শংকর লাল সরকারের ছোটগল্প - ছোটনের অসুখ
ছোটনের অসুখ
শংকর লাল সরকার
ছোটনকে নিয়ে ডাক্তারখানা থেকে ফিরতে বেশ রাত হল। ভিতরের ঘরে বাবা মোবাইল ঘাঁটঘাঁটি করছেন। গতবছর এই সময়ে মা মারা গেছেন, তারপর থেকে মোবাইলই বাবার একমাত্র সঙ্গী। আগে বাবার লেখালিখির সখ ছিল, অবসর সময়ে বাড়ির সামনের বাগানে ফুলগাছের চর্চা করতেন। এখন সেসব একেবারে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। পিয়ালীর হাত ছাড়িয়ে ছোটন দৌড়ে চলে গেল ভিতরের ঘরে। ও জানে দাদুর কাছে গেলেই মোবাইল হাতে পাওয়া যাবে। মোবাইলের জন্য ছেলেটা যেন পাগল হয়ে যায়।
-তোমার ছেলে জীবনও ভালো হবে না, প্রচণ্ড বিরক্তিতে ঝাঁঝিয়ে উঠে পিয়ালী অনিমেষকে বলল, আমরা যে কদিন থাকব বাবাকে বল মোবাইলটা যেন সরিয়ে রাখেন।
তোমার ছেলে কিছুতেই ছাড়বে না। মাথা নেড়ে অনিমেষ বলল, রেখাই ওর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। ছোটন হবার পর নিউটাউনের ফ্ল্যাটে রেখা বলে একটা মেয়েকে রাখতে হয়েছিল। পিয়ালী আর অনিমেষ দুজনেই আইটি সেক্টরে চাকরি করে। সকালে বেরিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। ছোটনকে ভুলিয়ে রাখার জন্য রেখা ওর হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিত। ছোটনের জন্য পিয়ালীই অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা কিনে দিয়েছিল। দিনরাত ছোটন মোবাইল ফোন নিয়ে থাকত। ব্যাপারটা যে কী ভয়ংকর তখন সেটা ধরা যায় নি।
সামনের মার্চে ছোটন চার বছর পূর্ণ হবে কিন্তু এখনও সে কথা বলতে পারে না। হাসে না, এমনকি ভালো করে কাঁদতেও পারেনা। কাঁদলে চোখ দিয়ে জল পড়ে না। ছোটনের চিকিৎসার জন্যই অনেক কষ্টে পিয়ালী আর অনিমেষ দুজনে একসঙ্গে দশ দিনের ছুটি নিয়ে এখানে এসেছে।
পিয়ালী ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল রেখাকে দোষ দিয়ে কিহবে তার চাইতে ডঃ রায় যেমন বললেন মোবাইলটা ছাড়িয়ে ওকে একটু বেশি করে কম্পানী দাও। রোজ ওকে নিয়ে বাইরে বের হও। প্রকৃতির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে বেশি করে মেলামেশার কথা বলছিলেন ডাক্তার।
পিয়ালীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অনিমেষ বলল আমাদের ওখানে প্রকৃতিকে তুমি পাচ্ছ কোথায়? সবদিকে কংক্রিটের জঙ্গল, আর মানুষজন? যে যার নিজের কাজে ব্যস্ত, কারও কোন সময় নেই। বরং এই বাড়িতে সামনে পিছনের বাগানে একটু প্রকৃতির ছোঁয়া আছে।
আর বোল না এটা বাগান নাকি জঙ্গল? গাছের ডাল সরিয়ে মাথা নীচু করে তবে বাড়ি ঢুকতে হয়। আর বাড়ির ভিতরে যা গরম একটা এসিও লাগাতে পারেনা।
শুধু লেখালিখি বা বাগান নয় মা চলে যাবার পর বাবা দাড়ি কাটতেও ভুলে যায়। পার্বতী নামে যে মেয়েটা বাবার দেখাশুনা করে সে প্রায়ই সকালে এসে দেখে ডাইনং টেবিলের উপরে বাবার খাবার ঢাকা দেওয়া অবস্থায় পড়ে আছে। বিয়ের পর বাড়ি থেকে যাতায়াতের অসুবিধা দেখিয়ে অনিমেষ নিউটাউনের নতুন ফ্ল্যাটটা নিল। প্রথম প্রথম প্রতি সপ্তাহে ওরা যাতায়াত করত। তারপর যা হয় আরকি। অফিসে ছুটি ভীষন কম, কাজের চাপ নানা অজুহাতে যাওয়াআসা কমতে লাগল। মা তখনও বেঁচে। মা দুঃখ পেলেও মুখ ফুটে কিছু বলেননি। অনিমেষ নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছে, মানুষের আর যাই থাক দুঃখের অন্তত উপলক্ষের অভাব নেই।
