গল্প ।। এক হরিপদ কেরানির কথা ।। অভিষেক দত্ত
এক হরিপদ কেরানির কথা
অভিষেক দত্ত
“কাল কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট অফিসে মিটিং আছে হরিপদবাবু। অতি অবশ্যই এগারোটার মধ্যে চলে আসবেন।”
“আচ্ছা স্যার,” বড়ো সাহেবের কথায় মাথা নাড়ল হরিপদ।
মনে মনে হিসেবে কষতে থাকে। তার মানে সাড়ে ছটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠতে হবে। তারপর মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দেওয়া, বাজারহাট করা। এইসব সামলে সাড়ে নটার মধ্যে স্নান খাওয়া সেরে নটা পঞ্চাশের লোকালটা ধরতে পারলে তবেই এগারোটার মধ্যে অফিস।
পরেরদিন সোয়া ছটা নাগাদই ধড়মড়িয়ে উঠে পড়ল হরিপদ। চট করে প্রাতঃকৃত্য সেরে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে সারাদিনের যুদ্ধের জন্য তৈরি হল। অন্যদিন এই সময়ে চা বিস্কুট খায়। আজ আর সেসবের সময় নেই। একহাতে মেয়ে আর অন্য হাতে বাজারের থলে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
“আজ তোমার কী হয়েছে বলতো,” স্নান করতে করতেই গিন্নীর গলা শুনতে পাচ্ছিল “এতো টমেটো আর এই কটা আলু! কী রাঁধবো এই দিয়ে!”
সর্বনাশ করেছে, মনে মনে জিভ কাটে, অফিসের চিন্তায় এক কিলো আলু আর আড়াইশো টমেটো গুলিয়ে গেছে।
“ভুল হয়ে গেছে,” তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো, “কালকেই পাল্টে আনবো। এখন চট করে ভাত দাও।”
“আমার হয়েছে যত জ্বালা,” কটমট করে তাকিয়ে গিন্নী রান্নাঘরে গেলেন।
সাড়ে নটার মধ্যে তৈরি হয়েই ঊর্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে। মাথার মধ্যে ‘এগারোটা’ শব্দটা ঘড়ির মতোই টিকটিক করছে। একটাই বাঁচোয়া ইরিগেশন বাংলোয় লাঞ্চের বন্দোবস্ত আছে। টিফিন নেওয়ার ঝামেলা নেই।
সব সামলে এগারোটার মধ্যেই হাঁফাতে হাঁফাতে অফিসে পৌঁছল। বড়োসাহেব তখনও এসে পৌঁছননি। ঝট করে অ্যাটেনডেন্সের খাতায় সই করে মিটিংয়ের কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিল।
“সমস্ত শিডিউল চেঞ্জ হয়ে গেছে হরিপদবাবু,” একটু পরেই বড়োসাহেব শশব্যস্ত হয়ে অফিসে ঢুকলেন, “ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে নয়, এস.ডি.ও. সাহেবের অফিসে মিটিং হবে। দুঘন্টার রাস্তা, এক্ষুনি বেরোতে হবে।”
অফিসের গাড়িতে চেপে হাইওয়ে দিয়ে যেতে মন্দ লাগছিল না। দুধারে সবুজ মাঠ, গাছপালা, রেললাইন - মফস্বলের প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই মন ভালো করে দেয়।
ঝিরঝিরে হাওয়ায় চোখদুটো বুজে এসেছিল। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা থেমে যেতেই জেগে উঠল।
“ডায়নামো কাজ করছে না,” বনেট খুলে খানিকক্ষণ খুটখাট করে ড্রাইভার জানালো, “সারাতে মিনিমাম দুঘন্টা লাগবে।”
“সর্বনাশ,” বড়োসাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন, “এখন উপায়!”
হরিপদর বুদ্ধিশুদ্ধিও গুলিয়ে গেছে। ঠিকসময়ে বিল পাস হয় না বলেই বোধহয় গাড়ির মালিক একটা লজঝড়ে অ্যাম্বাস্যাডরকে এই অফিসের জন্য বরাদ্দ করেছে। মাঝেমধ্যেই সেটা বেশ ভোগায়। আজকে একেবারে চরম বিশ্বাসঘতকতা করলো।
বাস টোটো ইত্যাদি প্রভৃতির সাহায্যে কোন ক্রমে যখন পৌঁছল তখন মিটিং প্রায় শেষের দিকে। নিজের চেয়ারে গম্ভীর মুখে এস.ডি.ও. সাহেব বসে আছেন। আশেপাশে একাধিক 'উচ্চপদস্থ ব্যুরোক্র্যাট'। কলকাতা থেকে একটি কমিটির চেয়ারম্যান এসেছেন। ভিডিও কনফারেন্স চলছে।
ঘরটা খুঁটিয়ে দেখছিল হরিপদ। সুন্দর করে সাজানো এয়ার কন্ডিশনড ঘর। ওয়ালর্যা কে বিভিন্ন দামী মূর্তি। সামনে একটা তেতাল্লিশ ইঞ্চির টিভি।তার সাথে স্পিকার এবং অন্যান্য সমস্ত আধুনিক সরঞ্জাম। এই ঘরের মেন্টেনেন্স বাবদ যা খরচ তা দিয়ে বোধহয় গ্রামের কয়েক কিলোমিটার কংক্রিটের রাস্তা তৈরি করা যায়।
চেয়ারম্যান সাহেব বিভিন্ন বি.ডি.ও.দের সাথে কথা বলছেন।
একটি আইন ব্লক লেভেল পর্যন্ত কাৰ্যকর করা হয়েছে কিনা সেই নিয়েই আলোচনা চলছে। পাওয়ার পয়েন্টের সাহায্যে একের এক স্লাইডে আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। আলোচনা অবশ্য নামেই, চেয়ারম্যান সাহেবই একতরফা বলে চলেছেন। এস.ডি.ও. সাহেব মাঝে মাঝে মন্তব্য করছেন।
এইরকম ঢাককঢোল পিটিয়ে ইন্সপেকশন করে কী লাভ হয় সেটা হরিপদ বুঝতে পারে না। এ যেন আগে থেকে প্রশ্ন ধরিয়ে পরীক্ষা নেওয়া। এই সব না করে বিনা নোটিসে একাধিক ব্লকে সারপ্রাইজ ভিজিট করলেই তো আসল অবস্থাটা বোঝা যেত।
আড়চোখে চায়ের প্লেটগুলোর দিকে তাকায়। বেশ কিছু প্লেটে কাজুবাদাম, দামী বিস্কুট, প্যাটিসের ভুক্তাবশেষ পড়ে রয়েছে।
কে বলবে সরকারের রাজকোষে মা ভবানীর পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে!
