ছোটগল্প ।। তনুশ্রী পাল
ফান্দে পড়িয়া
ঘটনা ক’বছর আগের। সেই যখন সিলেবাস আলাদা আর পরীক্ষার সিস্টেম খানিক ভিন্ন তখনকার। তার নিজের শহর থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে রুমাম্যাডামের বছর তিনেক হল চাকরি হয়েছে মোটে, এস এস সি দিয়ে। তো সেদিন সেকেন্ড হাফে ডিউটি। বড় হলে নয়, স্কুলের নতুন বিল্ডিঙয়ের একতলায় একদম শেষঘরটিতে পাহারাদারি। ঘন্টা বাজতেই যথাসময়ে প্রশ্নপত্র, খাতাটাতা নিয়ে হাজির হয় রুমাম্যাডাম। ক্লাসরুমের চেহারায় মন তার খুশিখুশি। শুধুই ফাইভ আর সিক্সের ছেলেরা, দুপাশে দুটো ফাইভ মাঝে একটা সিক্স; একবেঞ্চে তিনজন। তায় ইতিহাস আর ভূগোল পরীক্ষা। ওদের স্বভাব তো জানাই আছে। নিচুক্লাসের বাচ্চারা এইসব সাবজেক্টে যা পারবে একঘন্টায় উত্তর লেখা শেষ করে বাইরে যাবার জন্যে ছটফট করে। তারপর একজন খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে গেলে তো হয়েই গেল; সে উত্তর লেখা সম্পূর্ণ হোক চাই নাহোক খাতা জমা দেওয়ার হিড়িক তখন। সে তুমি যতই বল, ‘ সব প্রশ্নের উত্তর লিখে বেরোবি।‘ কিন্তু কে শোনে কার কথা! তারা লাইন দিয়ে খাতা জমা দিয়ে দে ছুট। একঘন্টার আগে খাতা জমা নেওয়া যাবেনা এই নিয়ম স্কুলের।
এমনিতে পরীক্ষাহলে পাহারাদারি ব্যাপারটাই বড্ড বোরিং! উঁচুক্লাসে ছেলেমেয়েদের রুমে ডিউটি পড়লে ক্রমাগত বকবক ‘ এই সোজা হয়ে বস,হাতের মুঠোয় কী? এই ঘাড় এরপর এরকম ব্যাঁকা হয়েই থাকবে রে আর কোনওদিন সোজা হবেনা । ওর খাতার সঙ্গে তোর কিসের সম্পর্ক রে? কার খাতায় লিখবি বল নিজেরটায় না ওরটায়? ঘাড় তো এরপর বকের মতো লম্বা হয়ে যাবে তারচেয়ে বল ওর খাতাটা এনে দিই। এই নিয়ে সেকেন্ড টাইম হল এরপর কিন্তু খাতা নিয়ে নেব। অনেকবার বলেছি সোজা হয়ে বস। কবে থেকে তুই এরকম বেঁকে গেলি বল দেখি।‘ অনবরত সচকিত পায়চারি সঙ্গে সাবধানবানী প্রচার ঘন্টা তিনেক ধরে। আর ছোটক্লাসের বাচ্চাদের বলতে থাকো ‘ কিরে লেখ, চুপ করে বসে আছিস তখন থেকে। দেখি খাতা, ওমা! একটা উত্তর কেন? অন্যগুলো লেখ, তাড়াতাড়ি লেখ। যারা ভাবেন স্কুলের চাকরি আরামের আর পরীক্ষাহলের ডিউটি তো ভগবানবিষ্ণুর সুখনিদ্রাকাল ছাড়া কিচ্ছু না তাঁদের কাছে অনুরোধ জীবনে একবার এই কর্মটি করে দেখুন।
