ঋণী হয়ে রইলাম
অনিন্দ্য পাল
১.
অনেক দিন পর রুইতন আবার আজ বৌবাজার মুখো হয়েছে। গত পাঁচ বছরে আসে নি, মানে আসতে হয় নি। বিয়ের পর পয়সা খরচ করে শরীরের সুখ নেওয়ার দরকার হয়নি তেমন। রচনা এতদিন সব রকম আনন্দ দিয়েছে তাকে।
-- আরে কে রে? বুটু বাবু না! অনেকদিন পর যে বাবু!
ঘোর কেটে গেল রুইতনের। রেডলাইটে বুটু ছিল ওর ডাকনাম। সামনে যে শুকনো শরীরটা দাঁড়িয়ে আছে, সে কি সুখিয়া? এই ঘরে রুইতনের অনেক স্মৃতি লুকিয়ে আছে। এই ঘরেই প্রথম কৌমার্য হারিয়েছিল রুইতন। বাইরেটা এখন বেশ ঝকঝকে, গাঢ় সবুজ রঙে পুরোনো দেওয়াল গুলোকে খানিকটা যৌবন লেপে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু রুইতনের চোখ সেই সবুজ পেরিয়ে ভিতরের শরীরটা দেখতে পাচ্ছে, সেখানে এখনও অনেক ইঁটের খাঁজে তার গন্ধ লেগে আছে।
প্রথম দিনের স্মৃতিটা ভেসে ওঠে রুইতনের অবচেতন থেকে চেতনে। ভুলেই গেছিল, কিন্তু আজ হঠাৎ সম্পূর্ণ অক্ষত চেহারায় সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রমেশ পাড়ুই, তার জীবনের একটা অন্ধকার অধ্যায়, অস্পষ্ট শরীরে পাশে এসে দাঁড়ালো। শেষ দেখেছিল তাও বছর তিনেক আগে। কঙ্কালসার দেহ। এডস তখন প্রায় খেয়ে ফেলেছিল রমেশকে। বৌটাও একই ভাবে ক্ষয়ে গেল। কিছু করার ছিল না, রুইতনের। ইচ্ছাও ছিল না তেমন।
প্রথম যেদিন রমেশ পাড়ুই তাকে নিয়ে আসে, একটা অদ্ভুত ভয় আর আতঙ্ক ইচ্ছার ধুনুচিটা বার বার নিভিয়ে দিচ্ছিল। নেতিয়ে পড়ছিল রুইতনের অহঙ্কার।
মিনিট দশেকের মধ্যে কপর্দকশূন্য হয়ে যখন বাইরে এল, নিজেকে তখন ফ্যাতাড়ু ছাড়া আর অন্য কিছু মনে হচ্ছিল না। আর এই হেরে যাওয়া তাকে বাধ্য করেছিল জেতার লড়াইয়ে সর্বস্ব খোয়ানোর জন্য বার বার ওই ঘরে, ওই বিছানায় আছড়ে পড়তে।
ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এল একটা নতুন মুখ। অন্তত রুইতনের কাছে নতুন। দরজার বাইরে রাখা জলের বালতি থেকে জল নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে চলে গেল অন্য দিকে। ঘর থেকে বেরিয়ে এল মাঝ বয়সী এক ষণ্ডা গোছের লোক। রুইতন শেষ যেদিন মোহিনীর ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সেদিন বালতিতে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল সব জল। প্লাস্টিকের বালতিটাও বোধহয় ভেঙে গেছিল। হাজার টাকার একটা নোট মোহিনীর হাতে গুঁজে দিয়ে এসেছিল, বাড়তি হিসেবে। মোহিনী কিছু বলে নি, রুইতনের জামার একটা বোতাম খোলা ছিল, সেটা আটকে দিয়ে পিছন ফিরে চলে গেছিল, ঠিক আজকে যেমন করে এই মেয়েটা চলে গেল।
--আরে ও বুটু বাবু! চিনলে না তো? সুখিয়াকে ভুলে গেলে? আরে মোহিনীর কোলবালিশ! মনে পড়েছে এবার!
পাঁচ বছর পিছন থেকে ধাক্কা খেয়ে রুইতন বর্তমানে নেমে এল।
সুখিয়ার দিকে ফিরে বললো,
-- এত রোগা হয়ে গেছ কেন?
