ছোটগল্প ।। শংকর লাল সরকার
পেন্সিলবক্স
হাসপাতালের কেবিন থেকে বেরিয়ে সিঁড়িতে পা দিল ফইজান। কেবিনের ভিতর থেকে ভেসে আসছে ইনিয়ে বিনিয়ে চাপা কান্নার সুর। একবুক শূন্যতা নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল নীচের চত্ত্বরে। সামনের রাস্তাটা বড়ো দীর্ঘ মনে হয়। ক্লান্তিতে পা চলে না। ডাললেক পেরিয়ে যে রাস্তাটা সোজা চলে গেছে ঝিলাম নদীর ধার বরাবর সেই রাস্তার পাশে কুলসুমদের বাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে কুলসুমদের বাড়ির সামনে চলে এল। রাস্তা থেকে দোতলার ঘরের জানলাটা দেখা যায়। জানলাটা বন্ধ। জানলা খুললেও আর কোনদিন ওখানে কুলসুমকে দেখা যাবে না। শূন্য ঘরের ভিতর খালি তক্তপোশটা অন্ধকারের ভিতর চুপচাপ পড়ে আছে। তক্তপোশের পাশেই কুলসুমের পড়ার চেয়ার টেবিল। শেষবারের মতো ওই জানলার দিকে তাকাল ফইজান। আর কোনদিন কুলসুম ওখানে ফিরবে না। ওর কুলসুম! একটা বোধহীন শূন্যতায় বুকটা খালি লাগলেও ফইজান টের পেল ওর মস্তিস্ক থেকে একটা আগুনের স্রোত এসে ছড়িয়ে পড়ছে চোখের রেটিনার উপর। শুকনো খট্খটে চোখে এক ফোঁটা জল নেই, বদলে সামনে দেখতে পায় নানারঙের জ্বলজ্বলে আগুনের ফুলকি।
মাত্র এক সপ্তাহ আগের ঘটনা। টিউলিপ গার্ডেনে ওরা ঘাসের উপরে বসেছিল। দূরে ঘন সিপিয়া রঙের পাহাড়ের উপরে সাদা বরফ, সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে। তারই ছায়ায় লাল হলদে গোলাপি রঙের টিউলিপ ফুল ফুটেছে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে সবুজ মাঠের মধ্যে যেন একটা বহুরঙা ডুরে কাপড় পাতা। কুলসুমের পরনে একটা আকাশী নীল রঙের সিল্কের সালোয়ার। জরি বসানো। ফইজানের মনে হচ্ছে ওর ঠোঁট নাক চোখের পাতা সব ছবির মতো তুলি দিয়ে আঁকা। কথায় কথায় হাসছিল কুলসুম। স্মার্ট ফোনে বন্দী করে রাখছিল টুকরো টুকরো খুশির মুহুর্তগুলো। আচমকা প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে একদল লোক ওদের দিকে ছুটে এল। ভয় পেয়ে ওরা উঠে দাড়াল। হইহই করে লোক ছুটে আসছে। বেড়াতে আসা পর্যটকরাও ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে। কাছেই কোথাও গণ্ডগোল শুরু হয়েছে। কয়েকজন বিক্ষোভকারী নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে ইট-পাথর ছুঁড়তে শুরু করেছে। আর প্রায়ই যা হয় পুলিশও এলোপাথাড়ি লাঠি চালাতে শুরু করে দিল। উচ্ছৃঙ্খল জনতা এদিক ওদিক পালাচ্ছে।
ফইজান আর কুলসুম নিরাপদ জায়গায় সরে যাবার সময় পেল না, প্রবল ঢেউএর মতো জনতা প্রায় ওদের উপর দিয়েই ছুটে গেল। দুজনে ছিটকে চলে গেল দুদিকে। ভিড়ের ধাক্কায় তাল সামলাতে সামলাতে ফইজান যখন ধাতস্থ হল, তখন সে আর কুলসুমকে খুঁজে পেল না। ইট পাথর বৃষ্টি রুখতে ব্যর্থ হল পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাসের শেল। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা বেশ কয়েক রাউণ্ড গুলি চালাল।
ফইজান চিৎকার করে ডাকল, কুলসুম, কুলসুম!