যাইহোক সেদিনের কথায় ফিরি, ঘরে দশটা বেঞ্চে ত্রিশটি বাচ্চা। যথারীতি কেউ লিখছে, কেউ উদাস দৃষ্টি মেলে বাইরে তাকিয়ে; কেউ স্কুলমাঠে বিচরণরত গাই-বাছুর বা ছাগলছানার ছটফট দেখছে হাসিহাসি মুখে। কেউবা চিবিয়ে চিবিয়ে পেনটার দফারফা করে ছাড়ছে, কেউবা উত্তরপত্রের এককোনে ছবি আঁকছে মহা মনোযোগে – ফুটবল, ভুতের মুখ, ডানাওয়ালা পরী, রসগোল্লা, ঘুড়ি, ফড়িং, তরবারি, তীর-ধনুক আরও নানান চেনা অচেনা বস্তুর। কেউ প্রশ্নপত্রটাই উত্তরপত্রে টুকছে বসেবসে। এবারে তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্রে ফেরানো শিক্ষকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে তো বটে। একে গ্রামদেশের স্কুল তায় অনেক বাচ্চাই ফার্স্ট জেনারেশন লার্ণার। পরীক্ষা হলে পায়চারি করে রুমা। আকাশ খানিক মেঘলা তত গরম নেই। মাঝে মাঝে ফুরফুরে হাওয়া জানালা পথে ঘরে ঢুকছে। কেন যে আনন্দ হচ্ছে কেজানে; দেঢ়ঘন্টায় সব খাতা জমা পড়বে, ক্লাস ফাঁকা হয়ে যাবে, এইচ এমকে বলে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে পারব এসব সাতপাঁচ ভেবেই হয়ত রুমা ম্যাডামের ঠোঁটের কোনে হাসি ফোটে!
যথারীতি বহুক্ষণ ধরে উশখুস করে প্রথমঘন্টা পড়তেই খাতা জমা দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেল। রুমা লেগে পড়ে খাতা চেক করার কাজে। কে কিছুই লেখেনি, কে একটা বা দুটো প্রশ্নের উত্তর লিখে ছেড়ে দিয়েছে তাদের ধরে ধরে আবার বসাও। ‘চেষ্টা কর, মনে করার চেষ্টা কর ‘ এমন সব প্রচেষ্টার পরেও পনের-বিশ মিনিটের বেশি তাদের বসান যায়না। এরপর ঘর মোটামুটি ফাঁকা; সিক্সের ফার্স্ট আর থার্ডবয়ের সিট এরুমে। তারা ঘাড় গুঁজে লিখেই চলেছে। ফাইভের জনা চারেক ছাত্র লিখছে আর একদম ফার্স্ট বেঞ্চের কোণে একজন, ব্যাস। মোট জনাসাতেক, রুমাও চেয়ারে বসে বসে পা নাচায়। সহ প্রধানশিক্ষক শংকর স্যার, রিজার্ভে থাকা বিমল স্যারকে সঙ্গে নিয়ে বারান্দা দিয়ে একবার ঘুরে গেলেন। রুমা হাত নেড়ে জানায় না দরকার নেই। ভাবে ‘বড়জোর আধঘন্টা, সব খাতাই জমা পড়ে যাবে আমারও ছুটি সুতরাং এখন রেস্ট নেওয়ার দরকার কী? রিলিভারের দরকার নেই আমার।’ রহস্যময় হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে মাথা কাত করে শংকরদা আর বিমলস্যার চলে গেলেন।
ধারণা সত্য আধঘন্টার মধ্যে লেখা শেষ করে, জমা দেওয়ার আগে পুরো খাতা চেক করে সিক্সের ফার্স্ট বয় সহ সবাই বেরিয়ে গেল, শুধু একজন তখনও লিখছে। প্রথম বেঞ্চের কোণে বসা ছেলেটি ঘাড় গুঁজে লিখছে। রুমা আরাম করে রোলনাম্বার অনুসারে দুই ক্লাসের উত্তরপত্রগুলো সাজিয়ে ফেলে। ফাইভের খাতার বান্ডিল বেঁধে রাখে। এবার এ রুমের শেষ পরিক্ষার্থীটি খাতা দিলেই কেল্লা ফতে! সব্বার আগে ডিউটি শেষ। যাইহোক সে ছেলে লিখেই চলে, রুমা আকাশ-পাতাল ভাবে, ফেরার সময় বাসে বসেই রুদ্রকে ফোন করে ডেকে নিলে কেমন হয়; বাড়িতে ঢোকবার আগে একটু ‘গোল্ডেন এরা’য় ঢুকে ধোসা