চড়ক সংক্রান্তি। চৈত্রের খর দাহে ক্লান্ত মানুষজনের জীবনে ক্ষণিক স্বস্তির স্বাদ বহন করে আনে এই উৎসব ।সেদিন সংক্রান্তির উৎসবে মেতে উঠেছিল আবালবৃদ্ধবনিতা। আনন্দে উচ্ছ্বাসে দিগ হতে দিগন্ত মুখরিত হয়ে উঠে ছিল । সে দিন সংক্রান্তিতে হঠাৎ নীল আকাশের মুখ কালো করে সজল মেঘের সঞ্চারে ওরা আনন্দ পাগল চাতকের মত খুশিতে নেচে উঠে ছিল। শুধু এই আনন্দের জোয়ারে গা ভাসাতে পারেনি আনন্দ শর্মা। বড় একা একা দিন কাটে তার। হাত ধরে টান দিয়েছিল ও পাড়ার কুহেলি- ভাসো আনন্দে ভাসো। আজ সবাই মেতেছে মহুয়ার নেশায়। তবু আনন্দের আনন্দে কেন যে সব সময় ভাটা পড়ে থাকতো তা কুহেলি বুঝে উঠতে পারত না। আনন্দ সাফাই গাইত- ওইখানে যে আমার সকল আনন্দ লুকিয়ে আছে কুহেলি।
তবু সেদিন তাকে মাততে হয়েছিল, আর মাতাতে হয়েছিল ওই কুহেলি কে।
কুহেলি তখন সবে কৈশোর কাটিয়ে উঠেছে ।চনমনে শ্যামলা লতার মত লকলক করছে তার তনু । বারবার দোলখেয়ে লু্টিয়ে পড়তে চায় সে আনন্দের কোলে । এই ছেলেমানুষির অর্থ আনন্দ বুঝেছিল ঠিক কারণ তার যৌবন অতিক্রান্ত হয়েছে আরো বছর পাঁচেক আগে। তাই হাসতে আর হাসাতে গেলে ছেলে মানুষের ভয়ঙ্কর বাধা এসে আগলে দিত তাকে, সংকুচিত হয়ে পড়তো মনটা। তাই কুহেলির কলমি লতার মতো তনুকে অবলম্বন দিয়ে সোজা করতে ভয় পেত সে।
ঠিক এইখানেই দুঃখ ছিল কুহেলির। খেলার সাথী হিসাবে আনন্দকে তার বড় বেশি পছন্দ। আনন্দ ছাড়া তার সকল আনন্দ, নিরানন্দ- একথা আনন্দ ও বুঝত।আর এইখানে ছিল তার মস্ত বড় লজ্জা। মাঝে মাঝে রাগ হতো এই বোঝা রুপ বোঝাটার উপর । তবু তাকে কাটিয়ে উঠতে রাতের পর রাত কেটে যায় তার । অন্তহীন আশার নেশা করুনার সাগরে বারবার বিলীন হয়ে যায়। তারে ধরা যায় না , ছোয়া যায়না। শুধু মন কে নেশাগ্রস্ত করে।
বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিভেজা দুপুরে আবার ডাক এলো কুহেলির। সেই নব যৌবনার নবযৌবনের সাথী হতে পারত অন্য কেউ- যে তারই মত , কিন্তু পছন্দ হয়না তার হিরন কিংবা হারুকে। তাই নতুন করে যৌবনের ডালি সাজিয়ে আনন্দের বৈশাখী যৌবনে মাততে হয়েছিল আর মাতাতে হয়েছিল কুহেলিকে। সেদিনের সেই প্রথম বৃষ্টির কাছে আনন্দ কাতর প্রার্থনা জানিয়েছিল -হে নব বৈশাখী বরষা, তুমি তোমার স্নেহ কোমল পরশে আমার সমস্ত সংকোচ লজ্জা ধুয়েমুছে দাও , আনন্দ দাও ওই কিশোরীকে। কিংবা কিশোরীর দেহ-মনে লজ্জা দাও প্রভু, লজ্জা দাও। ধরুক কিংবা ছাড়ুক এই নববর্ষার প্রথম মধ্যাহ্নে এই হতভাগা আনন্দকে।
সেদিন প্রথম আনন্দকে নাচিয়ে ছিল বৈশাখী বরশা। বৃষ্টির রিম ঝিম ঝিম নুপুর নিক্কনে আনন্দের বাঁশি আপনিই বেজে উঠেছিল-
আজি এ বরষা মধুর হয়ে থাক
তোমার আমার স্বপনে
