ভগ্নপ্রাসাদ
অলোক দাস
অজিত কলেজে পড়ে, ভূগোলে অনার্স। তাদের বিভাগ থেকে প্রতিবছরই শিক্ষামূলক ভ্রমণে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই রকম এবছরও ভ্রমণে যাওয়া হবে ঠিক হয়; কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে এটা নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক সৃষ্টি হয়। কেউ বলে পাহাড়ে যাবে, কেউ বলে সমুদ্রে; তো কেউ বলে জঙ্গলে। কিন্তু বিগত বেশ কয়েক বছর পাহাড় ও সমুদ্রে ভ্রমণে যাওয়া হয়েছিল; তাই এবছর জঙ্গলে ভ্রমণে যাবে বলে পরিকল্পনা চলে।
অজিত খুব চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে, সব বিষয়েই তার নানা কৌতূহল। তবে সে খুব বুদ্ধিমান ও অত্যন্ত সাহসী। তার পাহাড় ও সমুদ্র দুটোই দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু সে জঙ্গল কখনো দেখেনি; তাই জঙ্গলে ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা হলে, সে মনে মনে খুব আনন্দ পায় এবং আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত জঙ্গলেই তাদের ভ্রমণ ঠিক হয়। অজিত যখন জানতে পারে জঙ্গলে তাদের ভ্রমণ ঠিক হয়ে গেছে, তখন সে অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে ওঠে। সে তার এক বন্ধু রিতমকে জিজ্ঞাসা করে, "রিতম তুই জঙ্গল দেখেছিস?"
--"না, আমি জঙ্গলে কোনদিন যাইনি।"
-- "আমিও কোনদিন জঙ্গলে যাইনি রে। জঙ্গলে তো অনেক পশু-পাখি থাকে। তবে আমরা যে জঙ্গলে যাব ওখানে কিছু আছে কিনা কে জানে!"
তখন তাদের একজন স্যার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। রিতম অজিতকে বলল, "স্যার যাচ্ছেন, জিজ্ঞাসা কর না।"
অজিত স্যার এর কাছে গেল, রিতমও তাকে অনুসরণ করল। অজিত স্যারকে জিজ্ঞাসা করল, "স্যার আমাদের জঙ্গলে ভ্রমণ ঠিক হয়েছে?"
--"হ্যাঁ, কারও কোনো সমস্যা আছে?"
--"না স্যার কোনো অসুবিধা নেই। আমরা জিজ্ঞাসা করছিলাম যে, আমরা যে জঙ্গলে যাব ওখানে জন্তু জানোয়ার কিছু আছে।"
--"আমরা যে জঙ্গলে যাবো ওখানে হরিণ, হাতি, হনুমান এই সব প্রাণী আছে শুনেছি। জঙ্গলটা বেশ সংরক্ষিত, ভাগ্য থাকলে এই সব জন্তু দেখতে পাওয়া যায়। তবে ওই জঙ্গলের পাশে আর একটা বড়ো জঙ্গল আছে, ওটাতে হিংস্র জীবজন্তু আছে শুনেছি। পাশের জঙ্গলটা প্রচন্ড ঘন, দিনের বেলাতেই সব জায়গায় ভালো করে আলো প্রবেশ করে না। তবে ওই জঙ্গলে আমাদেরকে ঢুকতে দেবে না। বনকর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষের ওই জঙ্গলে প্রবেশ নিষিদ্ধ।"
-- "স্যার আমরা বেড়াতে কবে যাব?"
--"এই মাসের শেষের দিকেই যাওয়া হবে মনে হয়।" এই কথা বলে স্যার চলে গেলেন।
ওই মাসের শেষেই ভ্রমণে যাওয়া স্থির হলো। চল্লিশ জন ছাত্র-ছাত্রী, চারজন শিক্ষক ও আরও চারজনকে নিয়ে মোট আটচল্লিশ জন ভ্রমণ ঠিক হয়। মোট আটদিনের ভ্রমণ, চারদিন তারা জঙ্গলে থাকবে, বাকি চারদিন তাদের যাতায়াত করতে সময় লাগবে।
নির্ধারিত সময়েই তারা ভ্রমণে গেল। জঙ্গল থেকে কয়েকশো মিটার দূরে একটা হোটেলে তারা আশ্রয় নিল। দুদিন ট্রেনে যাতায়াতের ফলে তারা সকলেই ক্লান্ত ছিল; তাই তৃতীয় দিনটা তাদের বিশ্রাম নিয়ে কেটে গেল। শুধুমাত্র বিকালে হোটেলের চারিপাশটা তারা একটু ঘুরে দেখলো।
পরের দিন সকালে তারা সবাই মিলে জঙ্গল পরিদর্শনে বের হলো। স্যারেরা সবাইকে একসঙ্গে থাকার নির্দেশ দিল। তারা সবাই একসঙ্গেই ঘুরে জঙ্গল পরিদর্শন করছিল। কিন্তু জঙ্গলে দু-একটি পাখি ছাড়া একটা পশুকেও দেখা গেল না। তাদের সাথে দু-একজন বনকর্মীও গিয়েছিল; তারা বলল, "এই জঙ্গলে সেরকম জন্তু আর নেই, অনেক জন্তু খাবারের জন্য পাশের ঘন জঙ্গলে চলে গেছে।"
তারা খাবার সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে গিয়েছিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটল; অজিত ও রিতমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। তাদেরকে সবাই খোঁজাখুঁজি করতে লাগলো; কিন্তু কোনভাবেই তাদেরকে খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে তারা বনকর্মীদের দপ্তরে খবর পাঠাল। সারাদিন খোঁজাখুঁজির পরে বনকর্মীরা হোটেলে এসে খবর দিল তাদেরকে পাওয়া যায়নি। সবাই আরও খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল।
--"আপনারা বলছিলেন না, এই জঙ্গলের পাশে আর একটা জঙ্গল আছে।"একজন স্যার বিষন্ন মুখে জিজ্ঞাসা করলেন।
--"হ্যাঁ, আর একটা জঙ্গল আছে; ওই জঙ্গলটা এটার থেকে বড়ো ও ঘন জঙ্গল।"বনকর্মীদের মধ্যে একজন বললেন।
