বড় গল্প ।। অরূপম মাইতি
নীলকন্ঠ
হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিকেল এসে গেছে। আকাশের পরিস্থিতি যদিও ভাল নয়। পাল্লা দিয়ে, মনোময়ের মনও ভারাক্রান্ত। তার মনে কালো মেঘের আনাগোনা। কাশীতে ফিরে যাওয়ার জন্য, ছোট ছেলে, কৃষ্ণপদ খুব জোর করছে। যদিও বড় ছেলে ষষ্ঠীপদ চায় না, বাবা চলে যাক। তার ইচ্ছে, বাবা দেশের বাড়িতে ফিরে যাক। এই নিয়ে দুই ভাইয়ের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। কথা প্রায় বন্ধ। যে যার মত, আলাদা করে, বাবাকে নিজেদের মনের কথা শুনিয়ে দিয়ে যায়। মনোময় কি চায়, তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই। তবে মনোময় নিজেও ধন্দে পড়েছে। কার কথা শুনবে, ঠিক করতে পারছে না।
ডাক ও তার বিভাগের তৈরি এই আবাসনগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। সব এক রকম দেখতে। তবে দুই ছেলের ফ্ল্যাট পাশাপাশি হয়ে মনোময়ের সুবিধা হয়েছে। নিজের ইচ্ছেমত সে এক ফ্ল্যাট থেকে আর এক ফ্ল্যাটে আসা-যাওয়া করতে পারে। কৃষ্ণপদর ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে সামনের বড় রাস্তা দেখা যায়। তুলনায় ষষ্ঠীপদর ফ্ল্যাটের বারান্দা আকারে ছোট হলেও সুন্দর সুন্দর ফুলের টব দিয়ে সাজানো। সেখান থেকে আবাসন চত্বরের পিছন আর ডান পাশের খালি অংশ দেখা যায়। ছোট ছেলের বারান্দা বেশি আকর্ষণীয় হলেও, ষষ্ঠীপদর ফ্ল্যাটের বারান্দা, মনোময়ের কাছে বেশি পছন্দের। বেশির ভাগ সময়, সে এই ফ্ল্যাটে থাকে।
ষষ্ঠীর পরিবার এখানে থাকে না। বৌমার বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল। দুটো চালের কল ছাড়াও ভূষিমালের দোকান আছে। তার ওপর কেরোসিনের ডিলারশিপ আর একটা রেশন দোকানও আছে। লক্ষীর ভাঁড়ার সর্বদা উপচে পড়ছে। তিন-তিনটে ভাইয়ের কোলে একটি মাত্র বোন। ষষ্ঠী পড়াশোনায় ভাল। তার ওপর সরকারি চাকরি করে। তাছাড়া মধুমতীরও তাকে প্রথম দেখায় মনে ধরেছিল। নাহলে তার সাথে ষষ্ঠীর বিয়ে হওয়ার কথা নয়। হালে অবশ্য ষষ্ঠীর প্রতি মধুমতীর ভাললাগায় দাগ ধরেছে। সে এখন বাপের বাড়িতেই বেশি সময় থাকে।
মনোময়ের বয়স হয়েছে, প্রায় ষাট ছুঁই-ছুঁই। পুরানো কথা মাঝে মধ্যেই মনে পড়ে... যেমন আজ মনে পড়ছে। ষষ্ঠীর বারান্দার গরাদ ধরে, হাতড়াতে ইচ্ছে করছে পুরানো স্মৃতি। এর মধ্যে কখন যে সন্ধে গড়িয়েছে, ঠাওর হয়নি। পিছন থেকে পরী ডাকছে, সেটাও খেয়াল হয়নি।
কি করছ এখানে?
কাঁধ ধরে জোরে নাড়িয়ে দিতে, মনোময়ের সম্বিত ফিরল।
ও-ও-ও তুই, কখন এলি?
এই তো একটু আগে। তুমি চা খেয়েছ?
