রবীন্দ্রনাথের 'ব্রাহ্মণ' কবিতা:
একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়া
ভুবনেশ্বর মন্ডল
রবীন্দ্রনাথ মানবতা ও মনুষ্যত্বের পূজারী। তিনি সর্বপ্রকার গোঁড়ামি, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতা মুক্ত সত্য দ্রষ্টা ঋষি তুল্য। বিশ্বে যখনই যেখানে মানবতা ও মনুষ্যত্বকে লাঞ্ছিত হতে দেখেছেন তখনই তিনি তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি ছিলেন উদার, মুক্তমনা ও গতিশীল মনের অধিকারী। তার 'চিত্রা 'কাব্যের 'ব্রাহ্মণ 'কবিতাটি তার সুউচ্চ মানবতাবাদী দর্শনের আলোকস্তম্ভ। কবিতাটি কবি রচনা করেছিলেন শিলাইদহে ৭ ই ফাল্গুন ১৩০১ বঙ্গাব্দে। কবিতার কাহিনীটি গ্রহণ করেছেন 'ছান্দোগ্য উপনিষদ' থেকে। কবিতাটি সত্য কামের ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের কাহিনী। উপনিষদের কাহিনীটি কে রবীন্দ্রনাথ বিনির্মাণ করেছেন। মানবতাবাদী, যুক্তিবাদী ও গতিশীল মনের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ তার চেতনার জারক রসে কবিতাটি কে জারিত করেছেন। যা প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় একটি বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছে। বর্ণাশ্রম শাসিত প্রাচীন ভারতবর্ষের সমাজ জীবনকে নব রূপে ও নবভাবে বিন্যস্ত করেছেন আধুনিক জীবন চেতনার আলোকে। কবিতাটি আজও প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। এদেশের সমাজ জীবনের গভীরে বর্ণাশ্রমের শিকড় এখনো সম্পূর্ণ ভাবে উৎপাটিত হয়নি। কারণ প্রকৃত শিক্ষার আলোটি এখনো আমরা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দিতে পারিনি। প্রাচীন ভারতবর্ষে সমাজ জীবনে তথা রাষ্ট্র জীবনে একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের। তারাই ছিলেন বর্ণ শ্রেষ্ঠ। এমনকি রাষ্ট্রের রাজশক্তি ও বহু ক্ষেত্রেই তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতেন। শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠের একমাত্র অধিকার ছিল ব্রাহ্মণদের। নিম্ন বর্ণ শূদ্র জাতির তাতে অধিকার ছিল না। শুধু শাস্ত্র গ্রন্থপাঠই নয় প্রায় সকল রকম সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন শূদ্র সম্প্রদায়। ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের জাতি তত্ত্বের অহং, ক্ষমতায়ন এবং উৎকৃষ্টতার কমপ্লেক্স শূদ্র সম্প্রদায়কে ঠেলে দিয়েছিল অপমান ,ঘৃণা ও বঞ্চনার অন্ধকারে। সে যুগে নিম্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের সামাজিক ঊর্ধায়নের কোন সুযোগ ছিল না। জন্মগত বা বংশগত অবস্থান দ্বারাই নির্ণীত হয়ে যেত সামাজিক বৃত্তি ও পেশা। আজ বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও শিক্ষার জোয়ারে সেই সামাজিক সংকীর্ণতার বেড়া প্রায় ভেসে গেছে । পেশা বা বৃত্তি হয়ে গেছে সর্বজনীন। সামর্থ্য ,দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুসারে মানুষ আজ যে কোন বৃত্তি গ্রহণ করতে পারেন বা সামাজিক পদমর্যাদা লাভ করতে পারেন। কিন্তু বেশ কয়েক দশক আগেও আমরা দেখেছি বি আর আম্বেদকার এর মত মহান মানুষকেও প্রথম জীবনে কতটা সামাজিক বঞ্চনা অপমান অবহেলা ও ঘৃণার শিকার হতে হয়েছিল। আম্বেদকারের সময়ও সেই বর্ণাশ্রমের ভূত ছিল। আজও প্রত্যন্ত গ্রাম জীবনে সে ভূত কোথাও কোথাও রয়ে গেছে। আম্বেদকার এসবের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, ভারতীয় সংবিধানে সেই সব অসাম্য দূর করার জন্য নীতি নির্ধারণ করেছিলেন। উপনিষদের সত্যকাম আর এ যুগের আম্বেদকার কোথায় যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। শুধু আম্বেদকার নয়, এরকম ঘটনা বহু মানুষের জীবনে ঘটেছে । আম্বেদকারের জীবনকে কেবলমাত্র একটি দৃষ্টান্তস্থল হিসাবে তুলে ধরা হলো। ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথকেও এই নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা কম লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতে হয়নি। এসবের প্রতিবাদ জানাতে রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হয়েছিল 'অপমানিতে'র মতো কবিতা। রবীন্দ্র সাহিত্যে বহুবার এসেছে প্রথা ও প্রাণের দ্বন্দ্ব । আচারের মরু বালু রাশি, জীর্ণ লোকাচার মানবতা ও মনুষ্যত্বকে যে কতখানি লাঞ্ছিত করে তা রবীন্দ্রনাথ হাড়ে হাড়ে চিনতেন। এইসব সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি ও অমানবিকতার মুখোশ খুলে দিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হয়েছিল 'গোরা'র মতো উপন্যাস। 'গোরা' উপন্যাসের শেষদিকে রবীন্দ্রনাথ যখন গোরার জন্ম রহস্য উন্মোচন করলেন তখন জাত পাত ,ধর্মীয় গোঁড়ামি,আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা , জাতীয়তা সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। একটা পরিচয়ই প্রতিষ্ঠিত হলো বিশ্ব মানবতা। আমরা হয়ে উঠলাম বিশ্ব নাগরিক। সমাজ জীবনের এই সংকীর্ণতা গুলো রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে যেভাবে পীড়া দিয়েছিল তাই বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়েছে তার কাব্য , নাটক, প্রবন্ধও কথা সাহিত্যে । আর এ জন্যই উপনিষদের সত্যকাম কে রবীন্দ্রনাথ তুলে আনলেন আমাদের বিংশ শতকের জীবনে। এ কবিতার অন্দরে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন মানবতা ও মনুষ্যত্বকে। সত্য কাম ছিলেন শূদ্র। শুধু তাই নয় যিনি ছিলেন পতিতা জবালার সন্তান। যে জবালা নিদারুণ দারিদ্র্যের কারণে বহু পুরুষের সঙ্গে সহবাস করেছিলেন। আর সেই সহবাসের ফসল সত্যকাম। তাই সত্যকাম পিতৃ পরিচয়হীন। সমাজের দৃষ্টিতে জারজ সন্তান। এই সত্যকাম ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষালাভের জন্য উপস্থিত হন ঋষি গৌতমের কাছে। কিন্তু গুরু গৌতম স্পষ্টই জানিয়ে দেন যে ব্রাহ্মণ ছাড়া ব্রহ্মবিদ্যা লাভের অধিকার শূদ্রের নেই। তাই সর্বপ্রথম গৌতম জানতে চাইলেন বালক সত্যকামের গোত্র কি। সত্য কাম তার গোত্র জানতেন না । তাই ফিরে গেলেন মাতা জবালার কাছে তার গোত্র জানতে। মা জবালা প্রকৃত সত্যটি জানিয়ে দিলেন সত্য কামকে। তার পিতৃ পরিচয় নেই। সে স্বামী হীনা পতিতার সন্তান। সত্য কাম ফিরে এসে অকপটে দিনের আলোর মত সত্যটি প্রকাশ করলেন ঋষি গৌতম এর কাছে। অন্যান্য বালকেরা যারা ছিলেন গৌতমের শিষ্য তারা সকলেই ঘৃণা ও বিদ্রুপের বাঁকা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন সত্য কামের দিকে। এইসব বালকেরা যেন সমাজের প্রতিনিধি। শূদ্রের স্পর্ধা ও অহংকার দেখে তারা স্তম্ভিত। কিন্তু গুরু গৌতম বালক সত্যকাম কে আলিঙ্গন করলেন। শুধু আলিঙ্গন নয় ,তিনি ঘোষণা করলেন সর্ব সম্মুখে যে সত্যকাম দ্বিজোত্তম। শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। কারণ সে সত্যের পূজারী। অকপটে সত্যকে আলোর মত উজ্জ্বল করে তুলেছে। নিজেকে আড়াল করেনি। মিথ্যার আশ্রয় নেয়নি। এই যে সত্যে স্থির থাকা, এ তো এক প্রকার পূজা। যে বৈশিষ্ট্য বা গুণ একজন ব্রম্ভজ্ঞ মানুষের থাকে। ইংরেজ কবি বলেছিলেন "truth is beauty beauty is truth"অর্থাৎ সত্যই সুন্দর, আর সুন্দরই সত্য। এই সত্য পূজায় ও সত্য রক্ষায় সত্যকাম ব্রাহ্মণের থেকেও ব্রাহ্মণ। গুরু গৌতম বুঝেছিলেন জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। কর্মের গুণেই মানুষ দেবত্বে উন্নীত হয়। এভাবেই সে ব্রাহ্মণত্ব অর্জন করে। ব্রাহ্মণত্ব কোন পোশাক নয়, কোন উত্তরাধিকার নয়, এটি হলো জীবন সাধনা লব্ধ অর্জিত সম্পদ। সেই সম্পদ সত্য কামের অন্তরে ছিল। তাই মহান গুরু ঋষি গৌতম চেতনার আলো জ্বেলে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ সত্যকামের আরতি করলেন। এখানে একটা কথা বলা দরকার যে গুরু গৌতম ব্রাহ্মণ সমাজের প্রতিনিধি হয়েও শূদ্র সত্যকাম কে যে উদার মানবিকতায় ব্রাহ্মণের মর্যাদা দিলেন তা কিন্তু সে যুগের পক্ষে বিস্ময়কর। ঋষি গৌতমের চেতনা এখানে কালের অগ্রগামী। নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও প্রচলিত ব্রাহ্মণত্বের গোঁড়ামির ভূত কে ঝেড়ে ফেললেন দুঃসাহসিকভাবে। উদার মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ 'ছান্দোগ্য উপনিষদে'র হীরক খন্ডটি তুলে আনলেন বিংশ শতকের পৃথিবীর চোখের সামনে। তাকে নবরূপে নবভাবে সঞ্জীবিত করলেন আমাদের জীবনে। বর্ণাশ্রম নামক 'কর্তার ভূত'টিকে বিদায় দেওয়া যে কতখানি দরকার তা দেখালেন ব্রাহ্মণ কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে ।আর তার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করলেন মানবতা ও মনুষ্যত্বের জীবন্ত বিগ্রহটিকে।
_________________________
ভুবনেশ্বর মন্ডল
সাঁইথিয়া লেবু বাগান
পোস্ট-সাইথিয়া
জেলা-বীরভূম
পিন নাম্বার-৭৩১২৩৪