-- "এই জঙ্গল থেকে পাশের জঙ্গলে যাওয়া যায়।"
--"আগে যাওয়া যেত না, দুটি জঙ্গলের মাঝে তারের বেড়া ছিল। কিন্তু বেশ কয়েক বছর হল সেই বেড়া নষ্ট হয়ে গেছে; এখন যাওয়া যায়।"
--"আমার মনে হয় ওরা ওই জঙ্গলেই গেছে। পাশের জঙ্গলে তো হিংস্র জন্তু আছে শুনেছি; ওদের যদি কিছু হয়ে যায়।"
-- "এখন আর ওই জঙ্গলেও সেরকম হিংস্র জন্তু নেই। বেশ কয়েক বছর ধরে হিংস্র জন্তুর কোন খবর পাওয়া যায়নি। কেবল হাতিরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় এটাই যা। আপনারা কোন চিন্তা করবেন না; পাশের জঙ্গলে যদি গিয়ে থাকে কাল সকালেই ওদের ধরে নিয়ে আসব।"
এই কথা শোনার পর সবাই একটু আশ্বস্ত হলো। তবুও তাদের খুব চিন্তা হতে লাগলো; ছেলেদুটো সারারাত জঙ্গলে থাকবে কোথায়, খাবে কি। তাই দুশ্চিন্তায় রাতে অনেকের ঘুম এলো না।
এদিকে অজিত ও রিতম দুপুরে খাবার পর জীবজন্তু দেখবে বলে চুপিচুপি পাশের জঙ্গলে দিকে চলে যায়। তারা স্যারের কাছে শুনেছিল পাশের জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার আছে। রিতম স্যারকে বলে যাবে ঠিক করেছিল; কিন্তু অজিত বলতে দেয়নি। কারণ তার ধারণা হয়েছিল, বললে যদি যেতে না দেয়। তারা যে জঙ্গলে ছিল সেই জঙ্গলটাও খুব একটা ছোট নয়; পাশের জঙ্গলে যেতে তাদের প্রায় বিকাল হয়ে গেল। কিন্তু তারা কোন জন্তু জানোয়ার দেখতে পেল না।
বিকাল হয়ে গেছে দেখে রিতম বলল, "অজিত বিকাল হয়ে গেছে, এবার হোটেলে ফিরে যাওয়াই ভালো; না হলে ফিরে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।"
অজিত খুব সাহসী কিন্তু একগুঁয়ে ছেলে। সে বলল, "এই তো জঙ্গলটাই ঢুকলাম, আর একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি না, যদি কিছু দেখতে পায়! সন্ধ্যার মধ্যে আমরা হোটেলে ফিরে যাব।"
-- "অনেকটাই তো এলাম কিছুই দেখতে পেলাম না, এবার আমরা ফিরে যাই চল।"
-- "জঙ্গলের পাশে কি জন্তু জানোয়াররা তোর জন্য বসে থাকবে, পশুরা জঙ্গলের ভেতরে থাকে।" অজিত বিরক্ত হয়ে বলল।
-- "কোন হিংস্র জন্তু, ধর বাঘ যদি আমাদের খেয়ে নেয়। জন্তু জানোয়ার দেখে আর কাজ নেই চল।"
-- "ভয় পাচ্ছিস তো এলি কি জন্য, আমরা কি বাঘের সাথে লড়াই করতে যাবো, যে বাঘ আমাদের খেয়ে নেবে।"অজিত রেগে জোর গলায় বলল।
-- "কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তো।"
-- "আর একটু চল, যদি না কিছু দেখতে পায় পালিয়ে আসব।" অজিত এবার খুব শান্ত ভাবে রিতমের কাঁধে হাত রেখে বোঝালো।
কথা বলতে বলতে তারা একটু একটু করে গভীরে জঙ্গলে প্রবেশ করলো। কিন্তু পাখি ও একদল বাঁদর ছাড়া কোন জন্তু তারা দেখতে পেল না। অবশেষে তারা হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। কিন্তু ঘন জঙ্গল হওয়াই সূর্যের আলো কমতেই হঠাৎ করে যেন অন্ধকার নেমে এলো। রিতম বিরক্ত হয়ে অজিতকে বলল, "দেখলি তো, শুধু তোর জন্য সন্ধ্যা হয়ে গেল।"
-- "তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন, আমি তো আছি। আমি তোকে হোটেলে নিয়ে যাব।"
ক্রমে পুরো জঙ্গল গভীর অন্ধকারে ভরে গেল। কোনদিকে রাস্তা দেখা যায় না, তারা কোন দিকে গেলে রাস্তা পাবে কিছুই বুঝতে পারছে না। জঙ্গলের মধ্যে তারা চারিদিক ঘুরতে লাগল। অনেক রাত হয়ে গেল কিন্তু কোনভাবেই তারা জঙ্গল থেকে বের হতে পারল না। রিতম ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, "বলেছিলাম তোকে হোটেলে ফিরে চল, তখন তুই আমার কথা শুনলি না। এবার কি হবে, আমার ভীষণ ভয় করছে।"
-- "ভয় পাচ্ছিস কেন, তুই একা নাকি, আমিও তো তোর সঙ্গে আছি। আজ যদি না যেতে পারি, কাল সকালেই ফিরে যাব।"
-- "সারারাত আমরা জঙ্গলে থাকবো; তুই কি পাগল হলি। আমার ভীষণ ভয় লাগছে, আর খুব খিদে পেয়ে গেছে।"
-- "ভয় পাশ না, এছাড়া উপায় কি আছে বল। এখানে শুয়ে ঘুমিয়ে পর, আমি তোকে পাহারা দিচ্ছি। ঘুমালে ভয় লাগবে না।"
রিতম চুপচাপ একটা উঁচু জায়গা দেখে শুয়ে পড়ল। অজিত তার পাশে বসে রইল। কিন্তু কখন যে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতে পারেনি কেউ।
প্রায় মাঝরাতে একটা শব্দে অজিতের ঘুম ভেঙে গেল। কিসের শব্দ সে বুঝতে পারলো না; অনেকক্ষণ ধরে শব্দটা বেজে চলল। কিন্তু এটুকু বুঝলো শব্দটা তাদের খুব কাছ থেকেই ভেসে আসছে। কিছুক্ষণ শোনার পর তার মনে হল; যেন কোথাও নাচ গান হচ্ছে। সে কান পেতে ভালো করে শুনতে লাগল; ভুল শোনেনি এটা নাচ গানেরই শব্দ। অজিত রিতমকে ঘুম থেকে তুলে বলল, "কিছু শুনতে পাচ্ছিস?"
