রমাপদ চৌধুরী স্মরণে ।। রবীন বসু

রমাপদ চৌধুরী : বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজের ভারতবর্ষ

গত দু' বছর হল, আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন মধ্যবিত্ত বাঙালী জীবনের নিপুণ রূপকার সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী l ১৯২২ সালে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার খড়গপুরে জন্ম গ্রহণ করেন l তিনিই প্রথম লেখক, যিনি ঘোষণা দিয়ে লেখা থেকে অবসর নেন এবং বছরে একটি মাত্র উপন্যাস লিখতেন l লেখার জন্য রূপচাঁদ আর পত্রনবীশ ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন l মাত্র ১৮ বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় দুই বন্ধুর অনুরোধে কলেজ কেটে ওয়াই এমসি এ রেস্তরাঁয় বসে লেখেন জীবনের প্রথম গল্প "ট্রাজেডি" l সাপ্তাহিক আজকালে প্রকাশিত হয় l তারপর লেখেন "উদয়াস্ত" যেটি যুগান্তরে এবং পরিশেষে "বারো ঘোড়ার আস্তাবল" আনন্দ বাজারে প্রকাশ পায় l  আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি l  পঁচিশ বছর বয়সেই কর্মসূত্রে আনন্দ বাজারে যোগদান l পরবর্তীতে আনন্দ বাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় বিভাগের সম্পাদক হন l

একে একে লেখেন, বনপলাশির পদাবলী, লালবাঈ,  এখনই,  খারিজ,  সুন্দরী, বাহিরী, সুখদুঃখ, দ্বীপের নাম টিয়া রঙ, বীজের  মত উল্লেখযোগ্য উপন্যাস l ভারতবর্ষ ও পোস্টমর্টেম-এর মত বিশ্বমানের গল্প l তাঁর অনেক উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে সফল চলচ্চিত্র হয়েছে l তার মধ্যে বিখ্যাত বীজ উপন্যাস অবলম্বনে "একদিন অচানক"  হিন্দী চলচ্চিত্রটি l

কম কথার এই সাহিত্যিক "বাড়ি বদলে যায়" উপন্যাসের জন্য ১৯৮৮ সালে পান সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার l এছাড়া তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার l কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ও জগত্তারিণী পদক l বনপলাশির পদাবলীর জন্য তিনি পান আই আই পি এম পুরস্কার, যার অর্থমূল্য ছিল ১ কোটি টাকা l

২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই  তাঁর লেখক জীবন শুরু l ১৯৯৪৪-৪৭ সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরীর উন্মেষকাল l ছোটগল্পে সিদ্ধহস্ত এই লেখক উপন্যাসের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে দেশভাগ জনিত ভেঙে পড়া মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবনের আলো-অন্ধকার খুঁজে বেড়িয়েছেন l মূল্যবোধের ভাঙন তিনি দেখেছেন কিন্তু বিশ্বাস হারান নি l এক নির্মোহ দৃষ্টিতে জীবনকে দেখতেন l এই সময়কার উল্লেখযোগ্য কথাকার অমর মিত্রের ভাষায় "রমাপদ চৌধুরীর গল্প, উপন্যাসে মানুষের ভিতরের হাড় কঙ্কাল বেরিয়ে আসে l সত্য উন্মোচনে তিনি অতি নির্মম l"

ঠিক তাই l এক নির্মেদ ঝরঝরে গদ্যভাষায় তিনি তাঁর  আখ্যান রচনা করতেন l অসম্ভব স্মার্ট তাঁর কাহিনীর বুনন l আপাত রুক্ষ লেখক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের অবক্ষয় যেমন দেখেছেন, তেমন দেখেছেন এ জীবনের অপার বিস্ময় l জীবন তার স্খলন পতন পাপবোধ আবার বিশ্বাস অবিশ্বাস সবটুকু নিয়েই তাঁর গল্প-উপন্যাসে উপস্থিত l

"বনপলাশির পদাবলী" আমাদের গ্রাম জীবনের এক আবহমানের দলিল l নর-নারীর প্রেম ভালোবাসা, স্বপ্ন হিংসা ষড়যন্ত্র প্রতিশোধ আর ভেঙে যাওয়া গ্রামজীবন তার সমস্ত কুৎসিতা নীচতা ও বিশ্বাস নিয়ে মহাকাব্যিক দ্যোতনায় উপস্থিত l  গ্রাম আর নগর জীবনের অভিঘাত যদি বনপলাশির পদাবলী হয়, তাহলে  "এখনই" হল সত্তর দশকের অনিকেত সময়, বেকারত্বে হতাশ দিশাহীন যুব-সমাজের বিপদগামীতা আর রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও দলবাজির বাস্তব রূপ লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন l রমাপদ চৌধুরীর  "পোস্টমর্টেম" আর "ভারতবর্ষ" গল্পদুটো  বাংলা ছোটগল্পের ভাঁড়ারে দুটি উজ্জ্বল রত্ন l প্রথমটিতে  ধনঞ্জয়বাবু নাম্নী এক ব্যক্তি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন l সকালে তাঁর বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া  প্রতিবেশীদের উক্তি সন্দেহ অনুসন্ধান অন্তঃসারশূন্য আমাদের বিবেক ও মানবিকতার কঙ্কাল বের করে l "ভারতবর্ষ" গল্পে মাহাতো বুড়োর ভিক্ষা না চাওয়া উঁচু মাথা শেষ পর্যন্ত বকশিস চাওয়ায় যেন সমৃদ্ধশালী ভারতবর্ষ মুহূর্তে নিঃস্ব নিরন্ন ভারতবর্ষে রূপান্তরিত হল l গল্পদুটির সমতুল গল্প বিশ্বসাহিত্যে কমই আছে l

যদিও তিনি লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তবুও বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজ তাঁকে বহুদিন মনে রাখবে l তিনি লেখকদের লেখক l আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনের আর এক ভারতবর্ষ l

                       

   ————

রবীন বসু

১৮৯/৯, কসবা রোড, কলকাতা-৭০০ ০৪২

ফোন : ৯৪৩৩৫৫২৪২১