ভালোবাসার প্রথম কলি ফুটুক
তোমার মাঝে--সংগোপনে।
সেদিন কুহেলির শ্যামলা লতার মত তনু প্রাক- বৃষ্টির পরশে এঁকেবেঁকে ময়ূরীর মত পেখম তুলে নৃত্য করে উঠেছিল- আনন্দের আনন্দ রসে মাতাল হয়ে।
কথাতে তার খেলা, হাসিতে তার খেলা, নাচেতে তার খেলা। খেলায় ভুবন ভরা। এ হেন খেলার রাজ্যে আনন্দরসে মত্ত আনন্দ, কিশোরীর লাবণ্যে মুগ্ধ আনন্দ -সেদিন রাতে শুধু কেঁদেছিল।
২
একথা উঠেছিল কুহেলির বাবার কানে হারুর বদান্যতায় । তিনি লুকিয়ে দেখেছিলেন কুহেলির ডাক । এ ডাকের অর্থ একমাত্র আনন্দ ই বুঝত , কোহলির বাবা বোঝেননি।তাই বকাঝকা করে সরিয়ে দিলেন অতীশবাবু তার আদরের মা মরা মেয়ে কে । এরপর আনন্দকে শুনিয়ে দিলেন –আমার মেয়ে না হয় ছেলে মানুষ, বোঝে না । কিন্তু তুমি কি বোঝনা ? তোমার তো না বোঝার কোন কারণ নেই বাপু । মেয়ে আমার বড় হয়েছে , আজ বাদে কাল বিয়ে দিতে হবে। এভাবে আমাদের গালে চুন কালি না মাখালে কি নয় ! আমি এ সব একদম ই পছন্দ করি না। পড়াশোনা শিখেছ , বড় হয়েছো। এভাবে আমার সম্মান ধুলায় মিশিয়ে না দিলে কি তোমার চলছিল না ?
আনন্দ নত মস্তকে সব শুনে ছিল । কী বলবে সে ? - এ কথার উত্তর যে তার জানা নেই।
নিরুত্তর আনন্দকে দেখে জ্বলে উঠলেন অতীশবাবু। বিস্ফোরিতদুই চক্ষু বের করে গম্ভীর গলায় জানিয়ে দিলেন- আমি চাইনা এ নিয়ে গ্রামে আলোচনা হোক। তুমি ভদ্রলোকের ছেলে , কথাটা মনে রেখো। চল হারু তিনি হনহন করে চলে গেলেন।
এক মুহুর্তে সব আশার আলো অন্ধকারের কালো গহ্বরে মুখ লুকালো । দুফোঁটা অশ্রু আর মনের কষ্টিপাথরে লুকানো আশাকে বড় এক পাথর দিয়ে অন্তরালে বন্দি করে ফেলতে সেদিন ই বদ্ধপরিকর হলো। বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে আশা রুপ গহবরের মুখ চুনকাম করে দিতে- তৈরি হলো আনন্দ । এখন এইখানেই তার বাঁশি আপনি সুর বাঁধে , আপনি ই সুর হারায়।
কুহেলি এখন কড়া শাসনের শৃংখলে বন্দি হল । বাবার ভয়ে পথ চেয়ে বসে রইল সারাটা দিন। সন্ধ্যার অন্ধকারে জল আনতে যেতে হতো নদীর ঘাটে । তার কোন ওজর আবদার খাটত না। ছোট্ট একটি ঘর আর কংক্রিটের পাঁচিল তোলা উঠান এখন তার জগত । হারু খেলার সাথী হতে চায়। অতীশবাবুর বদান্যতায় সে বাড়ি আসে -যায় । কিন্তু কুহেলি তাকে সহ্য করতে পারেনা। হারুর ওপর তার রাগের কারণ ও সে ভালো বোঝে তাও না। আনন্দের কথা বারবার মনে পড়ে। এখন মনটা কাঁদে, আর কাঁদায় কুহেলিকে।
৩
“ তোমার লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু
অনলে পুড়িয়া গেল…”