রিতমকে ঘুম থেকে তোলায়, সে একপ্রকার বিরক্তি প্রকাশ করে বসে রইল। কিছুক্ষণ পর শব্দটা শুনে ভয় পেয়ে বলল, "জঙ্গলে এটা কিসের শব্দ রে!"
-- "ভালো করে শোন, কোথাও নাচ গান হচ্ছে মনে হয়।"
-- "হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।"
-- "মনে হচ্ছে আমরা জঙ্গলের একেবারে প্রান্তে আছি; জঙ্গলের পাশেই কোন গ্রাম আছে। ওই গ্রাম থেকেই নাচ গানের আওয়াজটা আসছে।"
-- "হতে পারে হয়তো!"
-- "চল।"
-- "কোথায়?"
-- "কোথায় আবার ওই গ্রামে।"
-- "এতো রাতে ওই গ্রামে যাব, ওরা কি ভাববে।"
-- "ওরা কিছু ভাববে না। তুই বলছিলি না তোর খুব খিদে পেয়েছে, ওই গ্রামে গেলে খেতে পাবি। আমারও খুব খিদে পেয়েছে, চল যায়।"
তারা শব্দটা লক্ষ্য করে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে লাগলো। কিছু দূর গিয়ে রিতম বলল, "এতো মনে হচ্ছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করছি রে।"
-- "তাই তো মনে হচ্ছে।"
-- "আমার ভীষণ ভয় লাগছে, চল আমরা ফিরে যায়; যদি চোর ডাকাত হয়।"
-- "ডাকাতেরা এতক্ষণ ধরে বাজনা বাজাবে। আর যদি ডাকাতও হয়, দূর থেকে দেখতে পেলেই পালিয়ে আসব।"
শব্দ লক্ষ্য করে তারা প্রায় দশ-পনেরো মিনিট হেঁটে গেল। কিন্তু কোন গ্রাম বা ডাকাত দেখতে পেল না। অবশেষে তারা গভীর জঙ্গলে একটা ভগ্ন প্রাসাদের সামনে উপস্থিত হল। প্রাসাদটা বাইরে থেকে দেখে তাদের মনে হল, অনেকদিন ধরে এখানে কেউ বসবাস করছে না। কিন্তু তারা স্পষ্ট লক্ষ্য করলো নাচ গানের আওয়াজটা এই প্রাসাদের ভেতর থেকেই আসছে।
-- "চল প্রাসাদের ভেতরে কি হচ্ছে দেখি।" অজিত রিতমকে বলল।
-- "তোর কি মাথা খারাপ, প্রাসাদের ভেতরে যদি ডাকাতের দল থাকে।"
-- "বাইরে তো কেউ নেই, আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে ঢুকে দেখি না।"
তখনও মিষ্টি সুরে বাজনা বেজে চলেছে। তারা আস্তে আস্তে প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করল। তারা দেখল প্রাসাদের ভেতরটা বেশ বড়ো, বাইরে থেকে তা বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু তারা প্রাসাদের ভেতর কাউকে দেখতে পেল না। হঠাৎ তারা একটা বড়ো কক্ষের সামনে এসে উপস্থিত হলো।
তারা সেই কক্ষে এসে যা দেখলো; সেটা দেখে তাদের রক্ত জল হয়ে গেল। সারা শরীরের লোম কাঁটা দিয়ে উঠল, মাথার চুলগুলো খাঁড়া হয়ে গেল, হৃদপিণ্ড যেন লাফাতে লাগল। কক্ষটির মৃদু আলোয় তারা দেখল বাদ্যযন্ত্রগুলো কেউ বাজাচ্ছে না। সেগুলো এমনিতেই অনবরত বেজে চলেছে। কক্ষের ঠিক মাঝখানে দুটি ঘুঙুর বাজনার তালে নেচে যাচ্ছে। তার যেন ক্লান্তি নেই। তারা এই দৃশ্য দেখে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। হঠাৎ সেই বাজনা থেমে গেল, ঘুঙুরের নাচ বন্ধ হয়ে গেল। মৃদু নারী কন্ঠে মিষ্টি স্বরে কেউ যেন বলে উঠল, "কে তোমরা, এখানে কিভাবে এলে?"
কিন্তু কোন নারীকে তারা দেখতে পেল না। তাদের ভেতর যেন শুকিয়ে গেল। অজিত নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, "আমরা জঙ্গলে বেড়াতে এসেছিলাম, সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় হারিয়ে গেছি। বাজনা শুনতে পেয়ে এই বাড়িতে এলাম; ভাবলাম এখানে কেউ থাকবে হয়তো।"
-- "হ্যাঁ, এটা আমার বাড়ি, এখানে আমিই থাকি।" অদৃশ্য নারী কণ্ঠটি বলল।
অজিত বুঝতে পারল নারীকণ্ঠটা কক্ষের মাঝখানে ঘুঙুরের কাছ থেকে আসছে। অজিত নিজেকে একটু শক্ত করে বলল, "কিন্তু কোথায় আপনি! আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?"
-- "আমাকে তোমরা দেখতে পাবেন না; আমি মৃত।" অদৃশ্য নারী কন্ঠটি খিলখিল করে হেসে বলল।
সেটা অবশ্য তারা অনেকক্ষণ আগেই বুঝতে পেরেছে। অজিত জিজ্ঞাসা করল, "আপনি বলছেন এটা আপনার বাড়ি, তাহলে আপনি কি জীবিত অবস্থায় ডাকাত ছিলেন? না মানে আপনি জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি করেছেন, তাই ভাবলাম!"
