বাংলা ভাষায় রহস্য, রোমাঞ্চ বা অলৌকিক কাহিনীর জগতে এখন সবচেয়ে আলোচিত নাম হল হিমানী সেনগুপ্ত। এবারই একচল্লিশে পা রেখেছেন. এখনো অবিবাহিতা, অসম্ভব সুন্দরী এবং ভীষণ আধুনিকা শান্ত চেহারার এই ভদ্র মহিলা। হিমানী পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির থেকেও একটু বেশি লম্বা। গায়ের রঙ দুধে আলতা বললেও কম বলা হবে। চাকরি করে কলকাতার আমেরিকান লাইব্রেরীতে। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত অফিস করে ওর কলেজ রোঁর ফ্ল্যাটে ফেরেন সাতটার সময়। সকালে রাঁধুনির রান্না করা খাবার গরম করে রাতে খেয়ে নেন। তবে ডিনারের আগে হিমানীর কমপক্ষে তিন পেগ হুইস্কি না খেলে চলে না।
এদিকে রোজই ওর ফ্ল্যাটে সন্ধ্যা বেলা বসে মহিলাদের আড্ডা। সাড়ে সাতটা বাজল তো আসে পাশের বা উপর নিচের ফ্ল্যাটের প্রায় দশজন মহিলা এসে হাজির হবে ওর ফ্ল্যাটে, রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত ঘড়ি ধরে দুই ঘণ্টা ওদের আড্ডা চলবে। মাঝে চলবে চা সিঙ্গারা তেলে ভাজা বা অন্য কোন স্নাক্সের অঢেল ব্যাবস্থা। সেটাও একেকদিন একেকজন মহিলা নিয়ে আসে। হাসি ঠাট্টা গল্প আর পি এন পি শি করে আড্ডা ছাড়াও রাজনীতি, খেলা ধুলা, সীনেমা বা নাটক সব বিষয়েই চর্চা চলে। শুধু লেখা নিয়ে নয়। সবাই জানে যে হীমানি একজন নামকরা রহস্য গল্পের অনেক পুরস্কার প্রাপ্ত স্বনামধন্য লেখিকা। তাই ওর সামনে লেখার ব্যাপারে কেউ মুখ খুলবার সাহস দেখায় না। হিমানী নিজেও সেটা পছন্দ করে না। কিন্ত সবাই একটা জিনিষ ভেবে পায়না হিমানী লিখবার সময়টা পায় কখন ?
তার কারণ রোজ খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পাঁচটা কুড়ি মিনিটে হিমানী জগিং করবার ড্রেস পরে সামনের পার্কে চলে যায় আর পাক্কা একঘণ্টা জগিং করে এক্সারসাইস করে বাড়ি ফেরে সাড়ে ছটা নাগাদ। এরপর নাকি হিমানী সরবত খেয়ে স্নান করে রেডি হতে থাকে। ওর রান্নার ও কাজের লোক দুজনেই ফ্ল্যাটে ঢোকে বেলা সাড়ে সাতটার সময়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে সেই সময় হিমানী ড্রয়িং রুমে বসে খবরের কাগজ পড়ে আর চা খায়। কাজের মহিলা দুজন কাজ করে চলে যায় বেলা নটায়। এরপর হিমানী টিফিন খেয়ে নিজের লাল রঙের হুন্ডাই আই টেন গাড়ি নিয়ে অফিস চলে যায়। হিমানী নিজেই গাড়ি চালায়। ওর কোন ড্রাইভার নেই। আজ আট বছর যাবত এই আবাসনের সবাই হিমানীর এই একই রুটিন দেখে আসছে। হিমানী আগে নাকি জামশেদপুরে থাকত, রিটায়ার্ড বাবা ও মা মারা যাবার পর ও কলকাতায় চলে আসে।
চার তলাতেই হিমানীর পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মিসেস বোস। ওর অবিবাহিত ভাই কল্লোল আমেরিকা থেকে ফিরে দিদির সাথেই থাকে। মা বাবা নেই, দিদিই ওর কাছে সব। চাকরি করে একটা টেলিকম কোম্পানিতে। রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের একনিষ্ঠ পাঠক ও হিমানীর লেখার ভীষণ ভক্ত। দিদির কাছে রোজই খাবার টেবিলে হিমানীর গল্প শোনে কোল্লোল, কিন্তু এই দেড় বছরে ওর সাথে কল্লোলের আলাপ হয়ে ওঠে নি। কল্লোলের বয়স এখন চল্লিশ, আমেরিকায় একজন বিদেশিনীর সাথে লিভ ইন করত, কিন্তু ওদের ছাড়াছাড়ি হবার পর কল্লোল ভগ্ন হৃদয়ে দেশে ফিরে আসে।
এক রাতে দিদির মুখেই কল্লোল জানতে পারল হিমানীর রোজকার ছকে বাঁধা রুটিন করা জীবনের কথা। দিদিরা সবাই নাকি এটা বুঝে উঠতে পারে না যে মহিলা এসব লেখে কখন ?
