ছোটগল্প ।। ঝালমুড়ি ।। কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
ঝালমুড়ি
কানুরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা গিয়েছিলাম । হাওড়া থেকে ট্রেনে বর্ধমান ফিরছি ।
ফাস্ট লোকাল , গুটিকয় স্টপেজ আছে, আমার কামরাটা প্রায় পুরোটাই ডেলি প্যাসেঞ্জারে ভর্তি ।
ডেলি প্যাসেঞ্জারদের ছোট ছোট দল থাকে । সাধারনত একই অফিস বা পাশাপাশি দু তিনটি অফিস মিলে দল তৈরি হয় । আবার একই পেশার মানুষরাও স্বতন্ত্র দল তৈরি করে । ডেলি প্যাসেঞ্জাররা শুধু বহিরাগতদের সাথে ঝগড়ার সময় সবাই একজোট হয় । বাকী সময় তারা আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে তাস পেটে অথবা সারাদিনের গরম স্মৃতিগুলো জাবর কাটে।
আবার এদের মধ্যে এমন কেউ থাকে, যে হয়তো সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে , এখনো দল জোটাতে পারে নি। সব দল থেকেই প্রশ্ন করে , " দাদা , কোথায় বাড়ি ? কোন অফিসে আছেন ?" তারপর একসময় অজান্তেই একটা গোষ্ঠীতে ঢুকে পড়ে।
আমি জানালার ধারে একটা সিট পেয়ে শরীর এলিয়ে দিয়েছি। এইসব ট্রেনে জানালার ধারে বসার জায়গা পাওয়া মানে ভাগ্যের ব্যাপার । সারাদিন অনেক ধকল গেছে । ঠান্ডা হাওয়ায় চোখে ঝিমুনি ধরে এসেছে।
ডানকুনি পেরোতেই এক ঝালমুড়িওয়ালা পাশের কামরা থেকে এই কামরায় এলো । সঙ্গে সঙ্গে সব ডেলিপ্যাসেঞ্জার তাকে ছেঁকে ধরে ' হারুদা একটা সিঙ্গিল', ' হারুদা একটা ডাবল' বলে হাঁক পারতে লাগলো। ঝালমুড়িওয়ালা , যার নাম হারুদা , মাঝবয়স্ক ব্যাক্তি । মাথার অর্ধেক চুলই সাদা। চেহারা বেশ রোগা , ঝালমুড়ির সরঞ্জামসহ ঝাঁকা গলায় ঝোলাতে গিয়ে কোমর বেঁকে গেছে।
ঝালমুড়িওয়ালা অতি দ্রুততায় মুড়িতে চানাচুর-তেল-মশলা-লঙ্কা-পেঁয়াজ-বাদাম-আচার-আলু-শশা-মটর মাখিয়ে লম্বাটে নারকেলের ফালি আর মশলা মাখানো কাঁচা লঙ্কা দিয়ে ঠোঙ্গায় ভরে হাতে হাতে দিতে লাগলো।
ঝালমুড়ি খেতে খেতে ডেলি প্যাসেঞ্জারদের চোখ মুখ বদলে যেতে লাগল । কারো মুখ লাল হয়ে গেলো। কারো বা চোখ দিয়ে জল গড়াতে লাগলো। অনেকেই ঝালের চোটে হুশহাশ করতে করতে বোতল খুলে জল খেল।
আমি বললাম , " দাদা একটা ঝালমুড়ি দেবেন লঙ্কা ছাড়া"।
ঝালমুড়িওয়ালা জিজ্ঞাসা করল " দাদা কি এই ট্রেনে নতুন ? হারুদার ঝালমুড়ি চাইছেন লঙ্কা ছাড়া !"
ঝালমুড়িওয়ালা ঝালমুড়ি বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল , " নিন একটা সিঙ্গিল , দশ টাকা।"
সেই ঝালমুড়ি মুখে দিয়ে আমার আলজিভ অবধি জ্বলে গেল, তার সঙ্গে কাশি। ঝালমুড়ি যে এত ঝাল হয় জানতাম না।
আমার পাশে একটা ত্রিশ বত্রিশ বছরের ছেলে বসে ছিল । বাঁ চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। ঝালমুড়ি খেতে খেতে মাঝে মাঝে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে জল মুছছিল।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম , " ভাই , ঝালমুড়ি এত ঝাল কেন ?"
সে বলল," দাদা, এটা বর্ধমান ফাস্ট লোকালের স্পেশাল। হারুদার ঝালমুড়ি আর অন্য কোথাও পাবেন না।"
" আপনি কিন্তু উত্তর দিলেন না , এত ঝাল কেন ?"
সে বললো , " দাদা, এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন । সকাল থেকে লড়াই শুরু হয়। টোটোওয়ালা দাঁত খেঁচায় , ট্রেন লেটে চলে, বাসে ঠেলাঠেলি করে , অফিসে পাবলিক মেজাজ দেখায় , বস চোখ দেখায় , অফিস মাইনে কম দেয় – বাড়ি ফিরে আবার বউএর মেজাজ আর মা-বউএর লড়াই সহ্য করতে হয়, জমা খরচের হিসেব মেলাতে হয়। হারুদার ঝালমুড়ি সারাদিনের কষ্টগুলোকে চোখের জলে বের করে দেয় । আবার সবাই বাড়ি ফিরে নতুন লড়াইএর জন্য তৈরি হয়"।
আমি হতচকিত হয়ে গেলাম । বিভিন্ন দ্রব্যের বিভিন্ন ব্রান্ডের কথা শুনেছি , কিন্তু ঝালমুড়ির এই স্পেশাল ব্রান্ড কোনোদিন জানতাম না। ঝালমুড়িকে সেফটি ভালভ হিসাবে হিসেবে ব্যবহার করে বিক্রি এত বাড়িয়ে দিয়েছে !
একটা প্রশ্ন মাথায় আসছিল , জিজ্ঞাসাই করে ফেললাম ," সিঙ্গল , ডাবল- এইসব নিশ্চয় ঠোঙ্গার আকারের ব্যাপার নয় ।"
" ঠিকই ধরেছেন, ওটা ঝালের ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে । সিঙ্গল হলে খুব ঝাল আর ডাবল হলে খুব বেশী ঝাল"।
ঝালমুড়িওয়ালা গলা থেকে ঝাঁকা নামিয়ে দরজার ধারে মেঝেতে বসে বিড়ি খাচ্ছিল।
আমি কাছে গিয়ে বললাম , " হারুদা এই টিফিন কৌটোতে দুটো ঝালমুড়ি দিন । ট্রিপল হবে কি ?"
-------------
ঋণস্বীকার, ছবি- ইন্টারনেট
ঠিকানা- রাজগঞ্জ, বর্ধমান
যোগাযোগ- ৯১২৬৫৭৩০১০