তখনও মানুষজনের ছোটাছুটি শেষ হয়নি এর মধ্যে কাউকে খুজে বার করা অসম্ভব। ফইজান খানিকটা দুরে সরে গিয়ে একটা চিনার গাছের নীচে দাড়িয়ে রইল চুপ করে। সব শান্ত হয়ে যাবার পর, উদ্ভ্রান্ত হয়ে গোটা টিউলিপ গার্ডেনটা তন্নতন্ন করে খুঁজল। কিন্তু কুলসুমকে কোথাও খুঁজে পেল না। ভয়ে বুকটা ঠান্ডা হয়ে গেল। নিজেকেই অপরাধী মনে হল ফইজানের। জোর করে সে কুলসুমকে এখানে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু ওকে আগলে রাখার দায়িত্ব পালন করতে পারল না। এত ভিড়ের মধ্যে কিছু করারই ক্ষমতা ছিল না। ফইজান পাগলের মতো কুলসুমকে খুঁজতে লাগল এদিক সেদিক। অবশেষে পরদিন ওকে খুঁজে পেল। বুকে পেটে বুলেটের আঘাত নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি।
বেডে শোয়া কুলসুমকে দেখে ফইজানের বুকটা হাহাকার করে উঠেছিল। কুলসুম ওকে দেখে হেসেছিল। স্বচ্ছন্দে নয়। হাসির ছলে ফ্যাকাসে ঠোটের কোণদুটো অল্প কুচকে উঠেছিল। ফ্যাকাসে নিরক্ত মুখে সামান্য খুশিয়াল দেখা দিয়েই মিলিয়ে গিয়েছিল। কুলসুমের কণ্ঠার ঘনঘন উঠানামা দেখে ফইজান বুঝেছিল ওর মতো কুলসুমও আবেগের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। ইশারায় ওকে পাশে বসতে বলল। ফিসফিস করে বলল, আমার একটা কথা শুনবে?
বলো! ভেঙে পড়ার মুহুর্তে পৌছেও প্রাণপন চেষ্টায় নিজেকে সংযত করল ফইজান।
মুখখানা ওরকম তোম্বা করে রাখলে হবে না। তাকাও আমার দিকে। তুমি আমাকে ভালোবাস না!
ফইজান চমকে উঠল। এরকম অস্বাভাবিক একটা প্রশ্ন ও আশাই করেনি। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কুলসুমের দিকে তারপর আস্তে আস্তে বলেছিল এরকম কোন প্রশ্ন তোমার মনে এল কিকরে!
তাহলে একটা কথা বলি, আমরা যখন দুজনে থাকব তখন কারও কথা শুনব না, অন্য কিছু ভাবব না। কারুর প্রতি আমাদের কোন বিদ্বেষ বা আক্রোশ থাকবে না। আমরা দুজনে মিলে একটা আলাদা পৃথিবী তৈরী করে নেব। ভালোবাসার পৃথিবী।
ফইজানের ব্যাপার স্যাপার আব্বা ফয়াজ আহমেদের ভালো ঠেকছিল না। কলেজ যাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশুনায় মন নেই। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে গুম মেরে চুপচাপ থাকে। ডাকলেও সাড়া দেয় না। মাঝে কিছুদিনের জন্য বাড়ি থেকে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিল। উপত্যকার এখন যেরকম অগ্নিগর্ভ অবস্থা, ফয়াজ নিখোজ ছেলের কথা পুলিশে জানাতে সাহস করেননি। কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। ফয়াজ আহমেদ কানাঘুষায় শুনেছেন ফইজানের সঙ্গে একটা মেয়ের সম্পর্ক ছিল। মাস খানেক আগে টিউলিপ গার্ডেনের সামনে বদরুদ্দীনের মেয়ে কুলসুম নিরাপত্তা বাহিনীর ছোড়া গুলিতে মারা গেছে। ফইজানের আম্মা বলছিলেন ফইজান নাকি কুলসুমকে পড়াতো। ফয়াজ আহমেদের দুইয়ে দুইয়ে চার করতে কোন অসুবিধা হয়না। তিনি আল্লার কাছে প্রার্থনা জানান, এই অস্থির সময়ে ফইজান যেন কোন গলদ রাস্তায় পা না বাড়ায়।
আশীকের দেওয়া ঠিকানায় পৌছে ফইজান চুপ করে দাড়িয়ে ছিল। ডাললেকের সামনের রাস্তাটা তখন পর্যটকের ভীড়ে উপছে পড়ছে। পেপারমেসের মতো রঙচঙে পোশাকে সজ্জিত মানুষদের মধ্যে যেন উৎসবের আমেজ। চলমান জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ফইজান আসলে কিছুই দেখছে না। এক অসহ্য মানসিক অস্তিরতায় ছটফট করছে। সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। ভিতরে বসে থাকা চোয়াড়ে চেহারার একটা ছেলে ওকে গাড়িতে উঠতে ইশারা করল।