কল্লোল সেই রাতে সারারাত ভাবল কথাটা নিয়ে। সত্যিই তো, এটা তো ভাববার বিষয়। মহিলা তাহলে লেখেন কখন ? এতো বড় বড় উপন্যাস, গল্প এসব লিখতে তো যথেষ্ট সময় লাগে। অথচ ওর একটার পর একটা বই, লেখা বের হয়ে চলেছে। কত আলোচনা, সমালোচনা, পুরস্কার মাতামাতি ওকে নিয়ে। কিন্তু মহিলার চালচলন সেই যে কে সেই আছে। একমাত্র পুরস্কার বিতরনের বা কোন সম্মান প্রদানের বা টি ভি ইণ্টারভিউয়ের দিন হিমানী আড্ডায় থাকতে পারে না। বন্ধুদের আগের দিনই জানিয়ে রাখে যে ও কাল থাকতে পারবে না।
হিমানী সেদিন দিল্লীতে একটা মঞ্চে সম্মানিত হবার জন্য সকালের ফ্লাইটে দিল্লী গেল আর বলে গেল রাতে ফিরবে। বোস গিন্নির হাতে ফ্ল্যাটের চাবীটা রেখে গেল কারণ ওর এ সি মেকানিক আজ আসবার কথা আছে। হিমানী নাকি তাকে পাশের ফ্ল্যাটে চাবী থাকবে বলে দিয়েছে। সকাল নটা পাঁচের ফ্লাইট ধরবার জন্য বেলা পৌনে সাতটায় বেরিয়ে যায় হিমানী।
কল্লোল আর অফিসে গেলো না। হিমানীর মেকানিক এসে বেলা এগারোটা নাগাদ এ সি ঠিক করে দিয়ে গেল। দিদির কাছ থেকে চাবী নিয়ে কল্লোল আর ওর ভাগ্নে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাজ করা দেখে আধঘণ্টা বাদে ওকে বিদায় করল। এরপর কল্লোল দশ বছরের ভাগ্নে ছোটকাকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে বলল,'তুই ঘরে যা, আমি একটু বাদে আসছি। একবার চেক করে দেখি এ সিটা কাজ করছে কিনা।' হিমানীর ফ্ল্যাট ভিতর থেকে আটকে দিলো কল্লোল।
কল্লোল হিমানীর বেডরুমে একটা স্পাই ক্যামেরা ফিট করে দেয়। আর ক্যামেরাটা এমন জায়গায় লাগায় যাতে ওটা চোখেও না পড়ে অথচ হিমানীর লিখবার টেবিল পরিস্কার দেখা যায়। স্পাই ক্যামটা একটা জামার বোতামের মত ছোট এবং গোপন জায়গায় লাগালে কেউ ধরতে পারবে না, যদি না সন্দেহ হয় আর মোবাইল ফোনে স্পাই ক্যাম ডিটেক্ট করবার পদ্ধতি জানা না থাকে। রাতে হিমানী ফিরে এসে বোস বৌদির কাছ থেকে ফ্ল্যাটের চাবী নিয়ে ঘরে ঢুকে যায় ও ক্লান্ত শরীরটা নিশ্চিন্তে বিছানায় ফেলে দেয়।
ঘরে বসে দরজা আটকে কল্লোল কিন্তু ল্যাপটপে হিমানীর বেডরুমে রাখা টেবিলটার ওপর নজর রাখছিল। দেখল হিমানী অন্য ধারে দাঁড়িয়ে ড্রেস চেঞ্জ করল, বাথরুমে গেল আর একটা নাইটি পরে গিয়ে বছানায় শুয়ে পড়ল। কল্লোল বুঝতে পারল আজ হিমানী আর হয়ত লিখতে বসবে না। কল্লোল নিজেও শুয়ে পড়ল।
