগুলো খরচ করে সে তার জামাইকে নিয়ে চলে আসে কলকাতা চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার হাসপাতালে সেখানে জামাই মদ খেয়ে মাতলামি করে, টাকাপয়সা গুলো  কেড়ে নিয়ে চুরি  করে নিয়ে পালিয়ে যায় আর আদুরি পড়ে থাকে হাসপাতালের মেঝেতে

ডাক্তারবাবু নার্সরা তাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে তাকে হাসপাতালে একটা বেড করে দেয়  তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে কিছুদিনের মধ্যেই  ডাক্তারবাবু বলেন,তাহলে স্তন কেটে  বাদ দিলে তুমি সেরে উঠবেতুমি কি এই প্রস্তাবে রাজী আছো?

আদুরি বলে,আমি রাজী

  প্রায় পনের দিন পরে আদুরির স্তন অপারেশন করে বাদ দেওয়া হয়

প্রায় দুমাস হাসপাতালে থাকার পরে সে ছাড়া পায়

আদুরি পথে নামেকপর্দকশূন্য আদুরির এখন পথেই জীবন, মরণ নির্ভর করছে

 

 

ভাদু জেলে মাছ ধরে তার আগে তার দাদুও মাছ ধরে সংসার চালাতেন বাড়ির পাশেই কাঁদর অনেকে বলেন ঈশানী নদী ভাদু অত কিছু জানে না কাঁদরে চান, কাঁদরে টান তার একটা তালগাছের গোড়া ফাঁপা করে ডোঙা বানানো হয়েছে কাঁদর এপার ওপার করার জন্য ডোঙার তলাটা মাঝে মাঝে রঙ করা হয় ডোঙায় চেপে কাঁদরে জাল ফেলা শিখেছে তার দাদুর কাছে ভাদু তারপর মাছ ধরে বাঁশের কঞ্চির তৈরি ঝাঁপিতে 'রে মাছ বিক্রি   করত গ্রামে গ্রামে ছেলে ভোলাকে গাঁয়ের স্কুলে ভরতি করেছিল সাত বছর বয়সে এখন সে হাই স্কুলে পড়ে কিন্তু মাষ্টারমশাইরা বলেন ভাদুকে, তোর ছেলেকে বাড়িতে পড়তে বলিস খুব ফাঁকিবাজ এবার নম্বর খুব কম পেয়েছে

ভাদু রাতে ছেলের কাছে বসতে পারে না সন্ধ্যা হলেই সে চলে যায় হরিনামের আখরায় সেখানে হরিনাম হয় ভাদু হারমনিয়াম     বাজায় বড় সুন্দর তার হাত, সবাই বলে এদিকে ছেলে ভোলা বই গুটিয়ে অন্ধকারে বসে থাকে কাঁদরের ধারে পড়াশোনা তার ভাল লাগে না কাঁদরের ধারে অনিলের সঙ্গে বসে বাঁশি বাজায় অনিল বলে, তোর বাবা শুনলে মারবে ভোলা, সাবধানে থাকিস

 

ভোলা বলে, এই সবুজ আমাকে বড় টানে এই জল আমাকে শান্তি দেয় চান করার সময় এক ডুবে সে কাঁদর পেরিয়ে যায় অনিল ভোলার খুব ভাল বন্ধু সে সবসময় ভোলার সঙ্গে থাকে, থাকতে ভালবাসে

 

ভোলা মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফেল করল ভাদু বলল, আর স্কুলে যেয়ে লাভ নাই রে ভোলা রোজগারের ধান্দা কর

 

ভোলা তাই চাইছিল সে বলল,বাবা আমি জাল ফেলা শিখব তার বাবা ভাদু বলল,তা শেখ কিন্তু তুই তো ভালই জাল ফেলিস আমি চাইছিলাম রামের সঙ্গে তু কেরালা যা সোনার দোকানে কাজ শিখে লেগা তারপর এখানে এসে একটা দোকান খুলবি কত নাম হবে তখন তোর দেখবি ভোলা বলল,না বাবা আমি কেরালা যাব না বাবা ভাদু বলল,আমি সব ঠিক করে ফেলেছি তু আর অনিল কাল কেরালা চলে যা মেলা পয়সা হবে, নামডাক হবে তা না হলে জলে পচে মরবি

 

বাবার ভয়ে তারা কেরালায় চলে এল দোকানে কাজ করে, কাজ শেখে তাদের দোকান বাজার, কেনাকাটা সব কাজ করতে হয় ভোলাকে বাঁশি বাজাতে দেয় না তার মনে পড়ে কাঁদরের ধারে গেলেই মনটা ঘাসের গন্ধে ভুরভুর করে উঠত একটা ঠান্ডা বাতাস গায়ে কাঁটা তুলে দিত বাঁশির সুরে কাঁদরের জল নেচে উঠত ভোলার বাবা, মার কথা মনে পড়ত কিছু ভাল লাগত না তার বন্ধু অনিল কাজ করে অনেক দূরে আর একটা দোকানে সন্ধ্যা হলে দুজনের কথা হত অনিল বলত, ভাল করে থাক অনেক পয়সা নিয়ে বাড়ি যাব কত খাতির হবে, দেখবি, অনিলের বাবা, মা নেই সে ছোট থেকে মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছে তাই তার পিছুটান কম সে পরিস্থিতি বুঝে কাজ করে

 কিন্তু ভোলার কিচ্ছু ভাল লাগে না প্রায় দুমাস পরে সে জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হল মালিক বেগতিক বুঝে অনিলকে সঙ্গে করে ভোলাকে গাঁয়ে পাঠিয়ে দিলেন

 

বাড়িতে এসে ভোলা মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল অনিল মামার বাড়ি গেল একটা বড় ব্যাগ নিয়ে

ভোলা কিছুই আনতে পারে নি সে রোগে ভুগে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে মা তার বাবার ওপর রেগে গিয়ে বললেন, আবার যদি তুমি ওকে কেরালা পাঠাও তো আমার দিব্যি রইল বাবা ভাদু আর ভোলাকে কেরালা যেতে বলেনি শুধু বলেছিল, এখানে খাবে কি?  আমি তো আর বেশিদিন বাঁচব না তার মা বলেছিল, আমাদের একমুঠো জুটলে ওরও জুটবে

 

তারপর অনিল আবার কেরালা চলে গেল ভোলা দুমাস বিছানায় পড়ে রইল তারপর মায়ের সেবাযত্নে সে সুস্থ হয়ে উঠল

 

তারপর বছরের পর বছর কেটে গেল ভাদু জেলে মরে গেল তার হরিনামের দল তাকে উদ্ধারণপুর নিয়ে গেল ট্রাকটরে চাপিয়ে ভোলা সেই হরিনামের দলে ভাল বাঁশি বাজিয়েছিল সবাই বলল, সন্দেবেলায় পেত্যেকদিন হরিনামের আসরে যাবি বাঁশি বাজাবি

 

আজ অনিল এসেছে পাঁচবছর পরে গ্রামের মোহিনী ঠাকরুণ বলল, মামার একটু জায়গা নিয়ে গ্রামে সোনারূপোর দোকান কর আমরা তোর খদ্দের হব অনিল এইরকম    কিছু একটা করার কথা ভাবছিল মামাকে বলে একটা ঘর করল রাস্তার ধারে তারপর অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে দোকানের শুভ উদ্বোধন হল খুব ধূমধাম করে দোকান শুরু হল

 

এদিকে ভোলা কাঁদরে জাল ফেলে মাছ ধরছে ডোঙায় চেপে পাশ দিয়ে কাঠগোলার বড়বাবু যাচ্ছিলেন তিনি বললেন, জেলে ভাই মাছ পেলে?  ভোলা মাথাটা উঁচু করে বলল, পেয়েছি বাবু একটা কাতলা তা কেজি খানেক হবে বড়বাবু একটা দুশ টাকার নোট বার করে মাছটা নিলেন তারপর চলে গেলেন

 

ভোলা টাকাটা কোঁচরে গুঁজে বাঁশি বের করে বাজাতে শুরু করল সুরে সুরে আকাশ ভরে উঠল চিরকালের সুরে

 

 

সবিতা দেবীর বয়স নব্বই ছুঁই ছুঁই শরীরের নানারকমের অসুখ বাসা বেঁধেছে ডাক্তারবাবু বলেছেন কিডনি,হার্টের যা অবস্থা, বড়জোর আর কয়েকদিন বাঁচবেন ছেলে একটা প্লাসটিকের গামলা কিনে দিয়েছে বাথরুম শোবার ঘরের থেকে অনেক দূরে ওই গামলায় পেচ্ছাপ করা যাবে কিন্তু পায়খানা যেতেই হবে দূরে ফলে রাতে দরজার তালা খুলে উঠোন পেরিয়ে বাথরুম যেতে হয় তখন স্বামী বারবার বলেছিলেন,তোমার ঠাকুর ঘরের পাশেই বাথরুমটা হলে বুড়ো,বুড়ি আমাদের দুজনেরই সুবিধা হবে কিন্তু সবিতারাণী রাজী হন নি তিনি বলেছেন,ম্লেচ্ছ,নোংরা লোকের মতো কথা বলো না ঠাকুর ঘরের পাশে আবার বাথরুম হয় নাকি? স্বামী বলেছিলেন,তাহলে মানুষের শরীরটাতো বাথরুমের থেকেও নোংরা সবিতাদেবী তর্ক করেন নি আর শুধু বলেছিলেন, দূরেই করো সব মনে পরছে তার স্বামী বারো বছরের বড় ছিলেন আগেই চলে গেলেন মহাসিন্ধুর ওপাড়ে

তাঁর স্বামী বড়ো অভিনেতা ছিলেনসবিতাদেবীকে বলতেন,

তিরস্কারের থেকে জীবনে পুরস্কারই বেশি পেয়েছি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা এর থেকে বড় পুরস্কার আমার অভিধানে নেই আমার যোগ্যতার বেশি, তার পরিমাণ ঈশ্বর সময় হলেই প্রত্যেকের যোগ্য পাওনাটুকু দিতে ভোলেন না শুধু প্রয়োজন ধৈর্য আর সহনশীলতা সময় কিন্তু কারও কথায় এগিয়ে আসবে না বা পিছিয়ে যাবে না অভিজ্ঞ লোকেরা প্রথমে ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে থাকেন অন্য মানুষকে সহ্য করা, সম্মান করা ধর্মেরই নামান্তর মানুষের জন্যই মানুষ শুধু শুকনো লোক দেখানো ধর্ম যা মানুষকে ছোটো করে সেটা কখনই ধর্ম হতে পারে না ধর্ম হচ্ছে অণুবিক্ষণের মতো ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখে

সবিতাদেবীর মা ছিলেন গ্রামের লক্ষীদেবী তার দান,ধ্যানের জন্য সকলেই খুব ভালোবাসতো মনে পরে সবিতাদেবীর মায়ের কথা তিনি বলতেন,কথিত আছে কোজাগরি লক্ষীপুজোয় পুজো করার পরে যে গৃহস্থ রাত্রি জাগরণ করে রাত কাটাবে তার ঘরে লক্ষী স্বয়ং বিরাজ করেন কোনো অভাব, অনটন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না স্বার্থ নিয়েই মানুষ পুজো করে কারণ সে সংসারী  ছেলে, মেয়ে, বাবা,মা, ঠাকুমা, দাদু সকলকে নিয়ে এই সংসার তাদের মঙ্গল কামনা করেই মানুষের এই পুজো পার্বণ

মায়ের মূল লক্ষ্য থাকতো মানুষের সেবা করা

হয়তো তিনি আশ্রম করে যেতে পারেন নি কিন্তু প্রত্যেক পুজোতে গরীব মানুষকে পেট ভরে প্রসাদ খাওয়াতেন

বাজারে দরদাম করে ঠাকুর কেনার পরে পুজোর ফলমূল, দশকর্মার জিনিসপত্র কিনে বাড়িতে আলপনা এঁকে ঠাকুরের প্রতিষ্ঠা হয় তারপর পুরোহিতের পৌরোহিত্যে গৃহস্থের মঙ্গলসাধন  লৌকিক আচার, আচরণে বিশ্বাস জড়িয়ে থাকে আর বিশ্বাসে মিলায় বস্তু পুজোর প্রতিটি পর্যায়ে শিল্প ভাবনা বিরাজ করে তারফলে পুজো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে  দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে প্যান্ডেলে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কোনো কিছুর আদলে মন্দির বানানো হয় যেমন, তাজমহল, খাজুরাহো, কোনারক প্রভৃতি  নানারকম বাদ্যযন্ত্র পুজেকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে প্রত্যেক প্যান্ডেলে   যদি নর নারায়ণ সেবা হতো তাহলে আরও ভালো লাগতো সবিতাদেবী কথা বলার সঙ্গী পান না তাই বসে বসে নিরালায় পুরোনো দিনের কথা ভাবেন

