ছেলেটি কোথায় থাকে জানিনা । চার পাঁচ মাস ধরে দেখছি প্রত্যেক পূর্ণিমায় চাঁদের আলো চারদিকে যখন ঝলমল করে ওঠে তখনই আমাদের ঘরের পুবের জানালাটার নিচে এসে দাঁড়ায় । তারপর একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ছেলেটির পরনে জিন্সের প্যান্ট, পাঞ্জাবি চুলগুলো উস্কো খুস্কো মুখে একরাশ দাড়ি কাঁধে একটা সাইড ব্যাগ। চট করে দেখলে কবি বলে মনে হয় । আমি প্রথমটা তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু অরূপ লোকটার কথা শুনে বললো, "ধুস, এখানে কবি কোথা থেকে আসবে? কেনইবা আসবে ! আর যদি কবিই হত ছেলেটা তো ব্যাগ থেকে খাতা-কলম কিছু না কিছু বের করে লিখতো। "
অরূপ বলার পর আমার মনে হল সত্যিই তো যদি কবি হয় তাহলে প্রত্যেক মাসে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে নাকি!
খানিকটা আশ্চর্য হয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে অমন নিয়ম করে ছেলেটা কেন এসে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের জানালার কাছে । "পাগল হবে হয়তো"এই কথা বলে অরূপ পাশফিরে ঘুমোনোর চেষ্টা করে । আমি বললাম ছেলেটা যদি পাগল হবে তাহলে ছেলেটা নিয়ম করে সময়ে মিলিয়ে আসতে পারি নাকি? অরূপ মিট মিট করে হেসে বলল 'ওই সময়টা তুমিও জানালায় দাঁড়াও রোজ' তাহলে ছেলেটি মনে হয় তোমাকে দেখতে আসে। লজ্জায় শিরশির করে ওঠে আমার শরীর, রাঙা হয়ে যায় মুখ।
অরূপ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে ছেলেটিকে নিয়ে এতো ভাবছো কেন ?ছেলেটা তোমাকে তো আর বিরক্ত করছে না।
এক পূর্ণিমার দিনের অরূপ অফিসে রয়েছে আর সেই ছেলেটি এসে নিচে একই জায়গায় দাঁড়িয়েছে , আমি কৌতুহল নিয়ে সেজেগুজে নিচে ছেলেটার কাছে গেলাম। দেখলাম ছেলেটি একদৃষ্টে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখলোই না।
আমি তখন ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম প্রতি পূর্ণিমায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কেন দাঁড়িয়ে থাকো তুমি ? ছেলেটি বলল 'তাকে' চাঁদের আলোয় দেখতে পাই আমি। আমি বললাম কাকে দেখতে পাও? ছেলেটি বলল 'মাকে' দেখি। ছেলেটি হেসে বলে মায়ের শরীরটা চলে গিয়েছে কিন্তু তার আলো, ভালোবাসা, স্নিগ্ধতা তো মরে নি। আমি রোজ মায়ের আলো গায়ে মাখি, চেয়ে থাকি মার দিকে, তখন নিজেকে আর একা লাগে না । খোলা আকাশের নিচে যখন দাঁড়িয়ে থাকি আর চাঁদের আলো এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আদর করে, তখন মনে হয় মা যেন আমাকে জড়িয়ে আদর করছে।আমার মনে হয় এই প্রকৃতিতে কিছু হারায় না। আমারও মা হারাইনি, সব কিছুই রয়ে গিয়েছে এখানে, আর আমাদের এই জানালার নিচে দাঁড়ালে নাকি চাঁদ ও আলো দুটো স্পষ্ট হয়ে ওঠে ।
আমি আমি বলে উঠি "এই চাঁদের আলোর দিকে তাকালে সত্যিই নিজেকে একা লাগে না"? ছেলেটি বলল না । ছেলেটির কথায় আমিও মুখ তুলে তাকাই আকাশের দিকে। সত্যিই চাঁদের আলো নেমে এসে ভিজিয়ে দেয় আমাকে। আমিও হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় আমার 'মার' আদর ও ভালোবাসা পাওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে থাকি ।
-----------
ঋণস্বীকার, ছবি- ইন্টারনেট ।
--------------