গাড়িতে ওঠামাত্র ওর চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে দেওয়া হল। ফইজান বুঝতে পারল গাড়ি করে ওকে অনেকটা পথ নিয়ে আসা হল। চোখের কাপড় খুলতে দেখল একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। ওপাশে সবুজ ঢেউ খেলানো চাষের খেত। দূরে চিনার সিডার দেবদারু গাছের ঘন জঙ্গলের ওপাশে গাঢ় সিপিয়া রঙের পাহাড় নীল আকাশের বুকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
এক অন্যরকম ট্রেনিং শুরু হল ফইজানের। মেধাবী ছাত্র ফইজান কী কখনও কল্পনা করেছিল ওর জীবনটা এভাবে টাল খেয়ে যাবে। জীবনটা শুরু হয়েছিল দুর্দান্ত ভাবে। গরিব ফলওলার ছেলে, প্রাইভেট মাস্টার দূরের কথা, বইপত্তরই ঠিক মতো জোগাড় হত না। পড়াশুনার জায়গা জুটত না। তবুও ওরকম রেজাল্ট। নামকরা কলেজে ভর্তি হল। আম্মা আর আব্বার কত স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে। আজকাল কুলসুমকেও যেন ভালো করে মনে পড়ে না। ফইজান মনেমনে ভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতার চাইতে পারিপার্শিক প্রতিবন্ধকতায় মানুষ অনেক, অনেক বেশী অসহায় হয়ে পড়ে।
আশীক ছিল ফইজানদের মেন্টর। ছয়সাতজন ছেলের সঙ্গে ফইজানকে থাকতে হত। কিন্তু ওদের সঙ্গে ওর মিলত না। চলাফেরার কোন স্বাধীনতা নেই। মোবাইল নিষিদ্ধ। ফইজানের প্রাণ হাঁফিয়ে উঠত। ফইজান বেশ বুঝতে পারছিল ওদের টেররিস্ট তৈরী করা হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে মানুষকে ঘৃণা করতে।
এদের মূল উদ্দেশ্য এক ঘৃণার পৃথিবী তৈরী করা। প্রতিশোধের যে আগুন ওর মধ্যে জ্বলছিল তারই তাপে ক্রমাগত পুড়তে পুড়তে ফইজান ক্রমশ এক অন্য মানুষে পরিনত হচ্ছিল। আবেগ অনুভূতিহীন এক অমানব। একজন ভয়ংকর টেররিস্ট। যে হাতে একদিন ও কুলসুমের নরম উষ্ণ হাতটা নিত, সে হাতে আজ ও ধরে ঠাণ্ডা সব ধাতব যন্ত্র। মানুষ মারার অস্ত্র!
আশীক বলে আমাদের লড়াই সিস্টেমের বিরুদ্ধে। কাশ্মীর হবে কেবল আমাদের দেশ। আমরাই এদেশের শাসন ক্ষমতা দখল করব। শুনতে শুনতে ফইজানের মনে হয় এতো ক্ষমতা দখলের কথা, ঘৃণা আর হিংসাই যার সারমর্ম। সাধারণ মানুষের ভালো করার কথা কেউ বলেনা। কাশ্মীরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে প্রতিদিন অনেক তর্কবিতর্ক হয়, কিন্তু কাশ্মীরের উন্নয়ন, সাধারন মানুষের চিকিৎসা, শিক্ষা বা চাকরির কথা কেউ বলেনা। হাজারও প্রশ্ন কিন্তু কোন সদুত্তর পায়না। দোলাচলের মধ্যেই চলতে থাকে ফইজানের ট্রেনিং।
ঠিক একবছর পর টিউলিপ গার্ডেনে এসেছে ফইজান। সঙ্গে আরও চারটে ছেলে। পর্যটকদের আনাগোনা কলকাকলিতে এক উৎসবের পরিবেশ। অদ্ভুত এক অবসাদ আজ ফইজানের সঙ্গী। একটা ঘোরের মধ্যে হাঁটছে। ঠাণ্ডা মাথায় আশ্চর্য দ্রুতগতিতে ফইজানরা কাজটা সারল। আচমকা রাস্তা ফেটে গিয়ে একটা প্রচণ্ড বিষ্ফোরন। পর্যটক ভর্তি টাটাসুমো দুটো আগুনের গোলার মত রাস্তা থেকে ছিটকে উঠে বেশ খানিকটা দুরে গিয়ে উল্টে পড়ল। একবছর আগের সেদিনের মত আবার পর্যটকদের মধ্যে ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। টেররিস্ট অ্যাটাক! মুহুর্তে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকরা জায়গাটা ঘিরে ফেলল। কিন্তু একজন টেররিস্টও ধরা পড়ল না।
পালিয়ে যাবার সেই মুহুর্তে ফইজান কিছুতেই কুলসুমের চেহারাটা স্পষ্টভাবে মনে করতে পারল না। এ যে এক অসম্ভব ব্যাপার। এতদিন চোখ বন্ধ করলেই সামনে ভেসে উঠত কুলসুমের নানান ভঙ্গী, হাসি বা কান্নার সময় ওর মুখের রেখার পরিবর্তন। সে এখন কুলসুমের মুখটাও মনে করতে পারছে না!
