ছোটগল্প : ঋতম ।। সবিতা বিশ্বাস
ঋতম
সবিতা বিশ্বাস
"ঋতম নার্সিংহোম" | সকালবেলা আনন্দবাজারের ইন্টারনেট সংস্করণে জেলার
পাতায় চোখ রাখতেই ছবিটা চোখে পড়ল| সত্যি দারুন খবর ! ডঃ অর্ণব চৌধুরী খুব খুশি হলেন
|
সেই কত বছর আগে মাজদিয়া ছেড়েছিলেন | স্কুল ছাড়ার পর থেকে ধরলে তেত্রিশ বছর তো
হবেই | তেইশ বছর ধরে ডঃ চৌধুরী পিঙ্ক সিটি ব্যাঙ্গালোরের হিন্দুস্তান ইউনিলিভার
রিসার্চ সেন্টারের স্ট্র্যাটেজিক সায়েন্স গ্রুপের ডাইরেক্টর | বিদেশের সঙ্গে পাল্লা
দেওয়া এই শহরের উপচে পড়া সুখের মধ্যে থেকেও ডঃ চৌধুরী ভোলেননি শৈশব কৈশোর কাটানো
নিজের গ্রামকে | এখনো চোখ বুঁজলেই দেখতে পান ভরা বর্ষায় কচু পাতার ছাতা মাথায় দিয়ে
বঁড়শিতে কেঁচোর টোপ গেঁথে বিলের ধারে বসে আছে একটা বারো তের বছরের ছেলে | দোবিলের বিল
তখন যেন সমুদ্র | সেই ছেলেটার সমুদ্র দর্শন হয়নি তখনো | তাই বর্ষার জলে প্লাবিত দোবিলের
বিলকেই সমুদ্র মনে হতো | এরকম আরো কত ছবি যে ভেসে ওঠে এখনো | তাই 'ই সংস্করণে' মাজদিয়াতে
"ঋতম নার্সিংহোম" উদ্বোধনের ছবিটা দেখে পুরো মাজদিয়ার মানচিত্র চোখের সামনে
ভেসে উঠলো ডঃ চৌধুরীর |
শিয়ালদা থেকে গেদে লোকালে চেপে মাজদিয়া স্টেশন এ নেমে ঘিঞ্জি গলির রাস্তা পেরোলেই
বটতলা | ওখান থেকে কৃষ্ণনগর যাবার রাস্তা ধরে আরো খানিকটা এগোলে বাঁ হাতে মাজদিয়া হাইস্কুলের
ফুটবল খেলার মাঠ | ওরই প্রায় উল্টোদিকে ভাদুড়ী
বাড়ি | ডঃ চৌধুরী ছোটবেলায় দেখেছেন বাড়িটার চারিদিকে বর্শার ফলার মতো লোহার প্রাচীর
| মাঝখানে মস্ত বাড়ি | সে বাড়ির ঘরগুলোর উচু কড়ি বরগার ছাদ, জাফরি দেওয়া জানালা আর
ধবধবে সাদা পাথরের মেঝে | আম, জাম, নারকেল দিয়ে ঘেরা বাড়িটায় কি যেন রহস্য ছিল |
ভীম একাদশীতে শিবনিবাসের মেলা বসত | মেলা থেকে
ফেরার পথে সন্ধ্যাবেলায় যখন গোল থালার মত চাঁদ উঠত, সেই চাঁদের আলোয় বাড়িটার দিকে
তাকালে গা ছমছম করতো | কালের করাল গ্রাসে রহস্যময় সেই বাড়ি তার সব রহস্যময়তা, ঐশ্বর্য
হারিয়ে ইঁট কাঠের কঙ্কাল হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলত | সেখানেই গড়ে উঠেছে আধুনিক চিকিৎসা
ব্যবস্থাসহ ত্রিতল নার্সিংহোম | ভেবে দেখলে ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে | মানুষ অতীত
আঁকড়ে বেঁচে থাকতে পারে না | আর বাড়িটা হারায়নি
| সে তার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়ে জ্বলজ্বল করছে বিখ্যাত লেখকের উপন্যাসে |
ডঃ স্মার্ত মজুমদার বদলি হয়ে কৃষ্ণগঞ্জ হাসপাতালে এসেছিলেন বছর দশেক আগে | সপরিবারে
থাকতে শুরু করেন এখানে | কলকাতা থেকে একশো পাঁচ কিমি দূরের এই গ্রামের প্রেমে
পড়ে যান ডক্টর স্মার্ত এবং ওনার স্ত্রী শ্রীমন্তি | সেই কারণেই এই হাসপাতালের মেয়াদ