মনোময়ের গলায় আজ স্ফূর্তি নেই। সাদামাটা স্বরে বলে ওঠে
নারে, খাওয়া হয়নি। তুই এসেছিস, এবার খাব।
বেতের টেবিল থেকে খবরের কাগজ আর পাতা উলটে যাওয়া, পত্রিকাগুলো গুছোতে গুছোতে, পরী বলে
কৃষ্ণর বউ তো বাড়িতে আছে...তাকে তো বলতে পারতে...চা করে দিত!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মনোময় উত্তর দেয়
তাকে আর বিরক্ত করতে ইচ্ছে করল না...তাছাড়া সেও তো চায়ের কথা শুধোয়নি
বই, কাগজ গুছোনো বন্ধ রেখে, পরী খানিক স্থির দৃষ্টিতে মনোময়ের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল
একবার ভেবে দেখেছ, আমি না থাকলে, তোমার কি হবে?
কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে পরীর দিকে তাকিয়ে দেখে, মনোময় বলে
সেটাই তো মস্ত বড় প্রশ্ন রে পরী। সেই ভাবনায় তো আমার ঘুম উধাও হয়েছে।
তার মানে? কি বলছ? আমি তো কিছুই বুঝছি না।
হ্যাঁরে পরী, আমি ঠিক বলছি...
ঠিক আছে, আগে তুমি ঘরে চল...সবে শীত পড়তে শুরু করেছে...ঠাণ্ডা লেগে যাবে
পরীকে থামিয়ে মনোময় বলে ওঠে
এই তোর দোষ। সবেতেই তাড়া দেওয়া তোর একটা বাজে অভ্যাস!
তাড়া কি আর এমনি দিচ্ছি! সন্ধের পর খোলা জায়গায় দাঁড়ালে ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে...তাই তো ভিতরে যেতে বলছি...যা বলবে, ঘরে গিয়ে বল।
মনোময় আর কথা বাড়াল না। পরীর পিছন পিছন ঘরে ঢুকে পড়ল। স্মৃতির ভাঁড়ার এক বার নড়ে উঠলে, তার থেকে বেরোনো কঠিন। আরামকেদারা টেনে নিয়ে, মনোময় সন্তর্পনে তাতে বসল। তারপর দরজার দিকে চোখ পড়তে, দেখল পরী ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমাকে চেয়ারে বসতে বলে, কোথায় চললি?
ঠোঁটের কোণে মুচকি হেসে, ঘাড় ঘুরিয়ে পরী বলল
এত ছটফট কর কেন বল তো! আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না!
না, তা হয়ত যাচ্ছিস না, তবে তুই চললি কোথায়, সেটা তো বল!
কোমরে দু-হাত দিয়ে, মনোময়ের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে, পরী বলল
তোমার জন্য এক কাপ আর আমার জন্য এক কাপ, মোট দু-কাপ চা বানাতে যাচ্ছি।
ওহ...সেটা তো আগে বললেই হত...