কাটোয়ার কার্তিক লড়াই, চন্দননগরে জগদ্ধাত্রি পুজো, কাগ্রামের জগদ্ধাত্রি পুজো বাংলার পুজোর জগতে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে মা সব পুজোতেই মানুষকে খাইয়ে আনন্দ পেতেন সঙ্গে সবিতা থাকতেন মায়ের এই গুণ তার মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিলো

সবিতা দেবী এক লক্ষীপুজোর কথা মনে করছেন বসে বসে অখন্ড অবসর তার

 পুজো এলেই মায়ের লক্ষ্মীর ঝাঁপি উন্মুক্ত হয়ে যেতো কোজাগরীর রাতে মা কম করে তিনশো লোকের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন মাজা নীচু করে আসনে বসা মানুষদের প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভাই বোনেরা পরের দিনও খিচুড়ির ব্যবস্থা থাকতো ডোমপাড়ার সকলে এসে নিয়ে যেতো আনন্দে সর্দার বুড়ি  বেসকা দি, মঙ্গলীদি সবাই আসতো ছোটো পিসি, মানা, বড়পিসী, সন্ধ্যা,রুনু, শংকরী সকলে আসতো মায়ের ঘর পূর্ণ হয়ে উঠতো অতিথি সমাগমে গম্,গম্ করতো বাড়ি মানুষই যে লক্ষ্মী তা আবার প্রমাণ হয়ে যেতো চিরকালের সত্য সুরে

পুজোর বেশ কিছুদিন পরে মেয়েরা সকলে এক হয়ে মাংস, ভাতের ফিষ্টি করতো মনেআছে আমার, খেতে এসে বিশাখাদি বলেছিলো, আমি বিধবা মাংস খবো কি করে? আমার মাসতুতো দিদি বলেছিলো, বিধবা আবার কি কথা?  তোর স্বামী মরে গেছে দুঃখের কথা তার সঙ্গে মাংসের কি সম্পর্ক আচ্ছা কেউ মনে কর মাংস খেলো না আর মনে মনে স্বামীকে দোষ দিলো সমাজপতিরা, সমাজের সেনাপতিরা মনের নাগাল কি করে পাবে?  ওদের হাত ওই মাংস অবধি অতএব, নো চিন্তা, ডু ফুর্তি

১০

বিশাখাদি আনন্দে মাংস খেয়েছিলো  সমস্ত কিছুতেই চিরকাল কিছু মহিলার সংস্কারমুক্ত মনের জন্য পৃথিবী এত সুন্দর উন্মুক্ত সমাজ আমাদের সর্দার পাড়ার সেখানে সমাজের কোনো সেনাপতি বিধি আরোপ করে না যে যারইচ্ছেমতো খেটে খায় কেউ মুনিষ খাটে, কেউ মাছ ধরে, কেউ কেরালা সোনার দেকানে কাজ করে বুড়ো বয়সে তারা ছেলে মেয়েদের রোজগারে খায় ওদের কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয় না কার কৃপায় ওরা বুড়ো বুড়ি হয় না? শক্ত সমর্থ থাকতেই পরকালের ডাকে ওপাড়ে চলে যায় কাজই হলো আসল লক্ষ্মী

স্বামী বলতেন তার মায়ের কথা তিনি বলতেন,

আমার মা সাধনায় ছিলেন রামপ্রসাদ মা রক্ষাকালীর পুজো দিতে দিতে গেয়ে উঠতেন রামপ্রসাদি নিরামিষ মা কালীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ছেলেদের নিয়ে সংসার চালাতেন জীবনানন্দ ছন্দে অভাব থাকলেও কোনোদিন তার ছাপ পরেনি মায়ের চোখেমুখে আসল মূল্যবান রত্নের সন্ধান তিনি পেয়ে গেছিলেন পুজোর আসনে বসে কোনোদিন তার কথায় প্রকাশ পেতো  না  সেসব কথা তার চলনে, বলনে ফুটে উঠতো মাতৃরূপের জলছবি মাকে দেখেই মাথা নত হয়ে যেতো সকলের দাদু মাকে মা বলেই ডাকতেন তিনি সময়ে অসময়ে মাকে রামপ্রসাদী শোনাতে বলতেন মায়ের গান শুনতে শুনতে একদিন চলে গেলেন পরপারে তৃপ্ত মুখে একবার বৈশাখি ঝড়ে আম গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়লো মা বললেন,তোদের দাদুর আত্মা মুক্তি পেলো অই ডালে বাঁধা ছিলো দাদুর মুক্ত হবার লাল চেলি অবশ্য এটা ছিলো এক সাধুবাবার তুকতাক বুড়ি ঠাকুমা সেদিন কেঁদে উঠেছিলো জোরে ঠাকুমা বলে উঠলেন,চলে গেলো, চলে গেলো কোনো কিছুই আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না তবু কিছু ঘটনা বার বার তার অস্ত্বিত্বের কথা স্বীকার করে নেয় একটা দেশি কুকুর আমাদের বাড়িতে থাকতো ছোটে থেকে তোমরা বিশ্বাস করবে কি না জানি না? সে অমাবস্যা,পূর্ণিমায় কিছু খেতো না রক্ষাকালী পুজোয় উপবাস করতো তার সামনে খাবার দিয়ে দেখা গেছে সে খাবারের ধারের কাছে যেতো না শুধু কথা বলতে পারতো না কিন্তু ভাবে, ভঙ্গিমায় সব বেঝাতে পারতো মানুষের মতো মা বলতেন,পূর্বজন্মে তোর সঙ্গে কোনো আত্মীয়তা নিশ্চয় ছিলো তাই তোর আমাদের বাড়িতে আগমণ যেদিন জিম দেহ রেখেছিলো সেদিন ওকে মাটি চাপা দিয়ে ধূপ আর ফুলে শেষ বিদায় জানিয়েছিলো সারা পাড়ার বাসীন্দা তাহলে কি বলবে তুমি এই ঘটনাকে কোন যুক্তিতে অস্বীকার করবে তার সারা জীবন ধরে পালন করা ব্রত,উপবাস বলবে,কাকতালীয় সেসব তো এক আধবার হয় সারাজীবন ধরে নিয়মিত হয় না

বিজয়ার সময় আমার মা জিমকে প্রথম মিষ্টিমুখ করাতেন ধান রাখার গোলার তলায় একবার গোখরো সাপ দেখে, ঘেউ ঘেউ শব্দ করে আমাদের দেখিয়ে দিয়েছিলো সাপটা তারপর সাপুড়ে ডেকে  সাপটি বনে ছেড়ে দেওয়া হয় বড়দার বিছানার মাথার কাছে সে শুয়ে থাকতো কোনো বিপদ বুঝলে ঝাঁপিয়ে পরতো নিঃস্বার্থ ভাবে প্রত্যেক প্রাণীর কাছে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু

স্বামী চলে যাওয়ার পরে একদম একা হয়ে পরেছিলেন তিনি মনে পরতো তার আদর প্রথম ফুলশয্যার রাত কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয় একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে ঘুঘুর ঘু,ঘুঘুর ঘু সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব মনে হয় স্বামী ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলু সবিতাদেবীকে দেখে কিছু বলতে চায় তিনি বোঝেন আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন পুরোনো দিনের কথা বলেন ছেলের বৌ বল,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না হাসাহাসি করে শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে এবার আয়, এবার আয় বুড়ি বলে, ঘুঘুর ঘু,বলে না বলে,এবার আয়,এবার আয় নাতি এসে মাঝে মাঝে ঠাকুমার কাছে বসে আর ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলে,এবার আয়

নাতিকে গল্প বলে ঠাকুমা নিজের জীবনের কথা

বলেন,জানিস,ছোটোবেলায় আমার বন্ধুদল ছিলো বক্রেশ্বর নদী ছিলো গাছ ছিলো তারাও আমার বন্ধুর দলে ভিড়ে গেয়েচিলো নদীর ধারে বনকুলের গাছ ছিলো তারা সাজিয়ে রাখতে আমাদের জন্য মিষ্টি কুল আমরা আঁচলে করে, বা গামছায় বেঁধে মুড়ি নিয়ে যেতাম ছোলাভাজা,কুসুম ফুলের বীজ ভাজা চালভাজা নিয়ে যেতাম

নদীর ধারে বসে জলে পা ডুবিয়ে খেতাম নদীর জল হেঁট হয়ে বসে চুমুক দিয়ে পান করতাম পায়ে বিভিন্নরকমের রঙীন মাছ চুমু খেয়ে যেতো আমরা মুড়ি খাওয়ার পরে গামছা করে রঙীন মাছ ধরতাম আবার ছেড়েও দিতাম তারা সাঁতার কেটে খেলা দেখাতো

১১

একবার সন্ধ্যা হল,আমরা আমড়া গাছে ভূত দেখেছিলাম ভূতের কথা শুনে নাতি বললো,কি ভূত গো ঠাকুমা ভালো না খারাপ

তখন ভূত গুলোও ভালো ছিলো আমাদের শুধু বলেছিলো, তিনি সন্ধে বেলা বাড়িতে পড়তে বসবি এখন আমরা আসর জমাবো তোরা বিকেলে খেলবি জানিস না,তিনি সন্ধে বেলা, ভূতে মারে ঢেলা ভূতের গল্প শুনে নাতি ঠাকুমার কোল ঘেঁষে বসতো ঠাকুমা বলতেন,ভয় কি আমি তো আছি ঠাকুমা সবিতা দেবী ঠাকুরকে বলেন,আর একবার সময়ের চাকাটা উল্টোদিকে ঘোরানো যায় না তাহলে আবার ছোটো বয়সটা পাওয়া যাবে নদীর জল খাওয়া যাবে স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠে, মাঠে ঘোরা যাবে ঘু ঘু পাখিটা বিজ্ঞের সুরে বলে,না না না, ঘুঘু, ঘুঘু

আজ সকাল থেকে সবিতাদেবী উঠোনের রোদে বসল আছেন ছেলে অফিস যাওয়ার আগে আজকে প্রণাম করলো কোনোদিন করে না তো তিনি আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে প্রাণভরে ছেলে বললো,সাবধানে থেকো আজ ওরা পিকনিক করতে যাবে পুকুরের ধারে ছেলে চলে গেলো

এখন শীতকাল পিকনিকের সময় যাবে বৈকি নিশ্চয় যাবে তারও যেতেন যুগে যুগে পরম্পরা এইভাবেই তো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে ভাবেন সবিতাদেবী বৌমা নাতিকে দিয়ে একবাটি মুড়ি,তরকারী নামিয়ে দিয়ে গেলো ঠাকুমা খিদে পেলে খাবে ঠাকুমা বললেন,বেশ বাবা তোমরা যাও আমি ঠিক খেয়ে নেবো মনে পরে গেলো একবার ফাঁকা বাড়ি পেয়ে রান্না করে খেয়েছিলেন পুড়ে গেছিলো তরকারীটা সেই প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা তারপর দুপুরবেলা তালবোনা পুকুরে সাঁতার কেটে তাল কুড়িয়ে এনেছিলেন সব মনে আছে আরও মনে পরছে পাড়ার ধীরেন ফাঁকা বাড়ি পেয়ে তার কাছে এসলছিলো খুব ভালে ছেলে অনেক গল্প হয়েছিলো একটা চুমু খেয়েছিলো আর কিছু নয় বলেছিলো, সারা জীবন এই স্মৃতি মনে থাকবে তার ধীরেন এক বছর পরে ক্যান্সারে মারা গেছিলো কিন্তু কিশোরী সবিতার কাছে সে অমর হয়ে আছে

স্বামীকে সব কতা খুলে বলেছিলো বড় সরল তার মন বলার ফলে অশান্তি হয়েছিলো অনেক

একজন মৃত মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠেছিলো সংসারের টানা পোড়েনে তারপর বয়স বাড়লে তার স্বামী বুঝেছিলেন পাগলামীর কথা তখন তার গোপন বাল্যপ্রেমের কথা  তিনি বলেছিলেন সবিতা দেবীকে,যখন তখন নয়নার ছবি ভেসে উঠতো নয়ন জুড়ে তবু সেকথা বলা হয়নি আজীবন দূর থেকে শুধু দেখা আর দেখা  সে দেখা মৃত্যুর আগে অবধি ছিলো অন্তরজুড়ে

সবিতা দেবী এক মেয়ে এক ছেলে নিয়ে যৌবনে বিকেলে যখন বেড়াতে যেতেন তখন সবাই তাকিয়ে দেখতো ছেলে বড়ো মেয়ে ছোটো মেয়েকে অনেকে ভালোবেসে চকলেট দিতেন মেয়ে আর একটা হাত পেতে বলতো,আর একটা দাও দাদা খাবে ছোটো থেকে আমরা সবাই ভাগ করে খাবো, এই আদর্শে মানুষ তার ছেলে মেয়ে ভারতীয় দর্শন তো সেই কথাই বলে স্বামী অসীম চাকরী করতেন বেসরকারি একটা কারখানায় ম্যানেজার ছিলেন তিনি ছোটো থেকে নিজে অনেক কষ্ট করেছিলেন মুদিখানা দোকান ছিলো তার বাবার বৃদ্ধবাবা, বাজার যেতে পারতেন না তখন রাস্তায় ছিলো মাটির ধুলো বৃষ্টি পরলে কাদায় পিছল হয়ে যেতো পথ তবু মাথায় করে বয়ে আনতেন নুনের বস্তা, যার ওজন ছিলো ষাট কেজির মতো অমানুষিক পরিশ্রম করে বড় হয়েছিলেন তিনি পেট ভরে দুবেলা খাবার জুটতো না সবিতাদেবীর খুব খারাপ লাগতো তাই তিনি তার দাদা, দুকড়ি কে সব কথা খুলে বলেন দুকড়ি দাদা কলকাতায় কাজ করতেন অনেক মাড়োয়ারি, কারখানার মালিকের সঙ্গে তার জানাশোনা ছিলো তিনি অসীমকে একটা কারখানার ম্যানেজার পদের চাকরী জোগাড় করে দিলেন অসীম নিজের দুঃখের কথা ছেলেমেয়েদের কোনোদিন বলেন নি তিনি ছেলে ওমেয়েকে জমিদারের সন্তানের মতো মানুষ করেছিলেন ঝুলনের দিনে পুতুলে ভর্তি হয়ে যেতো ঘর ছেলেমেয়েরা ঝুলন সাজাতো আর অসীমবাবুর খুব ভালো লাগতো ছোটোবেলার নিজের না পাওয়ার দুঃখ তিনি ভুলে যেতেন দোলের সময় ছেলে মেয়েকে কিনে দিতেন নতুন জামা সেই জামা পরে তারা দোল খেলতো মিষ্টি,মাংস, ফল কিছু বাকি থাকতো না কত লোক আসতো তার বাড়িতে রং মাখাতে তারপর মিষ্টিমুখ করে ফিরে যেতো রাম রাম বলে আমরা শ্রদ্ধেয় লোককে দেখে যেমন নমস্কার করি যারা হিন্দীভাষী তারা শ্রদ্ধেয় গণ্যমান্য লোককে দেখলে বলে,রাম রাম রায় বাবু লিলুয়া শহরে পটুয়াপাড়ায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন অসীমবাবু তারপর একদিন তার গ্রামের ভাই মরে গেলো কম বয়সে জীবন ওলট পালট হয়ে গেলো চাকরী ছেড়ে আবার চলে গেলেন গ্রামে জমানো পয়সা,সোনাদানা সব খরচ হয়ে গেলো ধার, দেনা করে কোনোরকমে একটা দোকান করলেন মুদিখানা আবার শুরু হলে জীবন সংগ্রাম মেয়ের বিয়ে হলো কোনোরকমে ছেলের তখনও চাকরী হয় নি শরীরের ওপর চাপ খুব বেশি হয়ে পরলো তার ফলে অল্প বয়সে মারা গেলেন তিনি এবার দোকান চালায় ছেলে দোকান বেশিদিন চালাতে হলো না ছেলে চাকরী পেলো সেদিন খুব আনন্দ হয়েছিলো সবিতাদেবীর

১২

মনে পরে তার, একবার সুতিকা হয়েছিলো তার পেট ফেঁপে যেতো বারবার পায়খানা যেতে হতো তখন মাঠে,ঘাটে সারতো সবাই শ্বশুরমশাই খাল কেটে দিয়েছিলেন তারপর শুয়োগাছি গিয়ে সাধুবাবার কাছে শেকড়,বাকড় খেয়ে বাবা ভূতনাথের দয়ায় অসুখ ভালো হয়েছিলো শুয়োগাছি থেকে আসার সময় মেয়েটাকে সারা রাস্তা কাঁধে করে এনেছিলো ছেলে বাড়িতে এসে দেখলেন,শ্বাশুড়ি মরে গেছেন শ্বাশুড়ির ছোটো মেয়েটা ভুগছিলো খুব কাঠির মতো শরীর হয়ে গেছিলো শ্বশুর বললেন সবাইকে,ওর মরদেহের সঙ্গে মেয়েটাকেও বেঁধে দাও তো আর কদিন পরেই মরবে কিন্তু সেই মেয়ে বড়ো হয়ে গ্রামের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হয়েছিলো রাখে হরি মারে কে? সবিতাদেবী ভাবেন ঈশ্বরের করুণার কথা যাইহোক,চাকরী পাওয়ার পরে ছেলের বিয়ে দিলেন সবিতাদেবী এখন ছেলে,ছেলের বৌ আর নাতি এই নিয়ে তার সংসার কোনো কিছুর  অভাব নেই তবু সবিতাদেবীর মনে হয়,আগের দিনগুলোই ভালো ছিলো অভাব থাকলেও শান্তি ছিলো হৃদয় জোড়া যাইহোক এখন বয়স হয়েছে ভালোমন্দ সব সমান মনে হয়

বাথরুম যেতে গিয়ে কলতলায় পা পিছলে পরে গেলেন সবিতাদেবী বুকটায় খুব ব্যাথা করছে ঘুঘু পাখিটা নিচে নেমে এসেছে গলা কাঁপিয়ে কি দেখছে পাখিটা তিনি ভাবছেন,আমাকেই দেখছে একি হলো আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন? চিৎকার করার ইচ্ছে হলেও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোলো না তার বাবা,মা,স্বামীকে এবার দেখতে পাচ্ছেন আর দেখছেন,তিনি ঘুঘু পাখি হয়ে গেছেন একটা শীর্ণ শরীর পরে আছে কলতলা জুড়ে তার শরীর বেশ হাল্কা লাগছে ঘুঘু পাখিটার সঙ্গে উড়ে চলে গেলেন খোলা আকাশের নীচে

সন্ধেবেলা ছেলে,বৌমা,নাতি এসে দেখে,মা পরে আছে কলতলায় শরীর কাঠ হয়ে গেছে সবাই ধরাধরি করে নিয়ে এলো বারান্দায় দড়ির খাটে আর চাদর,বিছানা নষ্ট করে লাভ নেই বৌমা ভাবছে নাতি বললো,একটা চাদর ঢাকা দাও ঠাকুমাকে ঠান্ডা লাগবে ছেলে একটা সাদা শাড়ী এনে ঢাকা দিলো তারপর পাড়ার লোকজন এসে নিয়ে গেলো শ্মশানে সব মিটে গেলো পনেরো দিনের মধ্যেই

এখন ছেলে একা তার ছেলেও বড়ো হচ্ছে সমানে অনন্তকাল ধরে চলেছে এই প্রবাহ ছেলে ভাবছে,মা নেই,বাবা নেইমন খারাপ এবার তার মনের খবর কে নেবে?মায়ের কাছে সময় দিতে পারেনি শুধু কাজ, কাজ আর কাজ আর এই কাজ শেষ হলে সেও একা হয়ে পরবে আজ কবি বন্ধু বাড়িতে এসেছে বেশ ভালো লাগছে বন্ধু বলছে,জন্ম, মৃত্যু তো থাকবেই সত্যকে মেনে নিতে হয় তাহলেই আনন্দ সে বলছে,তবু সব কিছুর  মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি  সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই  তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর  আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে  সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে, আমার দেশই আদর্শ

সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক

আমি বললাম, এক নাগাড়ে বকে গেলি অনেকক্ষণ  বন্ধু বললো,  তুমি আরও কিছু বলো সেই জন্যই তোমার কাছে আসা  আমি আবার বলতে শুরু করলাম,আমার কথা আমার গোপন কথা আমার অনুভবের কথা  কবি বন্ধু আমার কথা শুনতে ভালোবাসে  সে সংসারী  তবু সব কিছু সামলে তার কবিতা  তো লিখে চলে

আমি বন্ধুকে বলতে শুরু করলাম শরত জীবনের কথা এবার আমার জীবনের পরবর্তী অঙ্ক শুরু

তারপর শুরু হলো আমার জীবনের রোজ নামচা আমি ট্রেনে এখন রবির সঙ্গেই যাওয়া আসা করি রবির সঙ্গে আমার খুব ভাব অন্তরঙ্গ বন্ধু আমার তাছাড়া ধীরে ধীরে আরও বন্ধু হলো রবি বললো,শোন আমার একটা কবি সম্মেলনের আলোচনার কথা এই ট্রেন জার্নির অভিজ্ঞ তার কথা

রবি বলছে, যে সব মানুষ অন্ধ, খোঁড়া কিংবা বার্ধক্যের কারণে মানুষের সাহায্য চেয়ে বাঁচতে চান তারা ভিখারি নন

একটা সাহিত্য সম্মেলনে রবি বক্তব্য রাখছিলো বিষয় হলো, ভিখারি- আপনার চোখে স্টেজে উঠে গল্পটা বলছিলো

রবি আবার  শুরু করলো তার বক্তব্য, দাঁড়িয়ে সামনে অনেক কবি, সাহিত্যিক, আরও অনেক গণ্যমান্য মানুষ বসে আছেন, তাদের আমি সকলকে শ্রদ্ধা জানাই আমি বলছি অভাবের কারণে, রোগের কারণে যারা ভিক্ষা করেন তারা ভিখারি নয় কারণ বাঁচার অধিকার জ্ঞাপন করার জন্য তারা

মানুষের দ্বারস্থ হন বাঁচতে চাওয়া, একমুঠো খেতে চাওয়া তো অন্যায় নয় মানুষকে ঠকিয়ে যারা টাকার পাহাড় গড়ে তোলে সত্যিকারের

ভিখারি তারাই

সে বলে চলেছে, আমি ভিখারি দেখেছি অনেক সেই গল্প আমি আপনাদের শোনাবো

সবাই একবাক্যে বলে উঠলেন, বলুন, আমরা শুনতে চাই

রবি বলছে, যাদের প্রচুর আছে অথচ সামান্য পেনশেন ভোগীর কাছে ঘুষ নেয়, বিধবা মহিলাকে মৃত স্বামীর জমানো হক্কের টাকা পাইয়ে দেবার আগে তাকে শোষন করে ছারপোকার মতো তারাই প্রকৃত ভিখারি এবার আমি আমার লেখা গল্প পাঠ করছি

আমার বন্ধু আমার সঙ্গেই আসা যাওয়া করতেন তিনি থাকলে আমার একাকিত্ব দূর হতো দুজনে গল্প করতে করতে সময় কখন যে পার হয়ে যেতো বুঝতেই পারতাম নাআর এক বন্ধুর নাম সুকুমার সুকুমার বললেন, দেখুন ট্রেন চলাকালীন বাইরের দৃশ্য মনোরম দুর্গাপূজা হয়ে গেছে কাশফুলগুলো মন খারাপ করে মাথা দোলানো বন্ধ করেছে বৃষ্টি হয়ে গেলো একটা ভ্যাপসা গরম মন আরও বিষন্ন করে তুলেছে

আমি বললাম,আপনি তো বেশ কবির মতো কথা বলছেন ঠিক বলেছেনট্রেনের ভিতরটা একবার দেখুন কেউ বাদাম খেতে ব্যস্ত কমবয়সীএকটা ছেলে একদৃষ্টে কলেজ ছুটির পরে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে আছে তার তাকানো দেখে পাশের মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে দাঁড়ালো  একটা সমগ্র দোকান বয়ে বেড়াচ্ছে বুকে হরেক মাল সাঁটানো ফেরিওয়ালা ফ্রি তে হজমি গুলি খেতে ব্যস্ত যাত্রী পাঁচজন কিন্তু কেনার লোকের অভাব একজন  যাত্রী ভাবুক মনে সব কেনা কাটা দেখছেএক মনে কেউ হিন্দীভাষী, কেউ ওড়িয়াভাষী, কেউ সাঁওতাল সকলের সমান অধিকার ট্রেনের একটা কামরা যেনো দেশ আত্মীয় পরিজন নিয়ে উঠে খাওয়া দাওয়ায় ব্যস্ত সোমড়াবাজারের মোহন ভোগ

মানুষের রসনা মোহিত করে রেখেছে

১৩

বন্ধু আর আমি কথা বলতেই ব্যস্ত বড়ো ভালো লাগে ট্রেনের এগিয়ে যাওয়ার গতি তারপর স্বস্থানে ফিরতে হবে সবাইকে

আমার চোখে ট্রেনরর কামরাটা গোটা পৃথিবী হয়ে উঠেছে লন্ডন থেকে আসা লাল রঙের লোকটা নবদ্বীপে নেমে গেলো হরে রাম, হরে রাম ধ্বনি দিতে দিতে তারপরই বিষ্ঞুপ্রিয়া হল্ট আর সেখান থেকেই আধঝুড়ি আপেল নিয়ে এক বিক্রেতা উঠলেন

তিনি হেঁকে চলেছেন, আপেল, কাশ্মীরী আপেল এক কেজি সত্তর,পাঁচশো চল্লিশ টাকা দেবো নাকি? ডিলিশাস, খেয়ে দেখুন

এদিকে  শসাওয়ালা বলছেন, দেবো নাকি ছাল ছাড়িয়ে,নুন মাখিয়ে...

আপেল দেখলাম খুব ভালো দুজনেই নিলাম  আর ফুল ফ্যামিলি নিয়ে যে ধনী লোকটি এতক্ষণ সব কিছু দরদাম করে কানের পোকা মারছেন,তিনি এবার ডাকলেন,এই  আপেল, এদিকে আয়

----যাই বাবু, আপেল...

--- কই রে, কত করে

-দিলাম সত্তর করে

---- না না ষাট টাকার বেশি দেবো না

তারপর অনেক কথা ক্ষয় করে বাবুটি পাঁচশো আপেল নিলেন তারপর আমরা দুজনেই দেখলাম পঞ্চাশ টাকা তার হাতে দিলেন

স্টেশনে এবার নামতে হবে তাড়াতাড়ির মাথায় আপেলওয়ালা একশো টাকা মনে করে পঁয়ষট্টি টাকা ফেরত দিলেন বাবুটিকেবাবু অম্লান বদনে  নিয়ে নিলেন টাকা আমরা দুজনেই প্রতিবাদ করলাম আমি বললাম, আপনি তো পঞ্চাশ টাকা দিলেন তাহলে কোন আক্কেলে আবার এতগুলো টাকা নিলেন

বাবু বললেন, আমি একশো টাকা দিয়েছিমুখ সামলে কথা বলবেন

আপেলওয়ালা বললেন, আমার ভুল হয়েছে দেখুন আপনি ভালো করে আপনি পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন

বাবুটি সমানে তর্ক করে চলেছেন

আপেলওয়ালা বললেন, বেশ আপনাকে আমি

ভিক্ষা দিলাম  এই বলে তিনি নেমে গেলেন

তারপর দেখলাম বাবু বিজয় গর্বে বলছেন, এই সুযোগ কেউ ছাড়ে মশাই একদম ফ্রিতে আপেল  তারপর আপেলে কামড় দিয়ে বললেন, আপনাদের দেখে নেবোপরের স্টেশনে আমি নামবো তারপর দেখছি

আমার বন্ধুটি বললেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিখারি আপনি আপনার ক্ষমতা কই?আপনি তো নিঃস্ব রিক্ত আপনাকে দেখে আমাদের দয়া হচ্ছে

বাবুটি ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলেন ওনার স্ত্রী চোখের ঈশারায় চুপ করতে বললেন স্বামীকে পরের স্টেশনে ওনারা নেমে গেলেন

বন্ধু বললেন, ভিখারি এরেই বলে...

আমার গল্প এখানেই শেষ এই বলে রবি সকলকে নমস্কার জানিয়ে বসে পরলো

 করতালি দিতে ভুলে গেলো অনেকেই...

ট্রেন থেকে নেমে আমরা চলে গেলাম বাড়ি

ছোটোবেলার মজার কথা বলতে, ভাবতে খুব ভালো লাগেসারা রাত পুজো দেখতে গিয়ে বন্ধুদের দলের একজনের খুব টয়লেট যাবার প্রয়োজন হলো বন্ধু পড়লে লজ্জা পাবে নামটা নকল বলি হেগো, হাগুর জন্য ছটফট করছে সামনে কোনো ব্যবস্থা নেই হেগো কাপড়ে চোপড়ে হবার আগে প্যান্টের বোতাম খুলে ফেলেছে একটা ড্রেনে বসতে যাবে এমন সময়ে বাড়ির মালিক বলছেন, একি আমার বাড়ির সামনে,খোলা স্থানে,আরে ছি, ছি,...

হেগো বলছে, মেসোমশাই একটুখানি, এক সেকেন্ড...

----- আরে, আরে,বেয়ারা..

মেসো ততক্ষণে নাক চেপে ধরেছেন

হেগো তখন মরিয়া কাজ সাবাড় মার ছুট মেসো আমাদের বললেন, তোমরা চেনো

আমরা বললাম, না না ব্যাটাকে ধরতে পারলেন না

------ কি করে ধরবো জল নেই তবু, শালার ঘেন্না নেই

বন্ধু বিপদমুক্ত হলে আমাদের আনন্দ হয়েছিলো

আবার সাঁতার শিখতে গিয়ে,ছোটোবেলার রায়পুকুরের রাধা চূড়ার ডালটা আজও আমায়  আহ্বান করে হাত বাড়িয়ে এই ডাল ধরেই এলোপাথারি হাত পা ছুড়তে ছুড়তে সাঁতার শিখেছি আদরের পরশে ডুবন্ত জলে যখন জল খেয়ে ফেলতাম আনাড়ি চুমুকে, দম শেষ হয়ে আসতো তখন এই ডাল তার শক্তি দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরতো অক্লেশে হয়তো পূর্ব জন্মে আমার দিদি হয়ে যত্ন আদর করতো এই ডালটা কোনোদিন তাকে গাছ মনে করিনি আমি এখনও জল ছুঁয়ে আদরের ডাক শুনতে পাই পুকুরের ধারে গেলে রাধা নামের মায়াচাদর জড়ানো তার সবুজ অঙ্গে ভালো থেকো বাল্য অনুভব চিরন্তন প্রকৃতির শিক্ষা অঙ্গনে নাম লিখে যাক নব নবীন  শিক্ষার্থী প্রবাহ আমি এইসব ভাবছি এমন সময় পিছন দিক থেকে একটা বড় পাঁঠা আমাকে গুঁতিয়ে জলে ফেলে দিলো খুব রাগ হলো কিন্তু পাঁঠার সঙ্গে লড়াই করতে লজ্জা হলো যদি কেউ দেখে ফেলে তারপর গাজনের রাতে স্বাধীন আমরা সারা রাত বোলান গান শুনতাম সারা রাত নাচতাম বাজনার তালে তালে সবাই মনে করতো, ব্যাটারা গাঁজার ভক্ত নাকি গাজনে একজন হনুমান সেজেছিলো আমরা তার লেজে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম পরে দেখলাম লোকটা রাগ করে নি বলছে,লঙ্কা পুড়িয়ে ছারখার করে দেবো

আর হনুমান লাফিয়ে শেষে জলে ঝাঁপ দিলো

চারদিকে প্রচুর লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে

বন্ধু রবি বলছ,ঠিক বলেছিস তোর কথা শুনলাম রবি আর আমি বসে গল্প করছি

এবার শোন আমার দাদুর কথা আমার হৃদয়ের কথা তোকে শোনাতে পারলে ভালো লাগবে

রাগ,হিংসা,ক্রোধের সংমিশ্রণে সংসার স্রোতে ভাসতে ভাসতে জীবন প্রবাহ এগিয়ে চলে হয়তো এর ফলেই দাদুর শেষজীবনে সেবার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা আমি নিয়ম করে দাদুকে গীতাপাঠ করে শোনাতাম দাদু কত গল্প বলতেন কোনোদিন হা পিত্যেশ করতে দেখিনি আমার সময় কাটতো দাদুর কাছেই বেশি পড়াশোনার ফাঁকে চলতো গীতাপাঠ আমি জিজ্ঞেস করতাম,দাদু মরণের পরে আমরা কোথায় যাই? দাদু বলতেন,জানি না ভাই তবে।।মরণের পরে যদি যোগাযোগ করা যায়,তাহলে আমি তোকে নিশ্চয় জানাবো দাদু বলতেন, আমি যখন শেষ বিছানায় শোবো,তখন আমি ঈশারা করবো হাত নেড়ে তখন তুই গীতার কর্মযোগ অধ্যায় পড়ে শোনাবি তোর মঙ্গল হবে আমিও শান্তিতে যেতে পারবো হয়েছিলো তাই কর্মযোগ পাঠ করা শেষ হতেই দাদুর হাত মাটিতে ধপাস করে পরে গেলো দাদু ওপাড়ে চলে গেলেন হেলতে দুলতে চারজনের কাঁধে চেপে মাথাটা দুই বাঁশের ফাঁক গলে বেরিয়ে ঝুলছিলো আমি বলে উঠলাম, ওগো দাঁড়াও দাদুর লাগবে মাথাটা ঠিক কর  বালিশে দি কেঁধো বললেন,মরে গেয়েচে ছেড়ে দে আমি বললাম, না ঠিক করো তারপর ঠিক করলো দাদাভাই,দাদুর মাথাটা বালিশে দিয়ে 

১৪

অনেক বছর অপেক্ষা করেছি,দাদুর কথা শুনবো ওপাড় থেকে যোগাযোগের উপায় থাকলে নিশ্চয় করতেন কিন্তু কোনোদিন স্বপ্ন পর্যন্ত দেখিনি কথা শোনা তো দূর অস্ত  ট্রেন কাটোয়া ঢুকে পরেছে যে যার নিজের রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলো আমি বাড়ি এসেই খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে পরলাম ফাঁকা মাঠে হাওয়া খেতে বন্ধুরা সবাই বেড়াতে আসে মাঠে গল্প গুজব করতে করতেই সবাই বাড়ি ফিরলাম তারপর কিছু ছেলেমেয়ে পড়তে আসে তারা চলে গেলে সপরিবারে রাতের আহার সারি

সকাল হলেই বন্ধু আশীষের খোঁজ নিতে গেলাম ফিরে এসেছে ভেলোর থেকে

খবর ভালো নয়

আশীষ নামের সীমাহীন আনন্দমাখা ছেলেটা ভেলোরে গিয়ে জানতে পারলো,তার হার্ট বড়জোর আর দুবছর চলবে এত কথা জেনেও কোনোদিন মুষড়ে পরেনি তার মন ফুটবল খেলতে ভালোবাসতো ছেলেটা সারা  বিকেল ছুটে ছুটে সে আনন্দ মাখতো সারা গায়ে আলো নামের আলো মনের মেয়েটা জেনেশুনে তার সমস্তকিছু দিয়েছিলো দুদিনের আনন্দের দেবদূতকে পৃথিবীর রঙ,রূপ, রস সে একশো বছরের পরমায়ুর মতো পেয়ে গিয়েছিলো মনের প্রসারতায় কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে এলেই কথা ঘুরিয়ে তার চোখে এঁকে দিতো স্বপ্ন

তার সঙ্গে ঘুরতে গেছিলাম মুর্শিদাবাদের রামপাড়া গঙ্গার ধারে গ্রামটি ছোটো হলেও আমরা বন্ধুরা প্রত্যেকটি বাড়ি বাড়ি ঘুরেছি কারো বাড়ি স্নান করা, কারও বাড়িতে খাওয়া দাওয়াকারওবাড়িতে গান বাজনা করেই দিন চলে যেতো দুর্গাপুজোর বিসর্জনের দিনে নৌকা করে ঠাকুর বিসর্জন দেখলাম গঙ্গার ধারের সব গ্রামের ঠাকুর নৌকো করে মাঝ গঙ্গায়এনে বিসর্জন করা হচ্ছে ঢাক,ঢোল বাজিয়ে দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমেএলো সন্ধ্যা নেমে এলো আশীষের জীবনে রাত হওয়ার আগেই পাড়ি দিলো ভবসাগরের ওপাড়ে তার সংসারে বাবা,মা, তিন বোন আশীষের বাবাকে আমি  জামাইবাবু বলতাম তিনি কেলকাতা লালবাজারের কমিশনারের দপ্তরে কাজ করতেন তার দাপ ছিলো ভীষণ তার নামে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো তিনি ছেলের শোকে মারা গেলেন দিদি কয়েক মাসের মধ্যেই চলে গেলেন বড্ড প্রাণপ্রিয় ছিলো তার আশীষ মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে রামপাড়ার বাড়িতে আর কেউ নেই কতকগুলো ঘুঘু মনখারাপের ডাক ডেকে চলে নিশিদিন ওই নিরীহ পাখি মানুষকে সত্য, সুন্দরের বাণী শোনায় আজীবন বড্ড প্রিয় আমার এই ঘুঘু পাখি ভিটেতে ঘুঘু চড়ে না,সে মনে রাখে এই ভিটের মালিক একদিন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো,আজও দিয়েছে তাই কৃতজ্ঞ সুরে তার শোকপ্রকাশ মালিকের অবর্তমানে আমার তাই মনে হয় সত্য ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়ার নাম ধর্ম জীবন একটা ছোটো নাটক জলে একমুঠো দেহছাই  ছড়িয়ে গেলেই সব শেষ রবি বলে চলেছে তার আবেগ,তার ভাবনার কথা

কি করে একটা সাজানো বাগান তছনছ হয়ে যায় বন্ধু রবি বললো,তবু কিছু মানুষের এত অহংকার তারা মনে করে মৃত্যু বোধহয় তাদের ভুলে গেছে সে ভোলে না হঠাৎ চলে আসে সময় থাকতে বাড়ির কাছের মানুষের সেবা করাই ভালো পৃথিবী সুন্দর হয়ে উঠবে,পরস্পরের সেবা, ভালোবাসার মাধ্যমে অন্তর্জলির আগে একবার মানুষকে ভালোবেসে তাদের সুখে দুখে আমাদের হৃদয়কে ভরিয়ে তুলি ভালোবাসায় আয় আমরা মানুষ হবার শপথ নিই...