-- "তুমি বুদ্ধিমান যুবক। কিন্তু আমি ডাকাত ছিলাম না; আর এই বাড়িটাও ঠিক আমার নয়।"
-- "তাহলে আপনি এখানে এলেন কীভাবে?"
-- "তুমি যখন জানতে চাইছো, তাহলে তোমাকে ঘটনাটা বলি।"
অজিত লক্ষ্য করলো ঘুঙুরদুটো বাজতে বাজতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার শরীরটা ছমছম করে উঠল; সে রীতিমতো কাঁপতে লাগল। রিতম অজিতের পিছনে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল আর ভয়ে কাঁপছিল। এবার ভীষণ ভয় পেয়ে সে অজিতকে জড়িয়ে ধরলো।
ঘুঙুরদুটি তাদের কাছে এসে বলল, "ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। তোমরা দুজন খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান; না হলে তোমরা এখানে আসতে পারতে না। তোমরা দুজন ওই চেয়ারে গিয়ে বসো।"
বাদ্যযন্ত্রগুলোর পাশে চারটি চেয়ার ছিল। তারা পাশাপাশি দুটি চেয়ারে বসলো। ঘুঙুরটি নারী কন্ঠে বলতে লাগলো, "আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগের ঘটনা; আমি এখানকার রাজার নর্তকী ছিলাম। এটা যদিও রাজবাড়ী নয়; এটা রাজার একটা গুপ্ত বাড়ি। রাজার খুব প্রিয় পাত্রেরাই এই বাড়ির কথা জানতো। রাজা এই বাড়ির দায়িত্বে আমাকে রেখেছিলেন। কিছুদিন ছাড়া রাজা এখানে আসতেন; আমার নাচ দেখতেন, এক-দুদিন থেকে আবার চলে যেতেন। আর কোন জিনিস রাজবাড়ীতে সুরক্ষিত নয় মনে হলে এখানে রেখে যেতেন; এমনকি অতিরিক্ত সোনাদানা, মনি-মুক্ত এসবও রেখে যেতেন। রাজা আমাকে খুব বিশ্বাস করতেন।" কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
-- "একদিন হঠাৎ রাজা আমাকে না জানিয়েই এখানে এসে উপস্থিত হলেন। ওনার বাড়ি, তা উনি আসতেই পারেন, কিন্তু প্রতিবার আসার আগে আমাকে খবর পাঠাতেন। একটা ঘটনা দেখে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম সেদিন। অন্যান্য দিন রাজা যখন আসতেন, তখন তিনি একাই আসতেন, দু-তিনজন প্রহরীকে সঙ্গে নিয়ে। কিন্তু সেবারে তিনি একা আসেননি; তার সাথে আট-দশটা ঘোড়া ছিল। আর প্রত্যেক ঘোড়াতেই একটা করে বস্তা ছিল। রাজাকে খুব চিন্তিত ও ব্যস্ত দেখাচ্ছিল।" কিছুক্ষণ থেমে রইল।
-- "আমি রাজাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মহারাজ কি হয়েছে, আপনাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে?"
-- "আমার বেশি কথা বলার সময় নেই; পাশের রাজ্যের রাজারা আমাকে দল বেঁধে আক্রমণ করেছে। আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। এই বস্তাগুলোই আমার গচ্ছিত ধন আছে; এগুলিকে আমি গুপ্ত কুটিরে রেখে যাচ্ছি।"
-- "রাজা তার গচ্ছিত ধনসম্পত্তি গুপ্ত কুটিরে রেখে চলে যান। আর যাবার সময় বলে যান, কৃত্তিকা আমি যতক্ষণ ফিরে না আসছি, ততক্ষণ এই ধন সম্পত্তি দেখার দায়িত্ব তোমার।"
-- "মহারাজ আপনি কোন চিন্তা করবেন না, আমি আমার প্রাণ দিয়ে আপনারা এই ধনসম্পত্তি রক্ষা করব।"
কিছুক্ষণ আবার সব নিস্তব্ধ রইল। ঘুঙুরটি আবার ক্ষীণ কন্ঠে বলল, "তারপর কিছুদিন পর আমি জানতে পারি মহারাজ যুদ্ধে মারা গেছেন। অন্য রাজারা মহারাজের রাজ্য দখল করেছে। তারপর এখান থেকে একে একে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু মহারাজের ধনসম্পত্তি আমি মারা যাবার পরও পাহারা দিয়ে এখানে এতো বছর ধরে আছি। আমি মারা যাবার পর, কোনদিন কেউ এই প্রাসাদে প্রবেশ করেনি, তোমরা দুজনেই এখানে প্রথম প্রবেশ করেছ।"
-- "আপনি এখান থেকে কোনদিন মুক্তি পাবেন না?" অজিত বিষন্ন মুখে জিজ্ঞাসা করল।
-- "তোমরাই পার আমাকে মুক্তি দিতে।"
-- "আমরা! কিন্তু কিভাবে?"
-- "হ্যাঁ, তোমরা। এতদিন আমি এই ধনসম্পত্তি পাহারা দিয়ে এসেছি। কিন্তু এই ধনসম্পত্তি দেবার মতো আমি কাউকে পাইনি। আজ পেয়েছি, তোমরা এই ধনসম্পত্তি নিয়ে আমাকে মুক্তি দাও। আমি এখান থেকে মুক্তি পেতে চাই।"
-- "আমরা এই ধনসম্পত্তি নেব?" অজিত অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
-- "এই ধনসম্পত্তি নিয়ে তোমরা আমাকে মুক্তি দাও। আমি বাঁচতে চাই; আবার নতুন জীবন চাই।" ঘুঙুরটি কাঁদতে কাঁদতে বলল।
-- "আপনি কাঁদবেন না, আমরা এই ধনসম্পত্তি নেব, আপনাকে মুক্তি দেব। কিন্তু এই ধনসম্পত্তি কোথায় আছে?"
--"এই কক্ষের নিচে গুপ্ত কুঠিরে।"
-- "গুপ্ত কুঠিরটি কোথায়?"