আর কফি খেয়ে একটু আড্ডা দিতে পারলে মনটা ভাল হয়ে যায়। ওই এক শনি আর রোববার ছাড়া তাদের দেখা হয় কোথায়? রুদ্রের বোনের বিয়েটা হয়ে গেলে ব্যাস আর চিন্তা কী? ক্লাসরুমের সামনের বারান্দা দিয়ে আবার একবার শংকর স্যার হাসিহাসি মুখে ঘুরে যান। রুমাও হাসি মুখে জানায়, ‘প্রায় শেষ একটি মাত্র বালক বসে আছে। আর রিলিভার লাগবেনা, এখুনি শেষ হয়ে যাবে।‘
সেকেন্ড মিনিট আধাঘণ্টা পেরিয়ে গেল সে ছাত্রটি লিখেই চলে লিখেই চলে; দেশের না পৃথিবীর কিসের ইতিহাস সে লিখছে বোধগম্য হয়না। তার দিকে চাইলেই দেখা যাচ্ছে চোখ গোল্লা করে সে রুমাম্যাডামকেই দেখে আর চট করে খাতায় মুখ গুঁজে ইতিহাস প্রশ্নের উত্তর লেখে। রুমার কেমন সন্দেহ হয়, এ আবার গোটা প্রশ্নপত্রই টুকছে নাকি? কাছে গিয়ে খাতা উল্টেপাল্টে দেখে এই দেঢ়ঘন্টায় সে দু’পাতা লিখেছে মস্ত গোটা গোটা অক্ষরে! কেমন মায়া হয় তার ছেলেটার অসহায় চোখের দিকে চেয়ে,’ কিরে অসুবিধা হচ্ছে প্রশ্ন বুঝতে? সব লিখতে পারবে তো, ভুলে গেছ নাকি? মাত্র দুপাতা লিখেছ এতক্ষণে? তাড়াতাড়ি হাত চালাও কেমন।‘ সে সন্মতি সূচক ঘাড় নাড়ে; সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারবে এটাই বলতে চাইছে মনে হোল।অনেক বাচ্চাই দ্রুত লিখতে পারেনা, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। বেশ, খানিক বাদে তাকিয়ে দেখে সামনের দেওয়ালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বসে সেই ছেলে, নড়েচড়ে না! কি হল, কি দেখছে অমন অখন্ড মনোযোগে? মহাজ্বালা তো! উঠে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়, ছেলে টেরই পায়না এমনই নিমগ্ন! দেওয়াল বেয়ে একসারি পিঁপড়ে; অবাক হয়ে সারা জগত ভুলে সেই দৃশ্যই দেখছে শ্রীমান! এ কেমন ছেলেরে বাবা! ‘ কিরে লেখা বন্ধ করে কি করছিস তুই? সব উত্তর লিখেছিস? খাতা দে তাহলে।‘ চমকে উঠে সে আবার খাতার ওপর উপুড় হয়। খানিক অবাক খানিক বিরক্ত হয়ে আবার চেয়ারে এসে অধিষ্ঠিত হয় ক্লান্ত রুমা ম্যাডাম।ছেলেটিকে লক্ষ্য করে ভালো করে। সারাটা ক্লাসের ছেলেরা চলে গেছে কখন, ওর যেন কিছুতে তাড়া নেই সেই দুপাতা লিখে বসেই আছে! অদ্ভুত!
বাইরের সবুজ মাঠের দিকে চেয়ে থাকে। দরজায় হঠাত অনিলের আবির্ভাব, নোটিশ নাকি? না ও একটা ভাঁজ করা শাদা কাগজের টুকরো এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘ মিস, শংকর স্যার আপনাকে কিসের যেন চিঠি দিল।‘ সেকি? চিঠি খুলেই দেখে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে, ঠিক সাড়ে তিনটায় আবার দেখা হবে। টা টা।‘ মানে ?