পূর্ণ হতে কলকাতা যাবার সুযোগ পেয়েও না গিয়ে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছিলেন
| কাজটা যে খুব ঝুঁকির ছিল জানতেন ওঁরা | আত্মীয়স্বজন সকলেই অনেক রকম কথা শুনিয়েছিল
কিন্তু ওরা ততদিন নার্সিংহোম এর জন্য জায়গা কিনে ফেলেছেন | ডক্টর মজুমদারের হাতযশ
ছিল খুব | ফলে প্রাইভেট প্র্যাকটিস জমতে সময় লাগেনি | অন্য ডাক্তাররা ঈর্ষান্বিত হয়ে
ক্ষতি করার চেষ্টা যে করেনি তাও বলা যাবে না | কিন্তু ডাক্তার মজুমদারের ডাক্তার হিসেবে
যতটা খ্যাতি ছিল ঠিক ততটাই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন ভালো মানুষ হিসাবে | সব বাধা পেরিয়ে
তিনি নার্সিংহোম তৈরি করতে সফল হয়েছিলেন |
মাজদিয়াতে দুটি এইচএস স্কুল, কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ, তিন তিনটি ব্যাংক এসব ছিল,
কিন্তু চিকিৎসা পরিষেবা ঠিকমতো
ছিল না | সেই জায়গাটা এতদিনে পূর্ণ হল |
ডক্টর মজুমদারের একমাত্র পুত্রের নাম ঋতম | ছেলের নামেই নার্সিংহোম | "ঋতম
নার্সিংহোম" |
শ্রীমন্তি চেয়েছিল ছেলের নাম রাখবে সুবর্ণ | কিন্তু স্মার্ত সেটা চাননি | পুত্রের জন্মের অনেক আগে থেকেই স্মার্ত ভেবে রেখেছিলেন ছেলে
হলে ঋতম নাম রাখবেন | এর পিছনে একটা কারণও আছে |
ডঃ স্মার্ত তখন মুর্শিদাবাদের ঘোড়শালা হাসপাতালে কর্মরত | সেই সময় ঘোড়শালায়
বেদযজ্ঞ সম্মেলন হয়েছিল | সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন স্মার্ত, সেখানেই শুনেছিলেন ঋতম
শব্দের অর্থ 'সত্য' | এই বিষয়ে প্রাঞ্জলভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভারত সেবাশ্রম সংঘের
একজন দিব্যকান্তি মহারাজ | তিনি বলেছিলেন "আমরা যজ্ঞ করি, কারণ যজ্ঞ মানুষের কামনা,
বাসনা, ক্রোধকে নিয়ন্ত্রিত করে মহাজাগতিক কর্মধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে সমস্ত জগতের
ভারসাম্য রক্ষা করে | এবং পৃথিবীকে সবার উপযুক্ত বাসভূমি রূপে সুরক্ষিত রাখে | বেদে
এই মহাজাগতিক কর্মধারাকে 'ঋতম' বলা হয় |"
মহারাজের মুখনিঃসৃত সুললিত বাণী শুনে ডঃ স্মার্ত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন | সেদিনই
ঠিক করেছিলেন পুত্র সন্তান হলে নাম রাখবেন ঋতম | আর কি আশ্চর্য ! ঋতম যত বড় হচ্ছে
নামের মর্যাদা রাখতে কোনরকম মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছে না | সত্যি বলতে কি এই জন্য মাঝে
মাঝে ওদের অস্বস্তিতে পড়তে হয় |
নার্সিংহোম উদ্বোধনে শ্রীমন্তির বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন সবাই এসেছে | কিন্তু স্মার্তর
মা আসেননি | শ্রীমন্তি স্মার্তর মাকে একেবারেই পছন্দ করেনা | তাই স্মার্তকে কিছুতেই
