কীটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ এবং জীবনানন্দ দাশ
সৌম্য ঘোষ
কীটস সৌন্দর্যের পুজারি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রকৃতির কবি। ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতায় নির্মাণ ও পুনঃনির্মাণ। শেলী সংস্কার করতে চেয়েছেন। বায়রন নিজের স্বর উচ্চকিত রেখেছেন; রাজনৈতিক অসন্তোষ তুলে ধরেছেন। কীটস ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ সিমিলি ব্যবহারে পারদর্শী ছিলেন। এই দুই জনের মহাসঙ্গমে জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় আলংকারিক প্রয়োগ , চিত্রকল্প নির্মাণে মুন্সিয়ানা লক্ষ্যণীয়। কীটস ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ দুজন কবির মতোই জীবনানন্দ দাশের 'সেন্স ডেভলপিং' ক্ষমতা অসাধারণ। আর পরাবাস্তবতার প্রয়োগ। সৌন্দর্যতত্ত্বও রয়েছে। অপার মহিমার প্রকৃতি ধরা দিয়েছে জীবনের কবিতায়। দেখা যায়, তাঁর কবিতায় দ্বিমুখী বোধ সক্রিয়। দৃশ্য ও মনোজগত- দ্বিমুখীবোধ জাগ্রত। সব মিলিয়ে চিত্রকল্প নির্মাণে অনন্য স্তরে জীবনানন্দ দাশ। চিত্রকল্প নির্মাণে কবি জীবনানন্দ দাশের পঞ্চইন্দ্রিয় সতত ও সমভাবে সক্রিয়। sense of sight, sense of touch, sense of smell, sense of hearing, sense of taste সক্রিয় করেই চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন তিনি। তাঁর বোধশক্তি লক্ষ্যণীয়।
Sense of hearing, taste, sight, colourপ্রভৃতি ইন্দ্রিয়জাত অনুভতি, জীবনানন্দ দাশের মধ্যে প্রবল। এমন সব চিত্রকল্প নির্মাণ তাঁর কবিতায় আমরা পাই। তিনি বলতেন, 'উপমাই কবিত্ব'। চিত্রকল্প ছাড়া আধুনিক কবিতা হয় না। অজস্র চিত্রকল্প সৃষ্টি করেছেন তিনি। ইংরেজি সাহিত্যের চিত্রকল্পের সেরা কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও জন কিটস; তেমনই বাংলা সাহিত্যে চিত্রকল্পনির্মাণের সেরা কবি জীবনানন্দ দাশ বলেই আমার মনে হয়। তিনি দেশজ বা লৌকিক উপাদান ব্যবহার করেছেন। লৌকিক উপাদান ব্যবহার করলেও সময়ের বাঁধনে বন্দী ছিলেন না। সার্বকালীন হয়েছেন। সময়োত্তীর্ণ হয়েছেন; পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে গেছেন।
নন্দনতত্ত্ব দর্শনের একটি শাখা। এখানে সৌন্দর্য, শিল্প, স্বাদ এবং সৌন্দর্য সৃষ্টি ও উপভোগ নিয়ে চর্চা হয়। নন্দনতত্ত্বে মানুষের সংবেদনশীলতা ও আবেগের মূল্য এবং অনুভূতি ও স্বাদের বিচার নিয়ে অনুশীলন করে। বোদ্ধাগণ বলেন, নন্দনতত্ত্ব শিল্প, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতি নিয়ে সূক্ষ্ণ ও সমালোচনামূলকভাবে আলোচনা করে। জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়লে পাঠকের নিকট এসব বিষয় সহজেই ধরা দেবে। পাঠক রসাস্বাদন করে বহুমাত্রিক তৃপ্তি পায়। 'মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য', 'সোনালি ডানার চিল', প্রভৃতি উপমা-অলংকার-চিত্রকল্পের ব্যবহার ও নির্মাণ কবির সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হয়েছে। 'আর্টস ই শিল্প' অন্যতম এ তত্ত্ব মুখ্য হয়ে উঠেছে কিনা তা আলোচনার দাবি রাখে।
'...কামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে-আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে'-
(আকাশে সাতটি তারা)।
চিত্রকল্পনির্মাণে যেন ----
'A rosy sanctuary will I dress' ('Ode to Psyche' : Keats)
কিটসের Fragrant bodice, warmed jewels, wooing sun, rich attire, Weeping cloud, whisp'ring roof, droop-headed flowers, mossay nest, bee-hive casts its swarm, bedded grass, dream and so dream all night without astir(Hyperion), soft-dying day প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করেছেন। এইগুলির sensous appeal দারুণ।
কিটসের সৌন্দর্যমাখা আর ওয়ার্ডসওয়ার্থের প্রকৃতিবর্ণনা ধরা দেয় জীবনানন্দের কবিতায়। জন কিটস লিখেছেন,
"O! Let me have thee whole, all, all be mine!
That shape, that fairness, that sweet minor zest
Of love, your kiss; those hands, those eyes divine,
That warm, while, lucent, million-pleasured breast"
('I Cry Your Mercy' : Keats)
জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' বা 'শ্যামলী' কবিতায় -----
(১) 'চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের 'পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
..সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।'---(বনলতা সেন)
(২)
'শ্যামলী, তোমার মুখ সেকালের শক্তির মতন:
যখন জাহাজে চড়ে যুবকের দল....
তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনও
আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রে নীল,
দুপূরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা,
বিকেলের উপকন্ঠে সাগরের চিল,
নক্ষত্র, রাত্রির জল যুবাদের ক্রন্দন সব
শ্যামলী, করেছি অনুভব।'-----
(শ্যামলী)
'The boisterous, mid-night, festive clarion,
The kettle-drum, and far-heard clarionet
('The Eve of St. Anes' : Keats) কিটসের hearing sense ভালো। কিটসের পর্যবেক্ষণক্ষমতাও অত্যন্ত শক্তিশালী। যুৎসই উপমা ও অলংকার ব্যবহার করে নিখুঁতভাবে চিত্রকল্পনির্মাণ তারই প্রমাণ করে। যেমন-
(1)
'The clouds were pure and white as flocks new-shorn,
And fresh from the clear brook;sweety they slept
On the blue fields of heaven, and then there crept
A little noiseless noise amobg the leaves
Born of the very sigh that silence heaves
('I Stood Tiptoea' : Keats)
(2)
'Thou shalt see the field-mouse peep
Meagre from its called sleep,
And the snake all winter-thin
Cast on sunny bank its skin:
Freckled nest-eggs thou shalt see
Haching in the hawthorn tree...('In Fancy' : Keats)
(3)
'In deepest grass, beneath the whisp' ring roof
Of leaves and trembled blissoms, where there ran
A brooklet scarce espied:
('Ode to Psyche')
(4)
'As late I rambled in the happy fields,
What time the skylark shakes the tremulous dew
From his lush clover covert
('To Charles Wells'), rose-bloom fell on her hands
('The Eve of St. Agnes')
কিটসের 'A bright torch, and a casement ope at night,
To let the warm Love in!'---
('Ode to Psyche')--- যেন জীবনানন্দের:
'একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা
...তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের পরে আমাদের বিকেলের রক্তিম বিন্যাস;
তোমার বুকের পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।'---- (তোমাকে)
"Nature for nature's own sake"-- ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। প্রকৃতিকে সৌন্দর্য মাখিয়ে আনন্দ দিতে পটু তিনি। নৈতিকতা জাগ্রত করতে পারঙ্গম। যেমন-"Nature for nature's own sake" এমন সব চিত্রকল্প মনকে অস্থির করতে সক্ষম। চিত্রকল্প নির্মাণে জীবনানন্দ দাশও সিদ্ধহস্ত। তাঁর বোধশক্তিও লক্ষ্যণীয়।
অঘ্রান-কার্তিক কবির প্রিয় সময়। বিভিন্ন উপকরণে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে বিভিন্নরূপে। চিল-হরিণ-জোনাকি-বেড়াল-বাদুড়, চাঁদ-নক্ষত্র-আকাশ-সাগর-নদী, ডানা-লতা-ঠাং-শরীর-পালক, ঘ্রাণ-ঘুম-নির্জনতা, হিজল-ঝাউবন,লেবু-আমলকি-দেবদারু,পাতা-ঘাস-ধান,বালি-শিশির- হাওয়া-রোদ-জ্যোৎস্না, ঝড় ঢেউ,নীল-সবুজ হলুদ, মুখোমুখি-স্তব্ধতা-অন্ধকার-নগ্ন-শাঁই শাঁই শব্দ, রূপালি ইত্যাদি ধরা দিয়েছে জীবনানন্দের কবিতাগুলোতে। এসব শব্দাবলি ও এরকমই একার্থক শব্দাবলির বারংবার ব্যবহার লক্ষ্য যায়। এগুলো প্রতীকী হিসাবেও ধরে নেওয়া যায়। নগ্ন, অন্ধকার যেমন হতাশার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে তেমনই হিজল-ঝাউবন প্রকৃতি বা সৌন্দর্যের প্রতিনিধি। আবার স্ফটিক, নীল আকাশ ইত্যাদি জীবন-মনের উদারতা ও উজ্জ্বল্য প্রকাশিত হয়েছে।
কবিতা এক বিরাট শিল্প। কবিতাকে শিল্পিতরূপ দেওয়ার ওপর কবির সার্থকতা নির্ভরশীল। কীটস ও ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে শিল্পগুণে উত্তীর্ণ করেছেন। আবার জনপ্রিয়তার শীর্ষেও উঠেছেন। বিশ্বব্যাপী এই দুই কবির বিরাট পাঠকগোষ্ঠী রয়েছেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রাপ্যমর্যাদা পাননি। এখন তাঁকে নিয়ে ব্যাপক ইতিবাচক আলোচনা চলছে। কিন্তু বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা খুব কমই হয়। অনুবাদও কম হচ্ছে। বিশ্বসাহিত্যে জীবনানন্দ দাশের কবিতা ভালো মর্যাদা পেতে পারে; তেমন গুণ তাঁর কবিতায় রয়েছে। তাঁকে নিয়ে আলোচনা ও কবিতার অনুবাদ বেশি বেশি করতে পারলে বাংলা সাহিত্যই বেশি লাভবান হবে বলে মনে হয়। কীটস ও ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতার চেয়ে জীবনান্দেরর কবিতা কোনও অংশে কম শিল্পিত নয়।
______________________________
____ সৌম্য ঘোষ।
পোঃ চুঁচুড়া। জেলা: হুগলী।
_______________________________
------------------------------------------------