-- "এই কক্ষের পাশেই আর একটা কক্ষ আছে। ওই কক্ষের একটি দেওয়ালে আমার বড়ো একটি ছবি আছে। সেই ছবিটা খুললেই একটা সুরঙ্গ দেখতে পাওয়া যাবে। ওই সুরঙ্গ দিয়ে গুপ্ত কুঠিরে প্রবেশ করা যায়। গুপ্ত কুঠিরের একটি দেওয়ালে রাজার একটি ছবি আছে। ওই ছবিটার ঠিক উল্টোদিকের দেওয়ালে গুপ্তধন আছে।"
-- "বুঝতে পারলাম।"
-- "আজ থেকে গুপ্তধনের দায়িত্ব তোমরা নিলে, আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি।"
-- "হ্যাঁ, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আপনি যেন আবার নতুন জীবন লাভ করেন।" কিছুক্ষণ থেমে বলল, "আমরা আজ রাতে এখানে ঘুমাতে পারি?"
-- "এই প্রাসাদটা এখন তোমাদের, তোমরা যেখানে খুশি ঘুমাতে পার। তবে পাশের কক্ষে ঘুমাবার জায়গা আছে।"
রিতম এতক্ষণ চুপচাপ বসে সবকিছু শুনছিল। এবার সে অজিতের কানে আস্তে আস্তে বলল, "এখানে ঘুমানোটা কি ঠিক হবে।"
-- "তোমরা কিছু জানতে চাও?" ঘুঙুরটি জিজ্ঞাসা করল।
-- "আমার বন্ধু বলছিল, ওর ভীষণ খিদে পেয়ে গেছে। এখানে কিছু খাবার পাওয়া যাবে?" অজিত জিজ্ঞাসা করল।
-- "পাশের কক্ষে তোমাদের প্রয়োজনীয় সব পেয়ে যাবে। এখন আমি আসি।"
তারা দেখলো ঘুঙুরটি আস্তে আস্তে প্রাসাদের বাইরে যেতে যেতে অদৃশ্য হয়ে গেল। অজিত রিতমকে বলল, "চল, পাশের কক্ষে কি আছে দেখি।"
রিতম কোন উত্তর দিল না। অজিত পাশের কক্ষে গেল, রিতম তাকে অনুসরণ করল। পাশের কক্ষটিতেও হালকা আলো জ্বলছিল। তারা দেখলো কক্ষটি বেশ সাজানো গোছানো; মেয়ে ছাড়া এমন করে সাজানো পুরুষের কর্ম নয়। তারা কক্ষটি ভালো করে প্রদক্ষিণ করল। কক্ষের এক পাশে একটি বিছানা, তার পাশেই একটি জায়গায় বেশ কতগুলো বিভিন্ন রকমের ফল এবং দেওয়ালে বিভিন্ন রকমের অতিসুন্দর কয়েকটি ছবি।
তাদের ভীষণ খিদে পেয়েছিল, তারা ফলগুলো খেতে আরম্ভ করল। খেতে খেতে তাদের কক্ষের দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে চোখ পড়ল। তারা দেখল দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে বেশ বড়ো একটা নারীর ছবি। তারা সেই দেওয়ালের পাশে গেল।
-- "বুঝলি রিতম, এটাই তাহলে নর্তকী কৃত্তিকা।" অজিত ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল।
-- "হ্যাঁ, তাছাড়া এই কক্ষে তো আর কোন নারীর ছবি নেই।"
অজিত ভালো করে ছবিটা দেখতে লাগল। আর মনে মনে ভাবলো, এতো সুন্দরী নারী সে কখন দেখেনি। এতো সুন্দর রুপ, পাতলা গোছের গড়ন, মুখের হাসি যেন প্রেম নিবেদন করছে। এই রুপ দেখে, যে কোন পুরুষই মোহিত হয়ে যাবে; কাছে পেতে চাইবে। আর রাজা, সে তো কোন কথাই নেই। রাজা তো এই নারীকে তার ধনসম্পত্তি দিয়ে গেছে, আমি হলে জীবন দিয়ে দিতাম।
-- "ছবিটা খুলে দেখ পিছনে সুরঙ্গ আছে কিনা।" রিতম বলল।
-- "নর্তকী কৃত্তিকা বলে যখন গেছে তখন তো নিশ্চয় থাকবে।"
তারা দুটো চেয়ার দেওয়ালের পাশে নিয়ে গিয়ে ছবিটা খুললো; কিন্তু কোন সুরঙ্গ দেখতে পেল না। রিতম অজিতকে বলল, "সুরঙ্গ কোথায় রে এতো দেওয়াল।"
-- "দেওয়ালটা ভেঙে দেখতে হবে বুঝলি। একটা শক্ত দেখে কিছু নিয়ে আয়।" অজিত দেওয়ালটা ঠুকেঠাকে দেখে বলল।
রিতম সারা কক্ষ খুঁজে একটা দণ্ড জাতীয় জিনিস নিয়ে এসে বলল, "এটাই হবে?"
-- "হ্যাঁ দেখি, ওটা দে।"
অজিত দন্ডটা দিয়ে দেওয়ালে বেশ কয়েকটা প্রহার করতেই দেওয়ালের খানিকটা অংশ ছেড়ে গেল। তারা উঁকি মেরে দেখল দেওয়ালের ওপারে একটা সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। কিন্তু সিঁড়িটা খুব অন্ধকার হওয়াই তারা কিছু দেখতে পেল না।
-- "এখন তো রাত আছে, তাই অন্ধকারে কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। চল আমরা এখন ঘুমিয়ে নিই, সকালে দিনের আলোয় কি আছে দেখা যাবে।" অজিত বলল।
-- "হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে।"
তারা যখন ঘুমাতে গেল, তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। তারা জঙ্গলে পাখির ডাক শুনতে পেল। সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে তারা খুব ক্লান্ত ছিল, তারপর সারারাত ভালো করে ঘুম হয়নি; তাই তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন অজিত প্রথমে ঘুম থেকে ওঠে, তারপর সে রিতমকে ডেকে তোলে। ঘুম থেকে ওঠে তারা দেখলো প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। তারা প্রথমেই দেওয়ালের সিঁড়ির কাছে গেল। কিন্তু তখনও সিঁড়িটা অন্ধকার; তারা প্রবেশ করতে সাহস পেল না। অজিত কিছুক্ষণ ভেবে বলল, "আলো ছাড়া গুপ্ত কুঠিরে ঢোকা যাবে না।"
-- "কিন্তু আমাদের কাছে তো আলো নেই, কি করা যাবে এখন?"
