শিকড়ের সন্ধানে : খড়ি নদীর তীরে
বারিদ বরন গুপ্ত
কথায় বলে মা মাটি মানুষ, জানো পাড়া গ্রামের গন্ধ মাখানো আবেগ অনুভূতি, যা কোনদিন হারিয়ে যায় না, বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে যায় শৈশবের আলো মাখা অকৃত্রিম ভালোবাসার দিনগুলোকে, সেই মেঠো আল পথ, ক্লান্ত দুপুর বা অশান্ত বিকেল, নদ-নদী নালা খাল বিল গাছপালা, সবই টানে পড়ন্ত বিকেল বেলা! একসময় আমরা নগরজীবনের আকর্ষণে পা রাখি শহুরে ব্যস্ততার সাম্রাজ্যে, সেখানে কোনো ফুরসত নেই, অনাবিল আনন্দ নেই,শুধু কাজ আর কাজ! কাজে হারিয়ে যাও, টাকা পয়সা নাম অর্থ যশ শুধু কিনে বেড়াও। কিন্তু একসময় এগুলোও ফিকে হয়ে যায়, মন বিদ্রোহ করে, একটু আলো মাখতে চায়, একটু হাঁফ ছাড়তে চায়, মন যেন সেই সকালের দেখা, কাদামাখা মানুষগুলোর সাথে হারিয়ে যেতে চায়! জীবন সায়াহ্নে জীবনের খোঁজে কেউ কেউ পেয়েও যায় সেই অনাবিল আনন্দ অনুভূতি, যার কোন ব্যাখ্যা মেলেনা, মেলে শুধু বাঁচার রসদ! একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচা!
এক বছর অতিক্রান্ত হল গবেষণার কাজে নদী-নালা, খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, দেবালয়, পরিত্যক্ত মন্দির, রাজবাড়ী, জমিদার বাড়ির ভগ্ন স্তুপ, জমিদারির অন্দরমহল ঘুরেছি, শুধু তাই নয়, মাঠে মাঠে ঘুরেছি, ঘামঝরা কৃষকের সাথে দেখা করেছি, নদীর ধারে আঁশটে গন্ধ মাখা জেলেদের সাথে মিশে গেছি, তাদের অভাব অভিযোগ শুনেছি! নদীর ঘাটে ঘাটে ঘুরেছি, দেখেছি মাঝিরা উদাস নয়নে তাকিয়ে, হয়তো খড়ি নদীর অতীতকে খুঁজছে, তাদের সাথে হারিয়ে গেছি সেই পাল তোলা যুগের প্রান চঞ্চল জীবনধারার এক রক্তিম আবেশে, কি ছিল নদীর রুপ? কি ছিল নদীর গতি? বর্তমানের আয়নায় মুখ রেখে অতীতকে খোঁজার চেষ্টা করেছি, সবকিছু আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। দুঃখ বেদনা মেপেছি ,দীর্ঘশ্বাস খুঁজেছি! হারিয়ে গেছি তাদের সাথে, সে ছিল একদিন -- ভালোবাসা, আবেগ অনুভূতি, অন্তর সবই ছিল রাশি রাশি, আজকে যেন ধূসর মরুভূমি!
এই কাজের সূত্রে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, অনেক সময় তাদের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় হারিয়ে যায় অনাবিল আনন্দের দেশে, এই সর্বগ্ৰাসী, শোষণকারী স্বার্থপর দুনিয়ার নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে ক্ষণিকের আনন্দে ভেসে যাই সেই সহজ সরল সাদাসিধে মানুষের সাথে। এখনো জীবন আছে, মাঝে মাঝে মাছের মত ভেসে ওঠে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস ছাড়ে, তারপর হঠাৎ আতঙ্কে ডুবে যায় সেই পাতাল পুরীর দেশে।
আমার গবেষণার বেশিরভাগই তথ্য দাতা সত্তরোর্ধ্ব সেকালের মানুষ! তাদের জীবনে চাওয়া পাওয়ার অংকটা কম ছিল! প্রতিযোগিতা ও ছিল, তবে সহযোগিতাই বেশি ছিল, এরা Rat race কে জীবনক্ষয়ী সংগ্রাম বলে মনে করেন! জীবনের সুখ-শান্তি আনন্দ অনুভুতি সব ক্ষুয়ে যেন আজ মানুষ একটা মেশিনে পরিণত হয়েছে বলে জানান! নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের দুঃখ বেদনা গুলো মেপেছি! বর্তমান প্রজন্মের সাথে তারা ঠিক নিজেকে মেলাতে পারছে না, বারে বারে হোঁচট খাচ্ছে, হাত পা ছিড়ে যাচ্ছে তবুও বেঁচে আছে, জীবনে বাঁচতে গেলেতো এডাপটেশন, কম্প্রোমাইজ তো করতেই হয়! সেটা হয়তো রপ্ত করে ফেলেছেন কেউ কেউ, আর যারা পারছেন না তারা উদাস উদভ্রান্তে খুঁজে বেড়াচ্ছেন অনাবিল আনন্দের দেশ, শিকড়ের সন্ধানে মাটির টানে তাই বারে বারে ছুটে আসছেন সেই হারিয়ে যাওয়া দেশের উৎস সন্ধানে!