উপত্যকা ছেড়ে ফইজান কলকাতায় চলে এল। খালার সঙ্গে ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার কলকাতায় এসেছে। এখানে খালুর কাশ্মীরী শাল জ্যাকেট কার্পেটের দোকান। পুজোর আগে আগেই মালপত্র নিয়ে চলে আসত। দোকান ছাড়াও কিছু বাঁধা খদ্দেরের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে ঘুরে মাল বিক্রি করতে হত।
এইসব গলি, ফইজানের কাছে যেন গতজন্মের স্মৃতি। পুরানো বাড়িগুলোর পাশাপাশি কিছু নতুন ফ্ল্যাট গজিয়ে উঠেছে। ছোটবেলায় এইসব গলির অনেক বাড়িতেই ওর ছিল অবাধ যাতায়াত। খালুর দোকানের একজন কর্মচারীকে সঙ্গী করে রাস্তার বাম দিকের একটা গলিতে ঢুকে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে ডানদিকে আরও সরু একটা গলি। গলিতে ঢুকতেই অবনীবাবুর বাড়ি। পুরানো বাড়িটার দরজায় কলংবেল টিপল। একজন কাজের লোক দরজা খুলল।
বাড়িটার চেহারা এই কয় বছরে অনেকটা জীর্ণ হয়েছে। স্যাঁতাপড়া দেওয়ালে অনেককাল চুনের প্রলেপ পড়েনি। বাইরের ঘরে ওদের বসিয়ে রেখে কাজের লোক উপরে গেল খবর দিতে। ঘরটার ভিতর প্রায় কিছুই বদলায়নি, এমনকি সোফাসেটের বিবর্ণ ঢাকনাগুলো পর্যন্ত একই রয়ে গেছে। দেওয়ালে একটা নতুন ছবি ঝুলছে তাতে শুকনো মালা। ফটো হয়ে যাওয়া লোকটিকে ফইজান চিনতে পারল। তার মানে অবনীবাবু মারা গেছেন। ছোটবেলায় ফইজান যতবার এইবাড়িতে এসেছে উনি ওকে কিছুনা কিছু মিষ্টি বা চকোলেট খাওয়াতেন। আজও হাসি মুখে ফইজানের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। ফটোর মধ্যে চিরস্থায়ী হাসিমাখা মুখ।
সিঁড়িতে হালকা পায়ের শব্দ। কেউ একজন আসছে। ফইজানের একটু উত্তেজনা হল কেমন যেন একটা আবেগ অনুভব করল।
সিঁড়ি দিয়ে এক ভদ্রমহিলা নেমে এলেন নীচে। ফইজানের থেকে হয়তো দুতিন বছরের বড়ো। কিন্তু মহিলাকে দেখলেই বুক কেঁপে উঠে। বীভৎস পোড়ার চিহ্নস্বরূপ মুখটা শুকনো নারকেল মালার মতো। নাকের জায়গায় কেবল দুটো ফুটো। গলার কাছে ব্যাঙের মতো চামড়া ঝুলছে। ওপাশের ঘর থেকে একটা ছোটো ছেলে হুইল চেয়ারে করে বেরিয়ে আসল । ফইজান বুঝতে পারে এই কয় বছরে পরিবারটির উপর দিয়ে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেছে।
মহিলা ঘরের দরজার কাছে দাড়িয়ে ফইজানের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু রক্তমাংসের ফইজানের দিকে নয়, যেন তাকিয়ে আছেন ওর শারীরিক কাঠামোর ভিতরে যে আত্মার অধিষ্ঠান তার দিকে।
ফইজান! কতদিন পর।