অজিত কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, সে যেন কিছু ভাবছিল। তারপর বলল, "আমাদের এখন হোটেলে ফিরে যাওয়াই ভালো। চল এখনই বেরিয়ে পরি, প্রায় দুপুর হয়ে গেছে, হোটেলে ফিরতে বিকাল হয়ে যাবে।"
-- "হোটেলে ফিরে যাব! গুপ্ত কুঠিরে কি আছে দেখবো না।"
-- "সে তো দেখবো, কিন্তু এখন নয়।"
-- "তাহলে কখন?"
-- "চল যেতে যেতে বলছি।"
-- "একটু দাঁড়া, কিছু ফল নিয়ে নিই। যেতে যেতে খিদে পাবে তো।"
রিতম বেশ কতকগুলো ফল নিয়ে অজিতের পিছনে পিছনে প্রাসাদের বাইরে এলো। যেতে যেতে অজিত রিতমকে বলল, "দেখ এখন দুপুর হয়ে গেছে। আমরা যদি এখন গুপ্ত কুঠিরে যায়, তাহলে গুপ্তধন উদ্ধার করতে প্রায় বিকাল হয়ে যাবে। তার ওপর আমাদের কাছে কোন আলোও নেই। অন্ধকারে প্রবেশ করা উচিত হবে না। তাছাড়া নর্তকী কি বলেছিল, যুদ্ধের সময় রাজা আট-দশটা ঘোড়া নিয়ে এসে গুপ্তধন রেখে গেছে। আর আমরা যদি ওই গুপ্তধন উদ্ধার করতে পারিও, তাহলে নিয়ে যাব কি করে।"
-- "বুঝতে পারলাম। আমরা হোটেলে ফিরে সবাইকে গুপ্তধনের ব্যাপারে জানাবো, তারপর কোন এক সময় করে এসে গুপ্তধন উদ্ধার করে নিয়ে যাব।"
-- "একদম ঠিক ভেবেছিস।"
কথা বলতে বলতে তারা বেশ কিছুটা পথ হেঁটে এলো। কিন্তু তারা কোন রাস্তা দেখতে পেল না। রিতম বলল, "অনেকটা পথই তো হেঁটে এলাম, কিন্তু আমরা যে রাস্তা দিয়ে এসেছিলাম সেটাই তো খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা হোটেলে যাব কিভাবে?"-- কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল, "রাতে কোন দিকে গিয়েছিলাম সেটাও তো মনে পরছে না।"
অজিত কোন কথা বলেনি, সে শুধু রিতমের কথা শুনছিল আর কোন দিকে গেলে রাস্তা পাওয়া যাবে ভাবছিল। হঠাৎ কিসের যেন শব্দ শুনে সে রিতমকে চুপ করতে বলল। কিছুক্ষণ পর সে রিতমকে জিজ্ঞাসা করল, "কিছু শুনতে পেলি?"
--"গাড়ির আওয়াজ মনে হল।"
--"হ্যাঁ ঠিক শুনেছিস। বনকর্মীদের গাড়ি মনে হয়, চল ওই রাস্তা দিয়ে গেলেই হোটেলে পৌঁছানো যাবে।"
কিছুটা যেতেই তারা একটা রাস্তা দেখতে পেল। বেশ চওড়া রাস্তা, দেখে মনে হল প্রতিদিনই গাড়ি যাতায়াত করে। অজিত রাস্তায় উঠে রিতমকে বলল, "জায়গাটা ভাল করে দেখে রাখ, আবার তো আসতে হবে।"
-- "হ্যাঁ, কিন্তু কোন দিকে যাব, বুঝতে পারছিনা তো?" রিতম এদিক সেদিক তাকিয়ে বলল।
-- "আমরা কাল দুপুরে পাশের জঙ্গল থেকে এই জঙ্গলে আসার জন্য বেড়িয়ে ছিলাম; তোর মনে আছে?"
-- "সে মনে খাকবে না কেন।"
-- "তখন সূর্য কোনদিকে ছিল?"
-- "কোনদিকে আবার মাথার উপরে ছিল, তবে আমরা যে দিকে যাচ্ছিলাম সামনের দিকে একটু ঝুঁকে ছিল, তাই না।"
-- "ঠিক, তাহলে এখনও দুপুর, আজকে সূর্য যেদিকে ঝুঁকে আছে তার বিপরীত দিকে গেলেই হল।"
-- "তোর মাথায় বুদ্ধি আছে।"
-- "বুদ্ধি তোর মাথাতেও কম নেই, তুই কেবল ভাবিস না।"
কিছুক্ষণ তারা ওই রাস্তা দিয়ে হাঁটার পর, আবার গাড়ির আওয়াজ শুনতে পেল। এবার যেন আওয়াজটা তাদের পিছন থেকে আসছে। কিছুক্ষণ পরেই একটা গাড়ি তাদের কাছে এসে থামলো। তারা পোশাক দেখে বুঝতে পারল এটা বনকর্মীদের গাড়ি। গাড়ি থেকে একজন বনকর্মী জিজ্ঞাসা করল, "তোমরা অজিত আর রিতম।"
-- "হ্যাঁ।" অজিত উত্তর দিল।
-- "দুজনে গাড়িতে এসে বসো।"
তারা কোন কথা না বলে গাড়িতে গিয়ে বসলো। একজন বনকর্মী বলল, "জঙ্গলে তোমাদের দুজনের ঘুরে বেড়াতে সাহস হয় কি করে?"