রুমার সব হিসেব উল্টে দিয়ে সত্যি ফাইনাল ঘন্টা পড়লে সে বালক খাতা জমা দিয়ে বিদায় নিল। খাতায় সেই গোদা অক্ষরে দুপাতাই মাত্র লেখা। নতুন একটি শব্দও সে লেখেনি! এই আঢ়াই ঘন্টা কি উদ্দেশ্যে সে বসে রইল? এতটুকু ছেলের এমনধারা আচরণের কারণ কী? এত ধৈর্যই বা তার এলো কোত্থেকে? খাতা জমা করে হাক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত রুমা স্টাফরুমে ঢুকে আগে ঢকঢকিয়ে অনেকটা জল খায়, টিফিনবক্স খুলে বসে। হাসিহাসি মুখে শংকরদা তার পাশে এসে বসেন, ‘ তাইলে চিঠি পড়লা? বুঝলা চক্কর। এইডা অঞ্চলপ্রধানের পুত্র বুঝচ, তার মা বাইরের গেটে বইসা আছে হাতে একখান লাঠি নিয়া, বুঝলা। ফাইনাল বেলের আগে ছেলে যদি খাতা জমা করে বাইরায় তাইলে এক্কেবারে সেই পিট্টি। এই চ্যাংড়ার যে রুমে সিট পড়বে, তো হয়ে গেল। ফান্দে পইড়া গেলা, ও বইসাই থাকবে, ফাইনাল বেল পড়লে খাতা জমা দিবে। তাই ওকে হলে আর বসাই না। ছোটরুমে থাকুক। হলে তিনজন টিচার গার্ড দেয়, একজনের জন্য তিনজনকে ফান্দে আটকায়ে কি লাভ কও। ’ শংকর স্যারের মিটিমিটি হাসির কারণ, চিঠির ধরণ সে বুঝেছে মনেমনে রাগও হয়েছে খুব, টিফিনের রুটি চিবোতে চিবোতে রুমা বলেই ফেলে, ‘ওর মাকে এনে স্কুলে ভর্তি করে নিন। কোন স্কুল থেকে ভদ্রমহিলা শিখে এলেন যে লেখাপড়া না করেও শুধু ফাইনাল বেল পড়া পর্যন্ত পরীক্ষার হলে বসে থাকলেই প্রমোশান পাওয়া যায়? গোদা গোদা অক্ষরে কিসব হাবিজাবি লিখেছে ওনার ছেলে!’ শংকর স্যার তার স্বভাবসিদ্ধ মিটিমিটি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলতে থাকেন ‘ আরে রাগ কর ক্যান। যেই দেশে যেই রীত, প্রধানের ছেলে বলে কথা। খাতা নিয়া নিলে বাড়ি গিয়া নালিশ করবে, হলের ইনভিজিলেটরকে চার্জ করবে বুজচ; চাইকি শো-কজ খাইতে পারো। তাই ঘুরায়ে ফিরায়ে সব টিচারদের ওই পোলার রুমে ডিউটি ভাগ করে দিতে হয়। কল্পনা ম্যাডামের আবার হাই ব্লাডপ্রেসার, পরীক্ষার হলে ছেলেটাকে দেখলেই ওনার আবার প্যালপিটিশন শুরু হয়ে যায়। মহামুস্কিল বুজচ! বাইরে মা বইসা থাকেন বেত্রহস্তে এদিকে এই। তা যাক আজকের মতো বিপদ কাটলো আরকি, কি কও। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে রুমা ম্যাডাম টিফিন খেতে থাকে, কোনও কথার আর উত্তর দেয়না সে। ছেলেটার জন্যে তার সত্যিকারের মায়া জাগে মনে, সে বাচারাও তো ফাঁদে পড়েছে! জগতে কতপ্রকারের ফাঁদ আর কত যে নিরুপায় বগা সে ফাঁদে ধরা পড়ে!
==============