-- আর, বেঁচে আছি এই না কত! তা তোমার খবর কি বল? বৌ বাচ্চা করেছ শুনলাম, তা আবার এমুখো কেন? বৌ পালাল নাকি?
একথার উত্তর না দিয়ে, একটু মুচকি হেসে রুইতন বললো,
--রমেশের খবর জানো কিছু? আসে টাসে এখনো?
-- না গো বুটু বাবু। ও হারামজাদা আর আসে না। দালালি শুরু করেছিল। আমার মেয়ে ফুসলিয়ে চলে গেছিল। ভালো করে মেজে দিয়েছিলাম ---- ছেলেকে।
রুইতন বুঝলো এরা কেউ রমেশ পাড়ুই এর মরার খবরটা জানে না। ও কিছু বললো না।
--- চল ভিতরে চল, এখন সিভিকের খুব চাপ। শুধু পয়সা খাবে। আর আমিও দাঁড়াতে পারি না বেশিক্ষণ। এদিকে এখন সব নতুন মেয়ে, বয়স কম, রেট বেশী।
২.
প্রায় ৮ টা বাজে। অন্যদিন সাড়ে ছটায় বাড়ি পৌছে যায়, আজ বাড়ির কথা মনে হলেই মনটা বিষিয়ে উঠছে রুইতনের। অফিস ফেরত পুরোনো আড্ডায় গিয়ে ভেবেছিল নিজের সর্বনাশ করবে কিন্তু সেখানে গিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই ব্যর্থতাই তার সঙ্গে ফিরেছে। অচেনা, অপুষ্ট শরীরের আড়ালে লুকোবার অনেক চেষ্টা করেও বার বার ধরা পড়ে গেছে, ধরা পড়ে গেছে নিজের কাছে, রচনার অদৃশ্য উপস্থিতির কাছে। মনে পড়েছে তিন বছরের অর্চনার মুখটা। পেশাদার শরীরের যান্ত্রিক সুখ আগুনের ছ্যাঁকার মত মনে হচ্ছিলো। যে জ্বালা নিয়ে গেছিল রুইতন, ফিরে এসেছে তার বহুগুণ জ্বালা নিয়ে।
বিয়ের পর নিজেকে সংযত করেছিল রুইতন। অর্চনা গর্ভে আসার আগে পর্যন্ত গভীর সুখে ডুবে ছিল রুইতন। রচনার ভালোবাসা, মিষ্টি ব্যবহার রুইতনের মনের ভিতর থেকে অনেকটা পাঁক-- কাদা ধুয়ে দিয়েছিল। প্রথম দু'বছরের উদ্দাম দাম্পত্য রুইতনকে একটা মাংসাশী জানোয়ার থেকে অনেকটা মানুষ করে ফেলেছিল। কিন্তু মেয়েটা জন্মাবার পর থেকেই বদলে যেতে লাগলো রচনা। বুকে দুধ ছিল না, তাই ব্রেস্ট ফিডিং করাতে পারতো না। বাচ্চাটাও চিৎকার করতো খিদেতে। আর এই ব্যর্থতা রচনাকে ভয়ানক মারমুখী করে তুলেছিল। অর্চনাকে দেখলেই আস্তে আস্তে পালাতে লাগলো। এমনকি কেঁদে মরে গেলেও মেয়েটাকে একটু কোলে পর্যন্ত নিত না রচনা। রচনার বোন, চেতনা সেই পরিস্থিতিতে রোজ আধ ঘন্টা স্কুটি চালিয়ে এসে অর্চনাকে দুধ খাইয়ে যেত। ওর মেয়ে সঙ্গীতা অর্চনার চেয়ে মাত্র দু'মাসের বড়। এতে ফল হল আরো খারাপ। রচনা যেন ঘেন্না করতে লাগলো সবাইকে, রুইতনকে তো কাছেই ঘেঁষতে দিত না। এমনকি নিজের ফুটফুটে ছমাসের মেয়েটাকেও একদিন আয়ার কোল থেকে হিঁছড়ে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিল বিছানায়। কম্বলের উপর আছড়ে পড়ায় সে যাত্রা বেঁচে গেছে অর্চনা।
রুইতন নিজেকে সহ্য করেছিল অনেক দিন, কঠিন সংযম আরো কঠিন করে দিয়েছিল ওই ঘটনার পর। কিন্তু রক্ত-মাংসের শরীরে জ্বালানি একদিন তো শেষ হয়। রুইতনের ও হল। এক রাতে চরম খিদে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রচনার উপর। নিংড়ে নিতে চাইলো সমস্ত কিছু, সব অধিকার আদায় করে নিতে চাইলো পাষণ্ডের মত। রচনা সেদিন ছিল, একটা মৃতদেহের মত। সমুদ্র স্নানে এসে শুকনো বালির গভীরে তলিয়ে গেছিল রুইতন। সেদিন, জীবনে প্রথমবারের জন্য তার নিজেকে ধর্ষক মনে হয়েছিল। আজো, এই মুহুর্তে নিজেকে তেমনি মনে হচ্ছে রুইতনের। স্টেশনের পাশের মদের ঠেক থেকে বেরিয়ে সামনের বন্ধ দোকানের চাতালে গিয়ে বসলো। উদভ্রান্তের মত রচনাকে হারাতে, নাকি নিজেকে হারাতে পয়সা দিয়ে সুখ কিনতে গেছিল। কিন্তু সুখ বড্ড স্বার্থপর, নিজের পছন্দ না হলে ধরা দেবে না। রুইতন তাই সুখ খুঁজতে এসে অনেকটা দুঃখ নিয়ে ফিরেছে। রচনার প্রতি রুইতনের ঘেন্না জন্মায়নি, কিন্তু ভালোবাসাটাও শুকিয়ে গেছে। দিনের পর দিন রচনার ছবিটা তার মনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে আসছে, সেটা বুঝতে পারছিল রুইতন, কিন্তু আজ রচনার ঘোলাটে ছবিটা হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আর তার নিজের ছবিটাই কেমন যেন নষ্ট হয়ে গেছে। ঘেন্নার জলে আধডোবা হয়ে নিজের মুখে নিজেই থুথু ছেটাতে লাগলো রুইতন।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাচ্চার কান্না ভেসে এল। রুইতনের কানে পৌঁছাতেই সে একেবারে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে উঠলো। অর্চনার জন্য তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। রচনার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক পাশাপাশি ফ্ল্যাটের দুই পরিবারের মত, যারা শুধু সিঁড়িতে ওঠা-নামার সময় একে অন্যের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে। রাতের খাবার অর্চনা তার সঙ্গেই খায়। যতক্ষণ না রুইতন বাড়ি ফেরে, যতই খিদে পাক কিছুতেই খাবে না অর্চনা। রুইতনই তার একমাত্র আশ্রয়, অন্তত নিজের বাড়িতে। রুইতন, রচনার পাল্টে যাওয়াটা সহ্য করতে পেরেছিল অনেকটাই অর্চনার জন্য।
টলতে টলতে বাড়ির রাস্তা ধরলো রুইতন। মেয়েটাই তাকে এখনও বেঁধে রেখেছে সংসারে।
৩.