আনন্দের আকাশ একটু একটু করে কালোয় ঢেকেছে। বর্ষার প্রাক্কালের এই প্রচণ্ড তাণ্ডব তার সমস্ত দেহ -মনকে নাড়িয়ে দিয়ে বারবার নিরুদ্দেশের আহ্বান জানিয়ে যায় । সে আহবানে সাড়া দিতে সে আজ প্রস্তুত। তবু ওপারের ক্ষীণ আলোর স্পর্শ পেতে মনটা এখনো কেঁদে ওঠে। এ ছিল খেলা, তবু সে ছিল এক মনের অপরিসীম তৃপ্তি, আর এক মনের আকুতি। কিন্তু একথা বোঝেনি অতিশ বাবু কিংবা বুঝেছিল ঠিক । ভাবনা আর ভাবনা , ভাবতে ভাবতে কূল হারিয়ে অকূলে হাবুডুবু খেয়ে ভরাডুবি হওয়ার পূর্বে হঠাত ই সে সিদ্ধান্ত নেয়- নিরুদ্দেশে পাড়ি দেবে। এখন মাঝ দরিয়ায় ভেসে পড়তে ও সে প্রস্তুত।
সুতরাং একদিন কাউকে কিছু না বলে আনন্দ নিরুদ্দেশ হল। কোনখানে তার যাত্রা, কতদূর তার গন্তব্য - সে কিছুই জানে না। জানার কথাও নয়, চিরকাল টা বইয়ের পাতায় মুখ বুজে পড়ে থেকে আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। কাজেই ভালোবাসার অন্তহীন সাগর অপেক্ষা, অন্তহীন যাত্রার পথ হোক তার সঙ্গী ।
এ খবর কোহেলিকে পৌঁছে দেয় হারু,- কুহি দি কুহি দি , আনন্দদা নেই।
- নেই মানে ! কোথায় গেছে ? - অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে কুহেলি।
-সে কথাই তো হচ্ছে গ্রাম ময় । হারু কি করে জানবে আনন্দ কোথায় গেছে ! আনন্দের মা পর্যন্ত জানে না। কুহেলির মনটা ছোট হয়ে যায়। আনন্দদা নেই , সে ভাবতে পারে না। রাগ হয় তার বাবার ওপর। কান্না পায় অতিথির দিনগুলোর জন্য। কিন্তু সে ক্ষণস্থায়ী । পাড়ায় আর পাঁচ জনের মত এখন সে বাইরে এসে আলোচনা শুনতে পারে। বাবা আর তাকে বাধা দেয় না। বকাঝকা করে না। এখন লুকিয়ে জল আনতে যেতে হয় না। কমলা, বিমলা, মাধবী দের সঙ্গে দিব্যি গল্প করতে করতে পথে ঘুরতে ফিরতে পারে। তবে ছেলেদের সঙ্গ
আজকাল তার আর ভালো লাগে না। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করে। নারী- জীবনের এই সহজাত লজ্জা, যা আজ কুহেলির সমস্ত দেহ- মনকে আচ্ছন্ন করে এক অভূতপূর্ব লাবণ্য এ চারিদিক ব্যপ্ত করে দিয়েছে- এ আগুনে কেউ বা নিজেরা পুড়ে মরে, কেহবা অপরকে পুড়িয়ে মারে।
কুহেলি ও আনন্দকে পুড়িয়ে মারতে পারত কিন্তু সে তো এখন তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই তার লজ্জা সুলভ প্রেম- যা কিনা আনন্দকে ঘিরে একটু একটু করে বিকশিত হয়েছে সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পের মত , এই চঞ্চলার দেহ-মনে- সেই সুধা রস আনন্দ ও পান করতে পারত।
কুহেলি এখন একা, বড় বেশি একা । তার সমবয়সী মাধবী তার সঙ্গ দিতে চায়। কাছে এসে বসে, কথা বলে। মাধবির সঙ্গে গল্প করে কুহেলি ও একটু শান্তি পায়। কিন্তু মনের কথা বোঝাতে তার প্রাণ কাঁপে , ভয় হয় , লজ্জা করে।
মাধবী বলে- ও সখি তোর হলো কি লা ? সব সময় কেমন গুমড়ে থাকিস…
কুহেলি বলে- হবে আবার কি !