-- "আমরা জন্তু জানোয়ার দেখার জন্য এই জঙ্গলে এসেছিলাম। আচ্ছা এই জঙ্গলে বাঘ আছে শুনেছিলাম।" অজিত বলল।
-- "এই জঙ্গলে কোন বাঘ নেই।"
-- "সেকি তবে আমরা যে শুনেছিলাম এই জঙ্গলে হিংস্র জীবজন্তু আছে।"
-- "আগে ছিল, এখন আর নেই। তবে বাঘের থেকেও এই জঙ্গলে আরও ভয়ঙ্কর জিনিস আছে।"
-- "কি আছে?"
-- "এই জঙ্গলে ভূত আছে। রাতে জঙ্গলে থাকাটা তোমাদের মোটেই উচিত হয়নি।" অজিত আর কিছু বলল না, চুপচাপ বসে রইল। গাড়িতে আসতে আসতে তারা এই কথাগুলো বলছিল।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই তারা হোটেলে পৌঁছে গেল। তারা গিয়ে দেখল, কেউ মারা গেলে কাছের মানুষেরা যেমন শোক পালন করে, তাদের স্যারেরা ও বন্ধুরা তাই করছে। তাদের দুজনকে দেখে সবার যেন প্রান ফিরে এলো। সবাই তাদের দুজনের কাছে ছুটে এলো, কিন্তু তাদের চোখে মুখে ভয়ের রেশ তখনও কাটেনি।
-- "কাউকে না বলে তোদের জঙ্গলে যেতে কে বলেছিল?" একজন স্যার তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন।
তারা কোন উত্তর দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। অন্য একজন স্যার বললেন, "আপনি উত্তেজিত হবেন না, ওরা এখন বিশ্রাম করুক, বিকালে সব জানা যাবে।" কোন কথা না বলে তারা চুপচাপ নিজেদের কক্ষে চলে গেল। তারা একই কক্ষে ছিল। একজন স্যার বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের বিরক্ত করতে বারণ করলেন।
নিজেদের খুব ক্লান্ত লাগার জন্য খাওয়া দাওয়া করে তারা ঘুমিয়ে পড়ল। তাদের যখন ঘুম ভাঙল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাদের একজন সহপাঠী এসে বলল, "তোদেরকে স্যারেরা ডাকছেন।"
-- "তুই গিয়ে বল আসছে।" অজিত বলল।
-- "ঠিক আছে।" সহপাঠী চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর অজিত ও রিতম স্যারেরা যে কক্ষে ছিল, সেই কক্ষে গেল। তারা সেখানে গিয়ে দেখল, স্যারেরা ছাড়াও তাদের বেশ কয়েকজন সহপাঠীও সেখানে আছে। একজন স্যার নরম স্বরে তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, "তোরা গভীর জঙ্গলে কি করতে গিয়েছিলি? তোদের কিছু হয়ে গেলে তখন কি হতো বলতো।"
তারা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। রিতম মাথা নিচু করেই বলল, "আমরা পাশের জঙ্গলটা দেখতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম স্যার।"
-- "তোরা নিশ্চয় খুব গভীর জঙ্গলে চলে গিয়েছিলি। এই রকম না বলে কোথাও যাবি না, সবাইকে বলছি।"
-- "ঠিক আছে স্যার। তবে স্যার জঙ্গলে এক ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটেছে।" রিতম বলল।
সবাই অবাক হয়ে রিতমের দিকে তাকালো। একজন স্যার কৌতূহলী দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করলেন, "কি হয়েছিল রে?"
-- "আমার এখনও সেই ঘটনা মনে করলে ভয় লাগছে। অজিত ভালো বলতে পারবে স্যার, ওর জন্যই সব ঘটেছে।"
-- "কি হয়েছিল অজিত?"
অজিত সমস্ত ঘটনার আদ্যপ্রান্ত বলে গেল। সবাই অবাক হয়ে সমস্ত ঘটনাটা শুনলো। "কোন দূর্ঘটনা ঘটলে কি হতো ভেবে দেখেছিস।" একজন স্যার বললেন।
-- "দূর্ঘটনা যখন ঘটেনি তখন আর চিন্তা করবেন না। তবে কাল সকালে আমাদের গুপ্তধন উদ্ধারের জন্য ওই প্রাসাদে একবার যেতে হবে।" অজিত বলল।
-- "গুপ্তধন সত্যিই কি আছে!"
-- "সম্ভবত আছে, আমি ওই নর্তকীর কথা অবিশ্বাস করতে পারছি না। কারণ গুপ্ত কুঠিরের দরজা আমরা দেখে এসেছি।"
-- "তাহলে শুধু আমাদের যাওয়াটা উচিত হবে না; বন দপ্তরের লোকেদেরও জানানো দরকার।"
-- "সে আপনারা যা ভালো বুঝবেন।"
সেদিন রাতেই বনদপ্তরে সব জানানো হয়। গুপ্তধনের ঘটনা বলে বনদপ্তরের লোক পুলিশকে খবর দেয়। পরের দিন তিনটি গাড়ি হোটেলের সামনে দশটার সময় হাজির হয়। সমস্ত ছাত্রই জঙ্গলে যেতে চাইছিল; কিন্তু পুলিশ নিয়ে গেল না। গুপ্তধনের উদ্ধারে গেল অজিত ও রিতম ছাড়া তিনজন স্যার।
বনদপ্তরের কর্মীরা অজিত ও রিতমকে জঙ্গলে যেখান থেকে তুলে এনেছিল সেখানে নিয়ে গেল। তারপর আর গাড়ি গেল না, অজিত ও রিতম রাস্তা দেখিয়ে সবাইকে গভীর জঙ্গলে ভগ্নপ্রাসাদে নিয়ে গেল। দিন-দুপুরেই প্রাসাদটাকে বাইরে থেকে দেখে অনেকের ভয় করতে লাগল; কিন্তু অনেকজন থাকায় কেউ তা প্রকাশ করল না। তারা প্রাসাদে ঢুকলেই অজিত গুপ্ত কুঠিরের ভাঙা দেওয়ালের কাছে সবাইকে নিয়ে গেল। ভাঙা জায়গাটা দিয়ে আলো জ্বেলে দেখে একজন বনকর্মী বলল, "সুরঙ্গই মনে হচ্ছে।"
একজন পুলিশ অফিসার ছাড়া বেশ কয়েকজন কনস্টেবল সঙ্গে গিয়েছিল। অফিসার তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "দেওয়ালটা ভেঙে ফেল।"
দেওয়ালটা ভাঙা হলে অন্ধকার কুঠুরিতে সকলে আলো নিয়ে প্রবেশ করল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে একটা ছোট্ট কক্ষে তারা উপস্থিত হলো। সবাই খুব আবেগপ্রবণ, উৎফুল্ল মেজাজে আছে; কারণ কিছুক্ষণ পরেই গুপ্তধন উদ্ধার হবে। অজিত ও রিতম পুলিশের গাড়িতে এসেছিল; গাড়িতে আসার সময় পুলিশ অফিসার তাদের নাম জেনে নেই এবং গতরাতের সমস্ত ঘটনাটা শোনে। পুলিশ অফিসার অজিতকে প্রফুল্ল বদনে জিজ্ঞাসা করলেন, "অজিত আমরা কি গুপ্ত কুঠিরে এসে পৌঁছেছি?"