এই সেদিন খড়ি নদীর তীরে এক প্রাচীনকালের কালীপুজোর উৎস সন্ধানে দেখা হয়ে গেল এক প্রবীণ অধ্যাপক এর সঙ্গে, ভদ্রলোক একসময় কলকাতার সিটি কলেজে জীব বিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন, অতি সম্প্রতি অবসর জীবনযাপন করছেন! এক সময় গ্রামের আলোমাখা জীবনের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে উচ্চশিক্ষা এবং কর্মজীবনের খোঁজে ঘাঁটি গেড়েছিলেন শহরে! জীবনের সিংহভাগ ইট কাঠ পাথরের ঘেরা নিরস কর্কশ জীবন কাটালেন! ছেলেরা উচ্চশিক্ষিত, নিজে নিজে কর্ম জগতে বিচরণ করছেন, আর এই অবসর উদাসী জীবন তাকে আর শহর টানতে পারছে না। বারে বারে মন বিদ্রোহ করে, তাই ইট কাঠ পাথর ছেড়ে, ছুটে আসেন আল পথ ধরে! খুঁজে বেড়ান সেই কাদামাখা সহজ-সরল জীবনের খোঁজে!
কিন্তু আজ এখানেও শান্তি নেই, গ্রাম উঠে গেছে শহরে, এখানকার মানুষও স্বার্থের দুনিয়া খোঁজে! সামাজিক সম্পর্কের এক নতুন সংজ্ঞা দিতে চাইছে, চাচা আপন প্রাণ বাঁচা, প্রয়োজনে সম্পর্ক, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে দরজা বন্ধ করে দাও! এতদিন ডক্টর পাল উদ্ভিদ রাজ্যে বিচরণ করেছেন, আজকে প্রানী রাজ্যের নতুন সামাজিক বিন্যাস তাকে বড়ই পীড়িত করে! আজ শারদ প্রভাতে ডক্টর পালের সাথে হারিয়ে গেলাম, সেই উদ্ভিদ রাজ্যে, সেই বনের যুগে মনগুলো ছিল ভালো! এখনো ছিটে- ফোটা দু-একটা প্রাচীন বৃক্ষের দেখা মেলে, মন খুলে গল্পগুলো উঠে আসে, সেই আশাতেই মাটির টানে বারে বারে ফিরে আসা এই বাংলার কোলে, তাই আসুন ডক্টর পাল, খড়ি নদীর তীরে, আজ অনেকটাই সভ্যতার গ্ৰাসে, তবুও শিখে ফোঁটা দু একটা আছে সেই শিকড়ের টানেই বারে বারে ফিরে আসুন! দেখুন এখনো দু-একটা প্রাচীন বৃক্ষ আছে, ওর তলাতেই একটু হাঁফ নিন!!
=======================
লেখক পরিচিতি::
বারিদ বরন গুপ্ত, কবি লেখক প্রাবন্ধিক, সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন, পূর্ব বর্ধমান জেলার মন্তেশ্বরের এই লেখক বর্তমানে নদ নদী এবং সমাজ জীবনে তার প্রভাব, বর্তমানে নদনদীর গুরুত্ব, নদীকে কিভাবে তার জীবনধারায় ফিরিয়ে দেওয়া যায় ইত্যাদি বিষয় গবেষণামূলক কাজে দীর্ঘদিন যুক্ত আছেন।