-তবে যে দিনে দুপুরে হোঁচট খাস, আনমনা হয়ে চিভ কামড়াস…
কুহেলি আড়চোখে তাকায় মাত্র। উত্তর দিতে পারেনা । কোহেলির এই পরিবর্তন আর কেউ না বুঝুক মাধবী বুঝেছিল ঠিক। তাই গলা ধরে, চুমু খেয়ে , ভালোবেসে সেদিন বলেছিল- তুই মরেছিস সই।
-মরেছি ! কেন !
-কেন ? তাও বুঝিস না পোড়ারমুখী ?
কুহেলি কাঁদে। লুটিয়ে পড়ে মাধবীর বুকে, কাঁদতে কাঁদতে বলে-
আজি এ বরশা মধুর হয়ে থাক
তোমার আমার স্বপনে
ভালোবাসার প্রথম কলি ফুটুক
তোমার আমার মাঝে-সংগোপনে।
কুহেলি আর স্থির থাকতে পারে না। দু চোখ ভিজিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা। মাধবী তাকে সান্ত্বনা দেয়।
৪
এ দিকে আনন্দ নিরুদ্দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেও সবটাই পথ আচমকা ভেসে পড়া কঠিন হয়ে পড়ল। স্টেশন চত্বরে ঘুরে ঘুরে সারাটা দিন কাটিয়ে দিলে সে । দিনমণি পশ্চিম দিগন্ত লাল করে ঘুমের দেশে চলেছে । আবছা আঁধারে দূরের গাছগুলো বড় বেশি অন্ধকারময় মনে হয় – তার জীবনের মত । পাখির দল বাসায় ফিরছে , শুধু আনন্দ তার নিশ্চিত বাসা ছেড়ে ভেসে চলেছে- কোথায় কে জানে !
টিকিট কাটতে গিয়ে সে জানলো জলপাইগুড়ি যাওয়ার গাড়ি আসছে। সাত পাঁচ না ভেবে জীবনের বাকি দিন গুলি দার্জিলিং ই কাটিয়ে দেবার বাসনা নিয়ে সে গাড়িতে চেপে বসল।
আদিবাসী আপনভোলা মানুষগুলোর মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে, নতুন করে গান বাঁধল সে । কুহেলির মনের মাধুরি দিয়ে বাধা সুর মন কে শক্ত করে সযত্নে তুলে রাখলো সে বাঁশির তান -এর মধ্যে। যখন একা একা আর দিন কাটেনা , পাহাড়ের কোন এক শ্যামল ছায়ায় বসে শ্রান্ত আনন্দ যখন ছোট্ট লছমি,ছোট্ট মানেইয়াকে আদর করতে থাকে - তখনই কুহেলির স্মৃতি সমন্বিত সুর আপনা থেকেই কেঁদে ওঠে বাঁশির সুরে । পাগল ভোলা ছন্দে। আর সেই আওয়াজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে এক বিষাদ রাগিনী তে ছোট্ট ঘর গুলোকে কাঁদিয়ে তুল ত। কখন লসমি মানেইয়া জুবরি রা তার সামনে এসে ভিড় করে দাঁড়াত - সে ঠাউর করতে পারত না। যখন চোখের জলে বাঁশির সুর ভেজে উঠত , আর ছোট লসমি তার কচি কচি দুটো হাত প্রসারিত করত , তখন আনন্দের সব সুর যেত থেমে। সব দুঃখ হতো অবসিত। চোখ মুছে ছুটে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার বার কতক চুম্বন না খেলে সে তৃপ্তি পেত না।
আনন্দের নিরানন্দ জীবনে কিছুটা হলেও আবার আনন্দ ফিরে এলো। এখন সকলের সাথে সকলের মাঝে আপনাকে বিলিয়ে দিতে পারে সে। সেখানে কুহেলির মতো কেউ তাকে আকর্ষণ করে না। সবাই মেশে অতি সহজেই । প্রাণ ভরা হাসি আর বুক ভরা ভালোবাসা সহজেই বিলিয়ে দিতে পারে তারা । আনন্দ না হলে এই আদিবাসী মানুষগুলোর যেন দিন চলে না। রোগে সুখে দুঃখে দারিদ্র্যে নেশায় পাগল হয়ে মাদল দুলিয়ে নাচতে গাইতে আনন্দের দিন কাটে বেশ।