বাইরের পোশাক ছেড়ে অনিমেষ বাবার ঘরে গিয়ে দেখল, ছোটন বাবার বিছানায় বসে মোবাইল খুটখাট করছে। একদৃষ্টে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখের পাতা পড়ছে না। ব্যাপারটা ডাক্তারকে বললে ভালো হত। ছোটনের পাশেই বাবা। পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে শূন্যদৃষ্টিতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের পাতা পড়ছে বটে কিন্তু কে বলবে বাবা বসে আছে তার নিজের নাতির পাশে? মা চলে যাবার পর থেকেই বাবা অন্যরকম হয়ে গেছে, কিন্তু তাই বলে এত শীতল! এ কিরকম বদলা? ছেলে বউ কাছে থাকে না বলে? পিয়ালী ঠিকই বলে।
অনিমেষ বাবার দিকে এগিয়ে গেল বাবা শোন, এদিকে দেখ।
বাবা মুখ ফিরিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল। তাকিয়েই রইল। সেই চোখে কোন অভিব্যক্তি নেই। ছোটন মোবাইলে একটা গেম খেলছে। বাবা অনিমেষের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। বিরক্তিতে গলা তুলল অনিমেষ, আজ ছোটনকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার ওকে স্ট্রিক্টলি মোবাইল হাতে নিতে বারন করে দিয়েছে। বাবা শুনছ?
বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ছোটনকে দেখল তারপর উদাসীন গলায় বলল মোবাইলে হাত দিতে বারন করে দিয়েছে?
হ্যা মোবাইল দেখতে দেখতে ওর ব্রেন সেল ঠিকমতো ডেভেলপ করেনি। সেজন্যই ও কথা বলতে পারে না। হাসে না, খেলে না দিনেদিনে ক্রমশ অ্যাবনরমাল হয়ে যাচ্ছে। শুনছ?
বাবা মোবাইলটা ছোটনের হাত থেকে নিয়ে নিল। মোবাইল নিয়ে নিতেই ছোটন চিৎকার করে উঠল। হাতের কাছে যা পেল ছুড়ে ফেলতে লাগল। অনিমেষ ওকে ধরে রাখতে পারছিল না। বাবার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল চুপচাপ বসে কী দেখছ? এস ধরো ওকে।
বাবা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল আমি না আমি না আমি পারব না।
পাশের ঘর থেকে পিয়ালী ছুটে এল। ওকে দেখে ছোটন আরও মারমুখী হয়ে উঠল। অনিমেষের জামার বোতাম ছিঁড়ে, খামচে ধরল পিয়ালীর মাথার চুল। লাথি ছুড়তে লাগল। থুতু ছুড়তে পিয়ালীও মেজাজ হারাল। ঝাপিয়ে পড়ে ভীষণভাবে ছেলেকে মারতে লাগল।
আরে কী করছ ও অসুস্থ, ওকে মের না। পিয়ালীকে হাত দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করল অনিমেষ।
পিয়ালী শুনল না, মেরেই চলল ছোটনকে। অনিমেষ বাবার দিকে আবার ঘুরে গেল। আমি না আামি না ভয়ার্ত মানুষের মতো বাবা ছিটকে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অনেকটা পরে অমিমেষ ছাদে গিয়ে দেখল আধ ভাঙা গার্ডেন চেয়ারটার উপরে গুটিসুটি মেরে বাবা বসে আছে। ছাদের আলো জ্বলতে যেন শিউরে উঠল।
অনিমেষ বলল এখানে কী করছ ঘরে চল।
ফ্যাঁসফেসে গলায় বাবা বলল পিয়ালী খুব রেগে আছে? না রে। আমি আর মোবাইল করব না।
দুদিন পরে অনেক রাতে পিয়ালীর ঘুম ভেঙে গেল। ছোটন বিছানায় নেই। সেদিনের ঘটনার পর থেকেই ছোটন কেমন যেন গুম মেরে আছে। ভালো করে খাচ্ছে না । আদর করতে গেলে ছিটকে সরে যায়। পিয়ালীর বুকটা ধড়াস করে উঠল। অনিমেষকে ঠেলে তুলল। সিড়ি দিয়ে নামতেই চোখে পড়ল একতলায় বাবার ঘরের ভিতরে হালকা আলোর আভাস। এত রাতে জেগে বাবা কি করছেন। সেদিনের পর থেকে বাবাও কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে গেছেন। পিয়ালীকে দেখলেই গুটিয়ে যাচ্ছেন।
ঘটনার পরদিন পিয়ালী বাবাকে বোঝাতে গিয়েছিল। সবসময় মোবাইল না দেখে আপনি তো আগের মতো লেখালিখি, বাগান করা, এইসব নিয়ে থাকতে পারেন, তাতে ছোটনেরও উপকার হয়। ডাক্তার ওকে প্রকৃতির মধ্যে সময় কাটাতে, মানুষের সঙ্গে বেশি করে মিশতে বলেছে।
বাবা মাথা নেড়ে বলেছিলেন ওসব আমার আর ভালো লাগেনা।
পিয়ালীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে অনিমেষও বাবাকে বলেছে ছেলেটার কথা ভেবে কটাদিন ওসব করতে পারো। ছেলেটাকে তো ভালো করতে হবে।
আমার আর ভালো লাগে না। বাবার সেই এককথা।
ফুঁপিয়ে উঠে পিয়ালী বলেছিল এরকম হলে ছেলেটা সত্যিসত্যি মরে যাবে । কাল থেকে ওকে ওষুধও খাওয়াতে পারছিনা। একিরকম লোক যে নিজের নাতির কথাও ভাবেনা। নিজের একমাত্র নাতি।
পিয়ালিকে থামিয়ে দিয়ে বাবা বলেছিলেন আমি তো বলেছি আর মোবাইল করব না।
বাবার ঘরের পর্দা ফাঁক করে পিয়ালী দেখল বাবা বিছানায় শুয়ে। বাবার বিছানা থেকে কয়েকফুট দূরে মোবাইল হাতে নিয়ে কাঠের পুতুলের মতো ছোটন দাড়িয়ে আছে। কী সাংঘাতিক ছেলে! এতো দেখছি সকলকে মেরে মরবে।
ওকে কিছু বোল না আমি দেখছি, পিছন থেকে ফিসফিস করে বলল অনিমেষ। পিয়ালীকে সরিয়ে অনিমেষ ঘরে ঢুকতেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল। অনিমেষকে দেখেই আঁতকে উঠে বিকট চিৎকার করে ছোটন ছুট দিল। মাকে ঠেলে সশব্দে ঘরের পাল্লা সরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
কে? কে? চমকে বিছানার উপরে উঠে বসে বাবা চেঁচিয়ে উঠল।
পিয়ালী এগিয়ে গিয়ে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিল। আমি আপনাকে বলেছিলাম মোবাইলটা সামনে না রাখতে।
ঘুম আসছিল না তাই।
পিয়ালী রুক্ষ গলায় বলল বেশ তো ঘুমোচ্ছিলেন। তারপর ফুঁপিয়ে উঠে কান্না জড়ানো গলায় বলল আমাদের এখানে আসা্ই ভুল হয়েছে, ওখানে থেকে ট্রিটমেন্ট করালেই ভালো হত। আপনারা কেউ ওকে বাঁচতে দেবেন না দেখছি।
অনিমেষ বলল অনেক রাত হয়েছে এখন চুপ করো।
পিয়ালী অনিমেষের দিকে ঘুরে হঠাৎ ফেটে পড়ল, তোমাদের জন্য.. তোমাদের জন্যই আজ আমার ছেলের এই অবস্থা। তোমরা সবাই সমান।
আরে কী যা তা বলছ। চুপ করো।
কেন চুপ করব? খুব গায়ে লাগছে না। মুখ বিকৃত করে চেঁচিয়ে উঠে পিয়ালী। ডাক্তার সেদিন কি বলেছেন শুনেছ তো। বাবা হয়ে একেবারে মাথা কিনে নিয়েছ! বাড়িতে ফিরলে ছেলেকে ধরতে হবে বলে রোজই নানারকম অজুহাতে দেরী করে বাড়ি ফিরতে। কেবল রেখাকে দোষ দিচ্ছ একটু কাঁদলে তুমিও তো ওকে মোবাইল হাতে ধরিয়ে দিতে। কোলে করে ছেলেকে কোনদিন বাইরে ঘুরিয়ে এনেছ?
