Click the image to explore all Offers

ছোটগল্প : অঞ্জনা গোড়িয়া


 

গুরুদক্ষিণা


সকাল থেকেই সাজ সাজ ব্যাপার।  আকাশটা  মেঘে ঢাকা।  আজ শিক্ষকদিবস। আজই   স্যারের  বিদায়ী  দিনের সম্বোধন  অনুষ্ঠা।  
আকাশে বাতাসে  বিরহের বাজনা বেজে উঠেছে। আজ আদরের মনি মাষ্টার  মশায়ের বিদায়ী সম্বোধন।  স্যারের ভালো  নাম মনিকাঞ্চন বাবু। আদর করে সবাই মনি মাস্টার বলে ডাকে। সারা স্কুলের নয়নমনি ছিলেন  মনিকাঞ্চন বাবু। কলকাতা  থেকে এসেছেন এই স্কুলে।
পাড়া গাঁয়ের নিম্নবুনিয়াদী স্কুল। অনুন্নত  ডোম, নাপিত,বাগদি নিয়ে এই পাড়াটা। ব্রাম্ভন দুচার ঘর আছে,বটে। তারা সবাই বড় বড় কে,জি স্কুলে পড়াতে পাঠায়। এসব ডোম ক্যাওড়ার সঙ্গে  পড়াশোনা করলে নাকি তাদের জাত যাবে। আভিজাত্য, আর টাকার অহংকারে উঁচু  তলার মানুষরা সরকারি গরীব স্কুলে  ছেলে ভর্তি  করেন  না। কিন্তু মনি মাস্টার  আসার পর, স্কুলে ছাত্র সংখ্যা বাড়তে লাগল। 
পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বাড়ি থেকে ধরে আনতো, ছেলে মেয়েদের।
তাদের মা-বাবাকে বুঝিয়ে , একপ্রকার  জোর  করে ই  স্কুলে নিয়ে আসত। 
অনেক কটূ কথা ও শুনতে হয়েছে গ্রামের কিছু  মানুষের কাছ থেকে। মাস্টার মশাই  কোনো  কথায় কানে তোলেন নি।  
সাধ্যমতো  এই স্কুলের জন্য কাজ করে গেছেন।
আজ সেই প্রিয় স্যারের বিদায় দিন। মন টা সবার খুব খারাপ।তবু ছেড়ে  দিতে হবে। এই নিয়মে  ই বাধা আমরা সবাই। 

