ছোটগল্প ।। ক্ষুধার পৃথিবী।। সৌর শাইন।।
ক্ষুধার পৃথিবী
সৌর শাইন
ঘুম ভাঙা ভোর। জানালার ওপাশে কুয়াশার আলপনা। খুব বেশি দূর দেখা যায় না। মাঘের সকাল হলেও শীতের প্রকোপ নেই। তবে একটা শিরশিরে ভাব বিরাজমান। চাদর জড়িয়ে ছাদে উঠার পর দুটো কাকের সাক্ষাৎ পেলাম। ওরা মৃত মুরগির দেহাংশ নিয়ে টানাটানি করছে। নখের আঁচড়ে রঙিন টবে বেড়ে ওঠা সবজির চারাগুলো নষ্ট হবে, এই ভয়ে কাক দুটোকে তাড়িয়ে দিলাম। মুহূর্তে ওরা পাখা মেললো সামনের রাস্তার দিকে।
আকাশমনি গাছের গোড়ায় রমিজ চাচার চায়ের দোকান। কাকদুটো প্রথমে দোকানের বেঞ্চিতে পা রাখলো। কয়েক মিনিট পর ওরা প্রায় জনশূন্য রোডে একপা দু'পা এগিয়ে খাবারযোগ্য আবর্জনা খুঁজতে লাগল। পেয়ে গেল একটি মৃত প্রাণির হাড়। তখন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মীরা রোড ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত। হঠাৎ ওদের তাড়া খেয়ে হাড় মুখে নিয়ে কাকদুটো আবার ছাদে এলো। আমাকে দেখেই আচমকা পেছালো। দু'জোড়া চোখ আমার চোখের দিকে। কী ভাবছে ওরা?
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আমার স্থির দৃষ্টিতে ভরসা পেয়ে ওরা শুকনো হাড় ভক্ষণে মন দিলো।
ফ্রেশ হয়ে মোড়ের দোকানে পরোটা ভাজি নাস্তা খেয়ে নিলাম। নাস্তা শেষে এককাপ গ্রিন-টি আমার প্রতিদিনই লাগে। এক একটা চুমুক কুয়াশার সকালকে ক্রমেই রৌদ্রোজ্জ্বল করে তুলছে। এদিকে চায়ের ধোঁয়া আমার চশমার গ্লাসে নির্দ্বিধায় আশ্রয় নিচ্ছে। ঝাপসা দৃষ্টির ওপাশে দেখতে পেলাম দোকানের চুলার পাশে জমানো সদ্য তোলা তন্দুরি স্তুপ থেকে একটা রুটি গড়িয়ে নিচে পড়ল। পাশে বসে থাকা কুকুরটি মুহূর্তে তা দখল করল। বিশ-পঁচিশ ফুট দূরে থাকা অপর কুকুরটি উঁচু গলায় ঘেউ ঘেউ শব্দে ছুটে এলো। শুরু হলো লড়াই। একটি মাত্র রুটি, দাবিদার দু'জন তিনজন, দেখতে দেখতে সংখ্যা বাড়তে লাগল। আর ঘেউ ঘেউ চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে পুরো মোড় কেঁপে উঠলো। শব্দের কম্পাঙ্ক থামতেও সময় লাগেনি। লোকজনের তাড়া খেয়ে কুকুরগুলো টিকতে পারলো না। অন্যত্র চলে গেল।
বিকেলে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে। ট্রাফিক জ্যামে প্রাণ অতিষ্ঠ। বাসটা কচ্ছপ গতিতে এগুচ্ছে। চলতে চলতে কাঁদো কাঁদো ইঞ্জিনটা যখন ক্ষেপে হুড়মুড়িয়ে ছুটতে গেল ঠিক তখনই দুঃসহ ব্রেক গলা চেপে ধরলো। যাত্রীরা প্রায় ঝুঁকে পড়ে নিজেদের সামলে নেয়। কেউ কেউ ড্রাইভারের প্রতি মারমুখী দৃষ্টিতে তাকায়।
আরেকটু এগিয়ে বাসটা হোঁচট খেয়ে থামে। একটা কটু টক দুর্গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলো। বাঁ দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে নগরীর ডাস্টবিন। অজস্র আবর্জনা স্তুপ করে রাখা। সেখানে ব্যস্ত পথশিশুদের দেখা যায়। ওরা খাবারের সন্ধানে আবর্জনাগুলো উল্টে পাল্টে দেখছে। হঠাৎ একটি ছেলে বাসি বিরিয়ানির প্যাকেট খুঁজে পেলো। তৎক্ষণাৎ পাশের ছেলেটি বিস্ফোরিত চোখে হাত বাড়ালো ওর দিকে। বাসি বিরিয়ানি পাওয়া সৌভাগ্যবান বালকটি দৌড়াচ্ছে। পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে আরো ক্ষুধার্ত উদর।
রাতে ঘুমোবার আগে চোখের সামনে ভেসে উঠে কাক-কুকুর ও মানব শিশুর দৃশ্য! ওরা ক্ষুধার্ত পৃথিবীর বাসিন্দা। ওদের চোখেও একটি সরল রৈখিক স্বপ্ন আছে। বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা, এই পৃথিবীকে ভালবাসার ইচ্ছে। অন্তত আকাশ দেখার শখ!
-------------------------------------
সৌর শাইন,
বাংলাদেশ।
+8801684243932
ঢাকা, বাংলাদেশ।