অজিত আলো জ্বেলে পুরো কক্ষটা ভালো করে দেখলো। একটি দেওয়ালের মাঝে সে একটা পুরুষের ছবি দেখতে পেল। ছবিটা ওই নর্তকীর ছবিটার মতোনই বেশ বড়ো। অজিত আলো নিয়ে এগিয়ে গিয়ে ছবিটার সামনে দাঁড়ালো। ছবিটা ভালো করে দেখতে লাগল। লোকটার সাজপোশাক, হাতে তলোয়ার ও মোটা গোঁফ দেখে অজিতের তাকে রাজা বলেই মনে হলো। তাছাড়া ওই কুঠিরে আর একটি ছবিও দেখতে পাওয়া গেল না। সে অফিসারের দিকে ঘুরে বলল, "হ্যাঁ, আমরা এখন গুপ্ত কুঠিরেই আছি।"
-- "গুপ্তধন কোন জায়গায় আছে অজিত?"
অজিত যেখান থেকে কথা বলছিল, তার ঠিক পিছনেই ছিল রাজার ছবি। আর পুলিশ অফিসার ছিল তার ঠিক বিপরীত দেওয়ালে; অজিতের দিকে তাকিয়ে। অজিত প্রফুল্ল বদনে বলল, "আপনার ঠিক পিছনের দেওয়ালেই গুপ্তধন আছে।"
অফিসার একথা শুনেই পিছনের দেওয়ালের দিকে ঘুরে তাকালো; কাছে গিয়ে দেওয়ালটা ভালো করে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল। তারপর কনস্টেবলদের দেওয়ালের মাঝখানটা ভাঙার জন্য আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কাজ সম্পূর্ণ হলো। তারা সবাই পরম কৌতূহলের সঙ্গে দেওয়ালের কাছে এগিয়ে এলো। তারা দেখল দুটি বেশ বড়ো বাক্স। অফিসারের আদেশে বাক্স দুটিকে কুঠিরের মাঝখানে আনা হলো। আবেগ আপ্লুত হয়ে কিছুক্ষণ পর অফিসার বাক্স দুটি খুললেন; তারা সবাই হাঁ করে বাক্স দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারা দেখল এক একটি বাক্সে পাঁচটি করে দশটি কাপড়ের বস্তা; প্রত্যেকটিতেই সোনা, মনি-মুক্তাই ভরা। আশ্চর্য হয়ে সবাই বিভিন্ন রকম আবেগের কথা বলতে লাগল, সেগুলো আমার পক্ষে বলা অসম্ভব। অফিসার অজিত ও রিতমকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "তোমরা অসাধ্য সাধন করেছো অজিত।" অজিত ও রিতমকে সবাই বিভিন্ন ভাবে অভিনন্দন জানালো। কিন্তু তারা কোন কথা না বলে বাক্স দুটির দিকে তাকিয়ে রইল। ওই রকম সোনা, মনি-মুক্ত তারা কোনদিন দেখেনি; আজকের দিনে ওই রকম জিনিস পাওয়া তো দূরের কথা, দেখাও যায় না।
বাক্স দুটি অফিসার অজিতের অনুরোধে হোটেলে নিয়ে গেলেন। কারণ অজিত তার সহপাঠীদের এই গুপ্তধন দেখাতে চেয়েছিল। অফিসার তা দেখানো কর্তব্য মনে করে নিয়ে যায়। পরে সেগুলিকে সরকারি দপ্তরে জমা করা হয়। তাদের বীরত্ব ও সাহসের জন্য তাদের সহপাঠীরাও অভিনন্দন জানায়। তখন রিতম তার সহপাঠীদের বলে, "আমার থেকে অজিতের সাহস অনেক বেশি, ও যদি না থাকতো আমি কখনও ওখানে যেতাম না। সুতরাং তোরা ওর সাহসীকতাকে অভিনন্দন জানা।"
তাদের দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করতে প্রায় বিকাল হয়ে গেল। তারপর তারা সবাই নিজেদের জিনিসপত্র গোছাতে লাগল; কারণ সন্ধ্যায় তাদের বাড়ি ফেরার ট্রেন। তাদের এই চারদিনের ভ্রমণ অজিত ও রিতমের জন্য দুঃচিন্তায় কাটলেও; শেষমেশ তারা সবাই পরম আনন্দে বাড়ি ফিরে এলো। এই ব্যাপারটা নিয়ে তাদের কলেজে রীতিমতো কোলাহল সৃষ্টি হয়। অজিত ও রিতম কলেজে সকলের কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে। কিছুদিন পর তাদের সাহস ও বীরত্বের জন্য সরকার তাদের সংবর্ধনা দেয়। তাদেরকে ও তাদের কলেজকে বেশ কিছু অর্থও সাহায্য করে।
__________________________
অলোক দাস
গ্রাম- খাটগ্রাম
ডাকঘর- সন্তোষপুর
থানা- গোঘাট
হুগলি, ৭১২৬০২
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত