গল্প।। দ্বীপের নাম সোনাদিয়া ।। শুভাশিস দাশ
আইজ আর মাছের আশা নাইরে সোলেমান । হ্ক্কালেই যে আন্ধার হইলো । কথা গুলো বলতে বলতে অস্থায়ী বাড়ির চারপাশে মোটা দড়ি দিয়ে ঘরের খুঁটিগুলো বাঁধছিল মকবুল ।
এই সোনাদিয়া চরের বেশ কিছু পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে । এরা স্থায়ীভাবে বসবাস করছে এই দ্বীপে । কক্সবাজার জেলার মহেশখালি উপ জেলায় এই সোনাদিয়া দ্বীপ । বঙ্গোপসাগরের একটা ক্যানেল বেরিয়ে এসে এই দ্বীপ তৈরি হয়েছে । বাংলাদেশের কক্সবাজারের থেকে সাত কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে এই সোনাদিয়া দ্বীপ ।
এই দ্বীপের মাটি সোনালী রঙের আর এই অঞ্চলের মানুষজন দ্বীপ কে দিয়া বলে । এজন্যই হয়তো দ্বীপটির নাম সোনাদিয়া হয়েছে । প্রায় নয় বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের নিসর্গ পর্যটকদের টানে । মাছ ধরার মরশুমে বাইরের থেকে জেলেরা আসে মাছ ধরতে । এই সোনাদিয়া দ্বীপ মৎস আহরণের অন্যতম স্পট । ঝঞ্ঝা প্রবণ এলাকা বলে এখানে বেশির ভাগই অস্থায়ী বসতি ।সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল মাস মাছ ধরার উপযুক্ত সময় এই দ্বীপে ।
সমুদ্রের খুব কাছে বলে একটা আতঙ্ক থেকেই যায় ওদের মনে । তবু জীবনের কঠিন লড়াই চলতে থাকে শুধু বেঁচে থাকার জন্য ।
সোলেমান বিড়িতে শেষ টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় । বলে আরে মকবুল ভাই আল্লার বিচার নাই । এই মরশুমে একটু সুখের মুখ দেখার কথা আমাগো কিন্তু আল্লার সেটা সহ্য হতিচে না ।
সোলেমানের কথা শেষ না হতেই প্রবল ঝড় শুরু হলো । নিমেষেই উড়ে গেলো দ্বীপের কিছু অস্থায়ী ছাউনি ।
মকবুল মিয়ার ঘরের ভিতর সোলেমান আশ্রয় নিলো । মাঝে মাঝে হাওয়ার গতিবেগ এমন বাড়ছিল ফাঁকা দ্বীপের মধ্যে মকবুল মিয়ার অস্থায়ী ঘর কেঁপে কেঁপে উঠছিল , এই বুঝি উড়ে যায় । মকবুল এই দ্বীপের পুরোনো মানুষ তাই এমন ঝড় ওকে অবাক করে না । সোলেমান কে বলে ভয় নাই রে সোলেমান । এই ঘর উড়বো না । দেখোস নাই ঝড়ের আগে দড়ি দিয়া বাঁধন দিলাম ?
এই দড়ির বাঁধনে আল্লার দোয়া আছে । দড়ির প্যাঁচে প্যাঁচে একটি করে সুরা পড়া আছে । কিচ্ছু হইবো না ।
প্রায় আধ ঘণ্টার ঝড় সোনাদিয়া দ্বীপ কে তছনছ করে দিলো । দশ বারোটা ঘর কোথায় যে উড়ে গেছে তাঁর ঠিকানা নেই ।
ঝড় থেমে গেছে কিন্তু আকাশের গতিক ভালো না । মকবুল এর পরিবার থাকে মহেশখালীর এক গ্রামে । মকবুল মিয়া একা পড়ে থাকে এই দ্বীপে ।
কয়েকশ পরিযায়ী মানুষ অবশ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই দ্বীপে । ওদের একমাত্র জীবিকা মাছ ধরা । মস্ত মস্ত বেড় জাল দিয়ে মাছ ধরে ওঁরা । তবে পঞ্চাশটি পরিবার দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দা ।
একটা কেরোসিনের পাম্প স্টোভ , হাঁড়ি , কড়াই আর একটা হাতা । ছোট খাটো সংসার যেন । মকবুল মিয়া বললো সোলেমানরে আইজ আর তোর কক্সবাজার যায়া কাম নাই । বরং চাউল ডাউল মিশাইয়া রান্না করি ।
ঝড়ের কারণে সমুদ্র সংলগ্ন এই ক্যানেলের জলে কেমন অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে । ঢেউয়ের স্ফীতি দেখে অজানা মানুষ ভয় পাবে । মকবুল মিয়া বললো কাল দেখিস খুব মাছ হবে ।
সোলেমান বললো মকবুল ভাই আইজ তো কোন সংকেত ছিল না ।
না তেমন হয়তো ভয়ংকর কিছু পায় নাই ওঁরা মানে ওই হাওয়া আপিস ।
এই দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটক দের আকর্ষণ করে । দ্বীপের সোনালী রূপে মুগ্ধ হয়ে নিজস্বি তোলে পর্যটকরা । খাড়ী এলাকায় গাঙকবুতর , বিভিন্ন প্রজাতির জলচর পাখি দ্বীপের সৌন্দর্যকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে । মাঝে মাঝে নিশিন্দার ঝোপ । সমুদ্র সৈকতে দেখা মেলে নানা রকমের কাঁকড়ার । পশ্চিম উপকূলে দেখা যায় মাঝে মাঝে বালুর টিলা। এটা ঝড় এসে তৈরি করে দেয় সেই সব বালুর টিলা।
বড় নৌকো আর স্টিমার নিয়ে জেলেরা মাছ ধরে এই ক্যানেলে । ক্যানেলের মাঝ বরাবর জাল ফেললে কেল্লা ফতে !
দশ বারো জন মিলে সেই জাল টেনে দ্বীপের কাছে আনে। বড্ড কষ্টের জীবন এই দ্বীপের মানুষ গুলোর।
মকবুল মিয়া ভাত বেড়ে বলে নে খায়া নে ।
সোলেমান আর মকবুল মিয়া খেতে বসে ।
হঠাৎ দূর থেকে সংকেত আসে । মকবুল মিয়া জানে এটা আবহাওয়া অপিসের সংকেত সাইরেন । বোধহয় বঙ্গোপসাগরে জলোচ্ছ্বাস হবে আজ । বুকটা কেঁপে ওঠে মকবুল মিয়ার । ভাতের পাত থেকে উঠে যায় । সোলেমান বলে খাইলা না মকবুল ভাই ?
না রে আর ভাত ঢুকবো না । এই জলোচ্ছ্বাস হইলেই ডর লাগে । কত্ত পরিবার বাচ্চা নিয়া এই দিয়াতে আছে ? জল এখানে প্রায় ছয় সাত ফুট উঁচুতে ওঠে ।
সোলেমান মকবুল মিয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ! দূরে কোথাও একটা হুম হুম শব্দ ভেসে আসে । মাটিতে হাঁটু গেড়ে মুখের কাছে দুহাত তুলে মকবুল মিয়া দোয়া পড়তে বসে যায় । ততক্ষণে জলোচ্ছ্বাসের হুম হুম শব্দটা আরো কাছে চলে আসে ।
-----------------------------------