এবারে অনিমেষের গলাও চড়ল। ডাক্তারের সবকথা কি তুমি শুনেছ। মনে নেই ডাক্তার কী বলেছিলেন? ওনলি চাইল্ড এজ এ লোনলি চাইল্ড। ছেলের নিসঙ্গতা, একাকিত্ব কাটাবার কথা তুমিও কোনদিন সিসিয়াসলি ভাবনি। একাকিত্ব কাটাবার জন্য দেড় বছরের বাচ্ছার হাতে মোবাইল ধরিয়ে দিয়েছিলে অস্বীকার করতে পার সেকথা।
আরে তোরা ঝগড়া না করে ছেলেটা কোথায় গেল দেখ! বাবা হঠাৎ বলে উঠলেন।
অনিমেষ পিয়ালীর দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
খর চোখে সেদিকে কয়েকমুহুর্ত তাকিয়ে পিয়ালী ঘুরে গেল বাবার দিকে। মোবাইলটা আমার হাতে দিন। আমরা যেকদিন থাকব মোবাইলটা আমার কাছেই থাকবে। বাবার হাত থেকে মোবাইলটা প্রায় ছিনিয়ে নিল পিয়ালী। ঘরের দেওয়াল ঘড়িটা ঢংঢং করে দুটো ঘন্টা দিয়ে সময় জানান দিল।
এক সপ্তাহ কেটে গেল, ছোটনের কোন উন্নতিই হল না। মাঝখান থেকে ওর চেহারা যেন আরও ভেঙে পড়েছে। তবে এখন আর তত চিৎকার চেঁচামেচি করে না। বসে বসে কেবল ঝিমোয় আর শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ডাক্তার বললেন এসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ওষুধ শেষ হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তবে এরমধ্যে মোবাইলের আশক্তিটা একদম কমিয়ে ফেলতে হবে।
ডাক্তার দেখানোর পর অনিমেষ, পিয়ালী আর ছোটনকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে কয়েকটা কাজ সারতে গিয়েছিল। কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে গেল। বাড়ির সদর দরজার ছিটকিনিটা আলতো করে উপরে তোলা ছিল যাতে অনিমেষের জন্য ওদের ঘুম না ভেঙে যায়। ঘরে ঢুকে অনিমেষ দেখল বাইরের জামাকাপড় পড়েই বিছানায় শুয়ে পিয়ালী অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ছোটন কোথায় গেল? বাবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল বাবা অকাতরে ঘুমাচ্ছে আর বাবার মোবাইলটাকে চার্জে দিয়ে ছোটন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলছে। রাগে সর্বশরীর জ্বলে উঠল অনিমেষের। ওদের ঘরে ঢুকে চেঁচিয়ে উঠল ওঠো ওঠো!