গলার স্বর শুনে অপর্ণাদিকে চিনতে ওর অসুবিধা হল না। সে কতকাল আগেকার কথা ছোট্ট ফইজান ওর খালুর সঙ্গে এখানে আসত শাল বিক্রি করতে। এরা ছিল বাধা খদ্দের, ইনস্টলমেন্টে জিনিষ কিনত। পুজোর সময় জিনিষ কিনে ছয়মাস ধরে পরিশোধ করত। দৈবাৎ একবার ভাইফোঁটার দিন চলে এসেছিল। ওর থেকে বছর তিনেকের বড়ো অপর্ণাদিদি একডিস মিষ্টি সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল ওকে ফোঁটা দেবে বলে। ও হাত বাড়িয়ে ডিস্ থেকে একটা মিষ্টি তুলে নিতে চাইছিল। দিদি ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিল আগে ফোঁটা দিতে হয় তারপর মিষ্টি। ফোঁটা দেবার পর দিদি ওকে বলেছিল আজ থেকে আমরা হলাম ভাই বোন। আজও দিদির সেদিনকার গলার স্বর ফইজানের কানে ভেসে আসে।
দিদির সাদা থানের কাপড় আর চুড়ি বিহীন নগ্ন হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে ফইজানের মুখ দিয়ে কথা সরল না। চোখের সামনে তখন ভেসে উঠেছিল লালকালো জমকালো ফ্রকপরা উচ্ছল এক বালিকার মূর্তি।
ফইজানকে চুপ করে থাকতে দেখে ম্লান হেসে অপর্ণাদি বললেন, মাস ছয়েক আগে তোমাদের দেশে বেড়াতে গিয়ে টিউলিপ গার্ডেনের সামনে একটা মর্মান্তিক দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছিলাম। আমাদের গাড়িতে টেররিস্ট অ্যাটাক হয়েছিল। অনুপমের বাবা মারা গেলেন। দুটো পা হারিয়ে হুইল চেয়ার চিরকালের জন্য অনুপমের সঙ্গী হয়ে গেল। আমিও অনেক দিন শয্যাশায়ী ছিলাম।
মাস ছয়েক আগে টিউলিপ গার্ডেনের সামনে টেররিস্ট অ্যাটাক! ফইজানের ভিতরটা কেঁপে উঠল। চোখ সরিয়ে নিল অপর্নাদিদির চোখ থেকে। আর কথা বাড়াল না। বলতে গেলে একরকম পালিয়েই এল ফইজান। বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রচণ্ড কষ্টের একটা অনুভূতি পেট থেকে কান্নার দলা হয়ে এসে আটকে গেল ওর গলার কাছে। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে ঢক্ঢক্ করে অনেকটা জল খেয়েও গলার শুকনো খট্খটে ভাবটা গেল না।
উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘন্টাখানেক রাস্তায় ঘোরাঘুরি করে ফইজান ফিরে এল আস্তানায়। খালুর বাসার এই ঘরটাতেই ছোটবেলায় থাকতো। কিছুক্ষণ খোঁজখুজি করতেই ঘরের দরজার উপরের তাকে তুলে রাখা একটা পুরানো বাক্সের মধ্যে জমিয়ে রাখা এটাসেটা অনেক আবর্জনার ভিতর পেয়ে গেল ওর ছোটবেলার স্মৃতি, ভাইফোঁটা উপলক্ষে অপর্ণাদিদির দেওয়া পেন্সিলবক্সটা। দীর্ঘ দিনের ধুলোময়লা অযত্নে বিবর্ণ হয়ে গেলেও এখনও অটুট আছে। আশ্চর্য! পেন্সিলবক্সটা হাতে নিয়ে দেখতে দেখতে ওর ঝাপসা চোখের সামনে ভেসে উঠল কুলসুমের মুখ। অপর্ণাদিদির নারকেলমালার মতো পোড়া মুখ কখন যেন একাকার হয়ে গেল হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা কুলসুমের ফ্যাকাসে নিরক্ত মুখের সঙ্গে। কানে ভেসে আসে কুলসুমের স্বর আমরা দুজনে মিলে তৈরী করব একটা আলাদা পৃথিবী। ভালোবাসার পৃথিবী। কাঁদতে লাগল ফইজান।
***