বলতে দেয়নি | ডঃ স্মার্ত অনেকবার বোঝানো সত্তেও শ্রীমন্তি কিছুতেই রাজি হয়নি | ঋতম
মায়ের উপর খুব রাগ করেছে, ঠাম্মা এলে কি হতো ? শরীর একটু খারাপ তাতে কি ! সে তো দিদুনের
শরীরও খারাপ কিন্তু বসে বসে সব দেখছে | ঠাম্মাও বসে বসে দেখত | ঠাম্মাকে খুব ভালোবাসে
ঋতম | শ্রীমন্তি ভেবে পায় না ঠাকুরমা ঠাকুরদার পরে এত টান কি করে জন্মালো ঋতমের |
ঋতমকে ওদের সঙ্গ পাওয়ার সুযোগই দেয়নি শ্রীমন্তি
|
স্মার্তর বাবা বি এস এন এলে কাজ করতেন | খুবই সরল সাদাসিধে মানুষ ছিলেন | কিন্তু
কেন যে শ্রীমন্তি ওদের পছন্দ করে না এটাই বুঝে উঠতে পারেনা স্মার্ত | ওদের বিয়েটা নিয়ে
প্রথমে আপত্তি ছিল, সে আপত্তিটা থাকাই স্বাভাবিক | জলপাইগুড়ি মেডিকেল কলেজে পড়তে
গেল ছেলে, পড়া কমপ্লিট হলো না তার আগেই বললো আমি বিয়ে করেছি | এ কথা শোনার পর যে
কোন বাবা মা আপত্তি করবে, এটা তো স্বাভাবিক | কিন্তু রাগ, অভিমান ঝেড়ে ফেলে শ্রীমন্তিকে
বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন স্মার্তর মা |
অনেকবার স্মার্ত শ্রীমন্তিকে কে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, বাবা নেই, এখন মাকে আমাদের
কাছে নিয়ে আসি | কিন্তু শ্রীমন্তি কিছুতেই রাজি হয়নি | দমদমের বাড়িতে দুজন কাজের লোকের
ভরসায় আছেন উনি | এটাও বলেছেন ঋতম বড় হচ্ছে ওর মনে খারাপ প্রভাব পড়বে কিন্তু শ্রীমন্তির
সেই এক গোঁ | তোমার মা এর সঙ্গে আমি একদিনও থাকবো না | বাঙালরা কখনও ভাল হয় না | এবার
স্মার্ত হেসে ফেলেছে, একটু ভেবে বল আমার বাবা মা বাঙাল, আমি কি ঘটি ? আমিও তো বাঙাল
তাহলে আমার সঙ্গে থাকছ কি করে ? শ্রীমন্তি আদুরে গলায় উত্তর দিয়েছে তুমি বাঙাল হলে কি হবে ? তোমার জন্ম এই দেশে | তুমি বাঙালদের
মতো কথা বলোনা | স্মার্ত হাল ছেড়ে দিয়েছেন যে বুঝেও না বোঝার ভান করে তাকে বোঝানো
বৃথা | শ্রীমন্তি এত বোকা নয় যে এটা বুঝতে
পারবে না | বাঙাল বাবা মায়ের সন্তান এ দেশে জন্ম নিয়েছে বলে সে ঘটি হয়ে যাবে |
এটা নিয়ে যত কথা বলবে ততই তিক্ততা বাড়বে | স্মার্ত দেখেছেন এগুলো ওর পেশার ক্ষতি
করে তাই এখন আর কিছু বলেন না | কিন্তু আজকের আনন্দটা কিছুতেই পূর্ণ হচ্ছে না | শ্রীমন্তির
কথা শুনে মাকে না বলাটা ভুল হয়েছে | না না ভুল নয়, অন্যায় হয়েছে | তাই পুরোহিত
যখন যজ্ঞ শুরু করেছেন তখন ডঃ স্মার্ত মাকে
ফোন করলেন, মা আজ আমি নার্সিংহোম উদ্বোধন করছি | তুমি আমাকে ক্ষমা করো মা |
আর বলতে পারলেন না স্মার্ত, ফোনটা হাতে নিয়ে ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন, নিজেকে আর সামলাতে
পারলেন না | শ্রীমন্তি তখন গেস্টদের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে | একবারও জানার চেষ্টা
করলো না আজ স্মার্তর মনে কি হচ্ছে !