 

১৫

 

ছোটো থেকেই আমার পিসির বাড়ি শ্রীরামপুর, রাউন্দি গেলেই একবার অট্টহাস ঘুরে আসতামআজ থেকে তিরিশ বছর আগে সেখানে পঞ্চমুন্ডির আসন মাটির বেদি ছিল আর ছিল মনোহরা সবুজ প্রকৃতিসনৎ বাবা,অরুণবাবা,সোনামহারাজ পেরিয়ে আজকের মহারাজ বললেন,এখন সতীপীঠের উন্নতি হয়েছে খুবঘুরে দেখলাম বৃহৎ শিবের মূর্তি,মনি্দির,অতিথি নিবাস নানারকম পরিযায়ী পাখিসাধুবাবা বললেন,সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যা করেন এর পর মহাদেব বীরভদ্রকে পাঠান দক্ষকে বধ করতেসতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে শক্তিপীঠ স্থাপিত হয়েছে এগুলোকে সতীপীঠ বলে এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে এখানে দেবীর অধঃ ওষ্ঠ, অধর / নিচের ঠোঁট,পতিত হয়এরজন্য এই সতীপীঠের নাম অট্টহাস সতীপীঠ

 

অট্টহাস শক্তিপীঠ পশ্চিমবঙ্গ এর বর্ধমান জেলার নিরোল গ্রাম পঞ্চায়েতের দক্ষিণ ডিহি গ্রামে অবস্থিতএর উত্তরে ঈশাণী নদী কিছুটা দূরে শ্মশান এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পীঠমন্দিরের কাছেই কিছু পিকনিক স্পট জঙ্গলঘেরা নিরিবিলি পরিবেশ এখানেএখানে গাছে গাছে বিভিন্ন রঙের প্রজাপতি, ফড়িং, পাখি দেখা যায় এখানে রাতের বেলা প্যাঁযচার ডাক প্রহরে প্রহরে শেয়ালের ডাক শোনা যায় যা এখানকার পরিবেশে আলাদা এক মাত্রা যোগ করে

 

 

এরপর অনেক বছর কেটে যায়এই স্থান জঙ্গল হয়ে ওঠেতখন স্থানের নাম ছিল খুলারামপুর বা তুলারামপুরপরবর্তীতে এই গ্রামের নাম দক্ষিণ ডিহি হয়এই গ্রামে কিছু কৃষক বাস করততারা মাঠে চাষবাদ করত ঈশানি নদীর ধারে অবস্থিত স্থান ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা দিনের বেলাতেও ওখানে কেউ যেত না একদিন কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে এক সাধুবাবাকে জঙ্গলে ধ্যাখনমগ্ন দেখতে পায়তাড়া কৌতূহলী হয়ে দলবদ্ধভাবে তার কাছে যায় তাকে প্রণাম করেনসাধুবাবা এখানে যজ্ঞ করেনযজ্ঞ শেষে তিনি যজ্ঞস্থানে একটি ত্রিশূল পুঁতে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যানচলে যাবার আগে বলেন, এটি একটি সতীপীঠ

 

 

এখানে দেবী ফুল্লরা ভৈরব বিশ্বেশ্বরক এখানে দেবীর দন্তুরা চামুণ্ডা মূর্তি এখানে দেবীকে অধরেশ্বরী নামে পূজা করা হয়এখানে আছে এক প্রাচীন শিলামূর্তিমন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে

 

কালমাধব মন্দিরটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের অন্তর্গত অমরকণ্টকে অবস্থিত সতীপীঠ কালমাধব একান্ন সতীপীঠের একটি অন্যতম পীঠ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর বাম নিতম্ব পড়েছিল এখানে অধিষ্ঠিত দেবী হলেন ভদ্রকালী এবং ভৈরব হলেন অসিতানন্দ মতান্তরে বলা হয়, কালমাধব সতীপীঠের দেবী কালমাধব এবং ভৈরব এখানে অসিতাঙ্গ নামে পূজিত হন একান্ন পীঠের মধ্যে কালমাধব সতীপীঠ অন্যান্য পীঠস্থানের তুলনায় অনেক কম পরিচিত অনেকের মনে এই কালমাধব মন্দিরের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক আছে নবরাত্রির পূজা উপলক্ষে প্রতি বছর এখানে বহু ভক্তের সমাগম ঘটে বিন্ধ্য এবং সাতপুরা পর্বতের মধ্যে অবস্থিত অমরকণ্টক সাধারণভাবেই একটি দৈবী মাহাত্ম্যপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে সমাদৃত, তার সঙ্গে জড়িত আছে এই শক্তিপীঠের মাহাত্ম্যও

 

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজের বাপের বাড়িতেই দেহত্যাগ করেছিলেন মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছাতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য শুরু করেন মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন সেই দেহখণ্ডগুলিই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয় সেই রকম একটি পীঠ হলো কালমাধব সতীপীঠ বলা হয় সতীর বাম নিতম্ব পড়ে জন্ম হয়েছে এই কালমাধব সতীপীঠের

 

সারা বছর এখানে ভক্তরা আসেতবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস পাঁচ মাস এখানে বহু ভক্তের সমাগম হয়বহু ভক্তের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে এখানে পূজা দিয়ে দোলের সময় এখানে বিশাল মেলা বসে এখানে থাকার জন্য অতিথি নিবাস আছেমন্দির থেকে ভক্তদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়

 

সাঁইথিয়ায় আর এক সতীপীঠ আছেকথিত আছে এই সতীপীঠে একটি শিয়াল রোজ নিয়ম করে মায়ের পায়ের কাছে অমাবস্যার রাতে বসে থাকতসকাল হলেই তাকে আর দেখা যেত নাসদাজাগ্রত মায়ের শক্তি আমাদের শক্তি দেয়, তাই তো তিনি শক্তিদায়নী কালিকা,মুণ্ডমালিনী কৃপালিনী তারা

 

১৬

 

কে জাগো রে...কথিত বিশ্বাস যে এই রাতে যে জেগে দেবীর সাধনা করেন তিনি ধনপতি হন

হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী কোজাগরী শব্দটি এসেছে 'কো জাগর্তি' থেকে, যার অর্থ 'কে জেগে আছো' ভক্তমনে বিশ্বাস যে এই পূর্ণিমার রাতে নাকি দেবী লক্ষ্মী স্বয়ং মর্ত্যলোকে পরিক্রমায় বেরোন৷ তিনি দেখেন তাঁকে আরাধনার রাতে সারা রাত কেউ জেগে আছে কিনা তাই ভক্তিপূর্ণ চিত্তে লক্ষ্মীপুজো করার পরে প্রথমে বালক, বৃদ্ধ শিশুদের খাবার গ্রহণ করাতে হয় আজও ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে পাওয়ার জন্য গৃহস্থেরা সারারাত ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালান কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন বাংলার প্রতিটি ঘর মুখরিত হয়ে ওঠে শঙ্খধ্বনিতে৷

 

 বিশ্বাসে মিলায় বস্তুসেই অনুসারে, শারদ পূর্ণিমায় দেবী লক্ষ্মী তাঁর বাহন পেঁচার উপর বসে পৃথিবী দর্শন করতে আসেন প্রথা অনুসারে, অনেকে শারদ পূর্ণিমায় বাড়ির ছাদে পায়েস রাখেন কারণ এই দিনে চাঁদকে বিশেষভাবে পূজা করা হয় এবং তার আলোতে পায়েস রাখার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে শারদ পূর্ণিমা অনেক নামেও পরিচিত শারদীয় পূর্ণিমাকে কোজাগরী পূর্ণিমাও বলা হয়, তবে কেন এটি বলা হয় তা জেনে নেওয়া যাক

শারদ পূর্ণিমা কোজাগরী পূর্ণিমা, রাস পূর্ণিমা, লক্ষ্মী পূজা এবং কৌমুদী ব্রত নামেও পরিচিত 'কোজাগরী' শব্দের অর্থ 'জেগে থাকা' এই উৎসব ঘিরে রয়েছে লোককথা

এক হিন্দু ধর্মের রাজা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন, যার কারণে রাজার সম্পদ কমতে শুরু করে রাজার উদ্বেগ কষ্ট দেখে রাণী উপবাস পালন করেন এরপর সারা রাত জেগে লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা করেন তখন দেবী লক্ষ্মী দেবীর পূজা উপবাসে অত্যন্ত প্রসন্ন হন এবং তাঁর স্বামী অর্থাৎ রাজাকে আশীর্বাদ করেন, যাতে তাঁর রাজ্যে ধন-সম্পদ বা সমৃদ্ধির কোনও অভাব না হয় এর কারণেও অনেকে শারদীয় পূর্ণিমার রাতে জাগরণ করেন

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, শারদ পূর্ণিমার দিনে সাগর মন্থনের সময় দেবী লক্ষ্মী সাগর থেকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এর কারণেও এই পূজার বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে কোজাগরী পূর্ণিমার জন্য, অনেক ঋষিরাও বিশ্বাস করেন যে এই রাতের চাঁদের জ্যোৎস্নার আশ্চর্যজনক নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে এবং এটি মন আত্মার জন্য উপকারী

আসুন জেনে নেওয়া যাক যে কিছু এলাকায় নববিবাহিত মহিলা এবং অবিবাহিত মেয়েরাও এই পূজায় উপবাস রাখেন এমনটা বিশ্বাস করা হয় যে এই দিনে পুজো করলে সুখ-সমৃদ্ধির পাশাপাশি গৃহে সদাচারী স্বামীও পাওয়া যায় হে হরিপ্রিয়ে, তুমি সকল প্রাণীকে বরদান করিয়া থাক, তোমাকে প্রণাম করি যাহারা তোমার শরণাগত হয়, তাহাদের যে গতি, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয়'

বর্তমানে গৃহস্থের সুবিধের জন্যই হোক বা পুজারীর স্বল্পতার জন্য, লক্ষ্মী পূজা (বারোমাসী পূজা বাদে) হয় সকাল থেকেই কিন্তু কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার প্রকৃষ্ট সময় প্রদোষকাল অর্থাৎ সূর্যাস্ত থেকে দু ঘণ্টা পর্যন্ত যে সময় সকাল অবধি তিথি থাকলেও সেই প্রদোষেই পূজা বিহিত কিন্তু আগেরদিন রাত্রি থেকে পরদিন প্রদোষ পর্যন্ত তিথি থাকলে পরদিন প্রদোষেই পূজা করা বিধেয় আবার আগেরদিন রাতে তিথি থাকলেও যদি পরদিন প্রদোষে তিথি না থাকে তাহলে আগেরদিন প্রদোষেই পূজা করা কর্তব্য

 কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাতে দেখা যায় জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক আচার অনুষ্ঠান এখনও ঘরে ঘরে প্রতি বৃহস্পতিবারে পাঁচালি পাঠ করে তার আরাধনা করা হয় উপচারে ফল মিষ্টি ছাড়াও থাকে আচার অনুষ্ঠানেও দেখা যায় নানা ধরনের তাৎপর্য কোনও কোনও পরিবারে পূজায় মোট ১৪টি পাত্রে উপচার রাখা হয় কলাপাতা দিয়ে সাজানো হয় পূজা স্থানটিকে পূজার উপকরণ এবং আচার অনুষ্ঠান দেখে অনুমান করা যায় এর নেপথ্যে থাকা কৃষি সমাজের প্রভাব কিছু কিছু জায়গায় লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে মেলা বসে কোথাও বা নৌকাবাইচও অনুষ্ঠিত হয়

 বলা হয়, 'যার কিছু নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে, আর 'যার আছে, না হারানোর আশায় জাগে আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পূজার বিশেষ আচার কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী রাত্রে খোঁজ নেন - কে জেগে আছেন? যে জেগে ধ্যান করে, লক্ষ্মী তাকে ধন সম্পদ দান করেন

                "নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী

             তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ

১৭

 আমরা ছোটোবেলায় গ্রামের বাড়িতে থাকতাম মনসা পুজো ঘুরে ঘুরে দেখতাম মা বলতেন, এই কাঁচা দেবীকে রোজ স্মরণ করবি তিনিই সাপ, বিষাক্ত কীটের দংশন থেকে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখেন তারপর ঝাপান গান শুনতে গানের দলের পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়াতাম জাতি,ধর্ম নির্বিশেষে এই মা মনসার পুজো এখন খুবই জনপ্রিয়

দূর থেকে ভেসে আসছে ভাদুগানের সুর ছুটে গিয়ে দেখলাম জ্যোৎস্না রঙের শাড়ি জড়ানো বালিকা ভাদু বসে আছে আর একটি পুরুষ মেয়ের সাজে ঘুরে ঘুরে কোমর নাচিয়ে গান করছে , "ভাদু আমার ছোটো ছেলে কাপড়় পর়তে জানে না" অবাক হয়ে গিলে যায় এই নাচের দৃশ্য অসংখ্য অপু দুর্গার বিস্মিত চোখ ঝাপানের সময় ঝাঁপি থেকে ফণা তোলা সাপ নাচিয়ে যায় চিরকালের চেনা সুরে ঝাপান দাদা

ঝাপান দাদা ঝাপান এলেই গান ধরতো,"আলে আলে যায় রে কেলে , জলকে করে ঘোলা কি ক্ষণে কালিনাগ বাসরেতে ঢোকে রে, লখিন্দরের বিধি হলো বাম " গ্রামের পুরোনো পুজোবাড়ি গাজনের সময় নতুন সাজে সজ্জিত হতো বাবা শিবের ভক্তরা ভক্তি ভরে মাথায় করে নিয়ে গিয়ে দোল পুজো বাড়িতে নামাতেন অসংখ্য লোকের নতুন জামা কাপড়ের গন্ধে মৌ মৌ করে উঠতো সারা বাড়ি তারপর পুজো হওয়ার পরে দোল চলে যেতো উদ্ধারণপুরের গঙ্গা স্নানের উদ্দেশ্যে কিন্তু আমার মন ফাঁকা হয়ে একা হয়ে পড়তো এই তো কিছুক্ষণ আগেই ছিলো আনন্দ ঘ্রাণ তবু দোল চলে গেলেই মন খারাপের দল পালা করে শুনিয়ে যেতো অন্যমনস্ক কবির ট্রাম চাপা পড়ার করুণ কাহিনী ঠিক এই সময়ে কানে ভাসতো অভুক্ত জনের কান্নার সুর আমি নিজেকে প্রশ্ন করেছি বারংবার, সকলের অনুভূতি কি আমার মতো হয় ?

রাতে শোয়ার পরে বোলান দলের নুপুরের ঝুম ঝুম শব্দ কানে বাজতো বেশ কিছুদিন ধরে

ফাল্গুনে হোলিকার কুশ পুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ নাচতে নাচতেই সবাই সমস্বরে বলতাম,

ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া

অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ পরের দিনে রং আর আবিরে ভরে যেত আকাশের নরম গা বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা সে এক অনির্বচনিয় আনন্দের প্রকাশে রাধা কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি

আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুনের অনিল পাঠকের রঙের খেলা শিল্পী একমাটি, দুমাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে আগে থেকে চোখ দেখতে নেই আর আমার চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম একবার সেই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি কি যেন বলেছিলো সেই চোখ আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায় ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে

দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে হয়তো আমার জন্য ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায়

আজ তিরিশ বছর পরে আমার মনে পড়ছে খড়ের চাল, মাটির দেওয়াল ভেদ করে সে এসেছিলো জ্যোৎস্না রঙের ফ্রকে হাত দিতেই একরাশ মুক্ত ঝরে পরে ছিলো তার রক্ত রাঙা দেহ মাটিতে

___পলাশ তোমার পরশ থেকে আমাকে ছিন্ন কোরোনা, আমি মরে যাবো

____এসো আমার আনন্দ জীবন, আমার করবী

কে যে মরে আর হা পিত্যেশ করে বোঝা যায় না এই পৃথিবীতে সেদিন খড়ের চাল ফুঁড়ে জ্যোৎস্না আমার উপর উঠে বিপরীত ক্রিয়াতে হেসেছিলো নেশাতে আমি শুধু অবাক হয়েছিলাম প্রথম সমুদ্র দেখার মতো

তারপর জয় পরাজয়, উত্থান পতনের ঢেউ আছাড় মেরেছে জীবন সৈকতে কোনোদিন ভেঙ্গে পরে নি মন হঠাৎ পাওয়া জ্যোৎস্না বিয়ে করে আমেরিকা চলে গেলো না ছাড়ার প্রতিজ্ঞা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি বয়ে বেড়ালাম তিরিশ বছর

এখন জলপাইগুড়ির প্রকৃতির সঙ্গে ভাব জমিয়েছি খুব আমার এক স্প্যানিয়াল বন্ধুকে নিয়ে ঘর করি কোনো কথা নেই , কোনো ঝগড়া নেই ভালোবাসার চোখে দেখি একে অপরকে আপন মনে থাকতে থাকতে মনে চলে আসে জ্যোৎস্নার কথা বৃষ্টির এক দুপুরে তার চিঠির কথা আজও মনে পড়ে সে লিখেছিলো ,ধনী পিতার একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবার যেমন নজর বন্দী করে রাখে পাছে ছেলে ভালোবাসা খপ্পরে পরে পর হয়ে না যায় ঠিক তেমনিভাবেই রেনকোট, ছাতার আড়াল করে আমরা নিজেদের বাঁচাতে চেষ্টা করেও বৃষ্টির ভালোবাসা থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারি না বৃষ্টি বলে সুন্দরী যেমন একমাত্র সুন্দর ছেলেকে পরিবারের নজর থেকে নিজের করে নেয় ,ঠিক একইভাবে বৃষ্টি আমাদের. একমাত্র সুন্দর দেহ জামার কলারের ফাঁক গলে ঢুকে পড়ে অন্দরমহলে তারপর হাঁটা পথে চলার রাস্তায় জল পরম মমতায় পায়ে জলের শে কল পরিয়ে রাখতে চায় বৃষ্টির সময় চোখে মুখে জল আদরের প্রলেপ লাগায় ঠোঁট চুম্বন করে শীতল স্পর্শকাতর জল তার আদরে প্রেমজ্বরে পড়তে হয় মাঝে মাঝে আমি ভালোবেসে তাকে বলছি, তুমি আমার জ্বরের মাঝে ঝরঝর ঝাঁপিয়ে পড়ো আমিও বৃষ্টি হয়ে যাই

তারপর জানতে চেয়েছিলো কেমন হয়েছে তার চিঠি তখনও আমি কিছুই বলতে পারি নি

আমি জ্যোৎস্না যে গ্রামে ভালোবাসা বয়সটা কাটিয়েছি তার কথা আজ মনে সবুজ সর ফেলছে শুধু মনে

আজ জ্যোৎস্না খোঁজ নিয়ে আমার জলপাইগুড়ি বাড়িতে বেড়াতে এসেছে এসেই নিজের ঘরের মতো এলোমেলো জীবন সাজাতে চাইছে আর কথা বলে চলেছো অনবরত ভালো করে তৈরি হয়ে এসে বিছানায় বসে শরীর টা এলিয়ে দিলো তারপর শুরু করলো, মনে আছে তোমার সব ঘটনা জানো আমি সুখী নই কথাটা শুনে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আবার আমার দুর্বল জায়গা জাগিয়ে তোলার জন্য পুরোনো কথা শুরু করলো জানে না আমি স্মৃতি জড়িয়ে ধরে বেঁচে আছি

আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনাতে লাগলাম পুরোনো বাল্য ভারত, তুমি শোনো জ্যোৎস্না,

ছোটোবেলার সরস্বতী পুজো বেশ ঘটা করেই ঘটতো পুজোর দুদিন আগে থেকেই প্রতিমার বায়নাস্বরূপ কিছু টাকা দিয়ে আসা হত শিল্পী কে তারপর প্যান্ডেলের জোগাড় বন্ধুদের সকলের বাড়ি থেকে মা দিদিদের কাপড় জোগাড় করে বানানো হত স্বপ্নের সুন্দর প্যান্ডেল তার একপাশে

বানানো হত আমাদের বসার ঘর পুজোর আগের রাত আমরা জেগেই কাটাতাম কয়েকজন বন্ধু মিলে কোনো কাজ বাকি নেই তবু সবাই খুব ব্যস্ত একটা ভীষণ সিরিয়াস মনোভাব তারপর সেই ছোট্ট কাপড়ের পাখির নিড়ে কে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম তা কেউ জানতে পারতাম না মশার কামড়ও সেই নিশ্চিন্ত নিদ্রা ভাঙাতে পাড়তো না তবু সকালে উঠেই মচকানো বাঁশের মত ব্যস্ততার আনন্দ মা বাবার সাবধান বাণী ,ডেঙ্গু জ্বরের ভয় কোনো কিছুই আমাদের আনন্দের বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে নি

হড়কা বানে যেমন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে সমুদ্রে ফেলে , আমাদের আনন্দ ঠিক আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেত মহানন্দের জগতে এরপরে সকাল সকাল স্নান সেরে ফলমূল কাটতে বসে পড়তাম বাড়ি থেকে নিরামিষ বঁটি এনে পুরোহিত এসে পড়তেন ইতিমধ্যে মন্ত্র তন্ত্র কিছুই বুঝতাম না শুধুমাত্র বুঝতাম মায়ের কাছে চাইলে মা না করতে পারেন না পুষ্পাঞ্জলি দিতাম একসঙ্গে সবাই

জোরে জোরে পুরোহিত মন্ত্র বলতেন মন্ত্র বলা ফাঁকি দিয়ে ফুল দিতাম মায়ের চরণে ভক্তিভরে তারপরে প্রসাদ বিতরণের চরম পুলকে আমরা বন্ধুরা সকলেই পুলকিত হতাম প্রসাদ খেতাম সকলকে বিতরণ করার পরে আমাদের সবার প্রসাদে ভক্তি বেশি হয়ে যেত ,ফলে দুপুরে বাড়িতে ভাত খেতাম কম সন্ধ্যা বেলায় প্রদীপ ,ধূপ জ্বেলে প্যান্ডেলের ঘরে সময় কাটাতাম পরের দিন দধিকর্মা খই আর দই পুজো হওয়ার অপেক্ষায় জিভে জল তারপর প্রসাদ বিতরণ করে নিজেদের পেটপুজো সাঙ্গ হত সাড়ম্বরে

এরপরের দৃশ্য প্রতিমা বিসর্জন কাছেই একটা পুকুর রাত হলে সিদ্ধিলাভে(দামীটা না) আনন্দিত হয়ে নাচ তে নাচতে অবশেষে শেষের বাজনা বেজে উঠতো মা তুই থাকবি কতক্ষণ, তুই যাবি বিসর্জন

তার সাথে আমাদের মনটাও বিসর্জনের বাজনা শুনতো পড়ার ঘরে বেশ কিছুদিন ধরে

কথা শুনতে শুনতে জ্যোৎস্না আমাকে জড়িয়ে ধরেছে আমার প্রবল কামনাকে কামড়ে ধরে নীলকন্ঠ হয়ে আছি জ্যোৎস্না বললো, জানো বিদেশে এটা কোনো ব্যাপার নয় এসো আমরা এক হই পরম সুখে আমি হাত ছাড়িয়ে বাইরে এলাম

জ্যোৎস্না কি ভুলে গেছে মনে ভাসা সবুজ সর নিয়ে ,দুঃখ কে জয় করার মানসিকতায় এক ভারতবর্ষীয় যাপনে আমি ডুব দিয়েছি জীবন সমুদ্রে….