কিন্তু এমনি করে আর কত দিন কাটে ! বুকের সেই পুরানো ক্ষতটা- যেটা কিনা বাঁশির তানে লুকানো , দুপুরে হঠাত মেঘ ঘনিয়ে এলে কিংবা রাত্রির জ্যোৎস্নায় পাহাড়ের সুদৃশ্য স্বর্গভূমি তে নিশিযাপন করতে হলে তার বাঁশি আপনিই বেজে ওঠে- পাগল ভোলানো ছন্দে । এ কেমন মায়া জালে বন্দি সে ! ভাবতে ভাবতে , দুঃখে দারিদ্র্যে, জীবনের আরও পাঁচটা বসন্ত পার হয়ে গেল। এখন এসব আর ভালো লাগেনা । বড় এক ঘিয়ে ঠেকে। কাজেই আবার একদিন তল্পিতল্পা গুড়িয়ে আবারও অজানার সন্ধানে পাড়ি দিতে তার ভবঘুরে মনটা আকুল হয়ে ওঠল। কিন্তু আদিবাসী রমণীদের মায়া কাঞ্চনে ভরা চোখ তাকে আবেশে ভরিয়ে তোলে । দুলে ওঠে বুক, কেঁপে ওঠে হৃদয় , সে উপলব্ধি করে সত্যি এরই নাম বোধ হয় ভালোবাসা। কিন্তু কোথাও স্থির হয়ে বসে থাকা বোধ হয় বিধাতা তার কপালে লেখেনি । তাই বিদায় তাকে নিতেই হবে । সবাই এর কাছে বিদায় নিয়ে , রশমি কে আদর করে আবার একদিন সে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিল ।
স্টেশনে এসে মায়ের জন্য মনটা তার কেঁদে ওঠল । এ ক'বছরে মাকে সে একটুও ভুলতে পারেনি । যতবার-ই বাড়ি যাওয়ার কথা সে ভেবেছে ততবারই মনে পড়তো অতীশবাবুর মুখ । আর কুহেলির নিস্পৃহ ভাব । তাই বারবার দুর্বল হওয়ার মুহূর্তগুলো সে কঠিন সংযমে বেঁধে রেখে ছিল । কিন্তু আজ আর তার মন সায় দেয় না। কুহেলির কথা মনে পড়ে। সে কেমন আছে ! কত বড় হয়েছে ! কে জানে ! গালের নিচে কুঞ্চিত দাড়িগুলো বুকের কাছে এসে পড়েছে । চক্ষু কোটরাগত । দেহ শীর্ণ । ঝরনার স্বচ্ছ জলে নিজের ছায়া দেখে নিজেই খানিক হেসে ওঠত আনন্দ।
রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আনন্দ আবার গ্রামে ফিরল । আনন্দের বৃদ্ধ মা শোকের ভারে আরো নিয়ে পড়েছেন । এ ক'বছরে তার যে কিভাবে দিন কেটেছে তা শুধু ভগবানই জানেন । তাই আজ ছেলের বাড়ি ফেরার আনন্দ তিনি তিনি বুকে চেপে রাখতে পারলেন না । কেঁদেকেটে সাত পাড়ার লোক এক পাড়ায় করে আনন্দের বাড়ি ফেরার সংবাদ রাষ্ট্র করে দিলেন । কুহেলির কানে ও ওঠে কথা টা ।
মাধবি এসে জানায় তাকে - সই ও সই , তোর বাঁকা শ্যাম যে ফিরে এলো।
কুহেলি কাঁদে- এলেই বা আর কি ! রাত পেরোলে বাজবে সানাই , গায়ে উঠবে চেলি , হাতে পাক খেয়ে পড়বে শাঁখা পলা । আর সন্ধ্যা হলেই একরাশ সিঁদুর মাথায় চড়িয়ে পরের ঘরের বউ হয়ে ঘর সাজাতে যেতে হবে । তার আজ কান্না ছাড়া কিই বা উপায় আছে ! কুহেলি শুধায় ।
মাধবী তার চিবুক ধরে নাড়া দিয়ে বলে- কি করবি সই ! পরকে আপন করে নিয়ে ই তো বাঁচতে হয় মেয়েদের ।
-আচ্ছা সখী , সে ভালো আছে ? তাকে তুই দেখেছিস ?