II২II
পাঁচ বছর হল, প্রমীলা গত হয়েছে। তারপর থেকে মনোময়ের সংসার দুই খাতে বইছে। দুই ছেলে দুই মেরুতে অবস্থান করে। তার সৌভাগ্য যে দুই ছেলের চাকরি আর বিবাহ, দুটোই সময়ে সম্পন্ন হয়েছে। সেসব নিয়ে তাকে খুব বেশি মাথা ঘামাতে হয়নি। তবে সে এখন, ছেলেদের থেকে কয়েক যোজন দূরত্বে দাঁড়িয়ে। দিনের পর দিন, সেই দূরত্ব কমার বদলে বরং বাড়ছে। প্রমীলার মৃত্যুর পরে, মনোময় খড়গপুর থেকে রামরাজাতলায় এসে, ইছাপুরে ছেলেদের কাছে থাকতে শুরু করে। নতুন করে ছবি আঁকাও শুরু হয়। ষষ্ঠীর ফ্ল্যাটের একটা ঘরে, মনোময়ের আঁকা কয়েকটা ছবি রাখা আছে। সে যে দারুণ ছবি আঁকে, এই তল্লাটের অনেকে সেটা জেনে ফেলেছে। ছেলেমেয়েদেরকে আঁকা শেখানোর জন্য, মনোময়ের কাছে প্রচুর অনুরোধ আসে। তবে সেসব অনুরোধ, সে পত্রপাঠ ফিরিয়ে দিয়েছে। ছবি আঁকা, মনোময়ের কাছে একটা নেশা। সেটাকে পেশা করতে, তার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই।
সবাই ফিরলেও, পরী আসা বন্ধ করেনি। সতেরো নম্বর থেকে দুটো বাড়ি ছেড়ে, কুড়ি নম্বরের দোতলায় ডান দিকের ফ্ল্যাটে পরীদের সংসার। বাবা ডাক বিভাগের কর্মী ছিলেন। সেই সূত্রে এখানে বসবাস। কলেজে পড়তে পড়তে আদিত্যের সঙ্গে ভালবাসা হয়েছিল। কলেজ থেকে বেরিয়ে বিয়ে। তবে সে বিয়ে বেশি দিন টেঁকেনি। বছর খানেক কোন রকমে গড়িয়েছিল সংসার। তারপর কাটছাঁট। পরী নাকি কামশীতল। তার সাথে সংসার করা যায় না, আদালতে দাঁড়িয়ে এই ছিল আদিত্যের অভিযোগ। পরীর বাড়ির লড়াই করার সাধ্য ছিল না। বিনা বাধায় বিচ্ছেদ পেয়েছিল আদিত্য।
শান্ত, নিরুত্তাপ জীবন দিব্যি কাটাচ্ছিল পরী। প্রতিবেশি হয়ে মনোময়ের সাথে পরিচয়ের পরে, তার আঁকা ছবির টানে একটু একটু করে বাড়তে থাকে অন্তরঙ্গতা। মনোময় একা থাকেন। ছেলেরা, কেউ বাবাকে সময় দিতে পারে না। পরীর সঙ্গ পেলে বাবা যদি ভাল থাকেন, মন্দ কি! ষষ্ঠী আর কৃষ্ণ পরীর আসা-যাওয়াতে আপত্তি করেনি। মনোময়ের কাছে পরীর যাতায়াত অবাধ হয়ে ওঠে। তাকে দেখাশোনার দায়িত্বও এক প্রকার তার কাঁধে পড়ে। যদিও সেটা তাকে কেউ দেয়নি, নিজের থেকেই সেটা সে কাঁধে তুলে নিয়েছে।
মনোময়ের মন আজকাল বড্ড বেশি উতলা থাকে। সব কিছু নতুন করে শুরু করতে ইচ্ছে করে। মাথা ঝুঁকিয়ে বসলেও মন শান্ত হয় না। আরামকেদারা থেকে উঠে, ঘরের বাঁ দিকে এগিয়ে যায় মনোময়। ঢাকা কাপড় সরিয়ে ক্যানভাসের দিকে এক দৃষ্টে থাকিয়ে থাকে। পেনসিল স্কেচে আঁকা ছবিটা সবে শেষ হয়েছে। মাথায় খোঁপা, লম্বা নাকের নীচে পুরু ঠোঁট, তার নীচে ঝুলন্ত চিবুক। চিবুকের মাঝে একটা বড় তিল। ওপরের ঠোঁটের বাঁ পাশে ঠোঁট ঘেঁষে, একটা ছোট্ট তিল। মনোময় যে কার ছবি এঁকেছে, ছবিটা ভাল ভাবে দেখলেও তা বোঝা যায় না।
এখন আর রঙ-তুলিতে হাত লাগিও না। চা খেয়ে নাও।
পরীর কথায়, চমকে ওঠে মনোময়।
ওহ! তুই এসে গেছিস...
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে, কেদারায় বসে, টেবিল থেকে, কাপ তুলে নিয়ে, গরম চায়ে চুমুক দেয় মনোময়।
বাহ! চমৎকার স্বাদ...তুই ছাড়া এমন চা আর কেউ বানাতে পারে না...