কী বলছ? ধড়মড় করে উঠে পড়ল পিয়ালী।
রাগে ফেটে পড়ল অনিমেষ, তোমার ছেলেকে কেউ ভালো করতে পারবে না। ছোটন বাবার ঘরে গিয়ে মোবাইল খেলছে। ওটা ও হাতে পেল কিকরে? বিকৃতস্বরে চেঁচিয়ে উঠল অনিমেষ। তুমি তো ওটা নিজের কাছে রেখেছিলে।
হুড়মুড় করে অনিমেষ বাবার ঘরে ঢুকে পড়ল। হাতের কাছে একটা স্কেল পেয়ে ওটা দিয়েই ছোটনকে মারতে গেল। পিয়ালী ওকে ধরে ফেলল, কী করছ? পাগল হয়ে গেলে নাকি?
আমি পাগল? তার মানে তুমিও আছ এরমধ্যে। শুধু মোবাইলকে দোষ দিয়ে কিহবে? মা কেমন সেটা দেখতে হবে তো।
থমকে গেল পিয়ালী। পরক্ষণেই গলা চড়িয়ে বলল ও এখন সব দোষ আমার হয়ে গেল?
ঝাঁঝালো গলায় অনিমেষ বলল তুমি আমাকে দোষ দিচ্ছিলে না, যে আমি ছুটির দিনে ছেলেকে রেখার কাছে রেখে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মারতে যাই। তা তুমিও বা কম কিসে? মার্কেটিংএর সময়ে কোনদিন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যেতে দেখিনি। তুমি কদিন ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছ? তাও দাদু ঠাকুমার কাছে থাকলে ছেলেটা একটু কম্পানী পেত, তুমি শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ঘর করবে না বলে জোর করে ফ্ল্যাটটা কেনালে।
তাই বুঝি শুধু আমার ইচ্ছায় ফ্ল্যাট কিনে তুমি আলাদা হয়েছো? ঠোঁট বেঁকিয়ে রূঢ় গলায় বলল পিয়ালী।
বাবা হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল চুপ কর তোরা। আচমকা চার্জে লাগানো অবস্থায় মোবাইলটা প্রচণ্ড শব্দে ফেটে গেল। পিয়ালী আর্তনাদ করে উঠল। ছোটন স্পষ্ট দা.দ্.দু বলে চেঁচিয়ে বাবার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। বাবা প্রথমটায় হকচকিয়ে গিয়েছিল, পরমুহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে ছোটনকে বুকে চেপে ধরে বলতে লাগল কিছু ভয় নেই বাবা, এইযে আমি তো আছি। দুষ্টু মোবাইলের ব্যাটারিটা গরম হয়ে ফেটে গেছে।
ছোটন বাবার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফুলেফুলে কাঁদতে লাগল। ওর চোখের জলে বাবার গেঞ্জিটা অনেকখানি ভিজে গেল।
রাগ ভুলে অনিমেষ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল পিয়ালী দেখ ছোটন কাঁদছে। ওর চোখ দিয়ে জল পড়ছে! ও ভালো হয়ে গেছে।
হাত বাড়িয়ে পিয়ালী ছুটে গেল আয় ছোটন আমার কোলে আয়।
থাক, বাবা মাথা নাড়ল, ছোটন আমার কাছেই থাক। এক অদ্ভুত ভালোলাগার আবেশ অনুভব করল অনিমেষ। কত, কতদিন পরে সে তার বাবাকে বাবা বলে চিনতে পারছে। বাবা কাকে আদর করছে ছোটনকে? নাকি অনিমেষকে?
পিয়ালী শুনেছ ছোটন কথাও বলেছে। গলা কেঁপে গেল অনিমেষের। হু বলে পিয়ালী এগিয়ে গেল অনিমেষও এগিয়ে এল কথা বল ছোটন কথা বল। কন্নায় ভেঙে গেল ওদের গলার স্বর।
থামো আর ভয় নেই । ছোটন এবারে ঠিক হয়ে যাবে। মোবাইল নষ্ট হয়ে গেছে আর আমরা কেউ মোবাইল দেখব না। যাও তোমরা বাইরে যাও ছোটন আমার কাছেই থাক।
-----------