অবশেষে মিটিং শেষ হল। এবারে ইরিগেশন বাংলোয় লাঞ্চ।
“আপনি আমার গাড়িতে আসুন,” চশমা চোখে এক মহিলা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বড়োসাহেবকে ডাকলেন, “আর আপনি পিছনের গাড়িতে।”
চোখের সামনে গাড়িটা ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল। হরিপদ পরের গাড়িতে উঠতে গেল।
“এটাতে উঠবেন না,” একজন সিকিউরিটি রুক্ষস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, “দেখছেন না ম্যাডামের গাড়ি।”
হতভম্ব হরিপদ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর এক সিকিউরিটিকে প্রশ্ন করলো আর কোন গাড়ি ইরিগেশন বাংলোয় যাবে কিনা।
“যা গাড়ি যাওয়ার চলে গেছে,” সিকিউরিটি নির্বিকার ভাবে বলল, “আর কোন গাড়ি যাবে না।”
মোবাইলে বড়োসাহেবকে ধরে সমস্যাটা জানাল।
“কী করি বলুন তো,” বড়োসাহেব জবাব দিলেন, “আমি নিজেও তো অন্য একজনের গাড়িতে যাচ্ছি।”
“আপনার স্টাফকে তো গাড়িতে উঠতে দেখলাম,” পিছন থেকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কথা শোনা গেল।
“ঠিক আছে হরিপদবাবু, আপনি আর দাঁড়িয়ে থেকে কী করবেন বাড়ি চলে যান।”
রাগে মাথায় আগুন জ্বলে গেল হরিপদর। ওই গাড়িতে আরামসে আরও দুজন যেতে পারতো। নিশ্চয় ওই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তাকে বেয়ারা বা আর্দালি ভেবেছে। তাই পাশে বসতে দিতে বোধহয় সম্মানে বাধলো।
সেই সাড়ে ন’টায় খেয়ে বেরিয়েছে। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু খাওয়ার থেকেও বড়ো সমস্যা হল সম্পূর্ণ অচেনা এই জায়গা থেকে বাড়ি ফিরবে কী করে।
লোকজনকে জিজ্ঞেস করতে করতে এগোতে শুরু করল হরিপদ। প্রায় এক মাইল গেলে তবেই মেনরোড। সরু অপরিছন্ন রাস্তা। দুদিকে খোলা নর্দমা। পাঁক জমে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা দোকান রাস্তাটাকে আরও ঘিঞ্জি করে তুলেছে।
এস.ডি.ও. সাহেবের সাজানো চেম্বারটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ওটা ‘ইন্ডিয়া’ আর এটা ‘ভারত’!
সব কিছুরই যেমন শেষ আছে ঠিক তেমনই গোটা দুয়েক বাস পাল্টে হরিপদ যখন বাড়ি ফিরলো তখন সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে যাচ্ছে। জামাকাপড় ছেড়ে স্নান করতে গেল।
স্নান সেরে চিঁড়েভাজা আর চা নিয়ে খেতে বসলো। আঃ, খিদের মুখে এই চিঁড়েভাজা আর চা যেন ইরিগেশন বাংলোয় লাঞ্চের থেকেও ভালো লাগছে।
কষ্টর থেকেও অপমানটা হরিপদর কাছে অসহ্য লাগছে। ওই সরকারী লাঞ্চের থেকে এই চিঁড়েভাজা অনেক বেশি সম্মানের।
হঠাৎই ব্রেকিং নিউজটা চোখে পড়লো। যে অঞ্চলের অফিস থেকে ঘুরে এলো সেখানেই বিষমদ খেয়ে বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যত্রতত্র চোলাই মদ তৈরি হয়। কিন্তু প্রশাসন নির্বিকার। তাদের কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
এর আগেও এই ঘটনা ঘটেছে। তবে এবারে তফাৎ হলো এলাকার মেয়ে বৌরা ঝ্যাঁটা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। একের পর এক মদের ভাঁটি ভেঙ্গে দিচ্ছে। পুলিশগুলো দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে।
এলাকার হোমরাচোমরা নেতারা এস.ডি.ও.র বাপ বাপান্ত করছে। সে সব ‘কথামৃত’ শুনলে কানে আঙ্গুল দিতে হয়।
নামের পাশে শুধু কিছু ইংরাজী অ্যালফাবেট বসানো আছে, মনে মনে ভাবলো হরিপদ, আসলে এই সব সোকলড ব্যুরোক্র্যাটগুলো 'স্পাইনলেস ইনভার্টিব্রেট'।
[সমস্ত ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোন মিল পাওয়া গেলে নিছক সমাপতন বলেই ধরতে হবে।]