কোন উত্তর না দিয়ে পরী চুপ করে চায়ে মন দেয়। দু-তিন চুমুক পরে জানতে চায়
তুমি কি একটা মস্ত বড় প্রশ্নের কথা বলছিলে! সেটা এবার বলতে পার।
মনোময় উত্তর দেয় না। চুপ করে চায়ে ব্যস্ত থাকে। অবাক হয় পরী।
কি হল...মস্ত বড় প্রশ্নটা কি...সেটা তো বল...
মনোময় খুব দ্রুত চা শেষ করে। তার মুখ এখনও বন্ধ। অধৈর্য হয়ে ওঠে পরী।
না বলবে তো না বলবে, জানতে আমার বয়ে গেছে।
মনোময় এবার মুখ খোলে। থমথমে গলায় বলে ওঠে
যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, তোর চা খাওয়া শেষ হলে, কপালটা একবার টিপে দে।
সে নাহয় দিচ্ছি। তবে তুমি এখনও কিছু বললে না!
টেবিলে কাপ নামিয়ে রেখে, মনোময়ের কাছে যেতে যেতে, কৌতুহলের বশে, পরী হঠাৎ খোলা ক্যানভাসের দিকে এগিয়ে যায়।
নতুন ছবিতে হাত দিয়েছ, বলনি তো!
বিরক্তিভরা গলায়, মনোময় বলে উঠল
ছবি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না...পরে দেখলেও চলবে...আগে মাথা টিপে দে
একটু দাঁড়াও, ছবিটা এক ঝলক দেখে, তারপর যাচ্ছি।
মনোময় আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে...মাথার যন্ত্রণায় আর সহ্য হচ্ছে না।
আরে বাহ, স্কেচটা তো দারুণ...আচ্ছা, কাকে ভেবে এঁকেছ বল তো!
মনোময় নিরুত্তর। পরী থামে না। একটার পর একটা কথা বলে যায়।
খোঁপা তো আমি করি না। এটা তাহলে আমার ছবি নয়। তবে নাক আর ঠোঁটের সঙ্গে আমার মিল আছে। ঠিক করে বল তো, কার ছবি এঁকেছ!
তুই কপাল টিপে দিবি না কি বকবক করবি...
আরে বাবা, দিচ্ছি কপাল টিপে, যাচ্ছি...
আর একবার ঘাড় ঘুরিয়ে ছবি দেখে, হাসি হাসি মুখ করে, মনোময়ের দিকে এগোতে এগোতে বলে ওঠে
ওষুধ-তেলের শিশি কোথায় রেখেছ?
এই তো আমার হাতে, নিয়ে বসে আছি...
শিশির ছিপি খুলে, মনোময়ের কপালে ওষুধ-তেল ভাল করে ঘষতে ঘষতে, ছবি নিয়ে আর একটা প্রশ্ন করার লোভ সামলাতে পারে না পরী।
আচ্ছা, চিবুকটা ঝুলিয়ে দিলে কেন? আমার চিবুক তো এমন নয়!
ওষুধ-তেল লাগানো শেষ। মাথা যন্ত্রণা একটু কমেছে। মনোময় এখনও কোন উত্তর দেয় না। ওষুধ লাগানো কপালে, পরী হালকা করে ফুঁ দেয়। হঠাৎ মনোময় বলে বসে
তুই কি নিজেকে আয়নায় দেখেছিস কখনও?