ঋতম বাবাকে ফোন হাতে চোখের জল মুছতে দেখে ছুটে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো | স্মার্ত
ছেলেকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মত কেঁদে ফেললেন | মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে শান্ত গলায়
বলল "বাবা চোখ মোছো, মা দেখতে পাবে" |
নার্সিংহোমকে কেন্দ্র করে মাজদিয়ার সামাজিক
অর্থনৈতিক চেহারাটাই বদলে গেছে | মেডিসিন সপ যে কত হয়েছে তার গোনাগুনতি নেই | হোটেল
লজ ফাস্টফুড সেন্টার সব হয়েছে | এখন আর রক্ত পরীক্ষা করতে পেশেন্টকে কলকাতায় রায়
ত্রিবেদী বা সিরামে যেতে হয়না | উন্নতমানের প্যাথলজি ল্যাব গড়ে উঠেছে | উল্লেখযোগ্য
ঘটনা হলো একটা নার্সিং কলেজ হয়েছে ঋতম নার্সিংহোমের পাশেই |
অনেকদিন ধরে বি এল আর ও অফিসের পাশে একটা ফাঁকা বাড়ি তালা বন্ধ অবস্থায় পড়েছিল
| ওই বাড়িতে একজন স্কুলশিক্ষিকা থাকতেন একাই | সুন্দরী অবিবাহিতা কালচার্ড মহিলা ছিলেন
| সবসময় পরিপাটি থাকতেন | কারো সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না | বাড়িতে পোষ্য বিড়াল ছিল
অনেকগুলো | ওদের নিয়েই অবসরজীবন কাটতো তার | মাঝে মাঝে ওনার এক দাদা আসতেন | তিনিও
রাশভারী ছিলেন | আর ওনার বোনঝি এসেও মাঝে মাঝে থাকতো | এইরকম শান্ত নির্বিরোধী প্রৌড়া
মানুষটি খুন হয়ে গেলেন একদিন | সকালে কাজের মাসি এসে ডেকে ডেকে সাড়া না পেয়ে বাড়ির
উলটো দিকের প্রতিবেশীকে ডেকে আনলো | এরপর পুলিশ, পুলিশ কুকুর , কৌতুহলী মানুষজন সবাই
এলো | আততায়ী বাড়ির পিছন দিকের জানালা কেটে ঢুকেছিল | কোনো কিনারা হলোনা | রহস্যের
আড়ালে থেকে গেল খুনটা | কে,কেন এমন কাজ করলো জানাই গেল না | অনেকদিন ধরে আলোচনা চলল
| তারপর কবে যেন সবার মন থেকে মুছে গেল ঘটনাটা | শুধু বিড়ালগুলো কেঁদে কেঁদে বেড়াত
বাড়ির চারপাশে | সাজানো বাগান আগাছায় ভরে গেল |
সেই বাড়ি ভেঙে নার্সিং কলেজ গড়ে উঠেছে | দেখতে দেখতে কতদিন হয়ে গেল | এখন গুগল
ম্যাপ খুললেই জ্বলজ্বল করে নার্সিংহোমের নাম | রানাঘাট কৃষ্ণনগর তো বটেই, কল্যাণী থেকেও
পেশেন্ট আসে এখানে | গরীব মানুষগুলো কম খরচে সঠিক পরিষেবা পায় |
ঋতম ও আর ছোট নেই পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি হাইটের গুড লুকিং স্মার্ট ইয়ংম্যান
| গুড ক্যারিয়ারও তৈরি করেছে | ডঃ ঋতম মজুমদার এম. ডি, ডি. এন. বি, ডি. এম (ক্লিনিকাল
হেমাটোলজি) | এন আর এস মেডিকেল কলেজের সঙ্গে এটাচড | মানুষের মনে একটা ভয় ছিল রক্তের সমস্যা, তাহলে
নিশ্চয়ই ক্যান্সার | পেশেন্ট অসুখ ধরা পড়ার আগেই ভেঙে পড়তো | কিন্তু ডঃ ঋতম চেষ্টা
করেন রোগীর মানসিক শক্তি বাড়াতে | জ্বর সর্দি কাশির মতোই এটাও একটা অসুখ | একে বেশি
প্রাধান্য দিলে রোগীকে কব্জা করে ফেলবে |
বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত | প্রতিবছর মারা
যায় প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষ | ডঃ ঋতম সবসময় বলেন খাদ্যাভাস পাল্টানো খুব জরুরী
| অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারই ক্যান্সার প্রতিরোধের অন্যতম উপায় |
এতদিন শ্রীমন্তি স্বামী গরবে গরবিনী ছিল | এখন বিখ্যাত ডাক্তার পুত্রের জননী |
