অঙ্কিতা পাল
সন্ধ্যায় সূর্য যখন পশ্চিম আকাশের কোলে ঢোলে পরলো, তখন সোনাঝুড়ি গায়ের ছোট্ট মেয়ে রকেয়া অধীর আগ্রহে তার আম্মার পথ চেয়ে বসে আছে। আম্মা রুবিনা এই ট্রেনে ওই ট্রেনে, এই ইস্টিশনে ওই ইস্টিশনে, এখানে-ওখানে ধূপকাঠি ফেরি করে বিক্রি করে।
রকেয়ার আব্বু আবু হোসেন তিন ছেলে-মেয়েসহ রুবিনাকে ত্যাগ দিয়ে ভিন গায়ে বিয়ে করে। তারপর থেকেই দারিদ্রতাকে সাক্ষী রেখে পেট চালানোর জন্য তাঁকে ফেরি করতে হয়। রুবিনা রোজ সকাল দশটায় ইস্টিশানে চলে যায় এবং বাড়ি ফেরে সেই বিকালে।
কিন্তু আজ এখনো বাড়ি ফেরেনি সেজন্য তার বড় মেয়ে রকেয়া তারই অপেক্ষায়। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি হয়ে গেছে, কিন্তু মেয়ের চিন্তা একটুও কমেনি। সে দেখছে _ কেউ যেন ছোট ছোট আলো জ্বালিয়ে দূর থেকে চাদরে মোড়া কিছু নিয়ে আসছে।
দূরের সেই ছোট্ট আলোগুলো যখন কাছাকাছি তাদের ভাঙা ঘরের দিকে আসতে থাকে, তখন রকেয়া দেখে চাদরে জড়ানো তার মায়ের লাশ। সেই লাশ রাখা হলো তাদের ঘরের সামনে, আল্লার কি নিষ্ঠুর বিচার, রুবিনা গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারায়। আশ্চর্যের বিষয় রুবিনার রক্তাক্ত লাশ দেখার পরেও তার দশ বছরের ছোট মেয়ে রকেয়ার চোখে পানি নেই, সে ভাই-বোনকে বুকে জড়িয়ে আমি সমুখে প্রতিজ্ঞা করল _ আম্মু, আজ থেকে রহিম ও রুণার দায়িত্ব আমার। তাদের আমি মানুষের মত মানুষ করে লেখা পড়া শেখাবো। ছোট্ট রকেয়ার এই শপথে খুশি হয়ে গ্রামের স্বনামধন্য গৌতম হালদার তাকে ওনার বাড়ীতে কাজের সুযোগ করে দেন। রকেয়া ধীরে ধীরে গৌতম বাবুর বাড়ির লোকের মত হয়ে ওঠে, সে তার ভাই-বোনকে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি করে দেয় এবং মাইনের টাকা জমিয়ে বাড়িটা সুন্দর করে মেরামত করে।
রকেয়ার ভাইবোন ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠে, তারা আম্মির মতো করে দিদিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে। এভাবে কেটে গেল কিছু বছর, রকেয়া এখন একটি বড় বাড়িতে ভালো মাইনের কাজ পেয়েছে, কিন্তু গায়ের অনেক লোকের রকেয়ার মতো সাধারণ একটি মেয়ের উন্নতি সহ্য হলো না। তারা আস্তে আস্তে রুনাও রহিমের মনে বিষ ঢালছে লাগলো। রকেয়া একদিন কাজ সেরে রাতে শুতে যাবে, এমন সময় রুনা বলে _ আপু কিছু টাকা দে, রকেয়া তার ছোটবোন রুনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে _ কি হবে? অমনি রুনা নাক মুখ শিটকে ঝাঝি মেরে বলে _ তা জেনে তোর লাভ কি? মূর্খ কোথাকার। ছোট বোনের এই আচরণ দিদির মনে কষ্ট দেয়, সে তখন একটা ভাঙা কৌটো থেকে একশো টাকা বের করে রুনাকে দিতে যাবে এমন সময় রহিম কৌটোটা কেড়ে নিয়ে রকেয়াকে জোরে চড় মারে। তারপর রেগে গিয়ে চোখ লাল করে বলে _ জোচ্চোর কোথাকার। শালা পাচশো টাকা থাকতে দিচ্ছে একশো। আমাদের দিলে কি শয়তানের কম পড়বে।
ছোট ভাই রহিমের এই আঘাত সহ্য করতে না পেরে সেইরাতে রোকিয়া গৃহত্যাগী হয়। মাঝরাতে ছুটতে ছুটতে ইস্টিশানে রাতের ট্রেন ধরে কলকাতায় পৌঁছোয়। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে রকেয়া বালিগঞ্জের এক বাবুর বাড়িতে রান্নার কাজ করে। সেখানকার বস্তির একটা ছোট্ট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে রকেয়া। এভাবে দিনের পর দিন কেটে যায়, ভাই-বোন কেউ খোঁজ নিতে আসে না একটিবার। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে একদিন সে রাস্তার পাশে একটা গাছের তলায় বসে থাকে কত গাড়ি যায় গত ঘোরা যায়; মনে পড়ে যায় সেই পুরানো স্মৃতি। আম্মার মৃত্যুর পর সে কিভাবে ভাইবোনদের আগলে মানুষ করেছে। অভাবের তাড়নায় কতইনা ঝড়-ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে তাকে। সে মনে মনে ভাবে এই বুঝি রুনা এলো রহিম এলো দেখা করতে।
অনেক অপেক্ষার পর সে আবার দিনের শেষে ঘরে ফেরে, নতুন দিন আসে আর কাজ শুরু হয় তার। একদিন সে রাতের বেলায় কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছে, হঠাৎ দেখে এক মহিলার রাস্তায় পড়ে আছে কিছু লোকজন জমায়েত হয়েছে। সবাই তাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত সেজন্য কৌতূহল বসত রকেয়া দেখতে এলো।
ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, রকেয়া হতভম্ব হয়ে যায় বলে_ হায় আল্লা, এ যে রুনা বেটি। সে তড়িঘড়ি করে রুনাকে রাস্তা থেকে তুলে বালিগঞ্জের ছোট্ট বস্তির ঘরে নিয়ে এলো। রুনা নিজের ভুল বুঝতে পেরে খুব কান্নাকাটি করে দিদির কাছে ক্ষমা চায় বলে _ আপু আমাকে ক্ষমা করে দিস।
রুনা কাঁদতে কাঁদতে আর ও বলতে থাকে_ ভাই রহিম নগেন গুন্ডার সাথে পরিকল্পনা করে আমার ক্ষতি চেয়েছে। সেজন্য আমি পালিয়ে এসেছি।
সবকিছু শুনে রকেয়া তার মালিকের সাহায্যে ও আইনি ব্যবস্থা নিয়ে সোনাঝুড়ি গায়ে যায় নগেন গুন্ডাকে শাস্তি দিতে, নগেন ঘোষকে পুলিশ অবিলম্বে গ্রেফতার করে। রকেয়ার ভাই রহিমের যথাযথ শাস্তি হয়, সে সমস্ত অন্যায় স্বীকার করে। তারপর রকেয়া তিন ভাই-বোন সহ সোনাঝুড়ি গায়ের ছোট্ট ঘরে নতুন করে থাকতে শুরু করে।
-------------
ছবি ঋণ- ইন্টারনেট