ফুঁ দিতে ব্যস্ত পরী, কথাটাকে প্রথমে খেয়াল করেনি। তবে কথাটা তার কানে পৌঁছেছে। তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অনুভব করে, মনোময় দু-হাত দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরেছে। এ ছোঁয়া তার ভাল লাগছে। বুঝতে পারে, তার ভিতর থেকে কেউ বিরোধ করছে না। পরিবর্তে একটু একটু করে বলিষ্ঠ দুটো পুরুষালি হাতের মধ্যে তার উপোষী শরীর একটু একটু করে ঢুকে পড়ছে। মনোময় তাকে নিজের শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে চাইছে। বহু দিন পরে, আজ পরীর শরীর সাড়া দিচ্ছে, পুরুষের হাতে।
ক্ষণগুলো এক এক করে কেটে যায়। পরী এখন শাড়ির বেষ্টনী থেকে আংশিক মুক্ত। শরীরের উপরিদেশ নিরাবরণ। খোলা পিঠের চওড়া জমিতে, আশ্লেষে বিঁধে যাচ্ছে, মনোময়ের নখ। নরম তুলতুলে পাখির শরীর যেভাবে হাতের মুঠোয় ঢুকে পড়ে, পরীও সেভাবে গলে যাচ্ছে মনোময়ের আলিঙ্গনে। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে, দুজনের কেউ তার খেয়াল রাখেনি! ধরা পড়ার ভয়, দুজনের কারও মনের মধ্যে ছিল না। তাই তো নির্বিঘ্নে একে অন্যের মধ্যে মিশে যাচ্ছিল। তবে তৃতীয় ব্যক্তি কিন্ত শেষ পর্যন্ত এলো আর তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটি মাত্র বাক্য।
কি করছ তোমরা?
কথাটা সশব্দে আছড়ে পড়ে, চাবুকের মত। পরী নিজেকে সামলে নেয়। মেঝে থেকে ছোঁ মেরে শাড়ি টেনে নিয়ে, শরীরের খোলা অংশ ঢেকে নিতে নিতে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আর্তনাদ,
না, না, এসব কিছু নয়...ভুল ভাবছ তুমি।
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না ষষ্ঠী। কথাটা বলে দিয়ে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। পিছনে পিছনে পরীও দৌড়ে বেরিয়ে যায়। লাভা উদগিরণের পরে মাটি যেমন একটু একটু করে শান্ত হয়, মনোময় তখন ঠিক সেই অবস্থায়। বয়স তাকে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধা দেয়। কিংকর্তব্যবিমূঢ়়, তার মুখ থেকে অস্ফূটে শুধু বেরিয়ে আসে একটা কথা
পরী! পরী! শোন আমার কথা! দাঁড়া! কথা শোন!
সেদিন মনোময়ের কথা কেউ শোনেনি। সে কি বলতে চেয়েছিল, অজানাই থেকেছে। খালি ঘরে, মনোময় সেদিন একা বসেছিল অনেক ক্ষণ। ক্যানভাসে পেনসিল স্কেচে আঁকা ছবিতে যদি প্রাণ থাকত, তবে মনোময় হয়ত তার সঙ্গে কথা বলে হালকা হতে পারত। বাবা অন্ত প্রাণ ষষ্ঠীপদ এ ঘটনা পাঁচ কান করেনি। মনের অন্তঃপুরে রেখে দিয়েছিল। এমন কি, পাশের ফ্ল্যাটে থাকে তার ছোট ভাই, কৃষ্ণপদ, তাকেও জানতে দেয়নি। ঘটনার পর অনেক দিন পর্যন্ত, ষষ্ঠীপদ বাবার মুখোমুখি হত না। দুজনের মাঝে তৈরি হয়েছিল অদৃশ্য দেওয়াল।
II৩II
বাবা! বাবা! খিদে পেয়েছে। খাবে না?
ট্রেন ছাড়া অবধি এখনও পর্যন্ত ষষ্ঠী ডুবেছিল ঘোরের মধ্যে। গাড়ির গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, ঝাঁপি থেকে বেরিয়ে আসছিল স্মৃতির এক-একটা টুকরো। গৌরাঙ্গ দু-একবার ডেকেছে। তবে সে ডাক তার কানে পৌঁছয়নি। গৌরাঙ্গ কি করছে, পাশ ফিরে দেখার কথা মনেও হয়নি। স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতে হুঁশ ফেরে এক যাত্রীর কথায়। মাঝবয়সি এক দেহাতি মানুষ জানতে চায়
বাবু! এ গাড়ি কাশী যাবে তো?