কিন্তু শ্রীমন্তির মনে শান্তি নেই এতটুকু |
অফুরান সুখ ঐশ্বর্যের মধ্যে থেকেও সর্বহারা বুভুক্ষু এক মা | মাধ্যমিক পাস করার
পর ঋতম কলকাতার নামী স্কুলে ভর্তি হয় | জয়েন্টের প্রস্তুতির জন্য কলকাতায় থাকাটা
জরুরী ছিল | শ্রীমন্তির আপত্তি সত্ত্বেও ঋতম ওর ঠাম্মার কাছে থাকতে শুরু করে | ভৌগলিক
দূরত্বের থেকেও মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল মা আর ছেলের মধ্যে | এজন্য শ্রীমন্তি সবসময়
স্মার্তর মাকে দায়ী করতো | নিজের ছেলেকে ধরে রাখতে পারেনি বলে নাতিকে কাছে টেনে নিয়েছে
| না, তা কখনো করেননি স্মার্তর মা | কিন্তু দিনের পর দিন ঠাম্মাকে অবহেলিত হতে দেখে,
অপমানিত হতে দেখে মায়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব জন্মেছিল ছেলের, সেটা বুঝতে পারেনি শ্রীমন্তি
|
শেষ বয়সে নাতিকে বুকে চেপে ধরে স্মার্তর মা ছেলের বিচ্ছেদব্যাথা ভুলে গিয়েছিলেন
অনেকটাই | ঠাম্মা যখন চলে গেল, ঋতমের তখন ফোর্থ ইয়ার | শ্রীমন্তি বলেছিল বাড়িটা বিক্রি
করে দাও | পুরনো বাড়ি রেখে কি হবে ? তার থেকে রাজারহাটে ফ্ল্যাট কেনো | কিন্তু কিছুতেই
তা হতে দেয়নি ঋতম | সেই পুরনো বাড়িতেই থেকে গিয়েছেন কলকাতার বিখ্যাত হেমাটোলজিস্ট
ডঃ ঋতম মজুমদার |
শ্বাশুড়ি মারা যাবার পরে একবার ওই বাড়িতে রাত্রে ছিল শ্রীমন্তি | কিন্তু পুরো
রাত্রি কাটাতে পারে নি | গভীর রাত্রে শ্রীমন্তির দরজায় কে যেন ধাক্কা দিয়ে বলেছিল,
" বৌমা-- অ --বৌমা ঘুমাইয়া পড়ছ নাকি ? ওডো মা, তুমার ল'গে দুধ আনছি | খাইয়া শোও
মা | খাওনের সাতে রাগের কি সম্বন্দ | এইডা জানো তো রাত উপাসে হাতি কাবু | বৌমা—অ—বৌমা"
|
ধড়মড় করে উঠে বসে ছিল শ্রীমন্তি | অনেক
বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন স্মার্ত | মা কোথা
থেকে আসবে ? তুমি নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখেছো | কিন্তু শ্রীমন্তি আর এক দন্ড ও থাকতে চায়নি
| রাজারহাটের বাড়িতেও যেতে চায়নি | সেই রাতেই
বাধ্য হয়ে ড্রাইভারকে ঘুম থেকে তুলে স্ত্রীকে নিয়ে মাজদিয়া ফিরে আসেন ডঃ স্মার্ত
মজুমদার |
নার্সিংহোম নিয়ে হাজার ব্যস্ততার মাঝেও
কোনো কোনদিন রাত্রে ডক্টর মজুমদারের মনে পড়ে বাবাকে, মাকে | মনে পড়ে বাবার মুখে শোনা
কবিগুরুর কবিতার এই লাইন গুলো –
"স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে ! অকস্মাৎ
পরিপূর্ণস্ফীতিমাঝে দারুন আঘাত
বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি চূর্ণ করে তারে
কালঝঞ্ঝাঝংকারিত দুর্যোগ-আঁধারে |
একের স্পর্ধারে কভু নাহি দেয় স্থান
দীর্ঘকাল নিখিলের বিরাট বিধান |"
ডঃ স্মার্ত মজুমদার ভাবেন শ্রীমন্তিকে শোনাবেন কবিতাটা | পরক্ষণেই মনে হয়, না থাক
| বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স করা শ্রীমন্তি রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটা কি পড়েনি কখনো
?
-----------------------------------------------
সবিতা বিশ্বাস
প্রযত্নে – লন্কেশ্বর বিশ্বাস
গ্রাম + পোস্ট – মাজদিয়া (বিশ্বাসপাড়া)
(শুভক্ষণ লজের পাশে )
জেলা-নদীয়া পিন-৭৪১৫০৭
ই মেইল- sraybiswas@gmail.com