বাবুল ছোটো থেকেই একরোখা জেদি ছেলেকোনো ভয়ডর তার হৃদয়ে নেইএক ডুবে সাঁতরে পুকুর পার হওয়া,গাছে ওঠা সবেতেই সে সিদ্ধহস্ত সব বন্ধুরা তার বশ্যতা স্বীকার করে নিত অনায়াসেতবু দেখতো বাবুল,দু একজন বন্ধু তার পিছনে নিন্দা করছে একদিন রবি এসে বললো,জানিস বাবুল তোর নামে হিরু খুব খারাপ কথা বলে বাবুল বললো,তোকে বিশ্বাস করে হিরু যা বলার বলেছে তুই আবার কেন সেই কথাগুলো প্রকাশ করছিসরবি লজ্জিত হলো, বললো,আর কখনও এরকম ভুল হবে না তোর কাছে মস্ত শিক্ষা পেলুম

বাবুল বাড়িতে দেখেছে, তার বাবার দাপট বাড়িতে একটু দেরি করে ঢুকলেই তার কৈফিয়ৎ দিতে হতো হাজারটা বাবার দুবেলা তিন ঘন্টা করে মোট ঘন্টা আহ্নিকের সময় সবাইকে চুপ করে থাকতে হতোকথা না বলে ধীরে সব কাজ সারতে হত মাকে বাবুল পড়তে বসে হারিয়ে যেত বইয়ের ছবিতে ওর চোখে ভেসে উঠত আমেরিকার ঝলমলে শরীর,টরেন্টোর বিলাস বহুল শহুরে আদব কায়দা মাঝে মাঝে সে ঘুমের ঘোরে বলে উঠত, আমি যাবো, আমি যাবো, আমেরিকা,টরেন্টো তার মা ডেকে বলতেন,কি সব বলছিস তুই কোথায় যাবি?আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবি তুই

তারপর সুখে,দুখে,শোকে কেটে গেছে অনেকটা সময় বাবুল হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছে সবাই খুব আনন্দিত কিন্তু বাবুলের মনে অন্য চিন্তা সে একদিন রাতে মায়ের আলমারি খুলে সব গহনা হাতিয়ে নিলো তারপর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো বাবুল তার মা সকালে উঠে দেখলেন,আলমারি হাট করে খোলা কোথাও কিছু নেই সোনাদানা, টাকা পয়সার থেকেও দামি তার সোনার ছেলে বাবুলও কোথায় যেনো হারিয়ে গেলো বাবুলের মা, বাবা পরামর্শ করলেন, চুরি যাওয়ার ঘটনা চেপে যেতে হবে

তারা একটা চিঠি পেলেন টেবিলের উপর তাতে লেখা,

মা বাবা,তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না আমি পড়াশোনার জন্য বিদেশ চললাম বাবা যেতে দেবেন না বলে আমি নিজেই ম্লেচ্ছ হতে যাচ্ছি তোমাদের নেওয়া জিনিসের আমি সদ্ব্যবহার করবো তোমরা আমার জন্য দুঃখ কোরো না ভালো থেকো

ইতিতোমাদের বাবলু

তারপর সময়ের স্রোতে কেটে গেলো অনেকগুলো বছর কিন্তু বাবলুর কোনো খবর পাওয়া গেলো না

এদিকে বাবলু সোনাদানা,টাকা পয়সা নিয়ে চলে এলো কলকাতায় সেখানে সোনাদানাগুলো সোনাপট্টিতে বিক্রি করলো তারপর একটা ঘর ভাড়া করলো তার সঙ্গে পার্ক স্ট্রীটের এক ইংরেজ মহিলার সঙ্গে পরিচয় হলো পড়াশোনার জন্য সে বিদেশ যেতে চায় শুনে মহিলাটি তাকে সব রকমের সাহায্য করলেন বাবলু সময় ঠিক করে একদিন সুইজারল্যান্ডে পাড়ি দিলো সেদিন তার খুব আনন্দের দিন জাহাজে তার সঙ্গে পরিচয় হলো এক ভদ্রলোকের তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই কলকাতা আসেন বাবলু বললো,আপনি আমাকে একটা কাজ দেবেন আপনার কাজ করে দেবো ভদ্রলোক বললেন, সুইজারল্যান্ডে তার হোটেল আছে সেখানে তাকে একটা কাজ নিশ্চয় দেওয়া হবে

বাবলু ভাবতে পারে নি, এত সহজে সব কাজ হয়ে যাবে জাহাজের বাইরে পাটাতনে বসে বাবলু সমুদ্র দেখছেএক নীল অসীম সমুদ্রের হাতছানিতে তার হৃদয় দুলে দুলে ওঠে বাঙালী ঘরের ছেলে হলেও অন্তর তার শক্ত এখন তার আর মায়ের মমতা কিংবা বাবার শাসন কিছুই মনে পড়ছে না এগিয়ে যাওয়ার এক নেশায় সে মশগুল

জাহাজ নোঙর বাঁধলো চলে এলো অন্যদেশে,অচিনপাড়ে জাহাজের সেই ব্যবসায়ী ভদ্রলোক বাবলুকে নিয়ে চলে এলেন নিজের বাসভূমিতেবাবলু কাজের ছেলেনিজের ঘরটা বুঝে নিয়ে মালপত্তর দু চারটে যা ছিলো গুছিয়ে রাখলোপ্যান্টের পকেটে টাকাগুলো রাখলো এখন টাকাই বল, ভরসা এখানে তো আর টাকা চলবে না ভদ্রলোক বললেন, ব্যাংকে গিয়ে এক্সচেঞ্জ করিয়ে নেবেন খাওয়াদাওয়ার পরে একঘুমে সকাল তারপর কাজ আর কাজ

এই কাজের দেশে এসে বাবলু বুঝে গেছে কাজ করতে পারলে সুইজারল্যান্ডে খাওয়ার অভাব হয় না ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাছে জেনেছে সে,কেউ কারও দাসত্ব করে না এদেশে খাটো খাও মৌজ করো রাতে কলেজে পড়াশোনা করে বাবলু পড়াশোনার জন্যই এখানে আসা তার, সেকথা সে ভোলে নি

আজ পাঁচ বছর কেটে গেলো বাবলুর স্বপ্নের মত একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী সে হাসিল করেছে এতদিনে আর তাকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় না একটা বড় কম্পানী তাকে চাকরী দিয়েছে ফ্ল্যাট দিয়েছে মাইনে অনেক টাকা আর তার কোনো চিন্তাই নেই এক বড়লোক মহিলাকে সে বিবাহ করেছে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্যবিশাল সম্পত্তির মালকিন সেই মহিলা একদিন গাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় মহিলার আ্যক্সিডেন্ট হয় একদম স্পট ডেথতখন বাবলু অফিসে ছিলো এসেই দেখলো চারদিকে পুলিশের ভিড় বাবলুর চোখে জল রক্ত দেখেবড় ভালোবাসতো মহিলাটি তাকে তার স্ত্রী আজ আর নেই হিসেবমত বডি সৎকারের কাজকর্ম মিটে গেলে সম্পত্তির একমাত্র মালিক হলো বাবলু

বাবলু লোভি নয় সে এখন ভালোই রোজগার করে তবে হাতের সম্পত্তি তো আর ফেলে দেওয়া যায় না বাবলুর অই বাড়িতে আর ভালো লাগতো না একটা কান্না ঘুরে বেড়াতো বাড়িটা জুড়ে তাই সে বাড়িটা বিক্রি করে দিলোগাড়িটাও বিক্রি করে দিলো সব টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত করে রেখে দিলো তারপর একটা কম বয়সী মেয়ে দেখে আবার বিয়ে করলো বছর দুই পরে ফুটফুটে একটি মেয়ে হোলো

দেখতে দেখতে মেয়ে দশ বছরের হয়ে গেলোবাবলুর এবার একবার দেশের বাড়ি যাবার ইচ্ছে হলো সবাইকে নিয়ে চলে এলো নিজের দেশ ভারতবর্ষে দেশের মাটিতে পা দিয়েই বাবলু একমুঠো ধুলো গায়ে হাতে পায়ে মেখে নিলো বললো,আঃ কি সুন্দর গন্ধপৃথিবীর কোনো পারফিউম এর থেকে সুন্দর নয় বাবলুর দেখাদেখি মেমসাহেব আর মেয়ে ধুলো নিয়ে গন্ধ শুঁকলোকিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হোলো না হবে কি করে? তারা তো আর এই মাটির গর্ভে মানুষ হয় নি তারপর কোলকাতা থেকে সোজা মায়ের কাছে চলে এলো বাবলু

বাবলুকে দেখে মা কেঁদেই আকুল মা বললেন,তোর বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই আমি তোকে একবার শেষ দেখা দেখবো বলে বেঁচে আছি বাবলু বললো,এই নাও মা তোমার সব গহনা,টাকা, পয়সা সব আমাকে ক্ষমা করে দিও মা মা বললেন,তুই মানুষের মত মানুষ হয়েছিস আমার আর কোনো দুঃখ নেই তুই আমাকে কলকাতার বাড়িতে তোর ভাইয়ের কাছে রেখে যা আর এই বাড়ি গ্রামের স্কুল গড়ার কাজে দান করে দে তোর বাবার নামে এই স্কুলের নাম হবে, মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ বাবলু বললো,তাই হবে মা তোমার কথার অন্যথা হবে না তারপর সেই বাড়ি আজ বিরাট বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে

প্রায় ছমাস ভারতে কাটিয়ে আবার ফিরে এলো সুইজারল্যান্ডেবৃষ্টিভেজা এই দেশে সবুজের সমারোহটইটম্বুর জলাধার মনে দাগ কাটেশীতের মরশুমে জানালার কাঁচে রেখে যায় বরফের ছাপএদেশের বেশির ভাগ বাড়ির চাল ঢালু বৃষ্টি বা বরফ গড়িয়ে পড়েকিছু ঐতিহাসিক স্থান দেখে মন জুড়িয়ে যায় এদেশে থাকতে থাকতে বাবলুর কেমন একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে মনে

বাবলু সেদিন অফিসে গেছে রাতে ফিরে এলে তার সুখের সংসারে আগুন লাগলোবাবলু দেখলো তার স্ত্রী মেয়ে একসাথে এক অপরূপ সুন্দর যুবকের সাথে যৌনক্রিড়ায় মত্ত বাবলুর মেয়ে কুড়ি বছরের বৌ এর বয়স বিয়াল্লিশ আর বাবলুর বয়স আটান্নবাবলু ভারতবর্ষের ছেলে সেখানকার সভ্যতা তার মনে প্রাণে এই দৃশ্য দেখার পরে সে আর বাড়ি ঢোকে নি অন্য এক বাড়ি ভাড়া করে ছিলো কয়েকবছর তারপর ডিভোর্স দিয়ে ছাড়াছাড়ি করে নেয় তাদের সম্পর্ক মেয়ে থেকে যায় মায়ের কাছে বাবলুর আর কোনো বাধা নেই এবার সে ভারতবর্ষে বাকি জীবনটা কাটাবে শান্তিতেভারতবর্ষের মাটির গন্ধ সে ভুলতে পারে নিফোর জি বা ফাইভ জির সুবিধা, আরাম তাকে দেশের মাটির গন্ধ ভোলাতে পারে নি

চলে এলো বর্ধমানের গাংপুরে তার মা, বাবা কেউ আর বেঁচে নেই ভাইরা নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত বাবলু দশটা কাজের ছেলে রাখলো আর পাঁচটা কাজের মেয়ে প্রায় কুড়ি বিঘে জমির উপর পুকুর,বাড়ি,বাগান এসব দেখাশোনার জন্যই সে এত লোক রাখলোআর নিজে অবসর কাটানোর জন্য প্রচুর পড়াশুনা করে বিগত জীবনের কোনো মায়া তাকে আটকে রাখতে পারে না বাবলু এখন দেখতে পায় আলোর ফুলকি ফুলকিগুলো লাল,সবুজ,নীল হরেক রঙের আলো ছড়িয়ে নিরাকার এক মূর্তি মনে তৈরি করে বাবলু এখন তার সাধনায় পরশ পাথরের খোঁজ করে একদিন হয়ত তার সন্ধান পাবে

পুরুলে গ্রামের মদন কাকা আমাকে দেখে বললেন, কি গো কেমন আছো? তিনি কথা বলতে ভালোবাসেন তিনি শুরু করলেন তার বক্তব্যবুঝলে বাবা কবরের পোকাগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেমরা পোড়ানোর ঝিলগুলো কোনো সময় খালি নেই পা টা ঝিলের বাইরে থাকলে বাঁশ দিয়ে গুটিয়ে আগুনে দেবে আত্মীয় স্বজনরা বলবে, আর কতক্ষণ লাগবে,একটু তাড়াতাড়ি করো না ভাই তবে কার জন্য এত মারামারি,কাটাকাটি,জাতিবিদ্বেষএত টাকা টাকা করে আমরা মরার আগে মরি কেন? যারা খেতে পায় না, কোটি টাকার মালিক হলেও তাদের খেতে দিতে পারি না কেন? কোটিপতি, আপনাকে বলছি,কত টাকা নিয়ে আপনি কবরে প্রবেশ করবেন? কত টাকা নিয়ে আপনি ঝিলে চাপবেন এই পোষ্টের বিরুদ্ধে অনেকে অনেক কথা বলবেন জানি কিন্তু একটু ভাবুন তো, কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়, কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত

আপনার দোষ, অকৃতকার্যতা, আপনার সংসার নিয়ে অনর্থক টেনশন সব বৃথা মরণ যখন চলে আসবে আরও কিছুক্ষণ বাঁচার জন্য আপনি ছটফট করবেন আপনি ভুলে যাবেন আপনার অহংকার,সংসার,স্ত্রী,কন্যা,পুত্র সকলের কথা জীবন একবার চলে গেলে আর ফিরবে না যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ আসুন আনন্দে থাকিভুলে যাই ঝগড়া,খুনোখুনি,চিটিংবাজিটাকার পাহাড় গড়ছে যারা তার ভাবুন তো, কত টাকা আপনি সঙ্গে নেবেন কত টাকা আপনাকে পোড়াতে লাগবে? কাকা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন

একজন গরীব রোগীর বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন তো?একজন ছাত্রকে বিনা পয়সায় সত্যিকারের মানুষ করেছেন তো?একজন শ্রমিককে শান্তিতে খেতে দিয়েছেন তো? শুধু পয়সা পয়সা করে সারাজীবন অসার হয়ে যায় নি তো?বিবেককে প্রশ্ন করুন ওর থেকে বড় আদালত আর নেই

তবে কেন এত লোভ,হিংস্রতা,বর্বরতার নিষ্ঠুর পরিহাস এগুলো তো রক্তমাংসের মানুষরাই করে তারা তো সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান প্রাণী তারা তো সব জানে আমার ফালতু বোকামি বক বক করে জ্ঞান দেওয়ার পাগলামি তবু যদি এই পাগলের লেখা পড়ে একটা মানুষেরও উপকার হয় তাহলে দুঃখ থাকবে না

যারা পুত্র,কন্যা, তোমরা বাবা মাকে দুঃখ দিও না স্বামী,স্ত্রী অকারণে সম্পর্ক ভেঙ্গো না বন্ধু তুমি বন্ধুকে ঠকিও নানিশ্চিত মরণ কে মনে রেখে সমাজে সকলে মিলে শান্তির পরিবেশ গড়ে তুলি জয় হোক মানুষের জয় হোক মানব ধর্মের জয় হোক মনুষ্যত্বেরভারতবর্ষের মূল আদর্শ কাকা তার বক্তব্যে তুলে ধরলেমগলা ভারি হয়ে এলোকিছু উত্তর দিতে পারলাম না

কাকার কথা শেষ হলে আমি এগিয়ে গেলামদেখি আরও এইরকম অখ্যাত মানুষের সন্ধান পাই কি না

 

১৮

 

আজ ভাইফোঁটা বোনের বাড়িতে এসে শুনলাম ভাইফোঁটার ইতিহাসআজ কাকাবাবু ঘরে আছেনতিনি বললেন,সূর্যদেব তার পত্নী সংজ্ঞার যমুনা নামে কন্যা এবং যম নামে পুত্র সন্তান ছিল তাঁরা হলেন মৃত্যুদণ্ডদাতা যমরাজ তাঁর বোন যমুনা হলেন সূর্যের সেই দুই সন্তান পুত্র কন্যা সন্তানের জন্মদানের পর সূর্যের উত্তাপ স্ত্রী সংজ্ঞার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে নিজের প্রতিলিপি ছায়াকে দেবলোকে রেখে মর্তে প্রত্যাবর্তন করেন সংজ্ঞার প্রতিরূপ হওয়াই কেউ ছায়াকে চিনতে পারেনা বিমাতা ছায়া কালক্রমে যমুনা যমের প্রতি দুঃব্যবহার করতে থাকেন কিন্তু ছায়ার মোহে অন্ধ সূর্যদেব কোন প্রতিবাদ না করায় অত্যাচারের মাত্রা দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে এভবেই একদিন যমুনা তার বিমাতা কর্তৃক স্বর্গরাজ্য থেকে বিতারিত হয় কালের নিয়ম মেনেই যমুনার বিবাহ হয় বিয়েরপর তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন দীর্ঘকাল দিদিকে চোখের দেখাটাও যম দেখতে পায়নি তাই তার খুব মন খারাপ করছিল দীর্ঘকাল দেখা না হওয়ায় বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হয় ভাই যমকে দেখার তখন ঠিক করল যে করেই হোক দিদির সাথে দেখা করতেই হবে তাছাড়া মন শান্ত হবেনা যম রাজদূত মার্ফত যমুনার নিকট বার্তা পাঠায় ভায়ের আসার খবর পেয়ে যমনা যারপরনাই খুশি হয়যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা' এই ছড়া কেটে কপালে তিন বার ফোঁটা দেওয়া হয় চন্দনের ফোঁটা দেওয়ার পর শঙ্খ ধ্বনির মাঝে ধান-দূর্বা দিয়ে ভাইকে আশীর্বাদ করে বোন এবার মিষ্টিমুখ করার পালা তার পর ভাই-বোনের মধ্যে উপহার আদান-প্রদান করা হয়সূর্য সংজ্ঞার সন্তান যম যমী বা যমুনা যমুনা নিজের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দিয়েছিলেন, তার পর থেকে এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে কথিত আছে, যমুনা নিজের ভাই যমকে একাধিক বার নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান কিন্তু ব্যস্ততার কারণে ধর্মরাজ যম নিজের বোনের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে যেতে পারতেন না কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে বাড়ির দ্বারে নিজের ভাই যমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, খুশিতে আত্মহারা হয়ে যান যমী প্রসন্নতা স্নেহের সঙ্গে সেই তিথিতে নিজের ভাইকে ফোঁটা দেন ভোজন করান যমুনা এর পর যম যমীকে বর চাইতে বলেন তখন, যমী ভাইয়ের কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা নেন যে, প্রতি বছর তিনি কার্তিক শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়ায় যমীর বাড়িতে ভোজন গ্রহণ করতে আসবেন পাশাপাশি - বর চান যে, এই তিথিতে যে বোন নিজের ভাইকে ফোঁটা দিয়ে ভোজন করাবে, তাঁর কখনও যমের ভয় থাকবে না তার পর থেকেই ভাই ফোঁটার রীতি পালিত হয়ে আসছে

 

কালী পুজার দুদিন পরে অর্থাৎ ভাতৃদ্বিতীয়ার দিন যম যমুনার বাড়ি যাত্রা করে ভাই যমরাজ এলে ভালমন্দ খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন দিদির বাড়ি পৌঁছে যম দিদির অতিথ্যে মুগ্ধ হয় যম পৌঁছানোর আগেই যমুনা বিশাল খাবরের আয়োজন করেছিল দিদি যমুনার আতিথ্য ব্যবহারে সুপ্রসন্ন যম যমুনাকে উপহার হিসেবে বরদান প্রার্থনা করতে বলে দিদি যমুনা এমনই এক বর প্রার্থনা করেছিল যা একটা ভাই অন্তপ্রান দিদির চিরন্তন প্রার্থনা হওয়া উচিত যমুনা বলেছিল "ভাতৃদ্বিতীয়ার দিন প্রত্যেক ভাই যেন তার বোনের কথা স্মরন করে আর প্রত্যেক বোন যেন তার ভায়ের মঙ্গলময় দীর্ঘ জীবন কামনা করে" যম তার দিদি যমুনাকে তাই বর হিসেবে দান করেন এবং বোনের ডাক পেলে বারবার আসার প্রতিশ্রুতি দেন যম এরপর যম পিতৃগৃহে ফিরে আসে যমুনা তাঁর ভাই যমের মঙ্গল কামনায় আরাধনা করে যার পুণ্য প্রভাবে যম অমরত্ব লাভ করে বোন যমুনার পুজার ফলে ভাই যমের এই অমরত্ব লাভের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বর্তমান কালের বোনেরাও এই সংস্কার বা ধর্মাচার পালন করে আসছে আবার অনেকে বলে থাকেন যমুনার সঙ্গে বিয়ে হয় শ্রীকৃষ্ণের দাদা বলরামের সেই দিনটিও ছিল কার্তিক মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বিতীয়া তিথি বিয়ের আগে ভাইদের কপালে ফোঁটা দিয়ে মঙ্গলকামনা করেছিলেন যমুনা সেই থেকেও ভাইফোঁটার প্রচলন বলেও অনেকে বলে থাকেনকার্যত শারদীয়া উৎসবের শেষ ভাইফোঁটা দিয়ে আর শারদীয়া উৎসবের সবকিছুর সঙ্গেই রয়েছে মা লক্ষ্মীর যোগ সেটা ভাইফোঁটার ক্ষেত্রেও সত্য এমনই এক পৌরাণিক কাহিনি শোনা যায় একসময়ে বালির হাতে পাতালে বন্দি হন বিষ্ণু বিপদে পড়ে যান দেবতারাও কোনওভাবেই যখন বিষ্ণুকে উদ্ধার করা যাচ্ছে না, তখন নারায়ণকে বালির হাত থেকে উদ্ধার করতে সকলে লক্ষ্মীর শরণ নেন লক্ষ্মী উপায় হিসেবে বালিকে ভাই ডেকে কপালে তিলক এঁকে দেন সেটাও ছিল কার্তিক মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি ফোঁটা পেয়ে বলি লক্ষ্মীকে উপহার দিতে চান আর তখনই লক্ষ্মী, ভগবান বিষ্ণুর মুক্তি উপহার চান

ভাইকে স্বাগত জানাবার এই এক প্রথার কথা শোনা যায় কৃষ্ণ আর সুভদ্রার উপাখ্যানেও সেই কাহিনি বলে, ধনত্রয়োদশীর পরের দিন চতুর্দশী তিথিতে নরকাসুরকে বধ করলেন কৃষ্ণ তার পর প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে দ্বারকায় ফিরে এলেন কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ নরকাসুর বধ নামের এক দৈত্য বধের পর কৃষ্ণ ফিরে এসেছেন বোন সুভদ্রার কাছে কৃষ্ণকে দেখে সুভদ্রার উচ্ছ্বাস বাধা মানল না তিনি বরাবরই কৃষ্ণের আদরের বোন এই কয়েকদিন তিনি দাদাকে দেখতে পাননি তার উপর আবার খবর পেয়েছেন সুভদ্রা, নরকাসুরের অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন কৃষ্ণ অতএব, দ্বারকা পৌঁছতেই কৃষ্ণকে তিনি বসালেন আসনে তাঁর কপালে পরিয়ে দিলেন বিজয়তিলক তাকে কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি খেতে দেন সুভদ্রা অনেকে মনে করেন, ভাই ফোঁটার শুরু এর মধ্য দিয়েই সেই জন্যই ভাইবোনের অটুট বন্ধন, আনন্দ খুনসুটির আর এক উৎসব ভাই ফোঁটা পশ্চিমবঙ্গে সাড়ম্বরে এই উৎসব পালিত হলেও, বাংলার বাইরে, উত্তর ভারতেও ভাই ফোঁটার প্রচলন রয়েছে সে ক্ষেত্রে এর নাম হয়ে যায় ভাই দুজ, ভাই বীজ, দক্ষিণ ভারতে এটি আবার যম দ্বিতীয়া নামে পরিচিত তবে নাম যাই হোক না-কেন, ভাইয়ের মঙ্গল কামনা দীর্ঘায়ুর লাভের কামনা করে দিন প্রতিটি বোন নিজের ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয় ভাইফোঁটা  একটি হিন্দু উৎসব এই উৎসবের পোষাকি নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া অনুষ্ঠান কার্তিক মাসের শুক্লাদ্বিতীয় তিথিতে কালীপূজার দুই দিন পরে,এই উৎসব অনুষ্ঠিত হয় বাঙালি হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, এই উৎসব কার্তিক মাসে হয় মাঝেমধ্যে এটি শুক্লপক্ষের ১ম দিনেও উদযাপিত হয়ে থাকে পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের শেষদিন আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ নেপালে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে সেখানে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব এই উৎসবের আরও একটি নাম হল যমদ্বিতীয়া কথিত আছে, এই দিন মৃত্যুর দেবতা যম তার বোন যমুনার হাতে ফোঁটা নিয়েছিলেন অন্য মতে, নরকাসুর নামে এক দৈত্যকে বধ করার পর যখন কৃষ্ণ তার বোন সুভদ্রার কাছে আসেন, তখন সুভদ্রা তার কপালে ফোঁটা দিয়ে তাকে মিষ্টি খেতে দেন সেই থেকে ভাইফোঁটা উৎসবের প্রচলন হয় ভাইফোঁটার দিন বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে ছড়া কেটে বলে-ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা যমদূয়ারে পড়ল কাঁটা যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা

 

 

 

Sudip ghoshal nandanpara khajurdihi purbo bordhaman 713150mo8391835900

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.