স্টিলের থালার ঝনঝন আওয়াজে রাত সাড়ে এগারোটার নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেল। বিরক্ত রচনা ভাতের থালাটা মেঝেতে ফেলে এঁটো হাতেই মেয়ের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগলো---
-- এক ঘন্টা ধরে বলছি খেয়ে নে, খেয়ে নে, শয়তান মেয়ে কিছুতেই শুনলি না, মর না, মরিস না কেন তুই? কত লোকের ছেলে মেয়ে মরে যায়, তোর মরণ হয় না কেন? বাবা না খেলে খাবে না? বাবা! বাবা যেমন জ্বালাচ্ছে, তুমিও তাই! মেরে ফেলবো একদম। সে মদখোর কোথায় মদ খাচ্ছে তার ঠিক নেই, শয়তান মেয়ে তুমিও সেই জন্ম থেকেই আমার পিছনে লেগে আছ! আমি তো কতবার বললাম, অনাথ আশ্রমে রেখে আসতে, হ্যাঁ বদমাইশ লোক শুনলোই না। এই বিচ্ছিরি জিনিসটাকে আমার ঘাড়ে ফেলে নিজে খুব মজায় আছে। মেরেই ফেলবো আজ, শয়তান তুই মরলে আমি বেঁচে যাই।
মেয়ের চুলের মুঠি থেকে রচনার হাতটা এত তাড়াতাড়ি সরতো না হয়তো, যদি না বাইরে গেটের লোহার ছিটকিনি খোলার শব্দ হত। এ শব্দ রচনা চেনে। রুইতন এসে গেছে।
রচনা হঠাৎ থেমে গেল। অর্চনার চুলের মুঠি খসে পড়লো ওর হাত থেকে। কিন্তু অর্চনা আর বসে রইল না, চেয়ার থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
রচনা একটু চোখ কুঁচকে তাকালো অর্চনার দিকে। মেয়েটা কাঁদছে না তো। ছোট বেলা থেকে কেঁদে কেঁদেই তো রচনাকে পাগল করে দিয়েছে, কখনো দুধ খাবার জন্য, কখনো কোলে ওঠার জন্য, কখনো হয়তো একটু মায়ের আদর পাবার জন্য। কোনোটাই ছিল না রচনার কাছে। কিন্তু আজ হঠাৎ সেই কান্না বন্ধ হয়ে গেল কেন? রচনা হাতের মুঠো খুলে দেখলো একগোছা ছেঁড়া চুল তার হাতে, সঙ্গে কয়েক ফোঁটা রক্ত। রচনার বুকের ভিতরটা কেমন যেন ধড়াস করে উঠলো। একটা অদ্ভুত এবং সম্পূর্ণ নতুন কষ্ট তার গলার কাছে এসে জমা হল। এ কষ্টটা অর্চনার জন্য নাকি তার নিজের জন্য তা বুঝতে পারছে না রচনা।
দরজায় কড়া নড়ছে। রুইতন এসে গেছে। মেয়েটা এখনও নীচে পড়ে আছে! কতক্ষণ ধরে মেরেছে ওকে? সত্যিই কি তবে... মাথাটা হঠাৎ ঝিমঝিম করে উঠলো রচনার। চোখের সামনে থেকে সব কেমন পিছনের দিকে সরতে লাগলো, কেঁপে উঠলো পায়ের তলার মাটি। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না রচনা। সম্পূর্ন অচেতন হয়ে অর্চনার গায়ের উপরেই ঢলে পড়লো সে। দরজায় তখন রুইতনের জড়ানো স্বর আস্তে আস্তে তীব্র হয়ে উঠছে --
--- অর্চনা, এই অর্চনা, দরজাটা খোল তো মা! কখন থেকে ডাকছি বল তো!
৪.
চোখটা খুলেই রচনা দেখলো তার চারদিকে অনেক গুলো মুখ। সবাই অত্যন্ত চিন্তা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে চারপাশটা পরিস্কার হয়ে এলে বুঝতে পারলো সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। বাবা, মা এবং রুইতন তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ রচনা এক ঝটকায় উঠে পড়লো বেড থেকে। চারদিকে খুব চঞ্চল ভাবে দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে উঠলো, অর্চনা, অর্চনা কোথায়?
রুইতন অবাক চোখে দেখছিল রচনাকে। এ কোন রচনা? গত পাঁচ বছরে এমনটা কখনো দেখেনি, মেয়েকে বরাবর দূরে ঠেলেই দিয়েছে, কখনো ভালোবেসে কোলে পর্যন্ত তুলে নেয় নি।
-- অর্চনা কোথায়? বলছো না কেন? আমি কি ওকে মেরে ফেলেছি? আমি খুব খুব খারাপ! ও কি সত্যি সত্যি মরে গেল?
কাঁদতে কাঁদতে রুইতনের পায়ের কাছে বসে পড়লো রচনা। দু'হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। ঠিক তখনি দু'টো ছোট্ট হাত কোথা থেকে এসে জড়িয়ে ধরলো রচনাকে। দু'টো ছোট্ট ঠোঁট একটা মিষ্টি চুমু দিয়ে ডাকলো,
--- মা-আ-আ
রুইতন মনে মনে অর্চনাকে বললো, ঋণী হয়ে রইলাম, তোর কাছে মা, ঋণী হয়ে রইলাম।