- দেখেছি । দূর থেকে । এই একগাল দাড়ি । রোগা । আমার যা ভয় করছিল …
কুহেলি হাসে। সে হাসিতে জৌলুস নেই । আছে ব্যথা লুকানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
মাধবী বলে - আমার দিকে তাকালো। আমার যেন কেমন ভয় করল । চোখ দুটি বসে গেছে , মুখটা শুকিয়ে গেছে , মনে হয় কতদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি ।
- আচ্ছা সই , আ.. মার কথা তার মনে আছে ?
- তা আর নেই ?
তারপর কিছু সময় চুপ করে থেকে কি যেন ভাবে মাধবী । কি জানি ! বিশ্বাস হয়না ! পুরুষ মানুষ তো !
কুহেলি আর কিছু বলে না । কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে । তাকে বিশ্বাস হয় না - একথা সে ভাবতেও পারে না। রাত বাড়তে থাকে । মাধবী আজ তার সঙ্গে শুয়ে পড়ে । কুহেলি পাশ ফিরে শোয় । বড় পিসিমা পাশের খাটে ঘুমাচ্ছেন । কুহেলির দু'চোখ জলে ভিজে যায়।
৫
যত আশা ভরসা উৎকণ্ঠা নিয়ে আনন্দ বাড়ি ফিরে ছিল তা এখন আর নেই । কেমন যেন সব পরপর মনে হয় । স্বস্তিতে শ্বাস নিতে পারে না সে । কি এক অমূল্য ধন যেন সে খুঁজে বেড়ায় আগন্তুক মানুষগুলোর মধ্যে । হাজার লোকের হাজারো প্রশ্ন - কোথায় ছিলিস ? কেমন ছিলিস ? চাকরি করছিলিস কিনা - এসব শুনতে শুনতে সে হাঁপিয়ে উঠে ।
সবাকার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় । ভালো ও লাগেনা । পাড়ার লোকজন বিদায় নিলে, মা বলেন - চল বাবা , এবার একটু শুয়ে পড় । রাত হলো ।
-হ্যাঁ মা , তাই চলো - আনন্দ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে । মা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে অভিমানি হয়ে উঠেন - এতদিনে মাকে মনে পড়ল তোর ? এমন করে কি ফাঁকি দিতে আছে রে ?
-আর তোমায় ছেড়ে কোত্থাও যাবো না মা । তুমি ছাড়া আজ আর আমার যে কেউ নেই । মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে ফেলে সে। আবেগ মথিত মা সহসা বলে ফেলেন
- অতিশের মেয়েকে তোর মনে আছে খোকা? বড় লক্ষ্মী মন্ত ছিল সে। আনন্দ চুপ করে থাকে মা বলতে থাকেন - কাল তার গায়ে হলুদ। মুখুজ্জে দের বড় ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ হয়েছে।
আনন্দ চমকে ওঠে । মাকে সে বুঝতে দেয় না। মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে- ও তাই বুঝি ? বড় বাড়ি সম্বন্ধ হয়েছে তাহলে।
-তা আর হবে না ? অতিশের কি আর টাকার অভাব আছে ? মা মরা মেয়ে , তাইতো সব দিচ্ছে ।
- আনন্দ চুপ করে শুনে যায় । তার বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে - কোহেলির কালকে বিয়ে, আর আজ সে ……
না আর সে ভাবতে পারেনা। কিন্তু সে মাকে ব্যথা দিতেও চায়না – মা আমার যে বড় ঘুম পেয়েছে ।
- তুই শুয়ে পড় খোকা । আমি ও ঘরে গিয়ে শুচ্ছি ।
মা আর কথা বাড়ায় না । আনন্দ ধীরে ধীরে শক্ত পাথরের মতো কালো বালিশ খানা বুকে আঁকড়ে ধরে চুপ টি করে পড়ে থাকে । কাল তার গায়ে হলুদ, মুখুজ্জে দের বড় ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ হয়েছে , আঁতকে ওঠে বুক । বারবার হৃদস্পন্দনে বিছানা দুলে ওঠে । সে আর স্থির থাকতে পারে না । বুকের কাছে সপাটে আঁকড়ে ধরে তার প্রিয় বাঁশি টা । তারপর ধীরে ধীরে চোরের মত পায়ে পায়ে আবারো বেরিয়ে পড়ে – মায়েরকোল ফাঁকি দিয়ে।