চুপচাপ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে, উত্তর দেয় ষষ্ঠী।
যাবে! আপনি বসুন। আমরাও কাশী যাচ্ছি।
এতক্ষণে চোখ পড়ল ছেলের দিকে।
কিরে, খাবি না? খিদে পায়নি?
খাব তো! তোমাকে তো কত করে ডাকছি। তুমিই তো শুনছ না!
আমাকে ডেকেছিস? শুনিনি? ওহহ! ভুল হয়ে গেছে...
গৌরাঙ্গের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ষষ্ঠী বলে ওঠে
ঠাকুর্দাকে মনে পড়ে? ছোটবেলায় তো খুব কম দেখেছিস!
আধো আধো গলায় গৌরাঙ্গ বলে
একটু একটু মনে পড়ে। তাতে কি, এবার তো ভাল করে দেখব। থাকব, ঠাকুর্দার সঙ্গে।
দীর্ঘ ছয় বছর পরে, ছেলেকে নিয়ে, বাবাকে দেখতে যাবে বলে, ট্রেনে চেপেছে ষষ্ঠী। নিজে দেখবে, ছেলেকেও দেখাবে। যদিও এই যাওয়া কিছুটা ছেলের জিদের কাছে হার মেনে।
গাড়ি ছাড়ুক, তারপর খাবারের প্যাকেট খুলব।
কিছু না বলে, গৌরাঙ্গ মাথা নাড়ে।
বাবা, আজকের খবর কাগজ পড়েছ?
নারে, পড়া হল কোথায়? তুই পড়েছিস?
গৌরাঙ্গের হাতে ধরা খবরের কাগজ টেনে নিয়ে, চোখ বোলায় ষষ্ঠীপদ। রবিবারের সাময়িকীতে প্রকাশিত একটা গল্পের হাইলাইট করা অংশে লেখা আছে...
'মনের মধ্যে বিড়ম্বনা নিয়ে তিনি চললেন, কাশী। বাবা কাশীবাসী বলে, খোঁজখবর নেওয়ার জন্য, দিব্যেন্দুকে প্রায়ই কাশী যেতে হত। জীবনভর তিনি এই কর্তব্য পালন করেছেন।' ষষ্ঠীপদ, নিমেষে শরীরে একটা শিহরণ অনুভব করে। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলের কাছে জানতে চায়,
পরের পাতা তোর কাছে?
হ্যাঁ, এই তো পরের পাতা...তুমি পড়বে?
বলতে বলতে গৌরাঙ্গ, কাগজের আর একটা পাতা এগিয়ে দেয় বাবার দিকে।
হাতে নিয়ে চোখে পড়ে, শিরোনামে বড় হরফে লেখা আছে...'নীলকন্ঠ দিব্যেন্দু'
আনমনে গলায়, কপালে, ঘাড়ে হাত বুলোতে শুরু করে ষষ্ঠীপদ।
নীলকন্ঠ তো আমিও...
খুব জোরে ছুটছে গাড়ি। গৌরাঙ্গ জানলার পাশে বসতে চাইলে তাকে জায়গা করে দিয়ে, ষষ্ঠীপদ পকেট থেকে মানি ব্যাগ বার করে। ব্যাগের ভিতরের একটা পকেট থেকে বার করে আনে একটা চিরকুট। কাগজের গায়ে সময়ের আঁচ লেগেছে। রঙ হয়ে গেছে হলুদ।
"আমায় মাফ করিস তোরা। পরীর মধ্যে আমি প্রমীলাকে দেখতে পাই। আমরা কোন পাপ করিনি। আমাকে ভুল বুঝিস না। ভাল থাকিস তোরা।
চোখের কোণ থেকে, টপ করে দু ফোঁটা জল পড়ে ভিজিয়ে দেয় কাগজটাকে।
=======০০০======
অরূপম মাইতি
১৫ নন্দীপাড়া লেন, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ – ৭১১১০৪
চলভাষঃ +৯১-৯৪৩৩০২৬৩৩৮ এবং +৯১-৯৮৩০০৬৫২৬৪ (W)