পরদিন রাতে কল্লোল নিজের বন্ধ ঘর থেকে আবার ওর ল্যাপটপে স্পাই ক্যাম কানেক্ট করে দেখতে পেল আজ হিমানী একটা অদ্ভুত আচরণ করল। রাত দশটায় সামনের ডাইনিং রুম থেকে ডিনার সেরে এসে হিমানী টেবিলে রাখা ওর ল্যাপটপটা ওপেন করে একটা ওয়ার্ড ফাইল খুলে ঘরের বড় লাইট নিভিয়ে নীল আলোটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়ল। কল্লোল ভাবল হয়ত একটু বাদে উঠে হিমানী লিখতে বসবে। কিন্তু প্রায় একঘণ্টা বাদেও যখন হিমানী উঠল না, কল্লোল অবাক হয়ে ওর স্পাই ক্যামের কানেকশনটা অফ করে শুয়ে পড়বার উদ্যোগ নেয়। হটাত কল্লোল লক্ষ্য করল টেবিলের উপর রাখা ল্যাপ টপটা একটু নড়ে উঠল যেন। কল্লোল ওর ক্যামেরা জুম করে ল্যাপ টপের স্ক্রিনে দেখে অটোমেটিক লেখা চলছে।
কল্লোলের বিশ্বাস হচ্ছিল না। এটা কিভাবে সম্ভব ? পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ল্যাপ টপের কি বোর্ডের বোতাম গুলি ওপর নিচ করছে আর স্ক্রিনে আপনা আপনি লেখা টাইপ হয়ে চলেছে। যেন কোন অদৃশ্য লেখক তার গল্প বা উপন্যাস খোলা ল্যাপটপে লিখে চলেছে। আর লেখিকা হিমানী সেনগুপ্ত নিশ্চিন্তে বিছানায় শুয়ে নাক ডেকে ঘুমচ্ছেন। কল্লোল অবাক হয়ে গেল যে কে এই ভূত যে নাকি হিমানী সেনগুপ্তের সমস্ত কাহিনী বা গল্প সারা রাত ঐ টেবিলে বসে ল্যাপটপে লিখে রাখছে।
ক্যামেরাতে তার শুধু আবছা ছায়া দেখা যাচ্ছে।
অনেক রাত অবধি হিমানী দেবীর ল্যাপটপে সেই একই ভাবে কেউ একজন বেশ কয়েক পাতা লিখে ফেলল। স্পাই ক্যামে কল্লোল লেখা গুলি পড়তে পারছিলনা ঠিকই কিন্তু কেউ একজন যে লিখছে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল। রাত প্রায় দুটো অবধি জেগে থেকে কল্লোল হিমানীর লেখার আসল রহস্যটা খুঁজে পেয়ে চিন্তিত এবং একই সাথে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ভাবল কাল এটা নিয়ে আরও একটু তদন্ত করতে হবে। ওর ল্যাপ টপে শেষ দিকের দশ মিনিট ভিডিও কল্লোল সেভ করে রেখেছে। বড় লাইট নিভিয়ে চিন্তিত কল্লোল শুয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে কল্লোল গত রাতের লেখাটার মর্ম উদ্ধার করতে পারল। এটা একটা খুনের কাহিনীর শেষ অংশ, যেখানে কোন এক পরিবারের বড় জামাই কালিপদ বাগচি তার ছোট শালী মীনাকে খুন করেছে। সেটা প্রমান করে ঘটনাটা বোঝাচ্ছে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ইন্সপেকটার রাজীব দত্ত। মনে হচ্ছে এই উপন্যাসটা একদম শেষের দিকে, হয়ত কাল রাতেই লেখাটা শেষ হয়ে গেছে। কল্লোল অবাক হয়ে গেল যে হিমানী সেনগুপ্ত কিভাবে একটা অশরিরী আত্মাকে দিয়ে গল্প লিখিয়ে নিচ্ছে আর সেটা আবার নিজের নামে প্রকাশ করে এতো সুনাম ও টাকা রোজগার করে চলেছে ?