স্বচ্ছ জ্যোৎস্নায় আকাশটা বড় সুন্দর। কোথাও এতটুকু মেঘের ছায়া নেই । সে দাওয়া থেকে নিচে নেমে , মৃদু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তাদের চির পরিচিত সেই খেলার বাগানে এসে পৌঁছায় । কুহেলির হাতে গড়া মাটির বেদিটার দিকে তাকায়- বনজ গাছগাছালিতে সেটি ঢেকে গেছে । রাতের স্বচ্ছ চাঁদের আলোয় মাটির ঢিবির ক্ষয়ে যাওয়া বুকের উপর ও কার মুখ ভেসে ওঠে ? আনন্দের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । আর তখনই বাঁশি আপনা থেকেই বেজে ওঠে সেই চির পরিচিত সুরে - আজি এ বরশা মধুর হয়ে থাক
তোমার আমার স্বপনে
ভালবাসার ……
বাঁশির সুরে বনের প্রতিটি বৃক্ষলতা সহসা যেন চমকে ওঠে । প্রতিধ্বনিত হতে হতে সে সুর রোমাঞ্চিত করে তোলে বনরাজি কে। সুরের মূর্ছনায় পাগল হয়ে ওঠে আনন্দ । পাগল পারা সে সুরের মায়ায় আকাশ বাতাস হয়ে ওঠে মুখরিত।
সে সুরের রেস কুহেলির কানে এসে পৌঁছায়। সে বুঝল এ যে তার আনন্দদার ডাক ।যে ডাকের অপেক্ষায় সে এতদিন পথ চেয়ে আছে । কিন্তু মাধবী আর পিসিমা যে তাকে আগলে রেখেছে । যাওয়ার উপায় নেই । বাঁশির সুরে মাতাল হরিণীর মতো দুলে ওঠে কুহেলি ও ।
আনন্দের বাশির সুর ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে এল ।
সে বুঝল কুহেলি আজ তার কাছে শুধু ই একটা স্মৃতি । কয়েক ফোঁটা অশ্রু তার বাশির সুর ভিজিয়ে দিয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ করল । বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁদটাকে একবার দেখে নিল । তারপর আসন ছাড়লো সে ।
এদিকে কুহেলি ও চুপি চুপি ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর এক দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে , বনের শুকনো পাতায় খস খস আওয়াজ তুলে , ভীত হরিণীর মতো সেই বেদীমূলে এসে দাঁড়ালো। এতদিনে তার সযত্নে রক্ষিত বেদি মুল । কিন্তু কোথায় সে আওয়াজ ! পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া চন্দ্রিমায় সে দেখল কয়েক ফোঁটা অশ্রু পড়ে আছে বেদি সংলগ্ন বনলতার বুকে । আর নীলাকাশের শুভ্র চন্দ্রিমা তাকে নিয়ে যেন লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে । সে হাঁটু মুড়ে বসে সেই অশ্রু তুলে নিজেকে ধৌত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে লাগলো পাগলের মতো । তার হাতের স্পর্শে সে অশ্রু মুছে গেল । আর তার বুক ভেঙে এত দিনের লুকানো অশ্রু রাশি বন্যার মতো বেরিয়ে এল ।চোখের জল মুছে সে অতি ধীর স্থিরভাবে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানালো বেদীমূলে । তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দূর পানে তাকিয়ে দেখল এক কাল ছায়া মূর্তি দূরে আরো দূরে অস্পষ্টভাবে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে । কুহেলির চোখ ঝাপসা হয়ে এলো । আকুল হয়ে দুই হাতে চোখ ঢেকে হাও হাও করে কেঁদে উঠল সে । তাঁকে সান্ত্বনা দেবার আজ আর কেউ রইল না । ভোরের সানাইয়ের সুরে তার খেলার সাথির সুর চিরকালের মতো হারিয়ে গেল স্থিরতার অন্তঃপুরে।