সমস্ত স্কুল ঘরটা সুন্দর করে সাজিয়েছে  ক্লাস ফোরের ছেলে মেয়েরা। নিজেরাই চাঁদা তুলে স্যারের জন্য উপহার কিনেছে। 
কেউ ছাড়তে চায় না তাদের প্রিয় স্যারকে।এই স্কুলে দীর্ঘ ১৫বছর ছিলেন।  স্কুলের সেরা মাস্টার মশাই কে বিদায় তাই  খুব কষ্ট  হচ্ছে।  রোহিত ক্লাস ফোরে উঠেছে।।  মাত্র তিন বছর কাছে পেয়েছে স্যারকে।  তাতেই তার মন খারাপ। 
যেদিন প্রথম স্কুলে আসে, কি কান্না।এক প্রকার জোর  করে ই   রোহিতের মা স্কুলে দিয়ে যায়। 
মনি মাস্টার কাছে এসে  মাথায় হাত বুলিয়ে কত ভাবে আদর করেছে। কিন্তু  রোহিতকে কিছুতেই স্কুলে মন বসাতে পারে নি। রোহিতের মাথায় সব সময় দুষ্টু  বুদ্ধি। কি করে স্যারকে জব্দ করা যায়? রোহিতের জ্বালায় সারা স্কুল অতিষ্ঠ  হয়ে যেত। কিন্তু  খেলাধূলায় আঁকায় রোহিত সবার সেরা।
যেমন  জোরে  ছুটছে  পারে, তেমন ই  লাফাতে পারে। আর যা দেখে তাই এঁকে ফেলে মনের মতো। 
বার্ষিক খেলায় প্রতি বছর রোহিত প্রথম হতো।  কেউ রোহিতকে হারাতে পারত না।
কিন্তু  পড়াশোনায় অমনোযোগ।  সব সময় ছোটাছুটি, হাতাহাতি  মারামারি  করেই থাকত। 
অন্য স্যারেরা বারবার  বলতো, ও ছেলেকে ধরে রাখা যাবে না স্কুলে।  কখন যে কার মাথা ফাটায়।  হাত পা  ভাঙে?  তার ঠিক নেই। ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই।
কিন্তু মনি মাস্টার  বলতো, এ ছেলে হিরের টুকরো। দেখবে একদিন সবার মুখ উজ্জ্বল  করবে।
একদিন স্কুলের বাইরে একটা  গাছে ঘুড়ি আটকে  থাকতে  দেখল।তাই দেখে,রোহিত ঘুড়িটা কে বাঁটুল দিয়ে  পাড়তে উদ্যত । ঠিক সেই সময়  মনিবাবু আসছিলেন ক্লাস নিতে। বাঁটুলের গুলি সোজা গিয়ে লাগে স্যারের চোখের ঠিক নীচে। মাস্টার মশাই  ছিটকে পড়ল মাটিতে।  আর রক্তে ভেসে গেল সারা মুখ। সবাই ভয় পেয়ে গেল। হয়তো  চোখ গেল।  রোহিত এই প্রথম ভয় পেল। কোথায়  যে লুকিয়ে পড়লো কেউ খুঁজে  পেল না।  রোহিতের মা, ভয়ে কান্নাকাটি শুরু  করল।  অনেক কষ্টে  রোহিতকে খুঁজে  পাওয়া গেল পুরানো  মন্দিরে। স্যারের জন্য প্রার্থনা  করছে।
মনি মাস্টারের অল্পের জন্যে  চোখ টা বেঁচে  গেল।  হসপিটাল  থেকে  ব্যান্ডেজ  করে  কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে গেলেন। বেশ কিছু দিন পর স্কুলে এলেন স্যার। স্কুলে ফিরেই  রোহিতের খোঁজ   করলেন স্যার।
 রোহিত আর স্কুলে আসে না।  সে এখন  অসুস্থ।  কারোর সাথে কথা বলে না। ভয়ে কেমন  কুঁকড়ে  আছে। ঠিক মতো  খাওয়া দাওয়া  করে না। থেকে থেকেই কেঁদে ওঠে  রোহিত। আর ঘুমের ঘোরে  ভুল বকে, বলে স্যার তোমায় মারতে চাই নি। তোমার খুব লেগেছে?   আমার জন্য  তোমার চোখটা ---বলেই কেঁদে  ফেলে। 
মনি মাস্টার সব শুনে, রোহিতের বাড়ি গেল। 
স্যারকে দেখেই জড়িয়ে  ধরল রোহিত। 
মাথায় হাত বুলিয়ে  বলল, স্কুলে যাও নি  কেন রোহিত? শাস্তি তোমাকে  নিতেই হবে।
কি শাস্তি স্যার? যা বলবে তাই শুনবো।
 তুমি যে আসো নি স্কুলে।  তুমি না থাকলে ভালো  লাগে  বলো? 
স্যার বলল,  কাল থেকে রোজ স্কুলে  যাবে। আর মন দিয়ে পড়াশোনা  করবে।  এটাই তোমার শাস্তি।
পরের দিন থেকে  রোহিত রোজ স্কুলে আসত। সব চেয়ে অবাক কান্ড, এ বছর   জেলাস্তরের খেলায়  রোহিত সমস্ত  জেলার মধ্যে  প্রথম স্থান লাভ করেছে। আর পড়ায় বেশ মনোযোগ।  সারা স্কুল তথা পাড়া প্রতিবেশী  রোহিতের প্রশংসায় ধন্য ধন্য করল। 
সমস্ত  বিদায়ী অনুষ্ঠান   শেষ।  এবার স্যারের বক্তৃতা দেওয়ার  পালা। স্যার রোহিতকে কত করে খোঁজ  করল, দেখতে পেল না। ওর হাতে পুরস্কার তুলে দিতে সেরা ছাত্রের। কিন্তু  কাছে এলো না  রোহিত।
যখন গাড়িতে  উঠতে  যাবে, সেই সময়  
একটা  ছবি,  স্যারের হাতে তুলে দিল রোহিত। 
ছবিটি  এত সুন্দর, যা দেখে স্যার অবাক হয়ে গেলেন। "আকাশে অসংখ্য  ঘুড়ি  উড়ছে। তার ই একটা  ঘুড়িতে বসে আছে একটা  ছেলে। লাটাই আছে স্যারের  হাতে। ইচ্ছে মতো  সুতো  ছেড়ে  দিচ্ছে স্যার। মুক্ত  আকাশে ঘুরে  বেড়াচ্ছে  ছোট্ট  ছেলেটা। স্যার মুগ্ধ হয়ে  গেলেন। বুকে হাত চাপড়ে বললেন,  তুই একদিন বড় আর্টিস্ট  হবি, দেখে নিস। তুই আমার গর্ব। গ্রামের গর্ব।  
গাড়িটা  চলে গেল শহরের দিকে।  রোহিত গাছের আড়াল  থেকে তাকিয়ে  রইল সেই আদর্শের  দিকে। দুচোখ ছাপিয়ে  পড়ছে  জলধারা। 
 
======000======

অঞ্জনা গোড়িয়া
গ্রাম- ভগবান পুর
পোস্ট- দিঘির পাড় বাজার
থানা- ২৪ পরগণা (দক্ষিণ)       
ফোন, - ৯৯৩৩১৪৬৭৭৭



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.