এরপর আরও দুদিন কল্লোল ঘরের দরজা আটকে অনেকক্ষণ যাবত স্পাই ক্যামে সেই একই জিনিষ দেখতে পেল। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ হিমানীর খুলে রাখা ল্যাপটপে ভূতের প্রবেশ ঘটে। হিমানী যখন গভীর ঘুমের দেশে তখন ভোর পাঁচটা পর্যন্ত রোজই সেই ভুত এসে ওর গল্প উপন্যাস লিখে রেখে চলে যায়। কল্লোল সেদিন সারারাত জেগে দেখল ভোর বেলা উঠে হিমানী প্রথমেই ওর ল্যাপটপের লেখাটা পড়ে সেভ করে তারপর সেটা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকল।
রবিবার কল্লোল সন্ধ্যা সাতটায় হিমানীর দরজায় এসে কলিং বেল টিপে দাঁড়ায়। পাজামা পাঞ্জাবী পরা পাশের বাড়ির বোস বৌদির ভাইকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে হিমানী দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল,' আরে আপনি ? আসুন আসুন, ভিতরে আসুন। আপনি সেদিন নাকি দাঁড়িয়ে থেকে আমার এ সির কাজ দেখাশুনা করেছেন। আমি ভাবছিলাম আপনাকে চায়ের নিমন্ত্রন করব।' বলেই হিমানী হাসতে থাকে। কল্লোল হাসি মুখে বলে,' হ্যাঁ, আমিও আপনার একজন গুণমুগ্ধ পাঠক। অনেক দিন যাবত আপনার সাথে আলাপ করবার ইচ্ছা ছিল। আজ ছুটি, তাই চলে এলাম। ডিস্টার্ব করলাম নাতো ?'
হিমানী হেসে বলে,' না না। আজতো রবিবার, আড্ডাও নেই । কিসের ডিস্টার্ব ? বসুন, কফি খাবেন না চা ?'
'কফি চলবে।' ছোট্ট করে জবাব দেয় কল্লোল। হিমানী কিচেনে গিয়ে দুই কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আসে আর কল্লোল সোফায় বসে ঘরের একপাশের শোকেসে রাখা একধারে হিমানীর লেখা সব বই আর আরেক ধারে রাখা অজস্র সার্টিফিকেট, কাপ, শিল্ড ও মেডেলের সম্ভার দেখতে থাকে। হিমানী কফির কাপ ও বিস্কুট সহ ট্রেটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বলে ওঠে , 'নিন, কফি এসে গেছে।'
কল্লোল আমেরিকায় কী করত, কত দিন ছিল আবার কেন দেশে ফিরে এলো এই সব বিভিন্ন কথা বার্তায় কফি শেষ হবার পর কল্লোল সামনের সোফায় বসা হিমানীর দিকে চেয়ে হটাত প্রশ্ন করে বসল,' তারপর, কালিপদ বাগচি তো ধরা পড়ল তার শালীকে খুন করবার দায়ে। এবার উপন্যাসটার কী নাম দেবেন ভাবলেন ? এটা কি আপনার শারদীয়া সংখ্যার জন্য লেখা নাকি ?'
হিমানী প্রথমে অবুঝের মত জিজ্ঞাসা করে,' আপনি কার কথা বলছেন ? কোন কালিপদ বাগচি, কিসের খুনের কথা বলছেন আপনি ? ঠিক বুঝলাম নাতো !'
কল্লোল হেসে বলে,' কেন, আমি আপনার শেষ উপন্যাসটার কথা বলছি যেখানে ইন্সপেকটার রাজীব দত্ত কেসটা সল্ভ করে কালিপদ বাগচিকে ধরিয়ে দিলেন। উপন্যাসের নাম ঠিক করেছেন ?'
হিমানীর মুখটা হটাত গম্ভীর হয়ে গেল। কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,'আপনি আমার লেখার ব্যাপারে জানলেন কী করে কল্লোল বাবু ? আমি ছাড়া তো আর কারো জানবার কথা নয় ?' হিমানীর মধ্যে তখন যে একটা বিরাট তোলপাড় চলছে সেটা কল্লোল ওর মুখ দেখেই বুঝতে পারছিল। আর আজ হিমানীকে ফাঁদে ফেলাটাই যে ওর উদ্দেশ্য সেটা বোঝাবার জন্য হেয়ালি করে বলল,' আমি আপনার অনেক তথ্যই জানি মিস সেনগুপ্ত। আপনার আর কিছুই গুপ্ত নেই আমার কাছে। এমনকি রাতে কোন রঙের নাইটি পরে শোন, কে আপনার লেখা লিখে দেয় সবই আমার জানা এখন।'
হিমানী আগে উঠে গিয়ে খোলা দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে এবার এসে কল্লোলের ডান পাশে সোফায় বসে পড়ল। কল্লোল তখন মুচকি মুচকি হাসছে। ডিটেকটিভ গল্পের স্বনাম ধন্য লেখিকা এখন ওর হাতের মুঠোয়। হিমানী তুমি করেই বলল,'দেখ কল্লোল, বুঝতে পারছি তুমি আমার উপর স্পাইং করছ। কি ভাবে আর কেন করছ জানিনা। তবে তোমাকে আমি জানাচ্ছি যেটা সেটা তোমার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবে। বাইরের কেউ যেন জানতে না পারে। কারণ ব্যাপারটা একদম গোপনীয়।'
কল্লোল হেসে বলে,'সেই গোপন ব্যাপারটাই তো জানতে এলাম হিমানী। বলো এবার কী হচ্ছে এসব ?'
হিমানী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,' আমার বাবা ছিলেন খুব ভালো রাইটার। কিন্তু কলকাতার কোন বড় হাউস ওঁর লেখা ছাপাতে রাজি হয়নি। বাবার খুব অভিমান হত, তবু উনি লেখা ছাড়েন নি। আমার আবার লেখবার তেমন কোন ইন্টারেস্ট ছিলনা। আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মা আমার তিরিশ বছর বয়সে মারা যাবার পর বাবা হটাত বিছানা নিলেন। আমি কিছুতেই বিয়ে করছি না, চাকরি করছি, মানে জামশেদপুরে একটা চাকরি করতাম তখন। বাবা চিন্তায় চিন্তায় বিছানা নিলেন। শেষে ধরা পড়ল ওঁর ক্যান্সার হয়েছে। নয় বছর আগে বাবার যখন শেষ অবস্থা তখন একদিন আমাকে ডেকে বললেন,' মারে , আমার লেখাগুলি তুই নিজের নামে ছাপার ব্যাবস্থা করিস। আমি মরে গেলেও রোজ রাতে এসে তোকে লিখে দিয়ে যাব। তুই সেই লেখা গুলিও তোর নামেই ছাপাস মা। আমার লেখা যেন বিফলে না যায়, এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।'
হিমানী একটু থামতেই কল্লোল অবাক হয়ে বলে ওঠে,' তার মানে এই আজ পর্যন্ত তোমার যত লেখা বের হয়েছে সবই আসলে তোমার বাবার লেখা ? মাই গড ! বলো কী , তুমি রহস্য গল্প লেখ বলে সবাই জানে, কিন্তু তোমার লেখার পিছনের এই রহস্য তো কেউ কোন দিন জানতেই পারতো না যদি না আমি...।'
হিমানী একটু চুপ করে থেকে বলে,' আমি বুঝতে পারছি তুমি সেদিনই আমার ঘরে কোথাও স্পাই ক্যাম লাগিয়ে গেছ। কিন্তু কল্লোল দয়া করে তুমি আমার এই গোপন সত্যটা কারো কাছে প্রকাশ করবে না। আমি তাহলে লজ্জায় অপমানে আত্মহত্যা করে বসব।' বলতে বলতে কল্লোলের হাতদুটো চেপে ধরে হিমানী। ওর চোখের কোনে জল দেখা যায়।
কল্লোল কী করবে ভাববার আগেই অনুভব করল ওর কাঁধে কেউ একটা হাত রাখল। তারপর ফিস ফিস করে কানের কাছে মুখ এনে বলল,' কল্লোল, তুমি তো এখনো বিয়ে করনি। আমার মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেল। আমার জীবদ্দশায় তো করল না। এখনো সময় আছে। আমি চাই তুমি ওর দায়িত্ব নাও কল্লোল। আমি আশীর্বাদ করছি তোমরা সুখী হও বাবা।' হাতটা সরে গেল কিন্তু কল্লোল অবশ হয়ে তাকিয়ে রইল সামনে বসা অসামান্য এক সুন্দরী নারীর দিকে যে তখন চোখের ভাষায় ওকে আকর্ষণ করছে। কল্লোল বুঝতে পারে হিমানীর বাবার আত্মা ওদের আসে পাশেই আছেন কোথাও।
- শেষ -
================================
উত্তম চক্রবর্তী।
ব্যাঙ্গালোর।